কার্ল মার্কস ও বিশ্ব-সাহিত্যের অতিমানবেরা – শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য (পর্ব ৩ )

কার্ল মার্কস ও বিশ্ব-সাহিত্যের অতিমানবেরা – শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য (পর্ব ৩ )

শেয়ার করুন

কার্ল মার্কস ও বিশ্ব-সাহিত্যের অতিমানবেরা (কিছু মনন সমলয়ন কথা)

প্রথম অধ্যায়: কার্ল মার্কস ও বালজাক

‘Le Père Goriot’-র সমাজ ও পুঁজি বালজাকীয় বীক্ষণে মার্কসের অশেষ মুগ্ধতা

মানুষ হিসেবে মার্কস ছিলেন স্নেহপ্রবণ, সংবেদনশীল এবং আপসহীন সত্যবাদী। শ্রমিক শ্রেণির দুঃখ কষ্টের জন্য তাদের প্রতি মার্কসের সহমর্মিতা ছিল গভীর। কিন্তু ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে কমিউনিস্টশোভন দৃষ্টিভঙ্গি মার্কস আয়ত্ত করেননি বরং তা ঘটেছিল ইতিহাস ও রাজনীতি-সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্র ও সম্যক দর্শন চর্চার ফলেই । মার্কসের সাহিত্য সংক্রান্ত রচনাগুলির থেকে ‘দাস ক্যাপিটাল’ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লেখাগুলি অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং বহুল পঠিত হওয়ার মানে কিন্তু আবার এই নয় যে তিনি শিল্প-সাহিত্যকে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দিয়েছেন। লিয়ঁ ট্রটস্কির সামগ্রিক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজারো বিতর্কের অবকাশ থাকলেও ‘Literature and Revolution’ বইটিতে তিনি সত্য কথাই বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে বহু লোক আছে যাদের ভাবনা বিপ্লববাদীদের মতো অথচ অনুভূতি বর্বরের মতো’।(1) মার্কস এঙ্গেলস কষ্টকল্পনাতেও এই ধরনের মানুষ ছিলেন না। মার্কস লিরিক কবিতা লিখতেন। অসমাপ্ত কমিক একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। তাঁর সকল রচনাই সাহিত্যিক ধ্যান-ধারণা এবং অনুষঙ্গ দিয়ে সম্পৃক্ত। ধ্রুপদী জার্মান ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে মার্কস ছিলেন অত্যন্ত শিক্ষিত একজন জার্মান বুদ্ধিজীবী এবং শিল্প-সাহিত্য তাঁর কাছে ছিল শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই অপরিহার্য ও স্বাভাবিক। সফোক্লিস থেকে স্পেনীয় নভেল, লুক্রেশিয়াস্ থেকে সাম্প্রতিক ইংরেজি ফিকশন—সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচিতির এই পরিধি ছিল বিরাট। এ বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখাও ছিল মার্কসের। শিল্প ও ধর্মের ওপরে একটি দীর্ঘ অপ্রকাশিত রচনা লিখেছিলেন, নাট্যসমালোচনার একটি পত্রিকা এবং বালজাকের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ও নন্দনতত্ত্বের ওপর একটি রচনার পরিকল্পনাও করেছিলেন। (2) প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পল লাফার্গ মার্কসের স্মৃতিচারণ করে বলছেন,

সের্ভান্তেস আর বালজাককে আর সব উপন্যাসিকের চেয়ে বড়ো বলে মনে করতেন মার্কস।…বালজাকের তিনি এতটাই ভক্ত ছিলেন, ভেবেছিলেন যে রাজনীতি-সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্র বিষয়ে বই লেখা শেষ করেই বালজাকের মহৎ রচনাবলী ‘La Comédie Humaine’-র একটি দীর্ঘ সমালোচনা লিখে ফেলবেন। মার্কস বালজাককে শুধু যে তাঁর যুগের ইতিহাসবেত্তা মনে করতেন তাই নয়, লুই ফিলিপের রাজত্বকালে যে-সব চরিত্র ভ্রূণাকারে ছিল এবং বালজাকের মৃত্যুর পর নেপোলিয়নের আমলে যেগুলি পূর্ণ ও পরিণত হয়ে উঠেছিল সেই সব সম্ভাব্য চরিত্রের ভবিষ্যৎ-দৃষ্টিমান স্রষ্টা বলেও তাঁকে মনে করতেন।”(3)

পল লাফার্গ

বালজাকের সৃজনে গড়ে ওঠা সাহিত্যে সমাজবৈজ্ঞানিক দিকটি ছিল গভীর, বিস্তৃত এবং তা বিবেচনা করা হলে, এই জাতীয় মূল্যায়নগুলি বালজাকের কথাসাহিত্য এবং মার্কসবাদী চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলির মধ্যে এক ধরনের আন্তঃপাঠিক(intertextual) সম্পর্ক স্থাপন করে। ‘La Comédie Humaine’-র সারবত্তা নিঃসন্দেহে মার্কসবাদী সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উৎস-কেন্দ্রে নিজের জায়গা করে নেয়। একইসঙ্গে বলতে হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক পরিসরে ভবিষ্যৎ-সাহিত্যের অনেক প্রভাবশালী সমালোচনামূলক গবেষণায় দাপটের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। সাহিত্যে অন্তর্গত সমাজবিজ্ঞানকে, সামাজিক বাস্তবতার সাহিত্যিক উপস্থাপনা বা সাহিত্য সৃষ্টিতে সামাজিক প্রভাব, যেভাবেই বোঝা হোক না কেন, বালজাক, মার্কস এবং এঙ্গেলসকে মননের এক বিশেষ মাত্রার নিরিখে সবসময়ই বিশেষ একটি গোত্রে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এক কথায়, মার্কস-এঙ্গেলস বালজাকের সৃষ্টিকাজ থেকে যা কিছু শিখেছিলেন তার পরিসর, গুরুত্বের কোনও শেষ নেই। মার্কসের বিশ্লেষণে মানবিক সত্তার সঙ্গে সৃজনশীল শ্রমের যে নিবিড় সম্পর্ক তা অনুধাবন করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মানুষের সৃজনীশক্তিকে মার্ক্স-এঙ্গেলস কী পরিমান কদর করতেন! তাঁদের কাছে শিল্পসাহিত্য এই সৃষ্টিশীলতারই এক বিশেষ প্রকাশ ক্ষেত্র।
মার্কসবাদ বলে, উৎপাদনী-শক্তিগুলির(productive force) ভিত্তিতে উৎপাদন-সম্পর্কগুলি(production relation) গড়ে ওঠে। গোড়ায় এই সম্পর্কগুলি—প্রভু-ক্রীতদাস জমিদার-ভূমিদাস, বুর্জোয়া-শ্রমিকের চেহারায় আবির্ভূত হয় উৎপাদনী-শক্তিকে আরও এগিয়ে দিতে, সমাজ এবং ইতিহাসকে আরও এগিয়ে দিতে। কিন্তু কালক্রমে শ্রেণিবিন্যাসই হয়ে দাঁড়ায় উৎপাদন তথা সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা স্বরূপ। তখন উৎপাদনী-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ ঘটে এবং অবশেষে দেখা দেয় নতুন শ্রেণিবিন্যাসের। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে উৎপাদনী-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া তারই প্রতিফলন হয় সেই যুগের সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, আইনে, দর্শনে, ধর্মে, লোকাচারে, রাষ্ট্রে, রাজনীতিতে।(4) এই বাস্তবতার নিরিখে বালজাকের লেখাতেও তাঁর সমাজের যে মূল বিরোধ, অসংখ্য ছোট-বড় ঘাত-প্রতিঘাত, টানাপোড়েন, সংঘর্ষ, তার সব কিছুরই প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য। চিত্রশিল্পী আঁরি মাতিস একবার মন্তব্য করেছিলেন যে সমস্ত শিল্পকর্মেই তার সমকালীন ঐতিহাসিক যুগের ছাপ থাকে; কিন্তু মহৎ শিল্প সেইটিই যাতে এই ছাপ গভীরভাবে ফুটে ওঠে। অথচ বেশিরভাগ সাহিত্যের ছাত্রকে ঠিক উল্টোটাই শেখানো হয়—সবচেয়ে মহৎ শিল্প তাই-ই যা সব ঐতিহাসিক পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে শাশ্বত ভাবে বিরাজ করে।(5) উনিশ শতকে ফ্রান্সের প্রারম্ভিক পর্যায়ের সামাজিক জীবনকে চিত্রিত করার অসামান্য ক্ষমতা ছিল বালজাকের এবং তাঁর এই প্রতিভা মার্কসকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিল। সংকটের মুখোমুখি হয়ে অর্থনৈতিক কাঠামোকে বদলে সর্বস্তরের সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে শোষণ-প্রক্রিয়া অটুট রাখতে পুঁজিবাদ বরাবরই সিদ্ধহস্ত। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই পদ্ধতির আগাগোড়া কৌশলগুলিও বোঝার ক্ষমতা ছিল বালজাকের। মার্কসের দৃষ্টিতে এর চেয়েও বেশি দেখার মতো বিষয় ছিল যে, এই নতুন শক্তির ক্ষমতাকে নিপুণ চোখে চিনতে বালজাকের মধ্যে একরকম বাধ্যবাধকতা কাজ করেছিল, যদিও সাবেকি নিয়মে তাঁর বিশ্বাস ছিল যথেষ্টই প্রতিক্রিয়াশীল। এই বিশ্বাস তো ছিলই, তা ছাড়াও বালজাকের ব্যক্তিগত জীবনশৈলীতেও ছিল ঘোর প্রতিক্রিয়াশীলতার আমেজ। জীবনের পরিণত অবস্থায় কোনও সময়েই বালজাককে ঋণমুক্ত অবস্থায় দেখা যায়নি৷ তিনি তাঁর নিজস্ব মুদ্রণ এবং প্রকাশনার কাজে বিনিয়োগ করার জন্য ব্যাপকভাবে ধার করেছিলেন কিন্তু শেষমেশ শোধ দেওয়া তো দূরের কথা বরং দিনদিন আরও বেশি ঋণে জর্জরিত হয়েছেন। জীবন ক্রমাগত দেউলিয়া হওয়ার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এমন যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতেও কিন্তু লেখা থেকে কখনোই নিজেকে সরিয়ে নেননি বালজাক। সম্ভবত বিপুল ঋণের তীব্র চাপই তা নিশ্চিত করেছিল। বাস্তবে, তাঁর স্বপ্ন যত বেশি ডানা মেলেছে, আকাঙ্ক্ষা যতই সুদূরপ্রসারী হয়েছে, ঋণের পরিমাণও বেড়েছে সমান তালে। যখন যে খেয়াল মাথায় চাপে তা যেন বালজাককে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে, ভূতগ্রস্ত করে তোলে। কপর্দকহীন না করে যেন সেই ভূত আর তাঁর কাঁধ থেকে নামতেই চায় না। সীমাহীন শক্তির প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে, আমি আমার আত্মাকে পুরোনো শয়তানের কাছে এতটাও বিক্রি করি না যতটা করি পুঁজিবাদের নতুন শক্তির কাছে, জীবনের এই ধরনটি তার কথাসাহিত্যে প্রবল মুনশিয়ানায় প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। বালজাকের সাহিত্যকর্ম প্রচণ্ড প্রভাবশালী ক্ষমতা, নির্ভীক কৌতূহল এবং প্রকৃত সমালোচনামূলক চেতনার অতুলনীয় এক মিশেল যার গভীরতায়, ব্যাপ্তিতে বুর্জোয়া সংস্কৃতির ভিতরের কঙ্কালটা কেলাস-স্বচ্ছতায় বেরিয়ে আসে।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে, ১৮৩৫ সালে বালজাকের লেখা ‘Le Père Goriot’ উপন্যাসটির কথা। এই রচনায় বুড়ো Goriot বিপ্লবের সময়ে নেপোলিয়ন প্রভাবিত ফ্রান্সে একজন স্প্যাঘেটি নির্মাতা হিসেবে পাস্তা এবং শস্যে ভালোই অর্থ উপার্জন করেন। তিনি অকৃতদার। দুই মেয়ে Delphine ও Anastasie-র জন্য প্যারিসের শ্রেষ্ঠ সমাজ থেকে উঠে আসা উপযুক্ত বরের সন্ধানে নিজের জীবনের প্রায় সবকিছুই তিনি ত্যাগ করেছেন। থাকেন এক ভাঙাচোরা বোর্ডিং হাইসে। বাড়িভাড়াটুকুই সম্বল। সেখানেই তার আলাপ Eugène de Rastignac-র সঙ্গে। সে একজন কপর্দকহীন তরুণ নোবল(noble)। মফস্বল থেকে প্যারিসে আইন পড়তে এসেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দারিদ্র্য এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সে নিজেকে গুছিয়ে নিতে তার কাজিনকে সাহায্য করতে Rastignac এক সালোনে (Salon) যোগ দেয়। সেই বিলাসবহুল সালোনে অভিজাত (grande bourgeoisie) এবং ধনীদের আনাগোনা। সে Delphine-র প্রেমে পড়ে। Delphine তার স্বামীর কাছে তখন পরিত্যাজ্য। স্বামী একজন ব্যাঙ্কার যে তার স্ত্রীর পণের টাকাকে নিয়মিত স্পেকুলেশন-ভিত্তিক ব্যবসায় নিয়োগ করে। এইসবের মধ্যেই তোর কি সমস্যা Rastignac-র একসময় বিভ্রম কাটে এবং সে আবিস্কার করে অর্থ কীভাবে সমাজের ভিতরটাকে এক আশ্চর্য সন্দেহবাতিকতায় দুর্নীতিগ্রস্ত করে রেখেছে। এদিকে বুড়ো Goriot-কে তার মেয়েরা পরিত্যাগ করেছে কারণ তারা এখন অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি। হতদরিদ্র একজন মানুষকে নিজের বাবা বলে পরিচয় দিতে, তার সঙ্গে দেখা করতে তারা বেশ লজ্জিত। এই সত্য জেনে Rastignac আতঙ্কিত হয়। অবশেষে বুড়ো মানুষটা জঞ্জালে ভরা প্রবল দারিদ্র্যে একা একাই মারা যায়। Rastignac-ই কেবল Goriot-র দাহকাজে উপস্থিত ছিল। এই অন্ধকার জগতের অন্যদিকে সে তখন দেখতে পায় কী প্রবল ঐশ্বর্যে ভরা প্যারিস শহর! তারপর সে বেরিয়ে পড়ে একটাই লক্ষ্যে—পুঁজি। সে শহরের উদ্দেশ্য বলে ওঠে, ‘it’s just you and me now!’ সমাজ এবং আবেগ নির্ভর শিক্ষার পর্ব তার এইখানেই শেষ। এখন থেকে সেও নির্মম। সামাজিক সংকট এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের মাঝে জড়িয়ে কালক্রমে Rastignac যখন এক নিবিড় অন্ধকার সময়ের মধ্যে এসে পড়ে, ছায়াময় ধূর্ত চরিত্রের Vautrin তাকে শিক্ষা দেয় ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথা বলে। Vautrin তাকে বোঝায় যে অধ্যয়ন, প্রতিভা আর প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে সামাজিক সাফল্য পাওয়ার চিন্তা বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন পথের হদিশ দিয়ে Rastignac-কে Vautrin বলে,
“তিরিশ বছর বয়সে আপনি একজন বিচারক হবেন, বছরে আয় বারোশো ফ্রাঁ(franc) যদি আপনি আগেভাগেই গাউনটি ছুড়ে না দেন। আপনার বয়স চল্লিশ ছুঁলেই আপনি একজন মিলারের মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারেন, বছরে তিনি প্রায় ছয় হাজার লিভরের(Livre) উত্তরাধিকারী। ধন্যবাদ জানবেন! ভাগ্য সায় দিলে বা আপনি যদি প্রভাব খাটাতে পারেন, সম্ভবত ত্রিশ বছর বয়সেই একজন পাবলিক প্রসিকিউটর হতে পারেন; পাঁচ হাজার ফ্রাঁর বেতন নিয়ে, আপনি মেয়রের মেয়েকে বিয়ে করতেই পারেন। কিছু খুচরো রাজনৈতিক প্রতারণায় শামিল হতে যদি আপনার হাত না কাঁপে আপনি সম্ভবত চল্লিশ বছর বয়সেই একজন প্রসিকিউটর-জেনারেল হবেন…এটা আমার দায়িত্ব আরেকটি সত্যের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা: গোটা ফ্রান্সে এই সময়ে প্রসিকিউটর-জেনারেলের সংখ্যা মাত্র বিশ, আর আপনার মতো প্রায় বিশ হাজার যুবক আছেন যারা সেই উচ্চপদের আশায় দিন গুনছেন, আবার তাদের মধ্যেও এমন কিছু একরোখা গোঁয়ার আছে যারা তাদের পরিবারকে পর্যন্ত বিক্রি করে ভাগ্য এক ধাপ এগিয়ে নিতে পিছপা হবে না। যদি এই ধরনের কাজকর্মে আপনার বিতৃষ্ণা আসে তবে অন্য কিছু চেষ্টা করুন। Baron de Rastignac কি উকিল হওয়ার কথা ভাবেন? তা হলে ঠিক আছে! অবিলম্বে দশ বছরের কঠোর পরিশ্রমের জন্য তৈরি হন। মাসে হাজার ফ্রাঁ খরচ করুন; অবশ্যই একটা আইনের বইয়ের লাইব্রেরি থাকতে হবে, আর একটা চেম্বার, সমাজে মেশামিশি করুন, সামান্য একটা কেসের জন্য নতজানু হয়ে নিচুতলার কেরানিকে তোষামোদ করুন, কোর্টহাউসের মেঝে থেকে ধুলোও চাটতে হবে। এই ধরনের কাজ যদি কোনও ভালো কিছুর দিকে আপনাকে নিয়ে যায় আমি তার বিরুদ্ধে কিছুই বলব না, তবু বলব, আমাকে এখানে প্যারিসে এমন পাঁচজন আইনজীবীর নাম বলুন তো যারা পঞ্চাশ বছর বয়সে বার্ষিক পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁর বেশি অর্থ উপার্জন করছেন! (6)
Rastignac-র উদ্দেশে Vautrin-র এই সামাজিক সাফল্য লাভের পরামর্শ দেখতে গেলে অনেক বেশি কার্যকর। মার্কস ‘দাস ক্যাপিটাল’-এ স্পষ্টতই বুঝিয়েছেন যে, শ্রমিকরা তাদের ক্ষমতা দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে এবং তা পুঁজির কৃপাধন্য ফল বলেই মনে হয়। পুঁজির নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতায় বলিয়ান শক্তি হিসেবে এই চেহারাকে পুঁজির ফেটিশিজম(fetishism of capital) বলা যেতে পারে। পণ্যের ফেটিশিজমের মতোই, পুঁজির ফেটিসিজম নিছক মিথ্যা চেতনা(false consciousness) বা একটি সাধারণ ভুল ধারণা নয়, এর ভিত্তি কিন্তু উৎপাদন প্রক্রিয়ার পুঁজিবাদী সংগঠন। পুঁজিবাদী সংগঠনের প্রবক্তা হিসেবে Vautrin-র কাজ Rastignac-র মনে এই মিথ্যা চেতনার সঞ্চার। Vautrin-র ছদ্মবেশে এ যেন আড়ালে থাকা মেফিস্টোরই হাতছানি। ফাউস্টকে সে বলছে,

“সম্পদ তোমার হবে
শঙ্কা ভয়ে দূরে ফেলে চঞ্চল পাখায় করে ভর
উড়ে চলো তরঙ্গিত আনন্দের লোকে
স্পর্শ করো, শুঁকে দেখো
যা কিছু সকাশে আসে মাংসল সুন্দর।
ছেনে ছুঁয়ে সর্ববস্তু বাঞ্ছিত পুলক রসে করো সন্তরণ।
ঝাঁপ দিয়ে ডুবে যাও
ক্ষিপ্র হাতে ছিঁড়ে ফেলো
সমস্ত দ্বিধার রেখা সন্দেহ-কন্টক।“ (7)

Rastignac বুঝতে পারে, কুমারী মেয়ে Victorine-কে বিয়ে করতে পারলে সে তখনই মিলিয়ন ফ্রাঁ আইনত হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এমনিতেই Victorine-র চোখ ছিল সুদর্শন Rastignac-র দিকে। অতএব এই বিয়ে মানেই কুড়ি বছর বয়েসেই বছরে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ (পুঁজির ৫ শতাংশ)। তার জন্য পঞ্চাশ বছর অব্দি অপেক্ষা করারও দরকার নেই, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রসিকিউটর-জেনেরাল হবার সেই দীর্ঘ পথকে এড়িয়ে এখনই দশগুণ সুখে থাকা যায়। ফ্রাঁ হোক বা টাকা এই বিশেষ পণ্যটি যা নেহাতই কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছুই নয় অর্থ হিসাবে কি চমৎকারভাবেই না কাজ করে। কাগজের টুকরোটি অর্থ হিসাবে কাজ করতে পারে কারণ সুখের সাম্রাজ্যে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পৃথিবীর যাবতীয় পণ্যই অর্থ হিসাবে এটির সঙ্গে সম্পর্কিত। সে কারণেই Rastignac-র ভাবনায় ফ্রাঁ কোন অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পন্ন অশুভ জিনিস নয় বরং আদ্যোপান্ত এক ধরনের “সামাজিক-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য”(socio-natural property)। এই যুক্তিতে দাঁড়িয়েই সাদামাটা চেহারার Victorine-র মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু না থাকলেও এই মুহূর্তেই তাকে বিয়ে করাটা Rastignac-র কাছে খুব দরকারি মনে হয় । অবৈধ সন্তান Victorine-কে যদি তার বাবার বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে হয় তাহলে সেই সম্পত্তির বৈধ দাবিদার তার ভাইকে খুন করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। Vautrin কমিশনের বদলে খুন করার ঝুঁকি নিতেও রাজি। সামাজিক সাফল্য লাভের জন্য Vautrin-র যুক্তি যতই লোভনীয় হোক না কেন খুন করার জন্য Rastignac মোটেও প্রস্তুত নয়।(8) এই উপন্যাসে এইখানে অর্থের প্রতি মানুষের অদম্য আকর্ষণ এবং মানবিক নৈতিকতা মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
আর্থ-সামজিক বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে মানব চরিত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার এমনই অনন্য প্রতিভা ছিল বালজাকের। চরিত্র গঠন, তাদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে বাস্তবে সামাজিক স্তরের খুঁটিনাটি ছাড়াও সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে অর্থ উপার্জনের নিখুঁত পরিমাপটুকুও বালজাক অসামান্য দক্ষতায় উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘১৮৪৪-র দর্শন ও অর্থনৈতিক পান্ডুলিপি’-তে গ্যোয়েটের ‘ফাউস্ট’ এবং শেক্সপিয়ারের ‘টাইমন অব অ্যাথেন্স’ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার আগে অর্থের ক্ষমতা প্রসঙ্গে মার্কস বলছেন,

“সবকিছু খরিদ করার, আত্মসাৎ করার বৈশিষ্ট্য ধারণ করার ফলে অর্থ বিশেষ ধারণ সম্পন্ন বিষয়। এর বৈশিষ্ট্যের সর্বজনীনতা হল এর সত্তার সর্বশক্তিমানতা। তাই সে গণ্য হয় এক সর্বশক্তিমান সত্তা হিসেবে। মানুষের প্রয়োজন আর বিষয়ের মাঝখানে তার জীবন আর জীবিকার মাঝখানে-অর্থই হল যোগানদার(pimp)। তবে যা আমার জন্য আমার জীবনের মধ্যস্থতা করে সে তো আমার জন্য অন্যান্য জনগণেরও মধ্যস্থতা করে, আমার জন্য তা হল অন্য ব্যক্তি।“ (9)

কার্ল মার্কস

নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, ‘দাস ক্যাপিটাল’-র প্রাথমিক খসড়া হিসাবে ১৮8৪-র পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত ‘দাস ক্যাপিটাল’, অর্থের ক্ষমতা প্রসঙ্গে মার্কসের যে অতুলনীয় অন্তর্দৃষ্টি তারই ঝকঝকে সাহিত্যিক-আভাস বালজাকের এইসব উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণে এবং সমকালীন সমাজ-বাস্তবতায়।
মার্কসের মতোই বালজাকীয় বীক্ষণে মুগ্ধ হয়ে এঙ্গেলস বলেছিলেন,

“…even in economical details (for instance the rearrangement of real and personal property after the Revolution) I have learned more than from all the professed historians, economists and statisticians of the period together” (10)

ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস


তথ্যসূত্র:

  1. মার্কসবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা, টেরী ঈগলটন, ভাষান্তর নিরঞ্জন গোস্বামী, দীপায়ন, ২০০৮, পৃষ্ঠা- ১৮
  2. Karl Marx: Interviews and Recollections, edited by David McLellan, Macmillan Press Limited, 1981, Page-70
  3. Karl Marx, Selected Works, Moscow, 1947, volume 1, Page-356.
  4. মার্কসবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা, টেরী ঈগলটন, ভাষান্তর নিরঞ্জন গোস্বামী, দীপায়ন, ২০০৮, পৃষ্ঠা- ২০
  5. Old Goriot, Honoré de Balzac, London, Everyman’s Library, 1963, Page 123-135
  6. ফাউস্ট-প্রথম খন্ড, আহমদ ছফা, মাওলা ব্রাদার্স, 2015, পৃষ্ঠা-132
  7. Capital in the Twenty-First Century, Thomas Piketty, Harvard University Press, Page-2014, Page- 238-240
  8. ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসোফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস ১৮৪৪, কার্ল মার্কস, ভাষান্তর জাভেদ হুসেন, বাঙলায়ন, ২০১৮, পৃষ্ঠা – ১১৮
    “By possessing the property of buying everything, by possessing the property of appropriating all objects, money is thus the object of eminent possession. The universality of its property is the omnipotence of its being. It therefore functions a s the almighty being. Money is the pimp between man’s need and the object, between his life and his means of life. But that which mediates my life for me, also mediates the existence of other people for me. For me it is the other person.”
  9. Marx Engels On Literature and Art. Progress Publishers. Moscow 1976, Page- 91
শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২