জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১৭ )

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১৭ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – সতেরো

আমি যখন প্রথম গীর্জার প্রার্থনাসভায় যেতে শুরু করলাম তখন যে খুব একটা বিশ্বাসের সঙ্গে যেতাম, এমনটা নয়। কিন্তু নিয়ম করে যেতাম বলেই বোধহয় সবাই ধরে নিয়েছিল এ আমার বিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। আর এই সদগুণের জন্য ছ’বছর বয়সে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ফাদার আঙ্গারিতার কাছে, প্রথম কম্যুনিয়নের (Holy Communion)[১] রহস্যের সঙ্গে আমার পরিচয় করাতে। আর তাতেই পালটে গেল আমার জীবন। সকলে আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে লাগল যেন আমি কত বড় হয়ে গেছি। গীর্জার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক নিজে আমাকে প্রার্থনার সময় সাহায্য করতে লাগলেন। আমার তখন একটাই সমস্যা ছিল, ঠিক কখন ঘন্টা বাজাতে হবে সেটা বুঝতে পারতাম না আর তাই নিজের ইচ্ছেমতো যখন খুশি বাজিয়ে দিতাম। এইভাবে তিনবার ঘন্টা বাজানোর পর ফাদার আমার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বেশ কঠোরভাবে আমায় ঘন্টায় হাত দিতে বারণ করলেন। এই কাজের একটা ভালো দিকও অবশ্য ছিল। আমার সঙ্গে অন্য একটি ছেলে প্রার্থনার কাজে সাহায্য করত। যখনি শুধুমাত্র আমরা তিনজন মানে সেই ছেলেটি, তত্ত্বাবধায়ক ও আমি স্যাক্রিস্টি (sacristy)[২] পরিষ্কার করে গুছিয়া রাখার কাজ করতাম তখনি আমরা কম্যুনিয়নের জন্য ব্যবহৃত পাউরুটির অবশিষ্টাংশ ওয়াইনের সঙ্গে খেয়ে ফেলতাম।

আমার প্রথম কম্যুনিয়নের আগের দিনের কথা। কোনো রকম কোনো ভূমিকা না করেই ফাদার আমার অপরাধের স্বীকারোক্তি নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তিনি ঠিক পোপের ভঙ্গীতে সিংহাসনের মতো একটা চেয়ারে বসে ছিলেন আর আমি তাঁর সামনে একটা নরম বালিশের উপর হাঁটু গেড়ে বসে। তখন আমার মনে ভালো ও মন্দের যে ধারণা ছিল তা খুবই সরল। কিন্তু ফাদার আমার সামনে পাপের একটা আস্ত অভিধান খুলে একটার পর একটা পাপের উল্লেখ করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন কোনটা করেছি আর কোনটা করিনি। আমি বেশ ভালোই উত্তর দিচ্ছিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল আমি কোনো পশুর সঙ্গে পাপ কাজ করেছি কিনা। এর আগে আমি শুনেছিলাম যে বড় ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ গাধীর সঙ্গে পাপ কাজ করে কিন্তু কাজটা যে ঠিক কি তা বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেই রাতের আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না যে সেই কাজটা মুরগীর সঙ্গেও করা সম্ভব। সে দিক থেকে দেখলে প্রথম কম্যুনিয়ন ছিল আমার সারল্য বিনাশের পথের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তারপর থেকে প্রার্থনার কাজে সাহায্য করায় আমি আর বিশেষ উৎসাহ পেলাম না।

আমার বাবা-মা যখন অন্য দুই ভাই-বোন লুইস এনরিকে ও আইদাকে নিয়ে কাতাকায় এসে হাজির হলেন তখন আমার সামনে সত্যি সত্যি অগ্নিপরীক্ষা উপস্থিত হল। মার্গোতের বাবাকে বিশেষ মনে ছিল না, সে প্রচন্ড ভয় পেত। আমিও ভয় পেতাম, তবে আমার সঙ্গে তিনি সবসময় সচেতন থাকতেন। মাত্র একবারই কোমরের বেল্ট খুলেছিলেন আমাকে মারবেন বলে আর আমিও জেদ ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে এবং বাবার চোখে চোখ রেখে। প্রস্তুত ছিলাম, যাই হোক না কেন সহ্য করব, কিন্তু কাঁদব না। শেষ পর্যন্ত তিনি-ই রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার বেল্টটা পরে নিলেন আর দাঁতে দাঁত চেপে আমায় বকতে লাগলেন। বড় হয়ে আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার সময় আমাকে বলেছিলেন যে আমাদের মারলে তাঁর খুব কষ্ট হত, তবুও তিনি তা করতেন এই ভয় থেকে যে নাহলে আমরা গোল্লায় চলে যাব। তাঁর মেজাজ ভালো থাকলে তিনি খুব আনন্দ করতেন। খাবার টেবিলে বসে মজার মজার চুটকি বলতে খুব ভালবাসতেন। কিন্তু একই চুটকি দিনের মধ্যে এতবার বলতেন যে একবার এনরিকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলঃ

  • ‘তোমাদের হাসাহাসি শেষ হলে আমায় জানিও।’

যাই হোক, এক ঐতিহাসিক বেল্টপেটা হয়েছিল সেই দিন, যেদিন লুইস এনরিকে রাতে বাড়ি ফিরল না, না বাবা-মায়ের বাড়ি, না দাদু-দিদিমার বাড়ি। তাঁরা সারা শহর ঢুঁড়ে ফেললেন তাকে খুঁজতে, শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল সিনেমা হলের মধ্যে। শরবত বিক্রেতা সেলসো দাসা রাত আটটার সময় এনরিকেকে সবেদার রস বিক্রি করেছিল, কিন্তু সে দাম না দিয়ে উধাও হয়ে যায়, এমনকি গ্লাসটাও ফেরত দেয়নি। যে মহিলা তেলে ভাজা বিক্রি করত সে তাকে একটা প্যাটিস বেচেছিল ও তার একটু পরে দেখেছিল এনরিকে সিনেমা হলের দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলছে। দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিয়েছিল কারণ সে বলেছিল যে বাবা তার জন্য ভেতরে অপেক্ষা করছে। সিনেমাটা ছিল কার্লোস বিয়ারিয়াস ও লুপিতা তোবার অভিনীত এবং জর্জ মেলফোর্ড পরিচালিত ‘ড্রাকুলা’। কত দিন ধরে কত বার যে লুইস এনরিকে আমায় গল্প করেছিল, কাউন্ট ড্রাকুলা যেই না সুন্দরী মেয়েটির গলায় দাঁত বসাতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা হলের আলো জ্বলে উঠল আর সে কি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল। গ্যালারির একেবারে কোনায় একটা খালি চেয়ার পেয়ে সেখানে সে লুকিয়ে বসেছিল। সেখান থেকে দেখতে পেল বাবা আর দাদু প্রত্যেক সারিতে তাকে খুঁজছে আর তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন সিনেমা হলের মালিক ও দুজন পুলিশ অফিসার। তাঁরা প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিলেন, কিন্তু ঠিক তখনই পাপালেলো তাঁকে দেখতে পান ব্যালকনির একেবারে শেষ সারিতে ও লাঠি উঁচিয়ে তাকে দেখিয়ে বলেনঃ

  • ‘ওই যে, ওইখানে!’

বাবা ওর চুল ধরে টেনে বের করে আনলেন। তারপর বাড়ি নিয়ে গিয়ে যে মার মেরেছিলেন তা আমাদের পারিবারিক ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে। ভাইয়ের এই স্বাধীনচেতা আচরণের প্রতি তখন আমার মনে যে ভয় ও ভক্তির উদ্রেক হয়েছিল তা আজও আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। যদিও আরো অনেক বেশি বীরত্বের কাজ সে সার্থকতার সঙ্গে অতিক্রম করবে। তবে আজ একটা কথা ভাবলে একটু কৌতূহলই হয় যে নামমাত্র যে কয়েকবার বাবা বাড়িতে ছিলেন না, সে সময় এনরিকের বিদ্রোহীভাব কিন্তু একেবারেই প্রকাশ পেত না।

এই পরিস্থিতে আমি আরো বেশি করে দাদুর ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। সবসময় তাঁর কাছে কাছে থাকতাম। সকালটা কাটাতাম তাঁর সোনার কাজের ঘরে বা আর্থিক প্রশাসকের অফিস-ঘরে। সেখানে তিনি আমায় একটা খুব সুন্দর কাজ দিতেন – অনেকগুলো গরুর ছবি আঁকতে বলতেন যাদের মাংসের দোকানে কাটতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি এত মন দিয়ে ছবিটা আঁকতাম যে দাদু তাঁর লেখার ডেস্কে পর্যন্ত আমায় বসতে দিতেন। তারপর দুপুরে খাবার সময় আমরা বসতাম টেবিলের মাথার দিকে আর অন্যান্য চেয়ারে বসতেন অতিথিরা। দাদুর পাশে রাখা থাকত একটা বড় জগে বরফ দেওয়া জল আর আমার হাতে একটা রুপোর চামচ, তাই দিয়েই আমি সবকিছু খেতাম। এক টুকরো বরফ নেওয়ার ইচ্ছে হলে আমি ওই জগের মধ্যে হাত ঢুকিয়েই তুলে নিতাম। তার ফলে জলের উপর তেলের একটা সর পড়ে যেত। অন্যরা তা অবাক হয়ে দেখত, কিন্তু দাদু আমার পক্ষ নিয়েই বলতেনঃ ‘ওর যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।’

প্রতিদিন এগারোটার সময় আমি আর দাদু স্টেশনে যেতাম। আমার মামা হুয়ান দে দিয়োস, যিনি তখন সান্তা মার্তায় থাকতেন, দাদুকে প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখতেন। সেই চিঠি দিতেন এগারোটার ট্রেনের গার্ডকে আর এর জন্য গার্ড নিতেন পাঁচ সেন্তাভো[৩]। দাদু সেই চিঠির জবাব আরো পাঁচ সেন্তাভো দিয়ে ফিরতি ট্রেনে পাঠিয়ে দিতেন। বিকেলবেলা, সূর্য অস্তাচলে গেলে, দাদু আমার হাত ধরে নিয়ে যেতেন তাঁর নিজস্ব পরিক্রমায়। আমরা যেতাম সেলুনে – আমার শৈশবের দীর্ঘতম পনেরো মিনিট; জাতীয় উৎসবে বাজি পোড়ানো দেখতে – আমার প্রচন্ড ভয় করত; সেমানা সান্তার (পবিত্র সপ্তাহ) শোভাযাত্রা দেখতে – ক্রশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি যেটা আমি সবসময় জীবন্ত ভাবতাম। সেই সময় আমি চৌখুপি কাটা একটা স্কটিশ টুপি পরতাম, ঠিক দাদুর মতো। মিনা সেই টুপিটা আমায় কিনে দিয়েছিলেন যাতে আমি আরো বেশি করে দাদুর সদৃশ হয়ে উঠি। আমাদের মধ্যে সত্যি সত্যিই এতটাই সাদৃশ্য ছিল যে কিন্তে তিয়োর মনে হত দুটি ভিন্ন বয়সের একটাই মানুষ।

দিনের যে কোনো সময়ে দাদু আমায় সঙ্গে নিয়ে কলা কোম্পানির খাবারের দোকানে যেতেন। সেখানেই আমি লাল স্ন্যাপার মাছ দেখি আর প্রথম বরফের উপর হাত রাখি। বরফটা এত ঠান্ডা ছিল যে তার আবিষ্কার আমায় কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেখানে আমার যা ইচ্ছে হত তাই খেতাম, সেটা আমার খুব পছন্দের ছিল। কিন্তু বেলগার[৪] সঙ্গে দাদুর দাবা খেলা ও রাজনৈতিক আলোচনা আমার খুব একঘেয়ে লাগত। এখন আমি বুঝতে পারি যে সেই দীর্ঘ বেড়ানোর সময় আমরা দুটো ভিন্ন জগৎ দেখতে পেতাম। আমার দাদু দেখত তাঁর দিগন্তরেখায় তাঁর নিজের জগৎ আর আমি দেখতাম আমার চোখের সমান উচ্চতায় থাকা আমার ভুবন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর যেসব বন্ধুরা বারান্দায় বসে থাকতেন তাঁদের অভিবাদন জানাতেন আর আমার চোখ থাকত ফুটপাথের দোকানে বিছিয়ে রাখা কত শত খেলনার রাজত্বে।

সন্ধ্যের শুরুতে আমরা ঘুরে বেড়াতাম চৌমাথার মোড়ের[৫] হই-হট্টগোলের মধ্যে। দাদু কথা বলতেন দোন আন্তোনিয়ো দাকোন্তের সঙ্গে তাঁর বর্ণময় সিনেমা হলের দরজায় দাঁড়িয়ে আর আমি বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকতাম সারা পৃথিবী থেকে আগত অভিনবত্বের দিকে। মেলার মাঠে গিয়ে দেখতাম জাদুকর টুপির ভেতর থেকে খরগোস বের করছে, কেউ আগুন খাচ্ছে, কেউ বা এমন ভাবে কথা বলছে মনে হচ্ছে যেন তার হাতে ধরা জন্তুটি-ই বুঝি কথা বলছে, প্রদেশে কী কী ঘটনা ঘটেছে তাই নিয়ে গান বেঁধে উচ্চৈস্বরে গাইছে অ্যাকর্ডিয়ান-বাদক। এইসব দেখে আমি প্রায় পাগল হয়ে যেতাম। আজ মনে হয়, তাদেরই একজন, খুবই বৃদ্ধ, মুখে সাদা দাড়ি, সেই-ই বোধহয় ছিল কিংবদন্তীর ফ্রান্সিসকো এল ওমব্রে[৬]।

দোন আন্তোনিয়ো দাকোন্তে যখনই কোনো সিনেমা উপযুক্ত বলে মনে করতেন তাঁর অলিম্পিয়া সিনেমা হলের প্রথম শো-এ আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন। তবে দিদিমার সেটা ঠিক পছন্দ ছিল না। তিনি ভাবতেন তাঁর নিষ্পাপ নাতি এতে বিগড়ে যাবে। কিন্তু পাপালেলো নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতেন এবং পরের দিন খেতে বসে আমার কাছে সিনেমার গল্পটা আবার শুনতেন। আমি যেখানে যেখানে ভুলে যেতাম বা ভুল বলতাম তা শুধরে দিয়ে কাহিনীর কঠিন পর্বগুলো আবার গড়ে তুলতে সাহায্য করতেন। এ ছিল নাটকীয়তা তৈরির প্রাথমিক ধাপ যা আমায় তখন দারুণ সাহায্য করেছিল। কারণ সেই সময় আমি ছবি এঁকে গল্প বলা (কমিক) সবে শুরু করেছিলাম এবং তা করেছিলাম লিখতে শেখার আগেই। প্রথম প্রথম আমাকে সবাই খুব বাহবা দিত, বাচ্চাদের কিছু কাজ দেখে যেমনটা বলে। কিন্তু বড়দের এই অকাতর প্রশংসা আমার এতই ভালো লাগত যে শেষে এমন অবস্থা হল আমি আসছি বুঝতে পারলেই তাঁরা পালিয়ে যেতেন। অনেক পরে যখন আমাকে বিয়ে বা জন্মদিনের আসরে গান গাইতে বলা হত তখন এই একই ঘটনা আবার আমার জীবনে পুনরাবৃত্ত হয়েছিল।

ঘুমোবার আগে বেশ খানিকটা সময় আমরা কাটাতাম বেলগার স্টুডিয়োতে। বেলগা একজন খিটখিটে বৃদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাকাতাকায় আবির্ভূত হন। তাঁর অদ্ভুত উচ্চারণ ভঙ্গী ও নাবিকের স্মৃতিকাতরতার যে সব কথা আমার মনে আছে তা থেকে আমি নিঃসন্দেহ যে তিনি ছিলেন বেলজিয়ামের মানুষ। তাঁর বাড়িতে তিনি ছাড়া আর একজন যে জীবিত প্রাণী বাস করত সে হল একটি গ্রেট ডেন কুকুর। সে কালা ও বাচ্চা দেখলেই তেড়ে আসত। তার নাম ছিল উড্রো উইলসন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এক রাষ্ট্রপ্রধানের নামে। আমার যখন চার বছর বয়স তখন বেলগাকে আমি প্রথম দেখি। দাদু আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়ি যেতেন দাবা খেলতে – এক নীরব ও অন্তহীন খেলা। প্রথম দিন রাতেই আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছিলাম যে তাঁর বাড়িতে এমন একটা জিনিষ নেই যার ব্যবহার আমার জানি। কারণ তিনি ছিলেন সব কিছুর শিল্পী আর নিজের শিল্পকর্মের বিশৃঙ্খলার মধ্যে বেঁচে থাকতে ভালোবাসতেন। তাঁর ঘরে প্যাস্টেলে আঁকা সমুদ্রের দৃশ্য, জন্মদিন বা প্রথম কম্যুনিয়নে বাচ্চাদের ফোটোগ্রাফ, এশিয়ার অলঙ্কারের অনুরূপ সৃষ্টি, গরুর শিংয়ের তৈরি মূর্তি, সম্পূর্ণ বিপরীত যুগ ও স্টাইলের আসবাব সব একটার উপর একটা ডাঁই হয়ে পড়ে থাকত।

আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম তাঁর গায়ের হাড়ের সঙ্গে লেগে থাকা ত্বকের রঙ ঠিক তাঁর চুলের মতো হলুদ আর কথা বলার সময় সেই চুলের একগাছি তাঁর মুখের উপর এসে পড়ছে। তিনি একটা হুঁকো খেতেন আর তাতে অগ্নি সংযোগ করতেন ঠিক খেলার সময়। দাদু বলতেন এটা ছিল তাঁর প্রতিপক্ষের মনযোগ হরণ করার একটা কৌশল। তাঁর একটা চোখ ছিল কাচের ও স্ফীত আকারের, কিন্তু সুস্থ চোখের চেয়ে সেই চোখটাই অধিক আকর্ষণীয় ছিল। তিনি ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী, কোমরের নিচে থেকে তাঁর শরীরটা সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে বাঁদিকে বেঁকে গিয়েছিল। অথচ ছড়িয়ে থাকা সেই অজস্র শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে কাঠের ক্রাচে ভর দেওয়ার বদলে প্রায় ঝুলে ঝুলে তিনি মাছের মতো যাতায়াত করতেন। তাঁকে কখনো সমুদ্রযাত্রার কথা বলতে শুনিনি, যদিও বহুবার অসম সাহসের সঙ্গে অসংখ্য যাত্রায় শামিল হয়েছেন। বাড়ির বাইরে তাঁর একটামাত্র পছন্দের জিনিষ ছিল, তা হল চলচ্চিত্র। সপ্তাহান্তে যে সিনেমাই আসত, তা যে মানেরই হোক না কেন,‌ তিনি কোনোটাই বাদ দিতেন না।

আমি তাঁকে একদম পছন্দ করতাম না, বিশেষ করে দাবা খেলার সময়। এক একটা চাল দিতে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন আর আমি ঘুমে ঢুলে পড়তাম। একদিন রাতে তাঁকে এত দুর্বল লাগছিল যে আমার মনে হল তিনি খুব শীঘ্রই মারা যাবেন। নিজের এই ভবিষ্যৎ দর্শনে নিজেই আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। তাঁর জন্য বেশ দুঃখও হল। কিন্তু তারপর খেলতে শুরু করে প্রতিটা চাল দেওয়ার জন্য এতক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলেন যে তখন আমি মনেপ্রাণে তাঁর মৃত্যু কামনা করতে লাগলাম।

টীকাঃ

১। কম্যুনিয়ন – বা Holy Communion, খ্রীস্টানদের একটি বিশেষ পবিত্র অনুষ্ঠান। ‘লাস্ট সাপার’-এ যীশু যে ভক্তদের মধ্যে পাউরুটি ও ওয়াইন দিয়েছিলেন তাকে স্মরণ করে এটি অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্য অনুযায়ী সাধারণত সাত থেকে তের বছর বয়সে এই কম্যুনিয়ন গ্রহণ করা হয়।

২। স্যাক্রিস্টি – বা sacristy, গীর্জার ভেতরের একটি ঘর যেখানে পোশাক ও অন্যান্য পবিত্র জিনিষ রাখা থাকে।

৩। সেন্তাভো – মেহিকো, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশে ব্যবহৃত মুদ্রা।

৪। বেলগা – বেলজিয়ামের অধিবাসীদের স্প্যানিশ ভাষায় বেলগা (belga) বলা হয়। এখানে চরিত্রটি বেলজিয়াম থেকে আগত তাই তাকে বেলগা বলে ডাকা হত।

৫। চৌমাথার মোড় – আরাকাতাকার কেন্দ্রীয় অংশে কয়েকটি রাস্তার সংযোগস্থলের নাম Las Cuatro Esquinas, যার একটির নাম Calle de los Turcos বা তুর্কী স্ট্রিট। এই পথের উল্লেখ ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’-য় আছে।

৬। ফ্রান্সিসকো এল ওমব্রে – কলোম্বিয়া, বিশেষত ক্যারিবিয়া অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের একটি কিংবদন্তী চরিত্র।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২