ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ৪)

শেয়ার করুন

১১.

ঘোড়ামাঠে ঝাউগাছ আজ মাতাল হয়েছে। জোরালো বাতাস ডেকে এনে তাদের খুনসুটি ধুলোকেও নেশায় মাতিয়ে তুলছে। বাতাসের গতি বুঝে এক চাগড়া ঘাসের দ্বীপে বসে আছে নন্দবাবা আর পঞ্চু। কবি দাঁড়িয়ে আছে আনমনা ঝাউ আর আকাশের আঁকিবুুকি নিয়ে। বলাই এখনও ফেরেনি কুঁরগি থেকে। আলোর কোনো চিহ্ন নেই এখন। পঞ্চুর মনেও কালো মেঘ ঢেউ তুলছে। সে ভেবেছিল, নন্দবাবা আসার আগেই বলাইয়ের সাথে বসে তার মনের কথা কিংবা বলা যায়, তার শেষ সিদ্ধান্তটা জানিয়ে যাবে। বিধি বাম। পড়ন্ত আলোয় চোখে মুখে স্বপ্নক্লান্তির ছাপ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘোড়ামাঠে এসে দেখে তার মতোই একা পড়ে আছে মাঠ। ধুলো সঙ্গে নিয়ে।

বলাই একা হেঁটে আসছে মন্দ গতিতে। বকুল গাছে মিশে যাচ্ছে। আবার স্পষ্ট হচ্ছে একটা আগাগোড়া মানুষ। সামনে এসে বসে। চোখ মুখ দেখা যায় না। গলার স্বর অস্বাভাবিক। বোঝা যায়, সে এখনও কুঁরগির নেশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদিও সে নিজে জানে সে আজ কুঁরগি দেখেনি। কুঁরগির বুকে পরমা। পরমার কোলে মাথা রেখে বলাই শুধু আকাশ দেখেছে। মেঘছবি দেখেছে। যা কিছু ভাবতে গিয়ে কল্পনার দরকার হয়েছে, সেখানে নিজে হাতে তুলি নিয়ে মেঘের লেজ ধড় মাথা মায় লোম পর্যন্ত এঁকে নিয়েছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে দেখিয়েছে পরমাকে। অন্ধকারে অন্ধকার তাকিয়ে আছে যেন। পটের চিত্র যেন পরপর সেজে উঠছে বলাইয়ের চোখের সামনে।
—পঞ্চু, মাটির কাজ কেমন চলছে?
—চলছে ভালোই। পায়ের পেশিতে ইদানীং খুব টান পড়ে। বেশিক্ষণ বসে বসে চাক চালাতে পারি না। মন উদাস হয়ে থাকে। হাতের আঙুলে আর যেন জোর নেই। চাক ঘোরাতে ভুলে যাই।
থেমে গিয়ে পঞ্চু কালো চিটচিটে ধুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
আরও অনেক কথা একটানে বলতে চেয়েছিল পঞ্চু। বুঝতে পারে, একটা নিয়মরক্ষার প্রশ্নে এটা রীতিমতো বকবক করা হয়ে যাচ্ছে। মুখ নামিয়ে হয়তো সে লজ্জা জানাতে চাইল। একটা মেঘ জমে আকাশটাকে আরও কালো করেছে। মৃদু হেসে নন্দবাবা পঞ্চুর খালি পিঠে হাত বোলায়। নন্দবাবা রামচকের গণ্য মানুষ। সে রামচককে চেনে গুঁড়ি বৃষ্টির মতো। কোনো জায়গা কোনো মানুষ তার কাছে অচেনা নয়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এসে খোলা মাঠের সবজায়গায় ঠোকর দিতে লাগল। নন্দবাবার মনে পড়ে সেই সন্ধের কথা, যেদিন পঞ্চুকে অনেক বুঝিয়ে কুঁরগি না পেরোনোর কথা শুনিয়েছিল। সেই সন্ধেটা এখুনি নিভে গেল এক ফোঁটা বৃষ্টির জলে।
কবি দাঁড়িয়ে আছে তফাতে। যেন এখনি প্রতিটা ঝাউগাছ জড়িয়ে নিজের ভাবনা শেখাবে ওদের। গুঁড়ি বৃষ্টিতে আগাগোড়া ওদের ভিজিয়ে দিতে তার সে কী প্রয়াস! একটা রোগা গাছে হেলান দিয়ে অন্ধকার ধুলোয় বৃষ্টির তপতপে শব্দ শুনছে।

বলাই এতক্ষণ আনমনা হয়ে নন্দবাবা আর পঞ্চুর মুখের দিকে এলোমেলো তাকিয়েছিল। বৃষ্টির ছোঁয়া লাগতে সেই ঘোর যেন আরো গভীরে ডুব দিয়েছে। তিনটি ঝাউগাছ যেখানে একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে, তার নীচে এসে দাঁড়ায় সবাই।
—কুঁরগি পেরিয়ে যাক এই আঙুলগুলো। আমি একরকম ভাবে হাঁড়ি সরা তৈরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। প্রাণটা আজকাল হাঁপিয়ে উঠছে।
ক্লান্ত দুচোখ তুলে নন্দবাবা পঞ্চুর দিকে চায়। সেদিনের মতো বাধা দেওয়ার সুর এত জোরালো নয় তার। যেন চোখের ভাষায় সে পঞ্চুকে কত কথা বোঝাতে চায়। বলাই হঠাৎ শিরদাঁড়ায় স্পষ্ট একটা টান অনুভব করে। সে ভুলে যাচ্ছে পরমার কথা, সে আলো-কে ছাড়িয়ে আসছে। তার চোখের সামনে রামচক একটা আবছায়া মূর্তি নিয়ে ভেসে আসছে। সেই মূর্তির চোখগুলো সবথেকে স্পষ্ট। করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। এখুনি কী আদেশ করবে বলাই রামচককে? একটা মায়া-দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলবে আষ্টেপৃষ্ঠে? অদৃশ্য একটা পাঁচিল তুলে ঘেরে ফেলবে কি কুঁরগি? রাজহাঁসগুলোকে কোনো জাদু শেখাবে? কাউকে যাতে রামচক ছাড়তে না হয়! সেই ঘোড়াটিকে ধরে আনার জন্য কাউকে অনুরোধ করবে? রামচকের জন্মগৌরব পালা শোনানোর জন্য? মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যে মুক্তি সে পেয়েছিল এই পবিত্র ভূমিতে—সেই ভূমি ছাড়তে চাইছে একজন! আর ভাবতে পারছে না বলাই। শিরায় শিরায় চাপ অনুভব করছে সে। ক্লান্ত… ক্লান্তি…

নন্দবাবা বলাই পঞ্চু ছবির মতো স্থির দাঁড়িয়ে। যেন তিন প্রেতাত্মা ভাবী যোনি নিয়ে ভাবুক। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ নিয়ে কবির অস্ফুট স্বর সবাইকে সচেতন করে তোলে।
—প্রতিটা সংকটে আমরা একটা করে নোঙর ফেলি। তারপর দাঁড়ের কাজ আরও বেড়ে যায়।
বলাইয়ের কান একটু যেন ঠিকরে ওঠে। তবে কি পঞ্চুকে আটকে রাখবার কোনো অধিকার নেই আমাদের? রামচকের স্বার্থে? পঞ্চুর নিজের স্বার্থে? যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে সে। গুঁড়ি বৃষ্টির ধোঁয়া আর অন্ধকার চেপে বসছে সবার চোখে মুখে। এই মুহূর্তে কোনো আততায়ী চুপি চুপি এসে সুযোগ নিয়ে হয়তো দূষিত করে যাবে রামচক। ঘোড়া মাঠ বুঝি এখুনি নগ্ন একটা চিঠি হয়ে জোর গলায় সকলকে শুনিয়ে যাবে রামচকের অক্ষমতার কথা! রাজহাঁসগুলো সাদা ডানা ঝাপটে মুখ গুঁজে পড়বে কুঁরগি পেরিয়ে!

আর ভাবতে পারে না বলাই। এখুনি যেন কেউ তাকে আছাড় দিয়ে ফেলে গেল এক কুৎসিত আগন্তুকের কাছে। নখ দাঁত দেখিয়ে সে কেড়ে নিতে পারে এতদিনের লাগামটা।

বৃষ্টি থেমে গেছে। এই ভরা বর্ষায়ও গোটা পৃথিবী থমথমে হয়ে আছে। অন্ধকার চাদর জড়ানো স্থির গাছপালার পৃথিবী। কোনো কথা নেই তার মুখে। নন্দবাবা কিছু বলতে চেয়েছিল হয়তো। প্রায় অবশ একটা হাত তুলে নন্দবাবার গায়ে রাখে বলাই। পঞ্চু এতক্ষণ এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করলেও মনের ওপর কীসের যেন একটা পেটানো দোমড়ানোর ভাব টের পায়। চোখ দুটো ভারি হয়ে আসে জলে। কত বছরের সাধের রামচক যেন গলে গলে পড়ছে তার গা থেকে। ঝাউগাছগুলোকে তার মনে হয়, নন্দবাবা আর বলাই। ওদের অনেক কিছু বলার আছে। বলছেও। বাতাস সঙ্গ না দেওয়ায় ওরা একটা ঝোপের মত স্থাণু হয়ে আছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কবি তখন ঘেমে যাওয়া শরীর। অনেক অন্ধকার জড়ো করে বানিয়েছে ধনুক। তার ভেতর তির বসিয়ে অবিরাম নিক্ষেপ করছে। তিরগুলোর মুখ একটা একটা রাজহাঁসের চঞ্চল ঠোঁটের দিকে। এইসব মায়া না থাকলে হয়তো রামচকের কোনো অধিকারই থাকত না নিজেকে সুন্দর বলার! বলাই আর নন্দবাবা কে কষ্ট পেতে হত না!

১২.

আজ শনিবার। ঘরের সামনেই পোয়ান। বৃষ্টি বাঁচাতে একটা কালো ত্রিপল চাপা দেওয়া আছে। চাকের মতোই পোয়ান তাদের কাছে চাতকের জল। আগুনে পুড়িয়ে ঠিক ঠিক রঙ আর মজবুত করে তুলতে না পারলে মাটির জিনিসগুলো ভালো বিকোয় না। কাকভোরের কালো অন্ধকারে পোয়ান ঘিরে বসে আছে পঞ্চু আর মালিনী। আগুনের হল্কা পোয়ান থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসে দুজনের মুখ বুঝিয়ে দিচ্ছে। পোয়ানের ওপর থরে থরে সাজানো মাটির হাঁড়ি কলসি সরা খুরি। আকাশ একদম পরিষ্কার। কাল সন্ধ্যা থেকে মালিনীর ভয় ছিল, ভোরে বৃষ্টি এলে পোয়ান জ্বালাতে পারবে না। শনিবারের হাটে মাটির পাত্র নিয়ে বসে পঞ্চু। লাল টকটকে পুড়িয়ে হাটে নিয়ে গেলে বিক্রি হয় ভালো।
মালিনীর মনটাও আকাশের মত খেলছে এখন। পরিষ্কার আকাশে লাল আভা ছেনে ছেনে সে হাঁড়িগুলোকেও এমন রঙ দিতে চায়। আঙ্গরা খুঁচিয়ে কতগুলো আগুনের ঝুরি উড়িয়ে দেয়। পঞ্চু উবু হয়ে বসে আছে। মাথা ভার। আগের অন্য দিনগুলিতে এই কাজের জন্য পঞ্চুর উৎসাহের অন্ত থাকত না। রাতভোরে উঠে গুনগুন সুর ভাঁজতে ভাঁজতে একটা ছায়ামূর্তিকে আঙিনাময় ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে – যার উৎসাহের অন্ত নেই – গোটা রামচক দেখেছে সেই মূর্তি দিনের পর দিন। কিন্তু আজ মনে মনে সে স্থির করে ফেলেছে, এই কাজের আজই শেষ দিন। যে চাকাটা ক’দিন ধরেই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বা বিশ্বাসের বলে মাটিতে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল – এখন মাটি থেকে প্রায় বেরিয়ে আসছে সেই চাকাটা। এবার সগর্বে সে তুচ্ছ করবে নিয়তিকে। আগুনে কাজ শেষ হয়। আগুনে কাজ শুরুও হয়। পঞ্চুর কাছে এখন পোয়ানের এই আগুন শুরু আর শেষের মাঝে একটা না বলা কওয়া বিচিত্র পৃষ্ঠা। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। পঞ্চু দুটো ঠোঁট মুড়ে মুখের দিকে টেনে নেয়। ভেতরে ভেতরে জিভটা বুলিয়ে শৈশবে ফিরিয়ে আনে ঠোঁট দুটোকে। আলো খেলতে থাকা মালিনীর মুখের দিকে এলোমেলো ভাবে তাকাচ্ছে। কিছু বলতে চায়।
— আমি আজ হাট থেকে ফিরে একটু বেরোবো।
মাটির হাঁড়িগুলো উল্টে পাল্টে আগুন খাওয়াচ্ছে মালিনী। পোড়া মাটির ঘষা খাওয়া শব্দে পঞ্চুর কথার শেষ দিকটা তার কানে আসেনি।
— তা যাওনা…
একটু অবাকই হয় পঞ্চু। এত সহজ! এত প্রশ্নহীন!
মালিনীর কাছে আরেকবার প্রশ্নহীন সম্মতি শুনতে চায় পঞ্চু।
— আজ আমি হাট থেকে ফিরে একটা জায়গায় যাবো।
এইমাত্র পোয়ান থেকে যেন এক টুকরো আগুনের ছিলকা বেরিয়ে এসে ছুঁয়ে ফেলে মালিনীকে। চমকে ওঠে মালিনী। একসাথে কতগুলো প্রশ্ন ভিড় করলে দৃষ্টি যেমন হয়, পঞ্চুর দিকে তাকায় সে। এই বিস্মিত তাকানো একেবারে নতুন। রামচক জানে, রামচকের সবাই জানে, এখানে ‘যাওয়া’ শব্দটার পেছনে কত সপ্রশ্ন দৃষ্টি থাকে। রামচকের ভেতরে কোথাও যেতে সবার অবাধ অধিকার। তাই যাওয়ার জন্য অনুমতি নেওয়া বাহুল্যমাত্র। আজ যখন কাকভোরে কয়েকদিনে গোপনে কিছুটা বদলে যাওয়া পঞ্চু মালিনীকে এই প্রস্তাব দেয়, কেঁপে ওঠে মালিনী। তার চোখ হঠাৎ জন্ম নেওয়া এক নারীর চোখের মতো। শুধু বিস্ময় নয়, ভয় সম্মান সবকিছু মিলে এই দৃষ্টি তৈরি হয়েছে মালিনীর নিজেরই অজান্তে।
— কোথায় যাবে! হাট থেকে ফিরে!
মালিনীর কাছে হাট থেকে ফেরা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ফিরে কোথায় যাবে পঞ্চু? সেটাই বেশি চিন্তার। তড়িঘড়ি সেই কোথায় যাওয়ার প্রশ্নটাই যেন মুখ থুবড়ে পড়ে।
— কুঁরগি পেরিয়ে…
পঞ্চুর আর কোনো কথা না শুনলেও চলে। মালিনীর কপাল, ভ্রু আর দৃষ্টি পরের কথাগুলো যেন মন্ত্র দিয়ে থামিয়ে দেয়। মালিনীর কাপড়ে যেন এখন আগুনের আভা লেগে আছে। ঝপ ঝপ শব্দ তুলে সে ঘরের দিকে চলে যায়। তার যাওয়ার বেগ আর ভঙ্গি পঞ্চুকে নীরব অথচ কঠোর একটা উত্তর শুনিয়ে যায়। সেই উত্তর এই মুহূর্তে পঞ্চু ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারে না – পারবে না। সতেজ মন নিয়ে বাসা থেকে বেরোতে চাওয়া কাকটাও নয়।
পূর্বদিক লাল হয়েছে। সূর্য উঠতে এখনও বাকি। আকাশে হালকা একটা বর্ষার মেঘ গোঁ ধরে আছে। একটা জামা গায়ে দিয়ে লুঙ্গিটা দু’ পাট করে বেঁধে পঞ্চু মাথায় তোলে ঝাঁকাটা। মালিনী হাত লাগিয়ে দেয়। এখনও গরম মাটির জিনিসগুলো। তালে তালে পা ফেলছে পঞ্চু। কোমর দুলছে। দূর থেকে দেখলে স্পষ্ট হয় ঝাঁকার দুলুনি।
কুঁরগির তীর শনিবার মঙ্গলবারের সকালে পোয়াতি হয়ে ওঠে। কত সন্তান একসাথে তার গর্ভে! পলির ঘাসের চাদরে কিছুটা ছাড়া ছাড়া পসরা মেলে বসেছে বিক্রেতারা। সবজি, মুদি, মাটির জিনিস, কাঠের জিনিস, মাছের বাজার, বীজের দোকান কী নেই! নদীর দিকে পেছন করে হাট বসে। রামচক গ্রামের সকল মানুষ যার প্রয়োজন, যার প্রয়োজন নেই সব্বাই একটি বার অন্তত হাটে এসে সকালটা কাটিয়ে যায়। কত মানুষ একসাথে এমন ভিড় করে আনাগোনা, কত রকমের কথা। রামচক শনিবার আর মঙ্গলবার যেন সমূল উৎপাটিত হয়ে কুঁরগির তীরে এসে পড়ে। কত রকমের মানুষ। কত রকমের জিনিস। কত গন্ধ। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
পঞ্চু একজনকে ডেকে ঝাঁকা নামায়। হাঁপিয়ে গেছে। হাট ধরতে গেলে এখুনি তাকে পসরা সাজিয়ে ফেলতে হবে। একটা কাপড় দু’ পাট করে বিছিয়ে সারি দিয়ে হাঁড়ি সরা কলসী সাজিয়ে দেয়। চোখ মেলে গোটা হাটের দিকে একবার তাকায়। বসে পড়ে কুঁরগির দিকে পেছন করে। বসার আগে মনে মনে কাউকে না দেখিয়ে কুঁরগিকে প্রণাম করে ফেলে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়। ক্রেতার সঙ্গে হাটুরে আলাপ সারতে থাকে। নন্দবাবা , বলাই হাটের জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। পঞ্চুর সঙ্গে তাদের চোখাচোখি হয়েছে যতবার, পঞ্চু চোখ নামিয়ে নিয়েছে। কী এক অস্বস্তি যেন তাকে ছেয়ে ধরছে।
এই প্রথম পঞ্চুর মনে জেঁকে বসছে রামচক। এই হাট সে হয়তো কতদিন দেখতে পাবে না। এই কুঁরগি। এই ভিড় গন্ধ। মালিনীকে ভালোবাসে পঞ্চু। তাকে খুব কষ্ট দেওয়া হল কি! উপুড় করা হাঁড়িগুলো সামনে দেখে তার বারবার মনে হয়েছে এর থেকেও ভালো কাজ সে করতে পরে। ঘন চোখে আঙুলগুলোর দিকে একবার তাকায় পঞ্চু। নন্দবাবা বলাই কবি সবাই তার প্রিয়। রামচক তাকে কোনোদিন কোনো কষ্ট দেয়নি। কাউকে দেয় না। তবুও … তার ইচ্ছে তাকে কোন্ এক অজানা জগতে টানছে। কুঁরগি পেরিয়ে রামচকের বাইরে সে জগৎ। যেখানে দেবতার মূর্তি গড়া যায়। সেখানে হাতের কাজ দেখাতে পারলে মন জয় করা খুব সহজ। মাঝে মাঝেই আজ পঞ্চু পেছন ফিরে কুঁরগির স্রোতহীন অথচ নড়তে থাকা জল দেখছে। রাজহাঁসগুলো মুখে করে জলের ভেতর বৃথা গর্ত করছে।
পঞ্চু হাটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আজ তার ফেলে যাওয়া পথের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মালিনী। এমনটা সচরাচর হয় না। পঞ্চুর মাথায় ঝাঁকা তুলে নিজের গেরস্থালির কাজে ধাক্কা খায় সে। কিন্তু আজ ভোরের মৃদু আলোয় এত সজোর আঘাত ছিল, যত বেলা বাড়ছে, বুঝতে পারছে মালিনী। তখন থেকে সে নিজেকে আর রামচককে নিয়ে চিন্তায় সাঁতার দিচ্ছে। সে কী মুখ দেখাবে সকলের কাছে! পঞ্চু কেন এমন ভূতে ধরা কথা বলে গেল! এখনও যেন সে কোনো স্থির বিন্দুতে আসতে পারেনি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে টুকটাক কাজ করছে। নাহলে বসেই আছে মাথায় হাত রেখে। দুয়ারের এক কোণে চাক। শুকনো মাটি চিটে আছে। যে কোনো সময় ছেড়ে পড়বে।
মেঘলায় বেলা ভুল হয়। হাটের লোকজন পাতলা হতে শুরু করে। পাশেই ছুতোরের ঠকাঠক শব্দে পসরা গোটানো। স্থির স্থাণু পঞ্চুকে যেন কেউ পেছন থেকে ঠেলা দিল। যন্ত্রের মতো বাকি থেকে যাওয়া জিনিসগুলি ঝাঁকায় গোছাতে শুরু করে। পসরা হালকা হয়েছে। কোমর নুইয়ে নিজেই ঝাঁকা তুলে নিতে পারে। কোমরের দোল নেই। সে গতি নেই।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২