কুমায়ুন ভ্রমণ ও তার নানা কিস্সা – শিবু মণ্ডল (পর্ব ২)
দ্বিতীয় পর্ব
ঝুলাদেবী মন্দির ও তাঁর প্রকট কাহিনি
পরদিন একটু বেলা করেই সবার ওঠা হল। সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিইং-এ। প্রথমেই গেলাম ঝুলাদেবী মন্দিরে। এখানে দেবী দুর্গা ঝুলাদেবী নামে পূজিত হন। রানিখেতের বিশেষত্ব হল এখানকার সমৃদ্ধ পাইনের বন ও মাঝে মাঝে সুদৃশ্য উপত্যকা। এই মন্দির চত্বরটিও পাইনের বনের মাঝে ছোট্ট একটি উপত্যকায় অবস্থিত। ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতে হবার ফলে মন্দিরের দেখভাল সেনাবাহিনীর হাতেই ন্যস্ত। মন্দিরটির বিশেষত্ব হল মন্দির চত্বরে চারিদিকে ঝুলন্ত ঘণ্টার সমাহার। সাধারণত মন্দিরের প্রবেশ দ্বারেই থাকে ঘণ্টা। কিন্তু এখানে মন্দিরকে ঘিরে ঝুলে আছে আঙুরের থোকার মতো ছোটবড় হাজার হাজার ঘণ্টা। স্থানীয় মতে মন্দিরটি ভীষণই জাগ্রত। কেউ কোনও মনস্কামনা নিয়ে এসে দেবীর কাছে প্রার্থনা করলে অবশ্যই ফলে। এখানকার প্রার্থনার রীতি অনুযায়ী দেবীকে নৈবেদ্যস্বরূপ যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী স্থানীয়রা একটি করে ঘণ্টা বেঁধে দেয়। আবার মনস্কামনা পূর্ণ হবার পরও দেবীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনস্বরূপ আরও একটি ঘণ্টা বেঁধে দেয় মন্দির চত্বরে।
মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত শ্রী ভুবন চন্দ্র পন্থের সাথে গল্প করে প্রায় সাতশো বছর প্রাচীন এই মন্দিরের নানা বৃত্তান্ত জানা গেল। মন্দিরকে ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। সেইসময় এই অঞ্চল গহীন অরণ্যের কবলে। বর্তমান মন্দির চত্বর থেকে দেড় কিমি দূরে একটিমাত্র গ্রাম ছিল যার নাম পিলখোলি। গ্রামবাসীদের একমাত্র জীবিকা তখন পশুচারণ। সেই গবাদি পশুদের চারণের উদ্দেশ্যে তারা বর্তমান মন্দির চত্বরের জঙ্গলঘেরা মাঠে নিয়ে আসতো। সেসময় মানুষের সংখ্যা কম ছিল কিন্তু বন্য পশুদের কোনও কমতি ছিলনা। চিতা, গুলদার, বাঘেদের অত্যাচারে পিলখোলি গ্রামবাসীদের ত্রাহি ত্রাহি রব। প্রতিদিন কারো না কারো গরুটি, ভেড়াটি উধাও। এভাবে চললে তো তাদের টিকে থাকাই দায়। ভীত সন্ত্রস্ত গ্রামবাসী দেবী মায়ের আরাধনা শুরু করলেন। সেইসময় দেবী দুর্গা এক গ্রামবাসীর স্বপ্নে দেখা দিয়ে কিছু নির্দেশ দিলেন। সেই স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী গ্রামবাসীরা বর্তমান মন্দির চত্বরে মায়ের একটি মূর্তি খুঁজে পান এবং সেখানেই তাকে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে থাকেন। দেবীর আশীর্বাদে বন্যজন্তুদের হাত থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পেলেন তারা। ধীরে ধীরে বসতি বাড়তে থাকল। দেবীর গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। নবরাত্রি সহ বিভিন্ন পরবে মহাসমারোহে দেবীর আরাধনা হয়। আরেকটি প্রচলিত মিথ হল- একবার এমনই উৎসবের মুহূর্তে গাছের ডাল থেকে ঝোলানো দোলনায় শিশুদের দোল খেতে দেখে দেবীমাতারও ইচ্ছে হয় দোলনায় চড়ে দোল খেতে। সেইমতো গ্রামবাসীদের স্বপ্নাদেশ দেন। সেই থেকে দেবীমূর্তি মাটিতে না রেখে একটি কাঠের দোলনায় প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামবাসীরা। সেই থেকে দুর্গাদেবী ঝুলাদেবী নামে প্রচলিত হন। বর্তমান মন্দিরের পাকা কাঠামোটি ১৯৩৫ সালে কুমায়ুন রেজিমেন্টের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়। গর্ভগৃহে একটি ধাতব দোলনায় বিরাজমান রানিখেতের রক্ষাকর্ত্রী শ্রী শ্রী মাতা ঝুলাদেবী। ঝুলাদেবীর আশীর্বাদ নিয়ে আমরা চললাম চৌবাটিয়া বাগান।
চৌবাটিয়া বাগান ও আপেল কিস্সা
চৌ মানে চার আর বাটিয়া মানে পথ অর্থাৎ চৌপথের মিলনস্থল। ভারগাঁও, রানিখেত, ধেরতি আর পিলখোলি চারটি স্থান থেকে চারটি রাস্তা এসে মিলিত হয়েছে এখানে। প্রায় ৬০০ একর জমি নিয়ে বিস্তৃত চৌবাটিয়া বাগান ফুল ও ফলমূলের এক স্বর্গ! সরকারী উদ্যোগে এখানে পাহাড়ি ফল সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে।
বাগানের গেটে পৌঁছতেই এক স্থানীয় গাইড এসে দাঁড়াল। ৩০০ টাকার বিনিময়ে পুরো বাগানটি ঘুরে দেখানোর প্রস্তাব দিল। যদিও গাইড ছাড়াই ঘোরা যেত তবুও লোকটিকে সাথে নিয়ে নিলাম। অনেক ছোট ছোট অজানা তথ্য জানা গেল তার থেকে। গুল্ম থেকে গগনচুম্বী বৃক্ষ সবার নাম ধরে ধরে তাদের গুণাগুণ সে বর্ণনা দিতে লাগল। পাইন, দেবদারু, রডোডেনড্রন, ওক গাছের ছায়াতলে এক বনজ সাম্রাজ্য হিমালয় ছেয়ে আছে। বৈদিক যুগ থেকেই আমাদের পূর্বজ মুনি ঋষিগণ সেই সব গাছ-গাছড়ার ঔষুধী গুণাগুণ আবিষ্কার করে গেছেন। আমাদের গাইডও ধরে ধরে চেনাচ্ছেন সেইসব বনজ সম্পদগুলি। ছোট ছোট কাটা সমৃদ্ধ একটি লতাগুল্ম ছিঁড়ে এনে দেখাল, বিচ্ছু গাছ বলে স্থানীয় ভাষায়। আর্থ্রাইটিসের এক অমোঘ বাণ। শরীরের যেখানে ব্যথা বেদনা একবার হালকা করে সেই বিচ্ছু গাছের লতাপাতা দিয়ে ঝেড়ে দিলেই কিছুক্ষণের জ্বালা, তারপর ম্যাজিকের মতন ব্যথা উধাও। এমনই কত সম্পদ। কত রংবেরঙের ফুল চলতে চলতে দেখছি, ছবি তুলে রাখছি। কিছু ছোট ছোট তৃণ সাপের মত ফণা তুলে আছে। না এর কোনো ওষুধি গুণ নেই, তবু পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার বিশেষ ভঙ্গি দিয়ে। ধীরে ধীরে আমরা চলে এলাম এখানকার বিখ্যাত আপেল বাগানে। গাছগুলি জাল দিয়ে ঢাকা। জালের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ছোটছোট গোলাপি আপেলের থোকা। আর মাস খানেকের মধ্যে এরা পরিপূর্ণ হবে। মানুষের রসনা তৃপ্তির উপযোগী হবে। তার আগে কোনো বানরসেনা যাতে তাতে কামড় না বসিয়ে দেয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা। ‘এশিয়ার বৃহত্তম ও ভারতবর্ষের প্রথম আপেল বাগান এটি। একসময় তার বিভিন্ন জাতের উৎকৃষ্ট আপেলের জন্য জগৎবিখ্যাত ছিলো। প্রায় ৩৬ প্রকার প্রজাতির আপেলের ফলন হতো এই বাগানে। কিং ডেভিড, উইন্টার বানানা, গোল্ডেন ডেলিসেস, বাকিংহাম রেড গোল্ড, গোল্ডেন বেলী এগুলো সব আপেলের একেকটি প্রজাতির নাম। তবে এদেরকে ছাপিয়ে রাজত্ব করতো লাল টুকটুকে ‘প্রিন্স অফ চৌবাটিয়া’ ; এই প্রজাতির একেকটি আপেলের ওজন হত প্রায় ২৫০ গ্রাম, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। ১৮৬৯ সালে এখানে ব্রিটিশ সেনা ছাউনি গড়ে উঠবার পর চৌবাটিয়ার প্রাকৃতিক গঠন ও জলবায়ু ইংরেজদের প্রলুব্ধ করে। সেনা অফিসারদের সাথে সাথে ধীরে ধীরে ভিড় জমাতে শুরু করে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা। তাদের হাত ধরেই এখানে শুরু হয় এই সব আপেল চাষ’- আপেলের এইসব কিস্সা শোনাতে শোনাতে গাইড ধীরাজ বিস্টের চোখদুটিও আপেলের মতো চকচক করে ওঠে। আবেগতাড়িত ধীরাজ এও বললেন যে- ‘ অতীতের এই গৌরব ধরে রাখতে পারেনি চৌবাটিয়া বাগান। একে তো পুরানো গাছের ফলন ক্ষমতা ও তার উৎকৃষ্টতা কমে গেছে, নতুন করে চারা লাগানোর উদ্যোগ তেমন নেওয়া হয়নি, যেটুকু নেওয়া হয়েছে সেখানে আগের সব প্রজাতি সরিয়ে নতুন আমেরিকান আপেলের প্রজাতির ফলন শুরু হয়েছিল, কিন্তু তার ফলন আশাব্যঞ্জক হয়নি। এইসব কারণে ও সরকারি অবহেলায় বর্তমানে আমাদের বাগানের ফলন ৫০০ কুইন্টাল থেকে ২০-৩০ কুইন্টালে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা স্থানীয় লোকজনেরা বাগানের উন্নতি সাধনের জন্য মাঝে মাঝে সরকারের কাছে দরবার করি, আন্দোলন করি। কিন্তু তাতেও কোনও কাজের কাজ হচ্ছে না। মাঝে মাঝে বাগানে ফলনের সময় ঠিকা কাজ পাই। বাগানের ফলন যদি আগের অবস্থায় ফিরে আসে তবে আমাদের নিয়মিত কাজ পেতে কোনও অসুবিধা হবে না আর। তাইতো বাধ্য হয়ে সংসার চালাতে এই গাইডের কাজও করতে হয়।’ ধীরাজের কাছে এসব শুনে ও দেখে আমাদের উত্তরবঙ্গের চা বাগানের কথা মনে পড়ে- সেখানেও তো সেই একই সমস্যা! ধীরাজের কাছ থেকেই জানলাম ছোট্ট একটি চা বাগানও আছে এখানে। তবে ওদিকটায় আর যাওয়া হয়নি আমাদের। যাই হোক জুলাই মাসের এই ভ্যাঁপসা গরমেও চলতে ফিরতে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। যখনই অতিরিক্ত ঘাম ঝরছে তখনই গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছি। গাছের ডাল পালার আড়াল থেকে নানা পাখির কুজন, আপেল গাছে আপেল, এপ্রিকোট গাছে এপ্রিকোট, পিচ গাছে পিচ ফল আর চলার পথের পাশে সদর্পে জ্বলে থাকা টর্চ লিলির আগুন রং- এসব দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও এক বাঞ্ছারামের বাগানে হাঁটছি! সময় বদলেছে, বদলেছে মালিকানা। এক জমিদার গেছে, এসেছে নতুন নতুন জমিদার! তবে বাগান আর আগের মতো স্বাস্থ্যবান নেই, ক্রমশ রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হয়েছে। বাগানের স্বাস্থ্যের সাথে সাথে বাঞ্ছারামদের সংসারও রুগ্ন হয়েছে ক্রমশ। হ্যাঁ এখানে একজন বাঞ্ছারাম নয়, ধীরাজের মতো শত শত পরিবার ও তাদের পূর্বপুরুষেরা এই বাগানের সাথে জুড়ে আছে এই বাগানের জন্মলগ্ন থেকেই। এইসব শতশত চাষি ও মালির হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও ভালোবাসার স্পর্শেই গড়ে উঠেছে এই বাগানসাম্রাজ্য- এরাই তো প্রকৃত মালিক এই বাগানের। এইসব বাঞ্ছারামেদের মতো করে এই বাগানের বৃক্ষ-ফল-ফুল-মাটি-বায়ুকে বুঝতে, চিনতে আর কেউ পারবে না সে জমিদারই হোক অথবা আমাদের মতো সৌন্দর্য বিলাসী পর্যটক! বরঞ্চ জমিদারের অবহেলায় জীর্ণ,দীর্ণ হয়েছে বাগান ও বাঞ্ছারামদের দশা। সময় সময় চেষ্টা হয়েছে বাগানের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের কিন্তু জমিদারের ম্যানেজার ও সেরেস্তাদারদের দুর্নীতি এই চেষ্টার মাঝে অন্তরায় হয়ে উঠেছে- এমনটাই অভিযোগ বাঞ্ছারামদের! তবে আশার আলো এটুকুই- আমাদের এই ভ্রমণের প্রায় মাসখানেক আগে একটি খবরে প্রকাশ( ১৪-ই জুন ২০২২, জাগরণ হিন্দি দৈনিক পত্রিকা) উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকার ‘ উত্তরাখণ্ড ইন্টিগ্রেটেড হর্টিকালচার ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট’ নামের একটি প্রকল্পের জন্য ৫২৬ কোটি টাকার বাজেট পাশ করেছে। এই প্রকল্পে হর্টি-ট্যুরিজম বৃদ্ধির পাশাপাশি চৌবাটিয়া বাগানের পুরানো উন্নত প্রজাতির আপেল গাছের সংরক্ষণ, তাদের পুনরুজ্জীবন ও গুণগত মান পুনরুদ্ধারের নানা উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানতে পারলাম। তবে তাতে বাঞ্ছারামদের কতটা কী হবে জানা নেই! তাতে আমাদের কী? আমরা ঘুরতে এসেছি, ঘুরে ঘুরে বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করি, একের পর এক ঢেউ খেলানো পাহাড় দেখে মুগ্ধ হই! মাইল মাইল দূর পর্যন্ত বিস্তৃত সেইসব পাহাড়ের শেষে বরফে ঢাকা নন্দাদেবী, নন্দাঘুণ্টি, ত্রিশূল,নীলকণ্ঠ শৃঙ্গগুলি খুঁজি! অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও না দেখতে পেয়ে মেঘের আড়ালে তাদের রূপ কল্পনা করে আমরা বেরিয়ে আসি চৌবাটিয়া বাগান থেকে। গেটের বাইরে বসে কয়েকজন স্থানীয় লোক সবুজ আধপাকা আপেল বিক্রি করার জন্য বসে আছে। দাম জিজ্ঞেস করতে বলল পঞ্চাশ টাকা কিলো। এতো দাম? উত্তরে ধীরাজ জানাল যে গতবছরেও কুড়ি থেকে ত্রিশ টাকায় এই আপেল বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এবার সরকারী বাগান বেসরকারি লগ্নিকারিদের লিজে দেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই এই মূল্যবৃদ্ধি!