বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়  (পর্ব ২)

বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়  (পর্ব ২)

শেয়ার করুন

পর্ব ২

নাম যতই ‘বর্ষশেষের কলকাতা: কলকাতার ক্রিকেট’ হোক না কেন, নববর্ষের ক্রিকেটও প্রসঙ্গক্রমে আসবেই। আসলে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৫/৭ জানুয়ারি, এটাই ছিল শৈত্যকালীন উৎসবের সময়। আর সঙ্গে ডি গামা সাহেবের কেক থাকত কিনা জানি না, তবে চেরি অফ দ্য কেক ক্রিকেট থাকতই।

উনিশ শতকের শেষের দিকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ক্রিকেটকে পূর্ণাঙ্গ আকারে গ্রহণ করে এবং অনেক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ক্রিকেট-ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়়, যেমন– টেলিগ্রাফ, নেভাল ভলান্টিয়ার্স (পরে রেঞ্জার্স), হরনেটস, ক্যালেডোনিয়ানস এবং ওয়াই এম সি এ। তাদের মধ্যে ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান উভয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যোগ্যতার খেলোয়াড়গুলি— F. T. Paine, H. R. Carruthers, W. E. Moran, J. H. Hechle, J.D. Guise এবং প্রাক্তনদের মধ্যে প্রফেসর বুথ এবং “Teddy” Templeton, Bruce Peeke, H. A. Bailey, C. M. Barlow, M. Quiterio প্রভৃতি। আন্ডার-আর্ম বোলিং বেশি ব্যবহৃত হত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ওভার-আর্ম বোলিং নিশ্চিতভাবে গৃহীত হয়েছিল। জে.টি. হার্নের অসাধারণ সাফল্য, যিনি ১৮৯৮ সালে পাতিয়ালার মহারাজা দলের হয়ে খেলেছিলেন এবং যার ওভার-আর্ম ডেলিভারি “অফ” থেকে ভেঙে যেত, তা বাঙালিদের মধ্যে ওভার-আর্ম বোলিংকে জনপ্রিয় করে তোলে। ক্রিকেট অবশ্য খুব ধীরে ধীরে শিকড় বিস্তার করছিল শহরে।
যদিও কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী ছিল, তবুও ক্রিকেটের অগ্রগতি শামুকের গতিতে চলেছিল এই শহরে, যখন বোম্বে একজন ক্রিকেটার গভর্নর লর্ড হ্যারিসের সাহায্যে এবং সমস্ত সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে পার্সিদের জনপ্রিয় করে তোলে, তখন কলকাতায় বাঙালি খেলোয়াড় কম ছিল।

তবে সে-যুগেও শীত ছিল। বেশ ভালোভাবেই জমিয়ে শীত পড়ত। উনিশ শতকের শেষ দশকে ভিন্ রাজ্যের দলকে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি বালিগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানীয় দলের সঙ্গে ম্যাচও চলত নিয়মিত।

৩ জানুয়ারি, ১৮৯১ ইডেনে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে পূর্ণিয়া ক্রিকেট ক্লাবের ম্যাচ ছিল। বিহারের সেরা ব্রিটিশ ক্রিকেটাররা ক্যালকাটাকে চরম বিপদে ফেলে দেয়। এ জি শিলিংফোর্ড ১১টি উইকেট নেন দেখতে পারছি। এ সি প্যাটারসন ৩৯ ও ডব্লিউ ই মোরান ২৭ করেন। ক্যালকাটা ১০২ ও ৭১ তুলতে সক্ষম হয়। এদিকে কলকাতায় জন্মানো কফি বাগানের মালিক কেমব্রিজের পেরেরা ১০৯ করেন। উইলিয়াম ৪১ ও শিলিংফোর্ড ২৩ করেন। মোরান ৪টি উইকেট নেন।

ওই বছরের শেষ দিকে, ২৪ ডিসেম্বর, গভর্মেন্ট সার্ভিসেস দল খেলতে নামে ইডেনে ক্যালকাটার বিরুদ্ধে। টি বি মফিট ৪৭ করলেও কুইন ৪ টি, মোরন ৩ টি উইকেট নেন। গভর্মেন্ট সার্ভিসেস ২০২ করে। জবাবে বেডি ৪০ ও মোরন ৪৫ করলে ক্যালকাটা ২১০ করে। হিক্লে ৭০ রানে ৭ উইকেট নেন। এরপর গভর্মেন্ট সার্ভিসেসের ডগলাস ৪৮ ও বেল ৫৯ করলেও হেয়ারের ৪ উইকেটের জন্য ১৯২ তোলে। ম্যাচ ড্র হয়ে যায়।

৩১ ডিসেম্বর, ১৮৯১ ক্যালকাটা আবার পূর্ণিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে নামে। আবার শিলিংফোর্ড ২৮ রানে ৫ উইকেট নেন, সেলস নেন ২৭ রানে ৪ উইকেট। ফলে ক্যালকাটা মাত্র ৭৯ রান তোলে। কিন্তু পিচার (৩/১২) ও মোরন (৩/৩৯) পূর্ণিয়া কে ৮৭ রানে আটকে রাখে।

এবার ব্যাট হাতে মোরন অপরাজিত ৬৪ ও ডগলাস ৩৩ করায় ক্যালকাটা ২৩১/৪ তোলে। এরপর ম্যাকেঞ্জি (৩/১১) ও পিচার (৩/৭) পূর্ণিয়া-কে ৬৫ রানে অল আউট করে দিয়ে ক্যালকাটা-কে ১৫৮ রানে জিতিয়ে দেয়।

একই সময় হাওড়া (৬৮ ও ৪৬/৪) বনাম বালিগঞ্জ (১৪১) খেলা হয়। হাওড়ার ক্যামেরন ৬ টা ও বালিগঞ্জের সুইনহো ৭টি উইকেট পান। ইনি অস্ট্রেলিয়ার ১৮৭৭ সালের প্রথম টেস্ট দলের ব্রানসবি কুপারের মামা।

ডিসেম্বরে বড়ো ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। তার মধ্যে যদিও মার্চেন্ট অ্যান্ড ব্রোকার্স বনাম দ্য ওয়াল এ ম্যাচ ছিল। মার্চেন্ট অ্যান্ড ব্রোকার্স-এর কুইন অপরাজিত ৯৩ করেন।
এবার আসি উনিশ শতকের সর্বাপেক্ষা বড়ো ঘটনায়।
লর্ড হকের নেতৃত্বে একটি ইংরেজ ক্রিকেট দল ১৮৯২-৯৩ সালের ভারতীয় মরশুমে সিলোন এবং ভারত সফর করে। ১৮৮৯-৯০ সালে জি এফ ভার্ননের একাদশের পর এটি ছিল কোনো ইংলিশ টিমের ভারতের মাটিতে দ্বিতীয় সফর এবং সিলোনে তৃতীয় সফর (সিলোনের প্রথম সফরে খোদ ডব্লিউ জি গ্রেস ছিলেন, সে-কথা অন্যত্র হবে)।

দলটি ১৪ অক্টোবর ১৮৯২ তারিখে টিলবারি ত্যাগ করে এবং ১৮৯৩ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সফরটি শেষ করে। চারটি প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ ছিল সফরে, সবকটিই ভারতে, যার মধ্যে একটি সর্বভারতীয় একাদশের অংশগ্রহণের প্রথম ম্যাচটিও ছিল, যা ভারতের প্রথম বেসরকারি টেস্ট। সব মিলিয়ে তারা ২৩টি ম্যাচ খেলে যার মধ্যে ১৫টি জেতে, ২টিতে হারে এবং ৬টি ড্র করে। তিনটি ম্যাচ ছিল সিলোনে।

লর্ড হক ট্যুরের শুরুতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন (যেমন তিনি ১৮৮৯-৯০ সালের আগের সফরে ছিলেন) এবং সিলোনে ম্যাচ মিস করেন।

দলটি সম্পূর্ণরূপে অপেশাদারদের নিয়ে গঠিত হয়। দলে ছিলেন— লর্ড হক (অধিনায়ক), গডফ্রে ফোলজাম্বে, জোসেফ গিবস, আর্থার গিবসন, ক্রিস্টোফার হেসেলটাইন, লেজার হিল, জন হর্নসবি, এফ এস জ্যাকসন (ইনি পরে বাংলার ছোটোলাট হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বীণা দাশ কর্তৃক আক্রান্ত হন), আলবার্ট লেথাম, মন্টেগু ম্যাকলিন, জন রবিনসন, জর্জ ভার্নন,চার্লস রাইট ও হেনরি রাইট।
এঁদের মধ্যে হক, ভার্নন, হেসেলটাইন, লেজার হিল, জ্যাকসন ও লেজার হিল টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যদিও জ্যাকসন ও হক ছাড়া কেউ খুব একটা বড়ো মাপের খেলোয়াড় ছিলেন না। এঁদের টেস্ট গুলোও ‘জোর করে স্বীকৃতি দেওয়া’।

হক, গিবসন, হর্নসবি, লেথাম এবং ভার্নন সকলেই ১৮৮৯-৯০ সফরকারী দলের সদস্য ছিলেন। জ্যাকসন এবং হিল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং জ্যাকসন সবেমাত্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তখন। পরে তিনি ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্ব করেন।

৫ই জানুয়ারি কলকাতায় ইডেনে বসে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব বনাম লর্ড হক একাদশের ম্যাচের আসর। ৫ বলে ওভারের এই ম্যাচ দেখতে তৎকালীন বড়োলাট ল্যান্সডাউন (যিনি নিজে কানাডায় থাকাকালীন ক্রিকেট খেলেন) উপস্থিত ছিলেন। ছোটো চার্লস আলফ্রেড ইলিয়ট উপস্থিত ছিলেন।

এইসময় রাজভবন থেকে কিছু অলংকার চুরি যায়, যা আজও নথিভুক্ত আছে Queen-Empress v. Makhan মামলার নথিপত্রে।

যাই হোক, ৫ বলে ওভারের এই খেলায় হেয়ারের বোলিং (৬/৯২) সত্বেও ২৯১ তুলতে হকের দলকে আটকাতে পারেনি। হর্নসবি ৮৬ করেন। হিল ৩৮ করেন। উল্লেখ করা যাক, হেয়ারের ৬ উইকেটের ৪টেই কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটারের। ইনি ছিলেন একজন ব্যাঙ্কার।

প্রথম দিনের বাকি সময়ে ২৬ রানে ৫ উইকেট হারায় ক্যালকাটা। ক্যারুদার ২৩, পেইন ১৯, হিক্লে ২৫ ও হেয়ার ১২ রান করায় ক্যালকাটা ১১৬ করে। হর্নসবি ৩৪ রানে ৪ উইকেট নেয়, হিল ৩৯ রানে ৪ উইকেট নেন।

ফলো অন ইনিংসে আবার ভরাডুবি। ক্যারুদার ২৩ না করলে ৯২ রানও উঠত না। হর্নসবি (৪/৩৫) ও ফোলজাম্বে (৩/৪) বিধ্বংসী বল করেন।

লর্ড হকের দল এক ইনিংস ও ৮৩ রানে জয়ী হয়।
লর্ড হকের এই দল কলকাতায় বিশাল প্রভাব ফেলেছিল ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা প্রসারে। পরবর্তী কালে বহু লেখকের রচনায় হকের কথা উঠে আসে। তিনি পরেও কলকাতা আসেন, সে আলোচনা যথা সময়ে লেখা হবে।

আরেকটা খেলা এই সময় হকের দল কলকাতায় খেলছিল। সেটা যদিও একসপ্তাহ পরে হয়, তবুও উল্লেখ করতেই হবে। ম্যাচটি হয়েছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সঙ্গে। নীল, টমাস, হোর এবং ক্যাম্পবেল বাদে সকলেই ক্যালকাটার খেলোয়াড়।

চার্লি রাইট (৩৭) ছাড়া কেউই হোরের (৪/৫৩) বোলিং এর সামনে দাঁড়াতে পারেনি। হকের দল মাত্র ১৫৮ করে। জবাবে প্রথম দিনের শেষে বেঙ্গল ৮/০।

দ্বিতীয় দিন কেবল ক্যাম্পবেল (২৭) ও টমাস (২৪) ছাড়া হর্নসবির (৬/৩৫) বোলিং খেলতেই পারেননি। বেঙ্গল মাত্র ৭২ করে। ফলো অন ইনিংসে রুখে দাঁড়ায় বেঙ্গল। নীল ৩৪, মোরান ৪০, ক্যাম্পবেল ৪০, পেইন ৩৫, হিক্লে ৩৫ করায় বেঙ্গল ২৬৮/৮ (ডি:) তোলে তৃতীয় দিনে। গিবসন ৪৮ রানে ৩টি ও হর্নসবি ৬৮ রানে ৩ উইকেট নেন।
১৮৩ রান করলে জয় এই অবস্থায় খেলতে নেমে হোরের (৪/৩৮) বোলিং হকের দলকে ২৬ ওভারে ৮৩/৬ এ আটকে দেয়। ম্যাচ ড্র হয়।

নিজের আত্মজীবনী Recollections and Reminiscences (Williams & Norgate Ltd, London, 1924)-এ লর্ড হক লিখেছেন যে কলকাতার ম্যাচগুলো প্রথম শ্রেণীর না হলেও তিনি খেলেছিলেন এবং দলের অন্য খেলোয়াড়দের মত হল, কলকাতার মাঠটি ওভালের থেকেও ভালো।

পাঠক! মনে রাখবেন, তখনও ভারত টেস্ট খেলেনি, এই ম্যাচের সময় তো বটেই, বইটি প্রকাশের সময়েও বটে। এমনকি এম সি সির ভারত সফর তখনও দুই বছর দূরে।

লর্ড হকের দল, ১৮৯২-৯৩ সালের ভারত সফরে
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২