বাবরিকাণ্ড এবং সম্প্রীতির সময় ( ১ম পর্ব ) – সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
বাবরিকাণ্ড নিয়ে বলতে গেলে আজও যে-কথা মনে পড়ে যায় তা হল গত শতকের ১৯৯২ এর ৬ ডিসেম্বর ঘটে যাওয়া বাবরি ধ্বংসের রাজনীতি এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপটে নির্মিত রাজনৈতিক বাতাবরণ। যা কিনা আজ বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের মূল কারণ। আজকে এত বছর বাদে কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। এখন সেখানে সাম্প্রদায়িক হিন্দু মৌলবাদী শক্তিসহ রাষ্ট্রের কর্ণধার ও পরিচালনায় প্রধান রাজনৈতিক দল রাম মন্দির নির্মাণের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। শুধু তাই নয়, রায় ঘোষণার দিনটিকে দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন হিসাবে তারা প্রচার শুরু করেছেন। এই পরিস্থিতিতে একটাই কথা বলতে চাই— অশান্ত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় বিভেদ ভুলে একত্রে কাজ করার সিদ্ধান্তসমূহ আমাদের পথ দেখাতে পারে। ধর্মে ধর্মে বিভেদের পরিবর্তে সম্প্রীতি ও শোষণমুক্ত সুষম সমাজ; অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মঙ্গল কামনায় সকলে হতে পারি উজ্জীবিত। সাম্প্রদায়িক হানাহানিমুক্ত সুন্দর সমাজ সৃজনের পক্ষে আজ আমরা। পৃথিবীর দেশে দেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার জন্ম হয়েছে তা থেকে মুক্তি প্রত্যাশা করি প্রত্যেকে। উগ্রবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বধর্ম সম্প্রদায়ের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে হলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সৃষ্টির বিকল্প নেই। এশিয়ার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারংবার। এর পশ্চাতে আছে কতিপয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ-সচেতনতা মানুষকে ব্যথিত করে। প্রত্যেক ধর্মের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেন। প্রকৃতপক্ষে মানবধর্মের কথার মধ্যেই আছে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির মূল ভিত্তি। সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিভাবনার নানা দিক আমাদের সামনে উন্মোচন করা দরকার। মানবতা, বহুমাত্রিক ঐতিহ্য-পরম্পরা, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও সাম্যচিন্তা আমাদের এশিয়ার সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য দরকার সামাজিক স্থিতিশীলতা। অসহিষ্ণু পৃথিবীর ধর্মীয় মৌলবাদিতা দূর করার জন্য মানুষে-মানুষে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। আর এর জন্যই প্রয়োজন বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আলোচনা।
আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা এশিয়ার সমাজ ও সভ্যতার কেন্দ্রীয় ভিত্তি। এই ভূখণ্ডে একত্র হয়েছে বহু ধর্ম, এখানে পাশাপাশি বাস করেন নানা ধর্মাবলম্বী মানুষ। একের মধ্যে বহুর অস্তিত্ব আমাদের সমাজের মতো পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে নেই। এশিয়ায় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সংখ্যাধিক্য। তবে বর্তমান বিশ্বে ধর্মের উদার বাণীসমূহ পৃথিবীর সর্বত্রই বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির বাস্তবতায় মানবতার চর্চার মাধ্যমে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। একের ধর্ম বিশ্বাস অন্যের বিশ্বাসের সঙ্গে বিভেদ সৃষ্টি না করে পরস্পরে প্রীতি সঞ্চার করতে পারে। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে ব্যস্ত না হয়ে, পৃথিবীর মানুষ অন্য ধর্মবিশ্বাসীর ধর্মীয় আচার-আচরণকে সম্মান করে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্কের বিকাশ ত্বরান্বিত করবে এটাই কাম্য। মানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অনগ্রসর কিংবা নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকা এবং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা অন্যতম কাজ হওয়া উচিত। মনে পড়ে যায়, সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওপর হিন্দুত্ববাদীদের হামলার জের ধরে দেশটির রাজধানী দিল্লির পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করার কথা। সংখ্যালঘু মুসলিমরাই এর প্রধান শিকার। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ওই বিশৃঙ্খলায় প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে, সরকারি বাহিনীগুলো যেখানে ব্যর্থ, সেখানে দুষ্কৃতকারীদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথে এখন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সম্প্রীতি। একই পরিস্থিতি সারা বিশ্বেও। দেশে দেশে সামাজিক ন্যায্যতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় মুক্ত আলোচনার আয়োজন করতে হবে। যা কার্যকর হবে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্ধতা দূর করার ক্ষেত্রে। ধর্মের নামে বিশ্বজুড়ে সহিংসতার অবসানকল্পে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার উপর জোর দিতে হবে। ধর্মীয় জীবনে বিশ্বাসীদের মানবিক বিকাশে সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। সমাজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবনের শক্তিকে মানুষের মঙ্গলে কাজে লাগানোর প্রণোদনাটি জরুরি। দায়বদ্ধতা, সাহস ও উদারতা দিয়ে এশিয়ার নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে এই উন্মোচন।
আবার ভারতবর্ষের কথা বলতে গেলে দেখি ভারতীয় উপমহাদেশ সহিষ্ণু জাতির বসতির অঞ্চল। বহুবর্ণ, বহুভাষীর বসতি এখানে। সকলে একই মানববৃত্তে বন্দি। এই সমাজের মানবিকতাই সকলকে একত্রিত করেছে। এ সমাজ পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করে। অর্থাৎ এখানে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষ বহুত্ববাদে বিশ্বাসী; একত্রে থাকতে আগ্রহী। অমানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবতা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। রাষ্ট্র, শাসক শ্রেণী ধর্মনিরপেক্ষ একটি সংবিধানকে অমান্য করলে সম্প্রীতির পক্ষে জোটবদ্ধ করার দায়িত্ব নিতে হয় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন, প্রগতিশীল মানুষজনকেই। আশা রাখব যে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে দেশের প্রতি গর্ববোধ ও জাতীয় অহংকার নিয়ে সকল নাগরিক সম্প্রীতি ও জাতীয় সংহতি রক্ষায় সামিল হবেন। আসুন আজ এই ধর্মীয় অসাম্যের সময়ে আমরা নতুন করে বাঁচার অর্থ খুঁজে বের করি। বাবরি মসজিদ ভেঙে ইতিহাস পালটে দেওয়ার দিনে এটাই হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অঙ্গীকার।