অ্যাক্ট নম্বর ফোর টুয়েন্টি – তৃণাঞ্জয় ভট্টাচার্য্য

অ্যাক্ট নম্বর ফোর টুয়েন্টি – তৃণাঞ্জয় ভট্টাচার্য্য

শেয়ার করুন

(১)

হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে আচমকাই ঠান্ডা লেগে গেছে সমীরণের। অসময়ে এই বৃষ্টির জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তাই বর্ষাতি নিয়েই বেরোয়নি। আসলে এখন কোনো কিছুতেই খুব বেশি খেয়াল নেই সমীর। কে এল, কে গেল, কোন্‌টা তার, কোন্‌টা নয়, কোনোকিছুই যেন আর স্পর্শ করে না তাকে। চাকরি করে অভ্যাসের মতো। ঠিক যেন একটা যান্ত্রিক রোবট। নিয়ম অনুযায়ী ঘড়ি মিলিয়ে নিজের সব কটা কাজ করে চলেছে। যদিও সবকিছুর সাথে এখন তার আরেকটা নতুন কাজ বেড়েছে, আর তা হল, নিয়মিত থানায় গিয়ে ডিউটি অফিসারকে খোঁচানো। একটা প্রশ্নের উত্তর না পেলে কিছুতেই হাল ছাড়বে না সমী। প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে তুলেছে ডিউটি অফিসারকে। তিনি এখন ওকে থানায় আসতে দেখলেই আতঙ্কে থাকেন, বড়োবাবুর সাথে দেখা করতে বলেন। তাতে অবশ্য সমীর কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু বড়োবাবুই হাজার ব্যস্ততায় সময় দিতে পারেন না। সমী যদিও হাল ছাড়ার পাত্র নয়, অফিসে যাওয়ার আগে একবার, অফিস থেকে ফেরার পথে আরেকবার, থানায় তাকে যেতেই হবে।

একবছর আগেও ছবিটা ঠিক এরকম ছিল না। প্রিন্সেপ ঘাটের ওই বেঞ্চিতে বসে তমসা যখন ওকে প্রথমবার কথাটা বলেছিল, সমীর মনে হয়েছিল, পৃথিবীটা বুঝি হঠাৎ এসে ধরা দিল তার কাছে। জীবনে আর কীই বা চাওয়ার থাকতে পারে? যাকে ও নিজের পৃথিবী মনে করে, সেই সেদিন এসে ধরা দিতে চেয়েছিল তার কাছে। সেই মুহূর্তটাকে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল তার। মনে হয়েছিল নিজের সব মানসিক যন্ত্রণার অবসান ঘটে গেল একটা সন্ধের কয়েকটা মাত্র মুহূর্তে। এত সহজ সবকিছু? আজ তমসা বলছে, সে বোঝে তার সমীকে। তার জীবনের সব থেকে বড়ো চাওয়াটা আজ মেনে নিতে রাজী তমসা। সে এবার পুরোপুরিভাবে চলে আসতে চায় সমীর জীবনে। বিয়ে করতে চায় সমীকে। কিন্তু, ফাল্গুন? তিনি কি মুখ বুজে ছেড়ে দেবেন তমসাকে? সেই সব কিছু ভেবে বলছে তো তমসা? গত কয়েকমাস শুধু এই এক প্রশ্নই সমস্যা সৃষ্টি করেছে তাদের জীবনে। অন্য তো কোনো ফাটল নেই তাদের মজবুত সম্পর্কে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটার থেকে সমীরণ বেশি বিশ্বাস করে তমাকে। তাদের সম্পর্কের তীব্র রসায়নের ওপর ভিত্তি করেই সমী চিন্তা করেছে ভবিষ্যৎ জীবনের কথা। অগোছালো ছেলেটা নিজের আগামীকে গোছানোর চেষ্টা করেছে শুধু একজন মানুষের ওপর বিশ্বাস করেই। অথচ, সেই তীব্র রসায়নের পরিণতিতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না তমসা। কেন? কেন? কেন? এই একটা প্রশ্নই তিক্ত করে তুলছিল ওদের দিনরাতগুলো। যদি ওর আর ফাল্গুনের বিবাহিত জীবন এতোই সুখের হয়, তাহলে সমীরণ কী করে প্রবেশ করল ওদের মধ্যে? সে তো জোর করে আসেনি। তমসা নিজে ডেকে এনেছিল তাকে জীবনে। আর তারপর যদি সেই মানুষটা তমসার দেখানো স্বপ্নে বিশ্বাস করে নিজের ভবিষ্যৎকে কল্পনায় সাজিয়ে তোলে, যদি বাস্তবের চাহিদাগুলোকে আবার নিজের জীবনে পরিপূর্ণতা দিতে চায়, তাহলে কি সে কোনো অন্যায় করছে? যদি আজ সে তমসাকে পুরোনো জরাজীর্ণ বন্ধনটা ছিন্ন করে নতুন জীবন হয়ে হাত বাড়ায়, তা কি সমীর দোষ? তাহলে তাকে সেই স্বপ্ন তমসা দেখিয়েছিল কেন?

এমনই নানা প্রশ্নই ঝড় তুলত তাদের গত কয়েক মাসের প্রতিটা মুহূর্তে। নিজের জগৎটাকে সেই অশান্ত বাতাসে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিল সমী। অফিসের সেরা পারফর্মার আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছিল হতাশার অন্ধকারে। হয়ে উঠছিল পড়ে থাকা আসবাবের মতোই অসাড় প্রাণহীন। কিন্তু সেইসব প্রশ্নের উত্তর একটা সন্ধের কয়েকটা মুহূর্তে তমসা দিয়ে দিল সমীরণকে। পুরো পৃথিবীর মালিক মনে হচ্ছিল নিজেকে সেইসময়। নিজের বিশ্বাসের ওপর আরও বেশি ভরসা তৈরি হল সমীর। পুরো পৃথিবীর কাছে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, তমসাকে ভালোবেসে কোনো ভুল করেনি সে। সেদিন কত পরিণত ছিল তমসার উত্তরগুলো। সমীকে আরও কয়েকমাস সময় দিতে চেয়েছিল তমসা, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। একটা অপ্রতিরোধ্য বিজিগীষা যেন চেপে ধরেছিল সমীকে। এতদিন তমসার প্রত্যাখ্যানে নিজেকে বড়ো হেরো লাগত তার। আজ আবার তারই দেওয়া স্বীকৃতিতে নিজেকে বিজয়ী মনে হচ্ছিল সমীর। একইসঙ্গে সে বুঝতে পারছিল, তার দায়িত্ব অনেকটা বেড়ে গেল। গত কয়েকমাসের ঝড়টা কেটে গিয়ে সেই বসন্ত যেন নতুন দক্ষিণা বাতাস এনে দিল সমীরণের জীবনে। যেই হৃদয় হারানো সমীরণে উড়ে গেল সব আবরণ, দূর হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে থাকা সামান্যতম বাধাটাও। যেন পিউকাহা আর পলাশ কুঁড়ির মতো মিলে গেল দুটো শরীর। গঙ্গার জলে তখন অশান্ত হিন্দোল। হিন্দোলে দুলে উঠেছিল পাপড়িতে ঢাকা একটা রঙিন আশা ও স্বপ্নের চাদরে ঢাকা শয্যাও। নিজেকে উন্মুক্ত করার আগে তমা ভীষণ আদুরে গলায় বলেছিল,

“আমরা এক হব সমী, আমরা এক হব।”

চোখদুটো আনন্দের জলে ভরে উঠেছিল সমীরণের।

“তোর জন্য পাততে পারি হাত,

হঠাৎ যদি মৃত্যু এসে দাঁড়ায় অকস্মাৎ,

রাখি চোখ ওই চোখে,

জীবনরাত্রি জড়িয়ে ধরেছি তোকে,

নিমন্ত্রণে ডাকছি আজকে আগামী বসন্তকে,

ফুলশয্যার রাত,

তোর জন্য ভিখারীর মতো পাততে পারি হাত।”

সমীকে জাপটে জড়িয়ে ধরেছিল তমা।

(২)

ট্রেনের জানলার পাশে বসে চোখের সামনে ঘরবাড়ি, ধানের ক্ষেত, দূরের গাছের সারি সরে যেতে দেখছে সমীরণ। এনজিওর  প্রয়োজনে তাকে মাসে একবার অন্তত পুরুলিয়ায় যেতে হয়। কখনও কখনও খুব প্রয়োজন না থাকলেও নিজেকে খুঁজে পেতেই যেন মুরগুমায় চলে আসে ও। ঠিক যেমন এইবার এসেছে। নিজেকে বারবার করে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে সমী। সত্যিই আঘাতটা পাওয়ার পর নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলছে থেকে থেকে। যাকে এতটা বিশ্বাস করে এগিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল, “এসো বধূ ঘরে এসো”, সেই আজ বধূসজ্জা খসিয়ে ফেলল। সরাসরি বলে দিল, “এই ঘরে জায়গা হবে না বন্ধু, সারাজীবন ধরে আমাদের সপ্তপদী গমন হবে।” কিন্তু সেই গমন তো সমী চায়নি, সে তো ঘরের স্বপ্ন দেখেছিল। জীবনের রাত ও গোধূলির এক সন্ধিক্ষণে এসে এক অবাধ্য প্রাণোন্মাদনাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল। সেই প্রাণের মানুষটাই আজ তাকে পথের দিকে ঠেলে দেবে ভাবতে পারেনি সমী। হোয়াটস্যাপের মেসেজটা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে জোড়া টিক হয়ে গেছে, তবু এখনও টিকগুলো নীল হয়নি। তারমানে মাত্র নয়দিনের মধ্যে তমা এতটা দূর করে দিল সমীকে? অথচ, মাত্র একমাস আগে ওরা যেদিন একসাথে শেষবার ক্যাবে করে ফিরছিল, তমা বলেছিল,

—মুখটা অমন গোমড়া করে রয়েছ যে?

—সবসময় এক অদ্ভুত হেরে যাওয়া ভিতরে কাজ করে, তমা।

—আমি জানি সমী। আমি বুঝি, আমাকে একলাটি ফেলে চলে যেতে কেমন করে তোমার বুকটা পুড়ে যায়।

—আমরা কি ঠিক করছি তমা? ফাল্গুনবাবুর তো কোনো দোষ নেই।

ওর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তমসা বলে উঠল,

—ও কথা বোলো না। ও এখন আমার গায়ে সামান্য স্পর্শ করলেও আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের স্পর্শ আমার অসহ্য লাগে।

—তাহলে ওকে সব কথা জানিয়ে দিচ্ছ না কেন?

—ঠিক সময়ে জানাব।

—তাড়াতাড়ি করো তমা। আমি কীভাবে নিজেকে বদলে ফেলেছি দেখেছ? নিজের সাথে লড়াই করে করে, আজ আমার প্রায় কোনো ত্রুটির দিকে আঙুল তুলতে পারবে না তুমি।

—আমিও সেটাই ভাবি সমী। তুমি যেন ম্যাজিকের মতো বদলে ফেললে সব।

তমার কথার উত্তরে সমী বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর বলল,

—আমাকে যে আমার তমার দায়িত্ব নিতে হবে। কোনো ক্যাজুয়াল আচরণ কি আর আমায় মানায়?

কথাটা শোনার পর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সমীরণকে জড়িয়ে ধরেছিল তমসা। সমীও একইভাবে জড়িয়ে ধরেছিল নিজের প্রাণভোমরা তমাকে। সমীর ঘাড়ে ওর নরম নিঃশ্বাস পড়ছিল। গোলপার্কের মৌচাক দোকানটার সামনে তমসা নেমে গেল। গাড়িটা ঘুরে সাদার্ন এভিনিউ দিয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তমসা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সমীরণের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যার বয়স তখন ক্রমশ রাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। অভিসারের এই পথটুকু কৃষ্ণচূড়া আর পলাশের পাতারা লজ্জার ঘোমটায় মুড়িয়ে রেখেছে। সমীর ক্যাব ছুটে চলেছে সাদার্ন এভিনিউ দিয়ে লেকের নতুন ব্রিজের দিকে। সরোবর থেকে উড়ে আসা জলসা হাওয়া সমীর বড়ো বড়ো চুলদাড়িগুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছিল। মুখের বিভিন্ন জায়গায় তমসার স্পর্শ করা স্মৃতিগুলোর ওপরে আলতো আঙুল বোলাচ্ছিল সমী। আর মাত্র কয়েকটা মাস। নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে নিয়েছে সমী। সামনে অনেক বড়ো দায়িত্ব আসতে চলেছে ওর ওপর। ও ভাবতেই পারেনি, তমসার সাথে এটাই শেষবার দেখা হচ্ছে ওর।

টেবিলের ওপর ফোনটা বাজছে। স্ক্রিনে বড়ো বড়ো করে নাম দেখাচ্ছে “সমীরণ”। ঘন ঘন এত বেশি ফোনে কথা বলা নিয়ে ফাল্গুন এর আগেও আপত্তি করেছে। তমসা তখন বিষয়টাকে হালকাভাবে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন সমীরণ একটা জোর পেয়েছে। তমসার সাথে কথা বলাটা এখন তার আবদার নয়, দাবি। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে যে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে, তার তো আজকে নিজের প্রাণের মানুষের সাথে কথা বলতে কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়।

কিছু না ভেবেই কথাগুলো সমীরণকে বলে দিয়েছিল তমসা। সত্যিটা সে নিজে সেই মুহূর্তেও জানত। সে কখনও ভাবেনি, সমীরণ এই নতুন জীবনের স্বপ্নে নিজেকে সত্যিই এতটা বদলে ফেলবে। ফাল্গুনকে কোনোদিনও কোনো অবস্থায় ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। মানুষটার চরিত্রে কোনো দোষই নেই। অদ্ভুত যত্নে রাখেন তমসাকে। কিন্তু লোকটি বড়ো যান্ত্রিক। আবেগের কোনো চিহ্ন কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে না। তমসার মতো আবেগপ্রবণ মেয়ের কাছে সেটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর। কলেজ লাইফে দুজন দুজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু গত সাত বছরে শুধু পেশাগত সাফল্যের পিছনে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে ফাল্গুন নিজের সবটুকু আবেগ যেন বিসর্জন দিয়ে দিয়েছিল। বাড়িটা একটা লোহার গরাদওয়ালা খাঁচা হয়ে উঠেছিল তমসার কাছে। তাই সে একটু খোলা আকাশ চাইছিল।

“চাইছি আকাশ খোলা,

সেইপথে তুমি কে এলে গো,

দিনান্তে পথভোলা?

আশ্রয় চাও তুমি,

আমার চরণ চুমি;

হৃদয় বদ্ধভূমি,

মুহূর্তে চঞ্চলা।

তাতে নেই তো কারোর ক্ষতি;

কেন চাও পরিণতি?

এ যুগের পথভোলা।”

সব ঠিক ছিল, কিন্তু বড়ো ভুল মানুষকে নির্বাচন করেছে তমসা। যে পরিণতির স্বপ্নেই বিভোর। প্রতিটা মুহূর্ত রঙিন আঁচড়ে সাজিয়ে তোলে একটা গোছানো বাসা বাঁধার স্বপ্নে। না, সেইপথে যাবে না তমসা। ফাল্গুনকে ছাড়া সম্ভব নয় কোনোভাবেই। সমীরণকে কথা দেওয়াটা মুহূর্তের অসাবধানতা ছিল। যে মানুষটা এখনও নিজের পেশাদার জীবনে সংগ্রাম করে চলেছে, সে কি সুরক্ষা দিতে পারে তমসাকে? সে নিজে একটা আবেগসর্বস্ব মূর্খ হতে পারে, কিন্তু তমসা তো তা নয়। তমসা ভাবতে থাকে কী করে, কী করে সমীরণকে বলা যায় কথাটা। রাতের পর রাত তার ঘুম আসে না। ব্যাপারটা ফাল্গুনেরও নজরে পড়ে। সে জানতে চায় কে ফোন করে তাকে দিবারাত্র সবসময়। একেবারে মিথ্যা বলে তমসা। বলে, একজন তাকে ভীষণ ফোন করে উত্যক্ত করছে। কিন্তু কথাটা বলার পরে নিজেই ভীষণ অনুশোচনায় ভুগতে থাকে ও। কারণ সত্যিই সমীরণ কোনোদিনও তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে ফোন করে বিরক্ত করেনি। ফাল্গুন জানতে চায়, লোকটার নাম। তমসা বলেও দেয়। তারপর থেকে নিজের জীবনের আর একটা মুহূর্তও তমসা সমীরণের সাথে জড়াতে রাজী ছিল না। কিন্তু কীভাবে বলবে সমীরণকে? যে মানুষটা শুধু আশা আর স্বপ্ন দিয়ে নিজের আগামীর লক্ষ্য স্থির করছে, তাকে কীই-বা বলা যায়?

এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল তমা। ফোন করল সমীকে। চোখ বন্ধ করে কোনো ভনিতা না করে সরাসরি বলল,

—আমি ভেবে দেখলাম, আমার পক্ষে ফাল্গুনকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

সেই মুহূর্তে মাথায় বাজ পড়লে বোধহয় কম আশ্চর্য হত সমী। খুব অস্ফুটে বলল,

—আর আমরা?

তীব্র কষ্টে গলা কেঁপে গেল তার। কেউ শুনলে বিশ্বাস করবে না, তমসার চোখেও জল এসেছিল সেই মুহূর্তে। তবু পাথরের মতো শক্ত হয়ে বলল,

—ধরে নাও, কোনোদিনও ছিলামই না। তুমি বড়ো বেশি দাবী করে ফেলেছিলে সমী।

আরো অনেক কথা পরপর বলে ফোনটা কেটেছিল তমসা। সমী আর একটা শব্দও শোনেনি। সব মিথ্যে? সবটা অভিনয়? এত নাটক নভেলে পড়া যায় বা সিনেমার পর্দায় দেখা যায়। বাস্তবে মানুষ এতটা মিথ্যে বলতে, এতটা অভিনয় করতে পারে? এ তো একপ্রকার ঠকানো। একপ্রকার কেন, সম্পূর্ণভাবেই বিশ্বাসঘাতকতা। ইন্ডিয়ান পিনাল কোর্টের মতে এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পিনাল কোর্টের সেকশন নব্বই এবং সেকশন তিনশো পঁচাত্তর অর্থাৎ বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস। আচ্ছা এই আইনগুলো কি শুধুমাত্র মেয়েদের রক্ষাকবচ?

পুরুলিয়া আসতে এখনও ঘণ্টা দেড়েক বাকি। বাইরের প্রকৃতির রং ধূসর হয়ে উঠছে।

(৩)

লেক থানার প্রশান্তবাবুর সঙ্গে সমীর যথেষ্ট ভালো পরিচয় হয়ে গেছে। ওর জীবনে ঘটে যাওয়া এই হৃদয়হীনতার দিনলিপির প্রতিটা পৃষ্ঠার সঙ্গে প্রশান্তবাবু পরিচিত। সমী সব বলেছে তাঁকে। যেমনটা কখনও কোনো ডায়েরিতেও লেখেনি। উত্তরে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন মধ্যবয়সি পুলিশ অফিসার। সমী শুধু জানতে চেয়েছে একজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে যদি এমন ভয়ংকর প্রতারণা করা হয় এবং সেটা করেন একজন মহিলা, তাহলে শুধু নীরব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলা ছাড়া আইনের আর কিছুই করার নেই, তাই না? এই একই কাজ যদি সমী করত তমসার সাথে, তাহলে আইন ছেড়ে দিত তো তাকে? সেকশন নব্বই ও সেকশন তিনশ পঁচাত্তর এমন চুপ করে বসে থাকত তো? এর উত্তরও দিতে পারেননি প্রশান্তবাবু। মুচকি হেসে থানা থেকে বেরিয়ে এসেছে সমী।

পুরুলিয়া যাওয়াটা হঠাৎই বেড়ে গেছে ওর। সকলেই ভাবছে, সত্যিই কি এনজিওর এত কাজ থাকে পুরুলিয়ায়? অফিসে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। চরম শারীরিক অসুস্থতাতেও যার অফিসের কাজে ছেদ পড়ত না কখনও, আজ সে যেন ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠছে সকলের কাছে। সব থেকে কাছের মানুষেরাও আজ সমীকে চিনতে পারছে না। এই কি সেই সমীরণ, মাত্র চারমাস আগে যে তারকা এমপ্লয়ীর সম্মান পেয়েছে এই সংস্থা থেকেই। অ্যালকোহল যে কখনও খেত না, তা নয়। কিন্তু আজ সমী যেন অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে উঠেছে, যেমনটা কখনও ছিল না। শরীরও তার প্রতিশোধ নিতে ছাড়ছে না। লিভারের সমস্যায় তার এখন জল খেলেও বমি পায়। কয়েকদিন আগেই নিজের পাড়ায় মোটরবাইক নিয়ে উলটে পড়ে গেল। যা সমীর সঙ্গে পরিচিত কোনো মানুষ বিশ্বাসই করবে না। ওর মোটরবাইক চালানো নিয়ে ঠাট্টা করে বলা হয়, ও ঘুমিয়ে পড়লেও মোটরবাইকে নিয়ন্ত্রণ হারায় না। পুরোনো পরিচিত উজ্জ্বল সমী যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল পৃথিবীর পৃষ্ঠা থেকে। কর্মক্ষেত্রে বা সামাজিক পরিসরে ওর থেকে অনেক কম যোগ্যরা পায়ে পিষে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তাদের দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সমী। সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন যাওয়া বন্ধই করে দিয়েছে। নিজের প্রতি হীনমন্যতা থেকেই ওর মনে হয়, সবাই যেন ওকে বড়ো করুণার দৃষ্টিতে দেখে। অথচ, এই সমী জ্বলজ্বল করত মাত্র কয়েক মাস আগে।

অফিস থেকে সেদিন একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে এসেছিল সমী। শরীরটা ভালো লাগছিল না একদম। হঠাৎ ফোনের রিংটা বেজে উঠল। ফোনটা বের করে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল সমী। তমসার ফোন। যাক তাহলে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তমা। এ তো হওয়ারই ছিল, কতদিন তার তমা তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে? কিন্তু ফোনটা ধরতেই তমসা বলে উঠল,

—একটা কথা জানাতেই তোমাকে ফোন করেছি।

—বলো… 

—আমি কনসিভ করেছি। আমি আর ফাল্গুন দুজনেই খুব সুখী সমী। প্লিজ আমাদের আর বিরক্ত কোরোনা।

—বিরক্ত!!

বড়ো অবাক হয়ে গেল সমী, “আমি তো তোমাকে কখনও ফোন করি না। বেশ, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। কখনোই বিরক্ত করব না তোমায়। সরি, তোমাদের। তোমাকে অনেক অনেক অভিনন্দন।”

ফোনটা কেটে থানার দিকে এগিয়ে গেল সমী। না না, কারোর বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখাতে নয়। নিজের প্রাণের বিরুদ্ধে কোথায় রিপোর্ট লেখানো যায়? ওর নাম সমী পৃথিবীর সামনে আনতে চায় না। আসলে, প্রশান্তবাবুর সাথে কথা বলতে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো মিশুকে ভদ্রলোক। তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার ডালি থেকে বিভিন্ন ঘটনা তুলে এনে সমীর সামনে পরিবেশন করেন প্রশান্ত। কিছুটা অতিরঞ্জিত, আবার কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে দারুণ গল্প বলেন উনি। সমী অবশ্য বাড়িয়ে বলাগুলো সবই বুঝতে পারে। কিছু বলে না, শুধু মুচকি হাসে। আজ একজন সাইক্রিয়াটিক ডাক্তারের ঠিকানা দেবেন বলেছেন প্রশান্তবাবু। সমী সত্যিই অ্যালকোহলের নেশাটা ছাড়তে চায়। কিন্তু, থানায় যেতেই, যা শুনল চমকে উঠল সমী। ওর নামে রিপোর্ট লেখানো হয়েছে লেক থানায়। লিখিয়েছেন ফাল্গুন চ্যাটার্জি। প্রশান্তবাবু বললেন,

—অবশ্য ননবেলেবল নয়। তুমি এখানে একটা সই করে দাও। দুশ চুরানব্বই, তিনশ চুয়ান্ন, এ, বি, সি, ডি, পাঁচশ নয় কিছু বাকি রাখেনি।

চমকে উঠল সমী,

—পাঁচশ নয়!! ইভটিসিং!!

নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

তমসার ওপর রাগে জ্বলে উঠেছে প্রশান্তবাবুর শান্ত চোখদুটো।

—আমার কথা শোনো সমীরণ, তোমার কাছে যে প্রমাণগুলো আছে, সেগুলো দিয়ে তুমিও একটা কেস ঠুকে দাও।

সমী আবার মুচকি হাসল।

—না স্যার, আমার কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

চান্দ্রেয়ী চন্দননগরে থাকে। অনেকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে সমীরণ মজুমদারকে। ভীষণ ভালো লাগে, একথা হয়তো বলতে পারে না, কিন্তু চান্দ্রেয়ীর খালি মনে হয়, লোকটার পুরোটা যেন দেখা যাচ্ছে না। লোকটা যেন মেঘে ঢেকে আছে পুরো। অনন্ত সম্ভাবনা মানুষটার মধ্যে, শুধু মেঘটা সরিয়ে দিতে হবে। সেই কাজ কি করবে চান্দ্রেয়ী?

থানা থেকে সেদিন সাইক্রিয়াটিস্টের কার্ডটা নিতে ভুলে গেছিল সমী। অভিভাবকের মতো এগিয়ে এসে কার্ডটা পকেটে ভরে দিয়েছিলেন প্রশান্তবাবু।

—তুমি কিন্তু সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবে সমীরণ। বাঁচতে হবে ভাই, বাঁচতে হবে। কারোর জন্য নিজের জীবনটা শেষ কোরো না।

সমী কোনো উত্তর দেয়নি, বেরিয়ে এসেছিল থানা থেকে। বাড়ি ফিরে অ্যালকোহলের মাত্রা যেন তিনগুন বেড়ে গেল। বারবার মনে হচ্ছিল তমসাকে ফোন করে একবার জিজ্ঞাসা করে, কেন করল ওর সাথে এরকম? কিন্তু না, ও তো বিরক্ত করতে বারণ করেছে। আর ফোন করলে কী উত্তর পাবে, সমী ভালোই জানে। প্রশান্ত আজও একবার ফোন করেছিলেন, সমী সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়েছে কি না। ভীষণ জড়ানো গলায় শুধু ‘না’ টুকুই বলতে পেরেছিল সমী। আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর থেকে। প্রচণ্ড মদ্যপ অবস্থায় সমী টলতে টলতে হাঁটা দিল ছাদের দিকে।

একদিন সমীর সঙ্গে মেসেজে কথা বলেই চান্দ্রেয়ী বুঝতে পেরেছিল, এ ছেলে দুই একদিনের মধ্যে ভয়ংকর কিছু করতে চলেছে। তাই কায়দা করে বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে নিয়েছিল। ঠিকানা হাতড়ে হাতড়ে জীবন খুঁজে বার করা চান্দ্রেয়ীর বহুদিনের শখ। জীবনের যেন এক অফুরান থলে আছে ওর কাছে। চান্দ্রেয়ী সত্যিই খুঁজতে খুঁজতে চলে এল সোনারপুরে। বারো বাই তিন মন্দির রোড খুঁজে নিতে কোনো অসুবিধাই হল না। সমীর বাড়ির সদর দরজা খোলা। কী অদ্ভুত বাড়ি এদের। কোনো ঘরেই কোনো দরজা বন্ধ নেই। আসলে বাড়িতে প্রাণী বলতে সমীর মা আর সমী। বৃদ্ধা এখন বসে বসে তরকারি কাটছেন। তাকে নিজের উপস্থিতি টের মাত্র পেতে না দিয়ে চান্দ্রেয়ী এগিয়ে গেল পাশের ঘরটার দিকে। কারোকে বলে দিতে হবে না, এটা একটা বাউন্ডুলে ভবঘুরের ঘর। হতাশায় মাথাটা একবার নাড়াতে গিয়ে বিছানার দিকে চোখ গেল চান্দ্রেয়ীর। অগোছালো বিছানায় একটা পরিষ্কার কাগজে কিছু লেখা।

“মা গো,

আমি চললাম। আর পারছি না। তোমাকে জীবনে আর একবার এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হল। আমাকে ক্ষমা কোরো। ছাদ থেকে পড়ার পর, যখন আমি আর থাকব না, সঞ্জুকে বলবে, ক্যানাল রোডের পাশে ডাক্তার সোম আছেন। তাঁকে ধরে আনতে, তিনি সার্টিফিকেট লিখে দেবেন। দোহাই মা, আমাকে কাটাছেঁড়া কোরো না।

                              ‌‌ ‌‌                          – তোমার সোনা”

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চান্দ্রেয়ী ছুট দিল ছাদে। ট্যাঙ্কি বেয়ে টলতে টলতে নেমে সমীর একটা পা তখন কার্নিশের বাইরে।

—দাঁড়ান!!!!

পাটা থেমে গেল সমীর। ছাদ থেকে হাত বাড়িয়ে দিল চান্দ্রেয়ী।

—উঠে আসুন। উঠে আসুন বলছি।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো কার্নিশ থেকে উঠে এল সমী।

—কী করতে যাচ্ছিলেন? সুইসাইড!! আপনার মুখাগ্নি কে করতেন? আপনার মা? ওয়াও!! এই না হলে প্রেম!!

চান্দ্রেয়ীর তীব্র কথার ঝাঁঝের কাছে মাথা নীচু করা ছাড়া কিছু করার ছিল না সমীর।

—এরকম বিরহী দেবদাস না কাতারে কাতারে এই শহরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু, সমীরণ মজুমদার একটাও ঘুরে বেড়ায় না।

হাতটা এগিয়ে দিয়ে চান্দ্রেয়ী বলল,

—বাড়ান!! হাতটা বাড়ান বলছি!!

এই প্রথমবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সমী।

অফিসে যাওয়ার পথে একবার লেক থানাতে প্রশান্তবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেল সমী। মানুষটা বড়ো ভালো। কিন্তু হঠাৎ দেখে সমীকে চিনতে পারেননি তিনি। চুল মাপ করে ছাঁটা, দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার কামানো। ফর্মাল শার্ট, প্যান্ট, জুতো, চোখে রিমলেস চশমা। হকচকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর সমীরণকে চিনতে পারলেন প্রশান্তবাবু। পকেট থেকে সাইক্রিয়াটিস্টের কার্ড বের করে সমী বলল,

—কার্ডটা ফেরত দিতে এলাম স্যার।

অবাক হয়ে প্রশান্তবাবু জিজ্ঞাসা করলেন,

—তুমি সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবে না?

আবার মুচকি হেসে সমী বলল, “আমি অ্যালকোহল ছেড়ে দিয়েছি স্যার”।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২