মনে পড়ে – অমিতাভ গুপ্ত ( কবিতার সূত্রে আত্মকথন: পর্ব ২ )

মনে পড়ে – অমিতাভ গুপ্ত ( কবিতার সূত্রে আত্মকথন: পর্ব ২ )

শেয়ার করুন

সন্ধ্যাগোধূলির আভা – অমিতাভ গুপ্ত ( কবিতার সূত্রে আত্মকথন: পর্ব ১ )

       তিরিশ বছর আগের কথা মনে পড়ে।

      ১৯৯০ সন। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে উত্তর ভারতের কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে কলকাতায় ফিরে এলাম। ভ্রমণ শেষের স্বাভাবিক প্রফুল্ল-প্রসন্নতা নিয়ে নয়, কোনো এক ব্যাখ্যাতীত বেদনা বহন করে। ভ্রমণসূচীর মধ্যে বারবার লক্ষ্য করেছিলাম, ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারাবাহিক সন্ত্রাস এবং নৃশংসতার অভিজ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে। কে জানত, চতুর্দিকের সেই কলঙ্কিত ইতিহাসের থাবা অচিরেই আছড়ে পড়বে আবার আমাদের দিকে।      

১৯৯০ সন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক গণহত্যা ঘটে গিয়েছে। সফদার হাসমি এবং তাঁর সঙ্গী রামবাহাদুরকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন করা হয়েছে। রামশিলা –অভিযানের সূচনা হয়েছে। ভাগলপুরে চালানো হয়েছে লাইট মেশিনগান। এবং শঙ্কর গুহ নিয়োগীকে হত্যা করার জন্য একটি রাইফেলের গুলি ছুঁড়তে সুপারি কিলারকে নাকি দেওয়া হল দশ লক্ষ টাকা। এদের সঙ্গে মিশে গেল ১৯৬৬ সনের খাদ্য আন্দোলনের সময়ে পুলিশের গুলিতে নিহত চোদ্দ বছরের  কিশোর নুরুল ইসলামের নাম, নব্বইয়ের দশকে নিহত রঘুনন্দন, রাজু দাস, মধুমিতার নাম। মিশে গেল সত্য থেকে আসা মৌর্যযুগ থেকে তথাকথিত আধুনিক যুগ পর্যন্ত মৌলবাদী কুকীর্তি।

      রঘুনন্দনকে যেদিন তারাতলায় পরপর দুটি গুলি করে হত্যা করা হয় সেদিনই কিছুক্ষণ রাজনৈতিক দাঙ্গা থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বাড়ি ফিরে ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ কবিতাটি রচনা করি। সন্ধেবেলা গৌতম চৌধুরী ও জহর সেন মজুমদার কবিতাটি শুনেছিলেন এবং গৌতম তাঁর ‘অভিমান’ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় দীর্ঘ কবিতাটি সম্পূর্ণ প্রকাশ করেন। কবিতার দীর্ঘ পংক্তির সৌজন্যে তিনি তাঁর পত্রিকার দু-কলমে ছাপানো আকার বড়ো পাতার এক-কলমে পরিণত করেন। পাণ্ডুলিপি এখনও তাঁর কাছে যত্নে রক্ষিত, শুনেছি। অবশ্য পরবর্তী মুদ্রণগুলিতে আমিই কয়েকটি পরিবর্তন ঘটিয়েছি। নিজামুদ্দিনের স্ত্রীর ধিক্কার ‘ধর্ম’ হয়ে উঠেছে ‘রাষ্ট্র’। ভারতবর্ষের প্রাক ইতিহাস এবং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যায় অধীত করলে বোঝা যায়, রাষ্ট্রই স্ট্রাকচার, ধর্ম সুপার স্ট্রাকচার। মহামতি অশোক থেকে মহান আধুনিক গণতন্ত্র ― সমস্ত স্ট্রাকচারই ধর্মকে যথেচ্ছ অত্যাচারের অস্ত্র করে তুলেছে। ধর্মকে করে তুলেছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যার সঙ্গে আধ্যাত্মিক চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই।

      ফিরোজ শা কোটলায়, সারনাথে, উদয়গিরির শীর্ষ অশোকস্তম্ভে উৎকীর্ণ লিপি পাঠ করলে শিউরে উঠতে হয়। রাষ্ট্রশক্তির এই নিপুণ ভীতি প্রদর্শন কুবাত-উল-ইসলাম ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে চলে এসেছে একুশ শতকে। প্রার্থনা করি, আজ আমরা যেন ‘বুলন্দ্ দরওয়াজা’-র মতো দৃঢ় ও উন্মুক্ত-উদার থাকতে পারি।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২