বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ১১) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ১১) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

একাদশ পর্ব

১৯৪০ এল বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। ভারত বাদে সর্বত্র প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও বন্ধ। কিন্তু ভারতে স্থানীয় ক্রিকেটের সর্বোৎকৃষ্ট রূপ এই সময়ে দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতীয় ক্রিকেটকে ব্রিটিশ নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়মিত উন্নত মানের ঘরোয়া ক্রিকেটের মাধ্যমে দলের জাতীয় ভিত্তি মজবুত করে।

এই পর্বে আলোচনা করব কলকাতার তৎকালীন ক্রিকেটের খণ্ড চিত্র। যা তুলে ধরবে তৎকালীন অবস্থা যা পঞ্চাশের দশকের সাফল্যের মূল ভিত্তি ছিল।

১৯৩৯ এর নভেম্বর এর ১২ তারিখে কলকাতায় ইউরোপিয়ান বনাম ইন্ডিয়ান ম্যাচ হয়েছিল। কিন্তু তার স্কোর পাইনি। ভবিষ্যতে এই ব্যাপারে লেখা যাবে। যাই হোক, ১৯৪০ এর পয়লা জানুয়ারি টালার মাঠে বেঙ্গল জিমখানা ও স্পোর্টিং ইউনিয়নের মধ্যে ম্যাচ ড্র হয়। সিঙ্গল ইনিংস ওয়ানডে ম্যাচের প্রথমে বেঙ্গল জিমখানা ৮ উইকেটে ১৯৫ করে। কমল ভট্টাচার্য ৭১ ও আব্দুল জব্বার ৭৯ করেন। এস মিত্র ৫৫ রানে ৩ উইকেট নেন। জবাবে স্পোর্টিং ইউনিয়ন ২ উইকেটে ১৩০ করায় ম্যাচ ড্র হয়ে যায়। নির্মল চ্যাটার্জী অপরাজিত ৭৩ করেন, কার্তিক বসু অপরাজিত ৩০ ও গণেশ বসু ২৫ করেন।

এদিকে ওইদিনই একটুর জন্য ইস্টবেঙ্গল মহামেডানকে হারাতে পারেনি। ইস্টবেঙ্গল ১৫৫/৯ করেন। ছোট ওবেদ আলী ৩১ রানে ৪ উইকেট পান। জবাবে পি সেন (৪ রানে ৩ উইকেট) ও জে গল (২৬ রানে ৫ উইকেট) মহামেডানকে (৭২/৯) শেষ অবধি অল আউট করতে পারেনি। ম্যাচে ড্র হবে।

ওইদিন ভবানীপুর (১৫৮) স্টুডেন্ট স্পোর্টিং (৯০) কে ৬৮ রানে হারায়। ভবানীপুরের অমর বসু ৬৫, ডি মুখার্জী (৫/৩১) ভালো বোলিং করেন স্টুডেন্ট স্পোর্টিং এর পক্ষে।

ইডেনে ওইদিন পি মিলারের অপরাজিত ১০০ ও লংফিল্ড ৫০ করায় ক্যালকাটা ২১৫/৫ তোলে। এরপর ক্যালকাটার এন এফ টার্নার ৩৮ রানে ৪ উইকেট ও স্কিনার ৩৫ রানে ৬ উইকেট নিলে ডালহৌসি ১৩৪ রানে অল আউট হয়ে যায়। গাব্বিস অপরাজিত ৪৪ ও গাইজ ৩৪ করেন।

অন্যদিকে বালিগঞ্জ মাত্র ৩০ রানে আউট হয়ে যায় আলেকজান্ডার (৩/১৩) ও পি দে (৬/১১) এর বোলিংয়ের সামনে। জবাবে নীরেন দের অপরাজিত ৭৮ এর ভরসায় ৫ উইকেটে ১৫৭ তোলে টাউন। তাঁরা জিতে যাওয়ার পরেও ব্যাট করেছিল।

এছাড়া ওইদিনই ইউনিয়ন স্পোর্টিং ১৫২ করে এস মজুমদারের (৬/৪৭) বোলিং এর সামনে। জবাবে এস চ্যাটার্জী ৬ অপরাজিত ৫৩ তোলায় এরিয়ান্স ৬ উইকেটে ১৭৪ তোলে। এরাও জিতে যাওয়ার পরেও ব্যাট করেছিল।

২ রা জানুয়ারি অঘটন ঘটে। সেসময় কলেজ ক্রিকেট ক্লাব ক্রিকেটের মর্যাদা পেত এবং সেখানে সর্বাধিক শক্তিশালী দল ছিল বিদ্যাসাগর কলেজ। তাঁরা সেন্ট পলসের কাছে ৩ রানে হেরে যায়। এস গুহ (৫/৩৩) ও এস ব্যানার্জী (৫/৩৮) সেন্ট পলসকে ১১৩ রানে আটকে দেয়। এরপর এস পাল (৩/৩১) ও এ ভট্টাচার্য (৩/৪২) বিদ্যাসাগর কলেজ কে ১১০ রানে আটকে দেয়। খেলাটি শ্যামপার্ক (?) এ হয়েছিল।

সেবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রোহিন্টন বারিয়া খেলেনি। আলীগড় সেবার সেমিফাইনালে উঠলে বোম্বের বিরুদ্ধে খেলতে যাওয়ার আগে কলকাতার বিরুদ্ধে কলকাতায় সফর করতে আসে। টসে জিতে কলকাতা প্রথম ব্যাট করতে নেমে ২৭৬ করে। ধ্রুব দাস (ভাসি দাস, কুমার প্রসাদের বড়ো কুটুম) ৬৩, কল্যাণ বসু ৫০ ও টি ডি সেনা (সিংহল থেকে এসেছিলেন) ৬২ করেন। আবদুল লতিফ (৪/৬১) ও আফতাব (৪/৭৮) বেস ভালো বল করেন। জবাবে প্রথম দিনের বাকি সময়ে আলীগড় ১২৪ রানে অল আউট হয়ে যায়। মজিদ খানের (ভবিষ্যতের পাকিস্তানের টেস্ট ক্রিকেটার) কাকা ভারতের হয়ে বেসরকারি টেস্ট খেলা মাসুদ সালাউদ্দিন ৪৪ করেন। টি ওয়াই খাঁ ৩১ করেন। এস দত্ত ৪৫ রানে ৫ উইকেট পান। নির্মল চ্যাটার্জী ১৬ রানে ৩ উইকেট নেন।

৩ রা জানুয়ারি দ্বিতীয় দিন আলীগড় ১০৩ রানে অল আউট হয়ে যায় ও এক ইনিংসও ৪৯ রানে হেরে যায়। সালাউদ্দিন একাই ২৮ মিনিটে ৫৩ করেন। এক ওভারে ৩৪ রান নেন। এইচ সাধু ২৪ রানে ৩ উইকেট নেন। নির্মল চ্যাটার্জী ৩ উইকেট নেন ৫৬ রানে, তারই বলে ৩৪ হয় এক ওভারে। সলিল দত্ত ২৪ রানে ৪ উইকেট নেন।

ওইদিন হাওড়ায় বাজে শিবপুর অ্যাসোসিয়েশন (১০০/৯) হেরে যায় শিবপুর ইউনিয়ন এর (৫/১০৬) বিরুদ্ধে ৫ উইকেটে। বাজে শিবপুরের বি চ্যাটার্জী (বড়) ৩১ করেন। ডি চ্যাটার্জী ৭ রানে ৩ উইকেট নেন। শিবপুরের দুলু চ্যাটার্জী ৩৮ করেন।

চৌঠা জানুয়ারি রঞ্জি ট্রফির ট্রায়াল ম্যাচ করা হয় দুটি দল করে। একটি দলের নাম ছিল রায় বাহাদুর কে ব্যানার্জী একাদশ ও অন্য দলটি ছিল কুমার বি কে রায়চৌধুরী একাদশ।

রায় বাহাদুর কে ব্যানার্জী একাদশ প্রথমে ব্যাট করে ২০৩/৭ তোলে। এস রায় ৭০, নির্মল চ্যাটার্জি ৭২ করেন। আলেকজান্ডার ৫৬ রানে ৫ উইকেট পান। জবাবে কুমার বি কে রায়চৌধুরী একাদশ ১০৯/৪ তুললে ম্যাচ ড্র হয়ে যায়। কে রায় ২৫, অমিয় দেব (কানি) ২৪ করেন। এন শী ৩৮ রানে ৩ উইকেট পান।

ওই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দল (তখন cu pg আলাদা দল হতো) ১৫৫/৫ তোলে এইচ সেনগুপ্তের ৩৮, এস দাসের ৩৩ ও আর ভট্টাচার্যের ৩৫ এর ব্যাটিং এর ভিত্তিতে সিটি নর্থের বিরুদ্ধে। এন মজুমদার ২৭ রানে ৪ উইকেট নেন।

জবাবে সিটি নর্থ (আর্মহার্স্ট স্ট্রিট) ৭ উইকেটে ১১১ তুলে ম্যাচ ড্র করে। এন মজুমদার ৩০ রান করেন। ডি ভট্টাচার্য ১২ রানে ৪ উইকেট পান।

পরের দিন ৫ই জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দল বিদ্যাসাগর কলেজকে পর্যুদস্ত করে। CU PG ১৪৬ করে। আর ভট্টাচার্য ৫৭ করেন। এস গুপ্ত ৫৭ রানে ৬ উইকেট নেন। জবাবে ডি চ্যাটার্জী ১১ রানে ৮ উইকেট নিলে বিদ্যাসাগর ৩৬ রানে অল আউট হয়ে যায়।

অন্য খেলায় স্কটিশচার্চ কলেজ ২০৩ তোলে রিপন (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ) কলেজের বিরুদ্ধে। স্কটিশচার্চের এস চক্রবর্তী ৬৭ করেন। এস বসু ৮৭ রানে ৫ ও এ পালিত ৩০ রানে ৪ উইকেট নেন। জবাবে রিপন কলেজ ১১৪ রানে শেষ। এস চ্যাটার্জী ৩৮ করেন। এস সেনগুপ্ত ২৪ রানে ৩টি ও এস চক্রবর্তী ৯ রানে ৩ উইকেট নেন।

১৩ই জানুয়ারি বাংলা ইডেনে মুখোমুখি হয় যুক্তপ্রদেশের। অধিনায়ক কার্তিক বসু, উইকেট কিপার তাঁর মামাতো ভাই ক্ষীরদা রঞ্জন রায়।

প্রথম দিন মিলার (৪০) ও বেরহেন্ড (১০৭) প্রথম উইকেটে ১০০ রান তুললেও সন্তোষ গাঙ্গুলী (০) ও অধিনায়ক কার্তিক বসু (০) আউট হয়ে যেতে বেশ সমস্যায় পড়ে বাংলা। বেরহেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে নির্মল চ্যাটার্জী (৬৪) ১২৭ রান যোগ করেন জুটিতে। কিন্তু সেই আলিগড়ের মাসুদ সালামুদ্দিন (৬/৬২) বিধ্বংসী বল করায় বাংলা প্রথম দিনের শেষে ২৪৫/৯।

দ্বিতীয় দিন ২৬০ রানে বাংলা শেষ। ফিরোজ পালিয়া (৩/৫৪) যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন সালামুদ্দিনকে।

যুক্ত প্রদেশ ৫৫ রানে ২ উইকেট হারালেও আফতাব আহমেদ (৭২) ও অধিনায়ক ফিরোজ পালিয়া (৭১) তৃতীয় উইকেটে ১৪৫ রান যোগ করেন। কিন্তু অচিরেই কমল ভট্টাচার্য (৫/৫৬) যুক্তপ্রদেশের ইনিংসে ধ্বস নামালে যুক্ত প্রদেশ দিনের শেষে ২৭১/৮।

পরের দিন ২৯৫ এ অল আউট হয়ে যুক্ত প্রদেশ লিড পেলো ৩৫ রানের।

তৃতীয় দিন বাংলা দ্রুত গতিতে রান তুললেও ফিরোজ পালিয়া (৪/৬৬) ও আফতাব আহমেদ (৫/৫৫) বাংলা কে ১৬৩ রানে (৩০.২ ওভারে) ফেলে দেয়। শুধু পি এন মিলার ৫৫ করেন।

জবাবে ১২৯ রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ৪৮ রানে ৫ উইকেট হারায় যুক্ত প্রদেশ। শামীম খ্বাজা (১১) ও সালামুদ্দিন (৩৮) ৩২ রান যোগ করে, তারপর খ্বাজা ৮০ রানের মাথায় আউট হন বেরহেন্ডের বলে তাঁরই হাতে ক্যাচ দিয়ে। এ এস এন মূর্তি (১১) নির্মল চ্যাটার্জির বলে বোল্ড হন যখন তখন রান ১০৫/৭। সালামুদ্দিন ১১০ রানের মাথায় নির্মল চ্যাটার্জির বলে বোল্ড হন। কিন্তু বি কে গারুদাচার (অপরাজিত ১০) ও ইকবাল আহমেদ খান (অপরাজিত ৫) মাঠ ছাড়েন তখন ১২৪/৮। ম্যাচ ড্র, প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থেকে যুক্ত প্রদেশ পরের ধাপে যায়, বিগত চ্যাম্পিয়ন বাংলা বিদায় নেয়।

১৯৪০ এর ডিসেম্বরে সিংহল (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) ভারতে খেলতে এলে কলকাতায় প্রথম বেসরকারি টেস্ট হয় ২৬ শে ডিসেম্বর। ৪৫ বছর বয়সি সি কে নাইডুর অধিনায়কত্বে ৫ জন বাঙালি সহ ৮ জন খেলতে নামে বাংলা থেকে।

টসে জিতে ভারত প্রথম ইনিংসে তোলে ২৫১। সন্তোষ গাঙ্গুলী ৬৯ করেন। নির্মল চ্যাটার্জী ৫৩। শুটে ব্যানার্জী করেন ৪৩, পালিয়া ৩৮। কেলার্ট ৭০ ও গুনরত্নে ৭৯ রানে ৪ উইকেট নেন। এরপর সিংহল নামলে মাত্র ২৫ রানে ৩ উইকেট পড়লেও জয়বিক্রমে ও জি জে ডি গুনরত্নে দিনের শেষে দলকে ৯৬/৩ এ নিয়ে যান।

পরের দিন জয়বিক্রমে ১৮৯ মিনিটে ১৩৮ করেন, জি জে ডি গুনরত্নে করেন ৪৪। চতুর্থ উইকেটে দুজনে ১৪২ রান যোগ করেন। এছাড়া এ এইচ গুনরত্নে করেন ৩৪, পরিট ৪৯ ও এগারো নম্বরে নামা জয়সুন্দেরা অপরাজিত ৩৭ করেন। শেষ উইকেটের ৫৭ রান উঠলে সিংহল তোলে ৩৭২। ভারত দিনের শেষে ৪২/১।

খেলার শেষ দিন ভারত ২৯৩/৫ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। নির্মল চ্যাটার্জী অপরাজিত ৭৩, নাইডু ৫০ ও সন্তোষ গাঙ্গুলী ৬৪ করেন। ১৫২ করলে জিতবে এই অবস্থায় খেলতে নেমে তাঁদের ৮২/২ এ ম্যাচ শেষ হয়ে যায়। পুল্লে ৩৫ করেন।

যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও ক্রিকেট দুইই পরের বছর থেকে বদলাতে শুরু করবে…


শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২