শুরুর সে দিন: কলকাতাতে পদার্থবিদ্যাতে স্নাতকোত্তর পাঠের সূচনা ও প্রেসিডেন্সি কলেজ – গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

শুরুর সে দিন: কলকাতাতে পদার্থবিদ্যাতে স্নাতকোত্তর পাঠের সূচনা ও প্রেসিডেন্সি কলেজ – গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে প্রাচীনতম। তবে এ কথা প্রায় সকলেরই জানা যে শুরুতে এ ছিল মূলত এক ডিগ্রিদানকারী প্রতিষ্ঠান। পড়াশোনা হত কলেজে ও স্কুলে; বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছিল সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা। ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠার ছ-বছর পরে ১৮৬৩ সালে প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া হয়, তবে বিজ্ঞানের কোনো ছাত্র সেই তালিকাতে ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী কোনো বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার অফ আর্টস অনার্স ডিগ্রি দেওয়া হয় প্রথম ১৮৬৫ সালে। ১৮৮৫ সাল থেকে ডিগ্রির নামের অনার্স শব্দটি বাদ যায়। সে যুগে বিজ্ঞানের ডিগ্রিকেও মাস্টার অফ আর্টস বলা হত এবং সেই প্রথা বহুদিন চলেছিল। ১৯০২ এবং ১৯১০ সাল থেকে বিজ্ঞানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাত্ররা যথাক্রমে ব্যাচেলর অফ সায়েন্স ও মাস্টার অফ সায়েন্স ডিগ্রি পেতে শুরু করে। আজকের দিনে যাকে বিজ্ঞান বলব, ১৮৬৫ সালের রেকর্ডে এমন দুটি বিষয় দেখতে পাই, একটি গণিত, অপরটি প্রাকৃতিক ও ভৌত বিজ্ঞান (Natural and Physical Science)। এই লেখাতে আমরা দ্বিতীয় বিষয়টিতে আগ্রহী, কারণ এটি থেকেই শেষ পর্যন্ত পদার্থবিদ্যার শুরু হয়। প্রথম বছর এই বিষয়ে একজনই পাস করেছিলেন। তাঁর নাম প্রসন্নচন্দ্র রায়; তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। ১৮৬৬ সালেও একজন পাস করেন, কালীপদ গুপ্ত। তিনি মেডিক্যাল কলেজে পড়েছিলেন। এরপর চার বছর ওই বিষয়ে উত্তীর্ণের তালিকায় কারোর নাম পাওয়া যায় না। এই বিষয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের বাইরে অন্য কোনো কলেজের নাম পাওয়া যায় ১৮৭৬ সালে, তা হল ফ্রি চার্চ ইন্সটিটিউশন অর্থাৎ বর্তমানের স্কটিশ চার্চ কলেজ।

তবে প্রাকৃতিক ও ভৌত বিজ্ঞানকে ঠিক আজকের দিনের মতো কোনো বিশেষ বিজ্ঞানের সঙ্গে মেলানো যাবে না। যেমন ১৮৮১ সালের সিন্ডিকেটের বিবরণী থেকে দেখা যাচ্ছে মোট ছটি বিষয়কে দুটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রথম ভাগে ছিল রসায়ন, তড়িৎ ও চুম্বক বিজ্ঞান, এবং তাপ ও আণবিক পদার্থবিদ্যা। দ্বিতীয় ভাগে পড়ত উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ও শারীরবিদ্যা, এবং ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা, এই তিনটি বিষয়ের থেকে। পরীক্ষার্থীকে যে কোনো একটি ভাগ থেকে দুটি বিষয় বেছে নিতে হত। প্রতিটি বিষয়ে ছিল তিনটি করে পেপার, তার মধ্যে দুটি থিওরি ও একটি প্র্যাকটিকাল। পাঠক্রম ছিল এক বছরের।

পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে ১৮৮৫ সালে। সেই বছর বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেয় পরীক্ষার্থীকে একটি বিষয় বাছতে হবে। যেগুলি পড়ানো হবে তা হল (ক) রসায়ন (খ) পদার্থবিজ্ঞান (এর দুটি ভাগ ছিল, পরে দ্রষ্টব্য) (গ) উদ্ভিদবিদ্যা, (ঘ) প্রাণীবিদ্যা ও শারীরবিদ্যা, এবং (ঙ) ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা। ১৮৮৭ সালের পরীক্ষা অবশ্য আগের পদ্ধতি অনুসারেই নেওয়া হয়েছিল। পরের বছর থেকে প্রথম দুটি বিষয়ের নাম দেওয়া হয় যথাক্রমে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান। প্রশ্নপত্রও সেইভাবে তৈরি করা হয়েছিল। তবে আধুনিক যুগের মতো দু-বছরের পাঠক্রম তখনও চালু হয়নি, তা চালু হয় ১৯০৮ সালে।

১৮৮৭ সালে মেধা তালিকা প্রকাশের পর প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক উইলিয়াম বুথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এক চিঠি দিয়ে জানান যেহেতু দুটি বিষয়ের পরীক্ষা আলাদা হয়েছে, তাই মেধা তালিকা সেইভাবেই প্রকাশ করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় সেই কথা মেনে নেয়। সে কারণে ১৮৮৭ সালে স্নাতকোত্তর পাঠ পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে ভাগ হয়েছিল এ কথা অনেকে বলেন। তবে মনে রাখতে হবে যে ১৮৮৫ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রশ্নপত্র বা ডিগ্রি ভাগ হয় ১৮৮৮ সালে। ১৮৮৭ সালে রসায়ন এবং তড়িৎ ও চুম্বক বিজ্ঞান পাঠক্রম নিয়ে পাস করেছিলেন ছ-জন, তাঁরা সবাই প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, তিনি আগের তালিকাতেও সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন।

১৮৮৭ সালে দ্বিতীয় তালিকাতে বিষয়ের নাম ছিল তড়িৎ ও চৌম্বক বিজ্ঞান এবং তাপ ও আণবিক পদার্থবিজ্ঞান। একেই আমরা পদার্থবিজ্ঞান বলছি। সে বছর সেই বিষয় নিয়ে সাতজন পাস করেছিলেন; তাঁদের মধ্যে তিনজন এলাহাবাদের ম্যুয়ার সেন্ট্রাল কলেজের, দু-জন ঢাকা কলেজের এবং দু-জন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র গোবিন্দচন্দ্র দাস। আগেই বলেছি পরের বছর থেকে বিষয়টির নাম হয় পদার্থবিদ্যা। সে বছর পাঁচ জন পাস করেছিলেন; তাঁদের মধ্যে একজন ম্যুয়ার সেন্ট্রাল কলেজের, অন্যরা সবাই প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। প্রথম হন প্রেসিডেন্সি কলেজের জ্যোতিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। পরের দু-বছরের উত্তীর্ণতালিকাতে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদেরই নাম পাওয়া যায়।

আমরা এই লেখাতে এর পরে সেই যুগে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করব। তবে তার আগে কী বিষয় পড়ানো হত সে সম্পর্কে জেনে নিই। স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞানে পাঠক্রম বা সিলেবাস জাতীয় কিছুর সন্ধান পাইনি, তবে অনুমোদিত পুস্তকের তালিকা ও প্রশ্নপত্র থেকে কিছুটা অনুমান করা সম্ভব। আগেই বলেছি পদার্থবিজ্ঞানের পাঠক্রমে দুটি ভাগ ছিল, একটিতে প্রধান বিষয় ছিল তড়িৎ ও চৌম্বক বিজ্ঞান ও তাপ, সঙ্গে পড়তে হত আলোক ও স্বনবিদ্যা। দ্বিতীয়টিতে মূল ও পার্শ্বের বিষয়গুলি উলটে যেত। মনে রাখতে হবে ক্লাসিকাল বা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সেই ছিল সর্বোচ্চ সময়, পরের দশক থেকেই তেজস্ক্রিয়তা ও ইলেকট্রন আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে নবযুগের সূচনা হয়। প্রশ্নপত্র থেকে দেখা যায় তড়িৎচৌম্বক বিজ্ঞান, তাপ ও তাপগতিবিদ্যা এবং আলোকবিজ্ঞান ছিল পাঠক্রমের অন্তর্গত। পাঠক্রমকে আধুনিক যুগের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকস্তরের সমতুল্য বলা যেতে পারে। অবশ্য স্নাতকস্তরের শেষ বছরে এখন যা পড়ানো হয় সেই সব শাখার অধিকাংশ তখনও সৃষ্টিই হয়নি, কাজেই তাদের থাকার প্রশ্ন ওঠে না। স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত বই ছিল ইংরাজিতে। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, মাইকেল ফ্যারাডে, জোসেফ ফুরিয়ার, জর্জ এয়ারির মতো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের বই পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ১৯১৬ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত সায়েন্স কলেজে এমএসসি চালু হয়, তখন কিন্তু কোনো বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়নি; বলা হয়েছিল শিক্ষকরা গবেষণাপত্র থেকে পড়াবেন। সহজেই বোঝা যায় যে এর পিছনে ছিল স্নাতকোত্তর পড়াশোনাকে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করার সচেতন প্রয়াস।

কলকাতাতে স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান পাঠ শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে। সকলেই জানেন যে ১৮১৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হিন্দু কলেজ হিসাবে, সেই ইতিহাসে আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই সময় বিদ্যালয় স্তর থেকেই পড়ানো হত, ১৮৫৫ সালে কলেজটি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। বিদ্যালয়ের অংশটি হিন্দু স্কুল নামে পরিচিত হয়, উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজকে তার অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে পদার্থবিদ্যা বিভাগ যে বাড়িতে অবস্থিত, তা তৈরি হয়েছিল অনেক বছর পরে ১৯১২ সালে। ১৮৭২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রির জন্য দুটি পাঠক্রম, A ও B চালু করে, এর মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল বিজ্ঞান। প্রেসিডেন্সি কলেজের পরিকাঠামোর কারণে সেখানে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ছাত্রদের আগ্রহ ছিল। রসায়ন পাঠ স্নাতক স্তরে ছিল আবশ্যিক, তাই সেই বিভাগই বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করত। ১৮৭৫ সালে রসায়নের প্রথম অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন আলেকজান্ডার পেডলার।

১৮৭৪ সালের প্রেসিডেন্সি কলেজের নতুন বাড়ি উদ্বোধন হয়। এটিই কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) মূল বাড়ি, পদার্থবিদ্যা বিভাগও সেখানেই স্থানান্তরিত হয়। এর আগে থেকেই প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্র ভর্তির চাপ বাড়ছিল, কিন্তু স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। নতুন বাড়িতে ল্যাবরেটরি তৈরি সম্ভব হয় এবং ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮৮০ সালে কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ গঙ্গার ওপারে শিবপুরে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৫ সালের গোড়া থেকে আইন বিভাগটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে কিছু জায়গা পাওয়া যায়।

কিন্তু একই সঙ্গে অন্য এক বিতর্ক ওঠে। আরও অনেক বেসরকারি কলেজ তৈরি হচ্ছে, সেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজের থেকে ছাত্রসংখ্যাও বেশি; তাহলে এই সরকারি কলেজের প্রয়োজনীয়তা কী? প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের জন্য সরকারের খরচ স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেশি, অন্য কলেজের শিক্ষকরা সরকার থেকে বেতন পেতেন না। ডায়রেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন বা ডিপিআই সরকারি কলেজের দেখাশোনা করেন, এই প্রশ্নের মীমাংসাতে ১৮৮৮ সালে তিনি লেখেন যে প্রয়োজনে অন্যত্র ব্যয় কমিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজকে শক্তিশালী করতে হবে। এই কলেজ প্রধানত অনার্স ও বিজ্ঞান পড়ানোর জন্যই তৈরি, এবং সেদিক থেকে দেশে এর তুলনীয় কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।

বিদেশী শাসকরা বেসরকারি কলেজগুলিকে সাহায্য করে সাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে উৎসাহী ছিল না। প্রশ্ন হল বাস্তবে প্রেসিডেন্সি কলেজ কি সরকারের এই মনোভাবের সুবিধা ভোগ করেছিল? সেই কথায় যাওয়ার আগে পদার্থবিদ্যা বিভাগের সেই সময়ের পরিস্থিতি দেখে নেওয়া যাক। ১৮৫৫ সালে ডাক্তার হেরম্যান হ্যালেউর ন্যাচারাল ফিলোজফি (অর্থাৎ বিজ্ঞান) ও অ্যাস্ট্রোনমির অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি পড়েছিলেন ডাক্তারি, তারপর জার্মানির বোখুমে রয়্যাল টেকনিক্যাল স্কুলের ডাইরেক্টর হিসাবে কাজ করেন। এরপর লন্ডনের কিউ অবজার্ভেটরিতে ছ-মাস কাটিয়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। মনে রাখতে হবে ইন্টারমিডিয়েট (বর্তমানের উচ্চমাধ্যমিকের সমতুল্য) ও স্নাতক স্তরে পড়ানো হত প্রকৃতিবিজ্ঞান, তার মধ্যে পদার্থবিদ্যার কিছু বিষয় পড়ানো হত। ১৮৬৩ সালে তাঁর স্থানে হেনরি ব্ল্যানফোর্ডকে ন্যাচারাল সায়েন্স বা প্রকৃতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। তিনি ছিলেন আবহাওয়াবিদ, তিনি ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত কলেজে পড়িয়েছিলেন। এম এল বিবি ছিলেন ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৫ পর্যন্ত ন্যাচারাল ফিলোজফি ও অ্যাস্ট্রোনমির অধ্যাপক। ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৬ পর্যন্ত ডব্লিউ জি উইলসন ছিলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। শেষোক্ত দুজন চাকরি করতে করতেই প্রয়াত হন।

পদার্থবিদ্যাতে যখন স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুসারে বিভাগে পড়াতেন জন এলিয়ট, উইলিয়াম বুথ, আলেকজান্ডার ম্যাকডনেল ও জগদীশচন্দ্র বসু। জগদীশচন্দ্রের পরিচয় পাঠকদের দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তিনি ১৮৮৪ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত এই কলেজে পড়িয়েছিলেন। ১৮৭৬ থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত প্রকৃতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন জন এলিয়ট, তিনিও আবহাওয়া বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। উইলিয়াম বুথ ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি পেয়েছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন গণিতের অধ্যাপক হিসাবে, পরে ১৮৮৭ সাল থেকে ১৮৯২ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক। আলেকজান্ডার ম্যাকডনেল ছিলেন গণিতের অধ্যাপক, তিনি একই সঙ্গে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপকের কাজ করতেন। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত জে এইচ গিলিল্যান্ডও বিভাগে পড়িয়েছিলেন। তিনি আগে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনা করেছিলেন, পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হয়েছিলেন। এছাড়া ল্যাবরেটরির কাজে সাহায্য করতেন আরও দুজন। ১৮৮৬ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বরদাপ্রসাদ ঘোষ ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট, তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই ১৮৭৫ সালে ন্যাচারাল এন্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সে প্রথম শ্রেণিতে এম এ পাস করেছিলেন। সে বছর ওই বিষয়ে একমাত্র তিনিই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হৃদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৭ সালের জুলাই মাসে ডেমোনস্ট্রেটর হিসাবে বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড দেখাচ্ছে তিনিও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই ১৮৮৮ সালে রসায়নে প্রথম শ্রেণিতে এম এ পাস করেন। তিনি ১৯১৯ থেকে ১৯২১ বিভাগে অধ্যাপক হিসাবেও কাজ করেছেন, তারপর চট্টগ্রাম কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল পদে যোগ দেন।

১৮৮৮ সালে ডিপিআই-এর চিঠির পরে কলেজের দুই শিক্ষক উৎসাহ পেয়েছিলেন। তাঁদের পক্ষ থেকে ল্যাবরেটরির উন্নতির জন্য কলেজ থেকে তিনটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হয়। গবেষণার সঙ্গে উচ্চতর শিক্ষার সম্পর্ক যে খুব নিবিড় তা বোঝা যায় যখন দেখি এই দুই শিক্ষকই গবেষণাজীবনে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হয়েছিলেন। রসায়ন বিভাগের উন্নতির জন্য একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন আলেকজান্ডার পেডলার। পদার্থবিদ্যার ল্যাবরেটরির উন্নতির জন্য দুটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন তরুণ শিক্ষক জগদীশচন্দ্র বসু। আমরা সেই দুটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করব। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রস্তাব ও সরকারের উত্তরগুলি অধ্যাপক লাডলিমোহন রায়চৌধুরি বাংলা সরকারের শিক্ষা বিভাগের ফাইল থেকে উদ্ধার করে প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রাক্তনীর পত্রিকাতে লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধ থেকেই পরের তথ্যগুলি পাওয়া।
সরকারি কলেজের নিয়ম অনুযায়ী জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রস্তাব দুটি কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনির কাছে জমা দিয়েছিলেন। প্রথমটি জমা পড়ে ১৮৮৮ সালের ২২ ডিসেম্বর। জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন যে বিভাগের ছাত্রসংখ্যা চারগুণ বেড়ে গেছে, একই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি কোর্সকে আবশ্যিক করেছে। তাই অবিলম্বে পরীক্ষাগারকে ঢেলে সাজানো দরকার। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, জগদীশচন্দ্রের প্রস্তাব স্বাভাবিক ভাবেই ছিল বিভাগের সমস্ত ছাত্রের জন্য। কিন্তু যে সময়ে কলেজে সঠিক অর্থে স্নাতকোত্তর স্তরে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হচ্ছে সেই সময়েই তা জমা পড়েছিল; তাই এই অনুমান করা হয়তো অসঙ্গত নয় যে নতুন পাঠক্রমের কথা তাঁর মাথায় ছিল। পেডলারের প্রস্তাব জমা পড়েছিল আগে, সেখানেও ছাত্রসংখ্যার কথা ছিল এবং বিশেষ করে এম এ ক্লাসের ছাত্র বৃদ্ধির উল্লেখ ছিল।

এই প্রস্তাবে জগদীশচন্দ্র পঁচিশটি টেবিল চেয়েছিলেন, তাদের সকলের সঙ্গে গ্যাস কানেকশন ও কয়েকটির সঙ্গে জলের ট্যাঙ্কের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কয়েকটি যন্ত্রের একাধিক কপি বানানো বা কেনার জন্য এক হাজার টাকা চেয়েছিলেন। এছাড়া বিভাগের বাৎসরিক অনুমোদন বাড়ানো ও ল্যাবরেটরিতে তৃতীয় এক ডেমনস্ট্রেটর নিয়োগের কথা বলেছিলেন। আগে দেখেছি কলেজের রেকর্ডে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ও একজন ডেমনস্ট্রেটরের খবর পাওয়া যায়, সম্ভবত জগদীশচন্দ্রের এই দুজনের কথাই একসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে তিনি বলেন যে তাপ, আলোক ও স্বনবিদ্যাতে পরীক্ষার যন্ত্রপাতি কলেজে বিশেষ নেই। কিছু তৈরি করা হবে ও কিছু স্থানীয় যন্ত্রনির্মাতাদের থেকে কেনা হবে। কোন্ যন্ত্র বানানো হবে এবং কোন্‌গুলো কেনা হবে, তার এক তালিকা তিনি সংযুক্ত করেছিলেন। আমরা স্মরণ করতে পারি যে পরে জগদীচন্দ্রের গবেষণার প্রায় সমস্ত যন্ত্র তিনি স্থানীয় কারিগরকে দিয়ে বানিয়েছিলেন। ১৫ জানুয়ারি ১৮৮৯ অধ্যক্ষকে লেখা এক চিঠিতে জগদীশচন্দ্র বলেন যে কলেজের ওয়ার্কশপের সীমাবদ্ধতার জন্যই স্থানীয় নির্মাতাদের থেকে যন্ত্র কিনতে হবে। এছাড়া তিনি আরও ল্যাবরেটরিতে যে ইঞ্জিন লাগে, তা চালানোর জন্য একজন কর্মী নিয়োগের কথা লেখেন; কারণ ল্যাবরেটরি মেকানিকের অধিকাংশ সময় ইঞ্জিন দেখাশোনাতেই চলে যাচ্ছে। চার্লস টনির অনুপস্থিতিতে কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলাতেন আলেকজান্ডার পেডলার, তিনি জগদীশচন্দ্রের প্রস্তাবটি ডিপিআই-এর কাছে পাঠান ২৮ ডিসেম্বর। সঙ্গের নোটে তিনি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য খুব জোর দিয়ে লেখেন যে এটি রূপায়িত হলে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগ ইউরোপের অধিকাংশ কলেজের স্তরে জায়গা করে নেবে।
একই সঙ্গে জগদীশচন্দ্র কলেজের ছাদে একটি অবজার্ভেটরি বা পর্যবেক্ষণাগার নির্মাণের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। হিন্দু কলেজের যুগে ব্যবহৃত দূরবিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি প্রেসিডেন্সি কলেজে অনাদরে রাখা ছিল। তার মধ্যে ছিল ভারতসচিবের থেকে পাওয়া একটি নক্ষত্রের বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র। জগদীশচন্দ্র সেগুলিকে উদ্ধার করেন। ২২ ডিসেম্বর, ১৮৮৮ লেখা অন্য এক চিঠিতে জগদীশচন্দ্র লেখেন যে এই সমস্ত যন্ত্র ব্যবহারের অভাবে খারাপ হয় যাচ্ছে। তাই কলেজের ছাদে এগুলি বসানোর ব্যবস্থা করা হোক। ৩০ জানুয়ারি ১৮৮৯ অধ্যক্ষ টনিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি পর্যবেক্ষণাগারে কী ধরনের ব্যবস্থা থাকবে তা ব্যাখ্যা করে লেখেন যে এর জন্য খুব বেশি খরচ হবে না। টনি সেদিনই প্রস্তাব ডিপিআই-এর কাছে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গের নোটে তিনি লেখেন যে কেমব্রিজে গণিতের অনার্সের ছাত্রদের অবজার্ভেটরির কোর্স বাধ্যতামূলক, তাই প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত ও পদার্থবিদ্যার এমএ পাঠরত ছাত্রদের জন্য এই ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

বাস্তবে অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজের পরিকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপারে ডিপিআই-এর প্রতিশ্রুতি শূন্যগর্ভ প্রমাণিত হয়েছিল। অর্থাভাবের অজুহাতে পেডলারের প্রস্তাব আদৌ গৃহীত হয়নি। জগদীশচন্দ্রের প্রস্তাবের মধ্যে ডেমনস্ট্রেটর ও ইঞ্জিন চালানোর কর্মী নিয়োগ এবং পনেরটি টেবিল ছাড়া কিছুই অনুমোদিত হয়নি। কয়েক বছর পরে জগদীশচন্দ্র গবেষণা শুরু করেছিলেন নিজের চেষ্টাতে, সেই গবেষণার সঙ্গে বিভাগের পঠনপাঠনের যোগ স্থাপনের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে কলকাতা তথা সারা ভারতেই পদার্থবিদ্যাতে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা তাই মূলত পুঁথিগত বিদ্যাতেই আটকে থেকেছিল।

তথ্যসূত্রঃ

• সিপাহি বিদ্রোহ থেকে স্বাধীনতাঃ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, শ্যামল চক্রবর্তী

• Years of Consolidation: 1883-1904, Anilchandra Banerjee, Hundred Years of the University of Calcutta 1857-1956

• The Formative Years: 1857-82, Niharranjan Ray, Hundred Years of the University of Calcutta 1857-1956

• History of the College, Subodhchandra Sengupta, Presidency College Calcutta, Centenary Volume 1955

• Presidency College Register 1927, Ed. Surendrachandra Majumdar and Gokulnath Dhar

• Proposals for Development of Science Teaching at Presidency College: 1888-1889, Ladli Mohon Raychaudhuri, Autumn Annual 1994-1995, Presidency College Alumni Association

• From King’s Instrument Repository to National Physical Laboratory: Kew Observatory, Physics and the Victorian World, 1840-1900, Lee Todd Macdonald, Ph.D. Thesis, University of Leeds

নীচের সূত্রগুলি থেকে কিছু তথ্য পেয়েছি:

• Presidency College Calcutta, Centenary Volume 1955

• Calendars and Minutes of the Syndicate of the University of Calcutta for various years

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২