কার্ল মার্কস ও বিশ্ব-সাহিত্যের অতিমানবেরা – শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য (পর্ব ৫ )

শেয়ার করুন

কার্ল মার্কস ও বিশ্ব-সাহিত্যের অতিমানবেরা (কিছু মনন সমলয়ন কথা)

প্রথম অধ্যায়: কার্ল মার্কস ও বালজাক

মহাজনী সুদ থেকে কল্পপুঁজির বুদবুদ- বালজাকের ‘গোবসেক’, মার্কসের দূরদৃষ্টি

সন্ন্যাসীর পোশাকে একের পর এক কফির কাপ নিঃশেষ করে মগ্ন বালজাক সারারাত ধরে লিখতেন। পরিশ্রান্ত হতেন না। তুখোর মেধা, প্রজ্ঞার অধিকারী সেই মানুষটির বেশ কয়েকটি ছোট গল্প এবং উপন্যাসিকা মিলিয়ে মোট নব্বইটি শিরোনামের সংকলন ‘দ্য হিউম্যান কমেডি’ (‘La Comédie Humane’) তাঁর সেরা কাজগুলির মধ্যে একটি। তীব্র অভিঘাত, বজ্রকঠিন ক্লাইম্যাক্স আর গভীর মনস্তাত্ত্বিক মোচড়ের যথার্থ সংমিশ্রণে তৈরি এই লেখাগুলি তাঁর পূর্ণ দৈর্ঘ্যের উপন্যাসের থেকে বিশেষ একটি জায়গায় আলাদা। তৎকালীন ফ্রান্সের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপর বালজাকের যে অসামান্য পর্যবেক্ষণ, বিশেষ করে অর্থনীতি সংক্রান্ত বোধ এই লেখাগুলিতে অনেক বেশি করে ধরা পড়েছে। একই সঙ্গে ধরা দেয় তাঁর সাহসিক কল্পনার তুমুল স্পর্ধা। এখানেই বালজাক খুঁজে পান আবেগের চরম নাটকীয়তার পরিসর। চূড়ান্ত উন্মাদনায় মানবিক সত্তা থেকে বিচ্যুতি, মহৎ শৈল্পিক সৃষ্টি, আবেগে আত্মহারা উদ্দাম উল্লাস, প্রতিশোধের তুমুল স্পৃহা থেকে জন্ম নেওয়া উদ্ভাবকের অভিনব সব রূপ, শিল্পীর মনোমানিয়া(monomania), প্রেমকে কেন্দ্র করে বন্যতায় ভরা উগ্রতা এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক লেনদেনের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদী স্বরূপের উদোম চেহারাটা অভাবনীয় দক্ষতায় ফুটে ওঠে ‘Passion in the Desert’, ‘Another Study of Womankind’, ‘The Unknown Masterpiece’, ‘Old Goriot’, ‘Gobseck’ ইত্যাদি রচনায়।

‘দ্য হিউম্যান কমেডি’-তে অন্তর্ভুক্ত বালজাকের আরও একটি অসামান্য উপন্যাসের বিষয়বস্তু সুদখোর গোবসেক(Gobseck)কে কেন্দ্রে রেখে। এখানে প্রধান চরিত্রটি সম্পদ, নারী, ক্ষমতার জন্য মানুষের গভীরতম সূক্ষ্ম আবেগ অধ্যয়ন করে। আবার অন্যদিকে বালজাক দেখিয়েছেন, এমনকি একজন জ্ঞানী ব্যক্তিও সোনা এবং সমৃদ্ধির বাসনায় সর্বগ্রাসী আবেগের ঘেরাটোপে আটকে পড়ে ধ্বংস হতে পারে। পুঁজির প্রথম খন্ডে ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের পুঁজিতে পরিবর্তন’ অধ্যায়ে মার্কস বলছেন, সঞ্চালন থেকে তুলে নেওয়া হলে পুঁজি হিসেবে অর্থের আত্মপ্রসারও সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিরাট পরিমাণে পণ্য সঞ্চিত হয় অতি উৎপাদনে সঞ্চয়ন থেমে যাওয়ার ফলে। এই প্রসঙ্গে বালজাকের ‘গোবসেক’ (Gobsek) উপন্যাসটিকে উদাহরণ হিসেবে ধরে বলেন,

“বলা যায় বালজাক, যিনি সবরকমের লোভকে এমন পরিপূর্ণভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন, বৃদ্ধ সুদখোর গোবসেক যখন গাদা গাদা পণ্য মজুত করতে শুরু করল, তখন তিনি তাকে তার দ্বিতীয় শৈশব অবস্থায় বলে বর্ণনা করেছিলেন।”(1)

পুঁজির তৃতীয় খন্ডে মার্কস বালজাকের লেখার উদাহরণ ধরে আরও বলছেন,


“বাস্তবের গভীর উপলব্ধির জন্য, যিনি সাধারণভাবে সুস্বীকৃত, সেই বালজাক তার সর্বশেষ উপন্যাস Les Paysans-এ সঠিকভাবে বর্ণনা করেছেন কেমন করে একজন ক্ষুদে চাষী তার মহাজনের, যারা অনুকূল্য পেতে চায়, তার জন্য বিনামূল্যে অনেক ছোট ছোট কাজ করে দেয় এবং ভাবে যে তাকে সে কিছুই বিনামূল্যে দেয় না, কেননা তার নিজের শ্রমের জন্য তো তাকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হয় না। আর এইভাবে তার মহাজন এক ঢিলে দুই পাখি মারে। সে মজুরি বাবদে অর্থ-ব্যয়টা বাঁচায় এবং ক্রমে আরও বেশি বেশি করে তাকে সুদের জালে জড়ায় কারণ সে তার নিজের ক্ষেতকে শ্রম থেকে বঞ্চিত করে ক্রমে ক্রমে সর্বনাশ ডেকে আনে” (2)


উপন্যাসে গোবসেককে বালজাক ‘পুঁজিপতি’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। উপন্যাসের কথক বিশেষ একটি মুহূর্তে বলছেন,

“আমি বুঝতে পারছি না কেন আপনার আমাকে মঁসিয়ে ভ্যান গোবসেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তিনি সবচেয়ে বিনয়ী, পুঁজিপতিদের মধ্যে সবচেয়ে নম্র। তার কাছে থাকলে সে আপনাকে টাকা দেবে-অর্থাৎ, আপনি যদি তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেন।”(3)

একুশ শতকের আবহে পুঁজিপতি শব্দটি কানে এলে যে ধারণা আমাদের মধ্যে তৈরি হয়, গোবসেককে সেই অর্থে পুঁজিপতি বলা না গেলেও তার প্রায়শই অত্যাধিক সুদের হারে ঋণ দেওয়ার কাজ বস্তুত পুঁজিবাদী যন্ত্রপাতিকে তেল দেওয়ারই নামান্তর। এমন একট সময়ের কথা বালজাক বলছেন যখন ব্যক্তিদের মধ্যে লেনদেন হওয়া ঋণগুলো IOU-র চেহারা নিচ্ছে যা লেটার ডি চেঞ্জ(lettre de change) নামে পরিচিত এমন একটি বিনিময়যোগ্য এবং ছাড়যোগ্য প্রতিশ্রুতি-নোট যা ছিল মূলত মহাজনদের দখলদারীতেই। কেবলমাত্র বিশ্বাসের ওপর ভর করে চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার পদ্ধতিটিকে ক্রেডিট সিস্টেমেরই একটি অংশ। ঠিক এই বিষয়টি উল্লেখ করে মার্কস ক্রেডিট এবং কল্পপুঁজি(fictitious capital)
প্রসঙ্গে ‘দাস ক্যাপিটাল’-র তৃতীয় খন্ডে বলেছেন,

“বাণিজ্য এবং উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যা উৎপাদন করে, সম্পূর্ণভাবে সঞ্চলনের দিকে দৃষ্টি রেখে, ক্রেডিট ব্যবস্থার এই স্বাভাবিক ভিত্তিটি সম্প্রসারিত, সাধারণীকৃত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। অর্থ এখানে কাজ করে, মোটামুটি ভাবে প্রদানের উপায় হিসেবে, তার মানে পণ্যসমূহ অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় না, বিক্রি হয় একটি নির্দিষ্ট তারিখে সেগুলোর দাম দেওয়া হবে—এমন একটি লিখিত প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। সংক্ষেপে বললে, এই সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে আমরা রাখতে পারি হুন্ডি (বিল অব এক্সচেঞ্জ)—এই সাধারণ শিরোনামের অধীনে।”(4)

আর্থিক লেনদেন ক্রেডিট সিস্টেমের হাত ধরে তখন নতুন এক অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করছে। ‘দ্য হিউম্যান কমেডি’-তে গোবসেকের অবস্থান আসলে এই ক্রমশ বদলে যাওয়া পৃথিবীর স্থির কেন্দ্রে। উপন্যাসের কথক আইনজীবী Derville-র বর্ণনা পড়ে মনে হয়, প্রত্যেককে জীবনের বিশেষ একটি দশায় নগদের জন্য অবধারিতভাবে গোবসেকের কাছে যেন আসতেই হবে। এই নতুন অর্থনৈতিক লেনদেনের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়া সামাজিক পরিস্থিতিকে কোনভাবেই যেন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আজও যেমন চড়া সুদে EMI, স্বাস্থ্য বীমা, প্রলুব্ধকর মিউচুয়াল ফান্ডের হাতছানিকে উপেক্ষা করা সহজ কাজ নয়। তরুণ Derville-কে গোবসেক বলেন, সবচেয়ে কাঁচা এবং সবচেয়ে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় মানুষের আবেগের দৃশ্য তিনি স্পষ্ট দেখতে পান। এই দেখাই তার কাজ অথচ যৌন সম্ভোগ এবং অন্যান্য আবেগজাত কাজকর্ম থেকে সচেতন ভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন গোবসেক। তিনি লক্ষ্য করেছেন কীভাবে ব্যভিচারী জীবন তার পরিচিতদের জীবনকে তছনছ করে তাদের সর্বস্বান্ত করেছে। তাই এই সকল জাগতিক আসক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকাতেই গোবসেক উচ্চতর আনন্দ পান। Derville-কে গোবসেক বলেন, “সামাজিক স্বার্থের খেলাই প্রত্যেক মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা সবাই আসে এবং আমার শান্ত জীবনে আমার সামনে প্যারেড করে।…এক কথায়, আমি বিনা পরিশ্রমে জগতকে অধিকার করি এবং পৃথিবীর আমার ওপর কোন দখল নেই।” গোবসেক কিন্তু আক্ষরিক অর্থে এখানে কোনও প্রতারক নন বরং তিনি ক্রেডিট ব্যবস্থার এমন এক মুখপাত্র যার মধ্যে রয়েছে প্রতারক এবং পয়গম্বরের মনোরম চরিত্র মিশ্রণ। এখানে প্রতারণার পদ্ধতিটি উচ্চকিত নয়। মনে হয় তা সহজ, স্বাভাবিক, সর্বজনগ্রাহ্য, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অভিনব এক অর্থতন্ত্র। মার্কসের কথায়,

“ক্রেডিট ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত দুটি বৈশিষ্ট্য হল একদিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রেরণাকে, যা হচ্ছে অপরের শ্রমের শোষণের মাধ্যমে ধনার্জন তাকে জুয়াড়িবৃত্তি ও জালিয়াতির সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও বিরাট রূপটিতে বিকশিত করা এবং যারা সামাজিক সম্পদ শোষণ করে, তাদের সংখ্যা ক্রমেই আরো আরো হ্রাস করা। অন্যদিকে উৎপাদনের এক নতুন পদ্ধতিতে অতিক্রমণের রূপটিকে গড়ে তোলা। এই দ্ব্যর্থবোধক প্রকৃতিটাই ল’ থেকে আইজাক পেরিয়ের পর্যন্ত ক্রেডিটের প্রধান প্রধান মুখপাত্রকে মন্ডিত করেছে প্রতারক এবং পয়গম্বর এর মনোরম চরিত্র মিশ্রণে।“ (5)

এই পয়গম্বরসুলভ ক্ষমতার অদম্য আকর্ষণেই প্যারিসের মার্জিত যুবক-যুবতীরা গোবসেকের জীবনের কাছাকাছি আসেন। দেখা যায় সৎ মানুষ Fanny Malvaut-কেও যাকে তিনি Derville-র নজরে আনেন। এই প্রক্রিয়ায়, বালজাকের পাঠক হিসেবে ‘দ্য হিউম্যান কমেডি’-তে বর্ণিত বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন চরিত্রগুলিকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণে দেখতে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। পিটার ব্রুকস্ বলছেন,

“ ‘Gobseck’ casts a new light on the final chapter of Balzac’s most famous novel, Le Père Goriot. In Old Goriot we saw Anastasie de Restaud, one of Goriot’s daughters, as a tragic figure exploited by her husband; here we are given the husband’s point of view, as he struggles to rescue the family fortune that Anastasie is squandering on her unscrupulous lover, Maxime de Trailles.”,(6)

প্রকৃতপক্ষে গোটা ‘দ্য হিউম্যান কমেডি’ জুড়েই ‘অর্থ’ ব্যাপারটাই বালজাকের লেখায় অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে কাজ করেছে। ‘গোবসেক’ উপন্যাসে পাঠক অর্থের ক্রমাগত এক ধরনের মোহগ্রস্ত অর্জন এবং তার অপ্রতিরোধ্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের খুঁজে পান। উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, গোবসেক বন্টনের চেয়ে ঢের বেশি অর্থ অর্জন করেছেন। দেউলিয়া ঋণদাতারা তার অ্যাপার্টমেন্টকে এমন সব জিনিসপত্র দিয়ে ভরাট করেছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই লুটের মাল এবং অকেজো। এক কথায় তা উদ্বৃত্ত পুঁজির এমন ধরনের সঞ্চয়ন যা খোদ সিস্টেমও কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বালজাকের সময়ের ফ্রান্স থেকে দেড়শ বছর এগিয়ে এক লাফে ১৯৮০-র দশকের আমেরিকায় এসে পৌঁছালে আমরা দেখি, আউটসোর্সিং-র প্রভাবে সস্তা শ্রমের দুনিয়ায় বেশিরভাগ কাজ চলে যাওয়ায় স্থির মজুরি এবং আর্থিক ভারে বিপর্যস্ত আমেরিকার সাধারণ মানুষের বিপন্ন মানসিক অবস্থা। আমেরিকায় তখন শেয়ার, ফাটকাবাজির রমরমা বাজার যার ভিত্তি আগাগোড়াই অর্থকেন্দ্রিক দূরকল্পনা(speculation)। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষের আকাঙ্ক্ষায় তখন চূড়ান্ত ফেটিশ সংস্কৃতির প্রতিফলন। জুয়াসর্বস্ব এমন এক নিরাপত্তাহীন সমাজের থেকে খানিক স্বার্থপর হয়েই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই তখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এই পরিস্থিতিতে আণবিক স্তরে নির্বাসিত পরিবারের মানুষগুলির কাছে ব্যক্তিবাদ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এইভাবে বাজারকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার এবং সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত, বড়োজোর পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর নতুন মনঃস্তাত্ত্বিক আমেজ গড়ে ওঠে। এই ভাবেই তখন প্রতি আমেরিকানের স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল অন্তত একটি সুসজ্জিত বাড়ি, সামর্থে কুলালে একাধিক। হরেক কিসিমের পণ্যে সুসজ্জিত সেইসব বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে চমৎকার দেখতে একটি বা একাধিক গাড়ি। মার্কস অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের চূড়ান্ত ফেটিশ(fetish)প্রবণতা জমা থাকে ঋণ-নির্ভর financial system-এর ভিতরেই। তিনি বুঝেছিলেন,

“Everything in this credit system is duplicate and triplicate and is transformed into a mere phantom of mind.”(7)

বাস্তবে এই ফ্যানটম-মনই গ্রাস করেছিল বালজাককে তাঁর নিজস্ব সময়ে। বালজাকের তখন বাড়ি নেই, বাড়ি বানানোর জন্য দরকারি জমিটুকুও নেই কিন্তু একের পর এক কিনে চলেছেন চোখ জুড়িয়ে দেওয়া ঘর সাজানোর মহার্ঘ্য সব জিনিসপত্র। বালজাকের স্ত্রী ইভা বালজাকের হাতে এক লক্ষ ফ্রাঁ তুলে দিয়েছিলেন। স্পেকুলেশনের নেশার খপ্পরে পড়ে বালজাকের ভূতগ্রস্ত মাথায় তখন ফাটকার প্রতি তীব্র ঝোঁক। কিনে নিয়েছিলেন নির্মীয়মান এক জাহাজের শেয়ার দশ হাজার ফ্রাঁতে। কেউ একজন লোভ দেখিয়েছিল, চল্লিশ পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড পাওয়া যাবে ওই শেয়ার থেকে। ডিভিডেন্ড দূরে থাক, শেয়ারের টাকাটাও আর ফিরে পাননি বালজাক। এমন আরও কত সব ঘটনা!
বালজাক যেন পুঁজিবাদের সঙ্গে এক ধরনের শয়তানের চুক্তিতে জীবনযাপন করেছিলেন। কিন্তু দেখার মতো বিষয়টি হল, অর্থের বিভ্রম থেকে তৈরি হওয়া বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে আর সকলে যেখানে ছাই হয়ে যায়, সেই আগুনই তাঁকে পুড়িয়ে করেছিল খাঁটি সোনা। সমকালের মানুষের সাহিত্য-ক্ষুধা মিটানোর উঞ্ছবৃত্তির দিকে তাঁর তখন কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল মানুষের নির্ব্যুঢ় সত্তার মূল্যায়নের প্রতি। সমকালে থেকে সমকালকে ছাপিয়ে ভবিষ্যতের দিকে অনেকখানি এগিয়ে এসে সমকালকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখার লোকত্তর প্রতিভা বালজাকের ছিল বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর পক্ষে। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য তাই সার্বজনিক ও সার্বদেশিকতায়। (8) বিশেষ দেশকালকে অতিক্রম করে চিরকালের মানুষের হৃদয়ের কথাকার হতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা তো হাতেগোনা। কার্ল মার্কসের মতোই অনরে দি বালজাকও তাঁদের মধ্যে একজন।

তথ্যসূত্র:

  1. Capital, Volume-1, Progress Publisher,1977, Page – 552
  2. Capital, Volume- 3, Page- 39
    “Balzac, who is generally remarkable for his profound grasp of reality, aptly describes in his last novel, Les Paysans, how a petty peasant performs many small tasks gratuitously for his usurer, whose goodwill he is eager to retain, and how he fancies that he does not give the latter something for nothing because his own labour does not cost him any cash outlay. As for the usurer, he thus fells two dogs with one stone. He saves the cash outlay for wages and enmeshes the peasant, who is gradually ruined by depriving his own field of labour, deeper and deeper in the spider-web of usury.”
  3. THE HUMAN COMEDY, Selected Stories, HONORÉ DE BALZAC, Edited and with an introduction by PETER BROOKS, Translated from the French by LINDA ASHER CAROL COSMAN and JORDAN STUMP, NEW YORK REVIEW BOOKS, New York, 2014, Page-226
  4. কার্ল মার্কস, ক্যাপিটাল, তৃতীয় খন্ড, প্রথমার্ধ, অনুবাদ পীযূষ দাশগুপ্ত, পৃষ্ঠা- ৪০৬
  5. Ibid, পৃষ্ঠা- ৪৫৪-৪৫৫
  6. THE HUMAN COMEDY, Selected Stories, HONORÉ DE BALZAC, Edited and with an introduction by PETER BROOKS, NEW YORK REVIEW BOOKS, New York, 2014, Page-7
  7. কার্ল মার্কস, ক্যাপিটাল, তৃতীয় খন্ড, প্রথমার্ধ, অনুবাদ পীযূষ দাশগুপ্ত, Page- 603
  8. বালজাক, যজ্ঞেশ্বর রায়, পরম্পরা, ২০১৩, পৃষ্ঠা – ১০৯
শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *