ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি যখন প্রথম নজরে আসে, তখন আমার বয়স সাত কি আট। ছবিটা ছিল জানলার পাল্লাসমান, তার নিজেরই একটা পোর্ট্রেট। সজ্ঞান চাহনি, পোড়া ইটের দাগছোপ ধরা মুখ—ছবিটা মুহূর্তে দেখায় আহত মানুষটাকে—নিজের রক্তক্ষরণের প্রতি উদাসীন। মা, তার সহজাত সংস্কারে মামাকে এরকম পৈশাচিক ছবি ঘর থেকে সরিয়ে ফেলতে বলেছিল। আমি শুধু ভাবছিলাম, আঁকিয়ের কথা, কীরকম লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল সে, যাতে সব ক্ষতমুখ খুলে যায়…
আর কিছু মনে নেই। ছন্নছাড়া হয়ে পরের কিছু বছর কেটে গেছে বিভিন্ন দেশ, রাজ্যে। ভবঘুরে জীবনের অনিবার্য প্রবণতা চেনা সমস্ত ছবির পাকাপোক্ত ভাব ঘেঁটে ফেলে। বাড়ি কথাটাই আচমকা উবে যাওয়াতে একটা ঘোরে পাগলাটেপনার পরিচয়হীন জগতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম আমি। সেখানে তেলাপোকার মতো অন্ধকার থাবা বসায় হাড়গোড়ে। সোফা-কার্পেটে লেগে থাকে বমির হরিৎ আভা, খোপখোপ বাড়িঘর—বরফ, বরফ আর বরফ পড়ে অনর্গল; ফাঁকা পার্কিং লটে ঝুলতে থাকা ফ্লেক্সের ওপর আধমরা আলো এসে পড়ে স্ট্রিট লাইট থেকে—মানুষের জন্য—মানুষ, যারা আর কখনও ফিরবে না। স্বচ্ছ আর জীবাণুবিহীন রাস্তায় ভূতুড়ে আলো জ্বলতে থাকে। পায়ে এসে লাগে চাঁইচাঁই বরফের ভিজে নিশ্বাস। হলুদ আলো রাত্রে তাতিয়ে রাখে, যাতে সকাল হলে লাশগুলোকে টেনে নেওয়া যায় বাইরে, পরদিন। সারাদিন মরা মানুষের মধ্যে হেঁটে চলা। কংক্রিট-গড়া পৃথিবীর নীচে চাপা পড়ে যাই আমরা, সূর্য শুধু ওঠে আর নামে। হাঁটা, হেঁটে চলা, শুধুই হেঁটে চলা সারাদিন। পুনরায় ভোরে, সব ক্লেদ লুকিয়ে ফেলা মারি অ্যানট্যোয়েনেটের (Marie Antoinette) মতো৷ বাড়ি থেকে এতদূরে এক পাগলামি আমাকে নিয়মিত আটক করে, আর ছেড়ে দেয়। কখনও নিখাদ অনিশ্চয়তায়, ক্ষিপ্র টালমাটালে, ক্রূর এক প্রেতরঙে—শেষমেশ ইটগলা লালচে স্রোতের মাঝখানে। ঘুমহীন রাতে ফ্যাকাশে হলদেটে আলো, গিজগিজে গ্র্যাফিতি, ফেলে দেওয়া সেই চেয়ারটা—যার পা ঠান্ডা লাইল্যাক আলোতে পিছল, চুপ মেরে যাওয়া জানলার প্রুসিয়ান নীল রং, ন্যাড়া গলি—ডাইনির বাঁকা দাঁত এবং বহুবিধ আরও নানা আকারের নিশ্চিত উন্মত্ততা আমার ভেতরে গলেগলে পড়ে। বাড়ি ফেরার পর যখন আরও একবার ছবিটার সামনে নিজেকে দাঁড় করাই, তার যাবতীয় খ্যাপামো তৎক্ষণাৎ চিনে ফেলতে আর অসুবিধা হয় না।
![](http://aponpath.com/wp-content/uploads/2020/12/WhatsApp-Image-2020-04-16-at-12.45.30-PM-1.jpg)
![](http://aponpath.com/wp-content/uploads/2020/12/WhatsApp-Image-2020-04-16-at-12.45.27-PM.jpg)
ফলত যে প্রশ্ন আমাকে এত বছর তাড়িয়ে বেরিয়েছে, এবারও প্রায় একই উত্তর পাই তার। এবার ছবির লোকটা আর অচেনা নয়। আমি তার রক্তক্ষরণ দেখি, সেও দেখে নেয় আমাকে ছবির ভেতর থেকে, সন্তর্পণে। দেওয়ালে টাঙানো তার চোখেমুখে ইঙ্গিতে ভরা হাসি খেলে যায়—সে সমস্ত জানে, দ্যাখে আমাকে রক্তাক্ত হতে তার সাথে, তার জন্য। কয়েক বছর ধরে, তার বাড়ি গিয়ে প্রথমেই দেখেছি, তার অক্ষয় অথচ ভঙ্গুর সব কীর্তিদের, যেন জলহীন ভূভাগ অথচ স্যাঁতস্যাঁতে আর ভেজা। তার এই আপাতবিরোধী রং ব্যবহারে বিস্মিত শ্রদ্ধাবোধ জেগেছে, ছবি থেকে ফিরে তাকিয়েছে সে-ও। অদ্ভুত শান্তিও পেয়েছি, প্রত্যাখ্যানের সীমান্তে দাঁড়িয়ে থেকে অনাগত সময়কে তার এক হিম দৃষ্টিপাতে গেঁথে ফেলা দেখে। একসময় মামাবাড়ির সব দেওয়াল ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়ের আঁকা ছবিতে ভরে গেল। ওই ভারী, ধূসর আকাশ, ধুলোকাদা মাখা সমতলে জল খাওয়ার শান্তি—হাবা, নীল বালকদের নেতিয়ে থাকা—কিংবা ফড়িংয়ের চিকচিকে ডানায় ছড়ানো পাগলামির মধ্যে আমি হারিয়ে যাই। আর দেখতে পাই, ওর বোবা ঘরের দিকে মৃত্যু কীভাবে পা টিপে আসে৷ ওকে সাঁতার কাটতে দেখি, বোবা হলুদ আর কমলা তেলরঙে—যা পরের মুহূর্তে লেপটে যায় শহরের সবুজ-ধূসর নিকাশি ড্রেনের জলে। বাঁজাজমি, ধু-ধু আইসোলেশন ওয়ার্ড, হাওয়ার ঠান্ডা গর্জন—যা শিল্পী হামেরশৈয়ের (Hamershoi) ছবির বৈশিষ্ট্য—তার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে ভাস্করপ্রসাদের ছবি, নিজস্বতা। যেখানে থাকে অনিশ্চিত বৃষ্টির পর কাঁপাকাঁপা রাত, ঝিঁঝিঁপোকার সুখনাদ—নধর কাদা ও কীটপতঙ্গময় প্রাগিতিহাস, যখন পৃথিবী ঢেকে ছিল গাছের গল্পে।
![](http://aponpath.com/wp-content/uploads/2020/12/DSCN6991-1.jpg)
![](http://aponpath.com/wp-content/uploads/2020/12/WhatsApp-Image-2020-04-16-at-12.45.33-PM.jpg)
খুব ছোটোবেলা থেকে সামনাসামনি ওর কাজ দেখতে পাওয়া বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। যেসব ছবি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সেরা ইম্প্রেশনিস্ট ও আরও অন্যান্য ধারার কাজের সাথে তুলনীয়। ওকে আমি চিনি ওর আঁকা থেকে, যে আদতে রোজরোজ ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে পাড়া মাথায় করে। জীবনের নানান সময়ে আমি প্রেরণা খুঁজেছি, ভাস্করপ্রসাদের ছবির জান্তব অস্তিত্বের কাছে, তার তরলতার কাছে আশ্রয় পেয়েছি, যেমন মানুষ সমুদ্রের কাছে পায়—তার ছবির আপাদমস্তক পাগল চরিত্ররা আগলে রাখে আমায়, ঘর দেয়।
![](http://aponpath.com/wp-content/uploads/2020/12/WhatsApp-Image-2020-04-16-at-12.45.35-PM-2-1.jpg)
ভাষান্তর— শাশ্বতী সরকার
One Comment
I’m not mature enough to fully understand her word’s. I only know she is from another world. 🙏👏👌👍