শিক্ষকের সম্মান – কণিষ্ক ভট্টাচার্য
মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শিক্ষকদের বলা হল, “বেশ তাহলে আপনারা রাইটার্স বিল্ডিংএর ঝাড়ুদারের পোস্টে অ্যাপ্লাই করুন ভ্যাকেন্সি হলে আমরা ডাকব।”
শিক্ষকেরা মাত্র দুটাকা বেতন বাড়ানোর দাবি করেছিলেন সরকারের কাছে। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে শিক্ষক নেতা বলেছিলেন, “আপনারা বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেন শিক্ষকেরা জাতির মেরুদণ্ড অথচ আপনি কি জানেন আপনার দপ্তরের ঝাড়ুদারের থেকেও আমাদের বেতন কম?” তো দপ্তরের সর্বোচ্চ অফিসারের বক্তব্যই এই লেখার প্রথম বাক্য।
সেই মুখ্যমন্ত্রীকে আমরা পশ্চিমবঙ্গের রূপকার বলে চিনি। তিনি ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়।
এই তো ছিল শিক্ষকদের অবস্থা এই প্রগতিশীল সংস্কৃতিমান রাজ্যে!
দেশভাগ হয়ে গেছে। ওপার বাংলা থেকে সবহারা মানুষের ঢল নেমেছে রাজ্যে। উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে কোনও ক্রমে মাথাগুঁজে সন্তানদের পড়ানোর জন্য ইস্কুল তৈরি হয়েছে চাঁচের বেড়া দিয়ে। কোনও ক্রমে চলেছে সেই স্কুল। সরকারি আওতায় আসা স্কুলের শিক্ষকেরা যখন মাত্র ৩৫ টাকা মহার্ঘ ভাতার দাবি তুললেন, মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার রায় বললেন, “স্কুলগুলো অর্ধেক দিলে সরকার অর্ধেক দেবে।” স্কুলের আয় কী তখন? ওই সবহারা পরিবারগুলোর থেকে নেওয়া ছাত্রছাত্রীদের বেতন! কোত্থেকে দেবে সেই পরিবারগুলো? রাষ্ট্র জানতো না তাদের অবস্থা!
হীরেন মুখার্জি তখন সাংসদ। তিনি বললেন, “এই মহার্ঘ ভাতা দিতে সরকারের খরচ হবে ৩৫ লক্ষ টাকা আর আর সরকার ইস্পাত কারখানার কনসালটেন্সি ফি বাবদ খরচ করেছ ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। আর টাটা কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন এ টাকা বৃথাই ব্যয় হচ্ছে।”( সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা / ২৯.০১.৫৪)
এরপরে যখন শিক্ষকরা কর্মবিরতিতে যান। ১৯৫৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তখন সরকার পুলিশ লেলিয়ে দেয় সেই রাজভবন অভিমুখী শিক্ষক মিছিলের ওপরে। গুলি চালায়। টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে। লাঠি চালায়। শিক্ষকেরা সেখানেই বসে পড়েন। শুরু হয় অবস্থান। ১২ দিনের সেই অবস্থানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা এগিয়ে এলেন ধর্মতলায়। হোটেল ব্যবসায়ীরা খাবার দিলেন। সদাগরি অফিসের ক্যান্টিনে নতুন করে হাঁড়ি চড়ল। হ্যাঁ শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্যে।
মূলধারার বাংলা সিনেমা আর সাহিত্যে যে গরিব শিক্ষককে মহিমান্বিত করা হয় তাদের খিদের কথাটা ভাবা হয় কতটুকু! একটি সিনেমায় মাত্র আজ পর্যন্ত সেই শিক্ষক আন্দোলন উঠে এসেছে। অবশ্যই মূলধারার ছবি নয় সেটা। ছবিটার নাম ‘কোমলগান্ধার’, পরিচালকের নাম ঋত্বিককুমার ঘটক। যিনি খিদে চিনতেন। কোনও মহিমান্বিত ন্যাকামি ছাড়াই নিখাদ পেট মুচড়ানো খিদে।
সারা পৃথিবীতে সেই আন্দোলন সারা জাগায়। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। সূত্র দিচ্ছি মিলিয়ে নিন। The New York Times, Dated 17.02.54 1st page Bold Caption “Calcutta Police Fire on Rioters & Die as Red Fan. Teachers Strike (Special Report on New York Times) রয়টারের রিপোর্টে চারজন মারা যায়। ৬৫ জন আহত হয়।
এত কম ছিল শিক্ষকদের বেতন যে কেউ সেই পেশায় আসতে চাইত না। শিক্ষকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা শুনলে আঁতকে উঠতেন মেয়ের বাবা। তাও সেই চাকরি পেতে গেলে স্কুল কমিটির সভাপতিকে ঘুষ দিতে হত। নিলাম হত একেকটা শিক্ষক পদ। যে বেশি টাকা দিতে পারবে চাকরি তার।
কংগ্রেস সরকারের আমলে পুরোটাই তাই চলেছে। বাম সরকারের আমলেও শুরুর দিকে তাই ছিল। স্কুল কমিটি নির্ধারণ করত কে চাকরি পাবে আর কত দামে পাবে। এই প্রবণতা বেড়ে গেল যখন স্বাধীনতার ৩৪ বছর পরে ১৯৮১ সালে রাজ্যে বাম সরকার শিক্ষকদের সরকারি বেতনক্রমে আনল। তার আগের শিক্ষকদের কাছে গল্প শুনেছি তাদের বেতনের কোনও নির্দিষ্ট দিন ছিল না। যেদিন স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা যেমন ফি জমা দিত তাই তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতেন। আজ পাঁচ টাকা। কাল দশ টাকা। পরশু হয়তো পনের টাকা। তার পরের দিন আবার দুটাকা। হ্যাঁ যে পরিবারে পুরনো মাস্টারমশাই দিদিমণিরা আছেন এখনও তাদের থেকে কনফার্ম করে নিন।
সরকারি বেতনক্রমে এসে শিক্ষকতার পেশা সম্মানজনক জায়গায় আসে। প্রসঙ্গত এই এই কথাটাও বলে রাখা যাক কলেজ শিক্ষকেরাও ওই সময়েই সরকারি বেতনক্রমের অন্তর্ভুক্ত হন। এক দর্শনের পিএইচডি করা প্রতিবেশি জেঠুর থেকে শুনেছিলাম তিনি কলেজের চাকরি ছেড়ে কলকাতা পুলিশের চাকরি নিয়েছিলেন বেতন বেশি বলে। পরে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হন। তৎকালীন বাম সরকার শিক্ষকদের সরকারি বেতনক্রমে এনে যেটা করেছিলেন সেটা অতিরিক্ত কিছু করেননি সেটাই সরকারের কাজ। কিন্তু তার আগের ৩৪ বছর (৪৭-৮০ সাল) শিক্ষকেরা এতো বেশি অবহেলিত হয়েছিলেন যে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কাজটাই আমরা ভুলে গেছিলাম।
স্বাধীনতার পরে ৭২ বছরের মধ্যে মাত্র ১৪ বছর এই রাজ্যে একটা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল ১৯৯৮ থেকে ২০১১। সেটাও সরকারের দায়িত্ব, সরকার পালন করেছেন। তাদের ধন্যবাদ। সেই সময়ে নানা কারণে কাজের জায়গা কমে গিয়েছিল (তার বিতর্ক আলাদা ভাবে করাই যায়) এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েদের কাজের এক নিশ্চিন্ত সম্মানজনক জায়গা হয়ে ওঠে।
বিগত কয়েক বছর ধরে ইতিউতি আবার টাকাপয়সার গল্প শোনা যেতে যেতে এখন নাকি সব খুল্লমখুল্লা। পরীক্ষা বন্ধ। বাস্তবিক কী অবস্থা সকলে সব জানেন। আবার সেই ধর্মতলা। আবার সেই পুলিশ। আবার…
এই তো আমাদের শিক্ষকদের ইতিহাস।
এই রাজ্যে উপন্যাস আর সিনেমার ডায়লগে শিক্ষকের সম্মানের ন্যাকা ন্যাকা কথা শোনাতে আসবেন না। প্লিজ।