দেবেশ রায়ের জিন – এণাক্ষী রায়

শেয়ার করুন

তিনি নেই। সবে হাতে এসে পৌঁছেছে আমারই লেখা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। আমারই তো লেখাটা। তবে এত মাস পার হয়ে আবার আমার হাতে এসে পোঁছনোর মানে কী! গত অক্টোবরে সেতুবন্ধন-এ প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাসটি। তাঁদের পত্রিকার বেঁধে দেওয়া শব্দের তুলনায় অনেকটা বড়ো ছিল আমার লেখাটা। সম্পাদক বললেন –যেকোনো একটা জায়গায় শেষ করে দে আমাকে। বই হলে সম্পূর্ণটা প্রকাশ করলেই হবে। লেখাটা যেখানে শেষ করলাম, সেটা একটা সম্পূর্ণ উপন্যাসের আদলই পেল এবং বলা বাহুল্য সেটা সম্পাদকের পরামর্শেই। হোয়াটসঅ্যাপে, ফোন মেসেজে নিয়মিত কথাবার্তার মাধ্যমে। এর পরেও গোটা উপন্যাসটার পাণ্ডুলিপি থেকে গিয়েছিল তাঁর কাছে। সেটা বই করার জন্য যে বন্ধু-প্রকাশক নিয়েছিল, দেবেশ রায় চলে যাবার পর তিনি একদিন বললেন—“তোমার এই পাণ্ডুলিপিটাতে দেবেশ বাবু কিছু পরামর্শ লিখে রেখেছেন, তুমি জানো?” বললাম—“না! আমি তো কিছুই জানি না।” তিনি চলে যাবার আগে এই কাজটাও সেরে রেখেছেন নীরবে, তা আমার জানা ছিল না। প্রকাশকের হাতে যাওয়ার আগে আবার পুরোটা পড়েছেন! পাণ্ডুলিপিটা দেখছিলাম, কোথাও একটা লাইনও পরিবর্তন করেননি তিনি। প্রুফ দেখে দিয়েছেন যত্ন করে! দেবেশ রায়ের মতো অত বড় মাপের লেখক আমার প্রুফ দেখে দিয়েছেন, এটা কিন্তু নতুন নয়। নতুন কোনো গল্প লিখেছি জানালেই মেসেজে লিখতেন, “কবে আসবি? কবে পড়ব!” আর গল্প নিয়ে গেলেই পেন নিয়ে বসতেন। বানান ভুল, হাইফেন, দাঁড়ি, কমা ঠিক করতে করতে যেতেন। দু-একটার বেশি বানান ভুল থাকলেই বকা। “আমি কি তোর প্রুফরিডার!” আমার মতো একজন নগণ্য, লিখতে শুরু করা মানুষের লেখা নিয়ে এত ভাবতেন কেন তিনি! কী দায়! এত স্নেহ, এত প্রশ্রয়ের জায়গাটা হারিয়ে গেল চিরতরে।
কে আমি! কেউ না। তবু তাঁর কাছে পৌঁছতে পেরেছিলাম, শুধুমাত্র অল্পস্বল্প লিখেছিলাম বলে। আমার লেখা পছন্দ করতেন তিনি, এটাই বড়ো প্রাপ্তি আমার কাছে।

তাঁর জন্মদিনে লেখা ছাড়া আর কী দিতে পারি! লেখা ছাড়া অন্য কোনো ফুলে কি তিনি সন্তুষ্ট হবেন!

মোট আটত্রিশটা বিভিন্নস্বাদের উপন্যাস আর অগুনতি গল্পের লেখক হলেও দেবেশ রায়ের কথা উঠলেই বলা হয় তিস্তাপারের লেখক। সেটা কি ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-র পাঠকগ্রাহ্যতার জন্যই! নাকি বারবার তার লেখায় উঠে এসেছে তিস্তা, সে জন্য!
আমার সঙ্গেও দেবেশ রায়ের অনেকগুলো যোগসূত্রের মধ্যে একটা যোগ ওই তিস্তাপারের সূত্রেই।

২০১৯-র জুনে দেবেশ রায় একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। রক্তশূন্যতায় ভুগছিলেন। সেই সময় সেরে উঠে তিনি বাংলা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে একটা ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ করছিলেন–
“এই তো মাস দুইও হয় নি—মৃত্যু চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ডেকেছিল, ‘এসো, চলো’। আমি তার চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম, ‘কী করে যাই। সেনটেন্সগুলো তো ঠিক আসছে না’। হাসপাতালের ডাক্তাররা আমায় বলেছিলেন—সত্যি না কি আমি এই কথাগুলি বলেছিলাম। তার পর থেকে ওঁরা এসেই আমাকে জিগগেস করতেন—‘কী? সেনটেন্সগুলো ঠিকঠাক আসছে তো?’”

“এবার একটি পুজো সংখ্যায় একটি ছোট উপন্যাস লিখেছি। উপন্যাসটির নিহিতার্থ যে-কোনো জায়গায়, দেশের বা বিদেশের, ঘটতে পারে। লিখতে বসে দেখি তার নায়ক হয়ে উঠল—ভোলা কোল মুন্ডা—জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে ক্লাস সেভেন থেকে স্কুল ফাইন্যাল পর্যন্ত আমার সহপাঠী। পরে এসে জুড়ল নাগরাকাটায় আমাদের পার্টির এম-এল-এ প্রেম ওঁরাও, তার এক পা কাটা, বগলে ক্রাচ, ভুটান পাহাড়ের সানুদেশে, এক চা-বাগানে। এ-উপন্যাস কোনো অর্থেই জলপাইগুড়ি নিয়ে লেখা নয়, কিন্তু যে-কোনো অর্থেই জলপাইগুড়ি নিয়ে লেখা।

আমার একটা ছোট উপন্যাস আছে, পশ্চিম এশিয়ার তেলের রাজনীতি নিয়ে। বাঙালি দম্পতি তাঁদের এক প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে কোনো এক বড় কর্পোরেটের বড় চাকরিতে থিতু। এই দম্পতি আমার চেনা—কলকাতায়। সেই উপন্যাসটিতে তো জলপাইগুড়ি আসার কোনো ছিদ্রপথও নেই। কিন্তু সেদিন পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি—সেই মরুভূমির রাস্তাঘাট ও দোকানপাটে জলপাইগুড়ি এসে গেছে।

লেখক বোধহয় দু-ধরনের হয়। কোনো-কোনো লেখকের স্বভাব মাছের মতো—নিজের জল ছাড়া সে বাঁচে না। তারাশঙ্কর তেমন লেখক। বলা হয়, ‘ডাবলিন’ শহর যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তা হলে জেমস জয়েস-এর ‘ডাবলিনার্য’ থেকে তা হুবহু পুনর্নিমাণ করা যাবে।

আর-এক ধরনের লেখকের স্বভাব পরিযায়ী পাখির মত। ঋতুতে ঋতুতে তারা মহাদেশ মহাসাগর পাড়ি দেয়। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তেমন লেখক। কেউ কি বলতে পারেন ‘পথের পাঁচালী’র গ্রামটা কোথায়? বা, ‘চতুরঙ্গ’ কোথায় ঘটছে?

লেখক তো সে, যে কল্পনাকে বাস্তব, ও বাস্তবকে কল্পনার সত্য করে তুলতে পারে। আর সেই কাজে যা সে লিখছে সেটাকে বিশ্বাসও করতে পারে, যাকে অভিনব গুপ্ত বলেছিলেন সাধারণীকরণ আর টি.এস. এলিয়ট বলেছিলেন ইউনিভার্সালাইজেশন।

আমার লেখা দেখে সবাই খুঁজুক কোথায় আছে জলপাইগুড়ি। আমার জিন।”

এই জিনের টানেই তিনি বারবার ফিরে এসেছেন তিস্তার পারে।

নিজের ফেলে আসা শহরে, যে কোনো লেখককেই বোধহয় বারবার ফিরে যেতে হয়। নিজের ফেলে আসা নদীটি এখনও বয়ে যাচ্ছে নিজের নিয়মে, পাড় ভাঙছে, তৈরি করছে অন্য পাড়। ধ্বসে যাওয়া পাড়ের কোথাও খসে পড়ে থাকছে আমাদের শৈশব-কৈশোর। নিজের শহর থেকে উৎপাটিত হয়ে অনেক দূরের কোনো শহরে বসবাসরত কবি-লেখকদের বোধহয় বয়স বাড়ে না। লেখালেখির নিজস্ব ভাষাটাও গড়ে দেয় এই জিন।

দেবেশ রায়ের আত্মকথন ‘জলের মিনার জাগাও’-এ তিনি লিখেছেন–
“লেখায় মান্য বাংলার ব্যবহারে আমি এই রোমাঞ্চ পেতাম না। সেখানে অন্যধরণের ঘাম ঝরত–বাক্য জটিল থেকে জটিলতর করে তুলতে, বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণকে প্রত্যাশার ও অভ্যাসের বাইরে নিয়ে যেতে, বাঁকাচোরা অথচ ব্যাকরণসিদ্ধ বাক্যে ঘটনাকালীন জটিলতা— একসঙ্গে অনেক কিছু ঘটছে—আনতে, কোনো ঘটনাকে টুকরো টুকরো ছোট ছোট বাক্যে সহজগম্য না-করতে, আর, একটি বাক্যও যেন পাঠককে হোঁচট না খাইয়ে না-ছাড়ে। তেমন একটা গল্প দীপেনকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। শুনে দীপেন বলল, লিখছিস লেখ, তবে একজনও পড়বে না।

রাজবংশী ভাষা আমার লেখার ভাষার কত-যে তল খুলে দিল। আমি একটা নিয়ম বানিয়েছিলাম নিজের জন্য—ভাষা এমন হবে যে পাঠক যেন আমার গলা চিনতে না পারে। নিয়মটা বেশ গোঁড়ামি করেই মানতাম। এখনো মানি কীনা জানি না। স্যামুয়েল বেকেট একটা চিঠিতে বলেছিলেন—প্রথম তাকে তিনি ইংরেজিতেই লিখতেন, তাঁর মাতৃভাষা; দুটো-একটা লিখেই তার মনে হল—ভাষাটা এত চেনা যে লেখাটাও চেনা হয়ে যাচ্ছে। তিনি তাঁর নিজের জন্য একটা নিয়ম বানিয়েছিলেন–বিদেশী ভাষা ছাড়া লেখা যায় না। সে-নিয়ম তিনি গোঁড়ামির সঙ্গেই মানতেন। বেকেট-এর এই চিঠিটা আমি বছর পাঁচ-ছ আগে পড়েছি। তারপর থেকে ভাবি বেকেট যা খুঁজছিলেন, আমিও কি তাই খুঁজছিলাম? নিজের ভাষাকে বিদেশী করে নিতে চাইছিলাম?
মনে হয়—না। আমাদের লেখার ভাষা নিয়ে সংকট আর ইয়োরোপীয় কোনো লেখকের লেখার ভাষা নিয়ে সংকট এক রকমের নয়।
আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার তাই সংকট কাটানোতে কোনো মিল পাওয়া যাবে না। তাছাড়া এ-সংকট যতটা আঞ্চলিক ও ঐতিহাসিক, ততটাই ব্যক্তিগত।

সেই ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, ব্যক্তিগত মিশে যায় কোনো-কোনো লেখকে। এর উলটো, কোনো-কোনো লেখক মিশতে দেন না। ভাষার সংকট লেখক নিজে তৈরি করে তোলেন, খুব স্পষ্ট কারণ ও অভাববোধ ছাড়াই। সহজবোধ্য করে বলা, সাধারণপাঠ্য করে বলা, কঠিন করে না বলা এই সব হস্তলিপি শিক্ষার নীতি দিয়ে কি শিল্প হয়? ভাষার হাড়মজ্জা যদি দেখাতে চাই?”

ভাষার হাড়মজ্জার ভেতরের যে মাটির গন্ধ, নদীর স্রোত, রোদ-বৃষ্টির খেলা মিশে যেতে যেতে ভাষাকে একটু কাঠিন্যের দিকে ঠেলে দেয়, গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা আরেকটু জটিল হয়ে ওঠে। প্রেক্ষাপটে অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে লেখকের চলাফেরা নিশ্চিত করে। সম্পাদক হিসেবেও এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন তিনি।

একটা গল্পের ভেতর ঢুকে গেলে গল্পের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী লেখকের নিজস্ব ভাষা যেদিকে লেখাকে নিয়ে যেতে চায় সে দিকে ডানা মেলে দেওয়ার স্বাধীনতা লেখকের নিজের। সহজ করে লেখা বা কঠিন করে লেখার সচেতনতা নিয়ে লেখককে লেখা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়।

আমারও জিন সেই জলপাইগুড়ি বলেই হয়তো, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছাড়াও, সম্পাদক দেবেশ রায় আমার অনেক কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

ডিসেম্বর চলে এলো, তাঁর জন্মদিন। গতবছর সতেরোই ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিনে তিনি আমাকে দেওয়ার জন্য উপহার গুছিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর তিনটে বই। নিজের হাতে লিখে দিলেন। আমি বললাম “তোমার জন্মদিনে আমিই উপহার পেলাম!” কিছু কথা শুনতে পাচ্ছিলেন, কিছু পাচ্ছিলেন না হয়তো। হাসি মুখে মাথা নাড়ছিলেন শিশুর মতো।

দেবেশ রায়, যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, মেধা আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অবিসংবাদিত। লেখক এবং সম্পাদক হিসেবে প্রবাদপ্রতিম। তাঁর এই অন্যরূপটা আমাদের কারো কারো কাছে সূর্যের আলোর মতো সহজ ছিল।
চলে গেলেন এমন একটা সময়ে, শেষ দেখা করাও দুষ্কর হয়ে গেল। এখন শুধু রয়ে গেলেন লেখক দেবেশ রায়। সবার মধ্যে। আমার কাছে তো তিনি আজও জীবন্ত।

দেবেশ রায়ের সঙ্গে লেখিকা
শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *