ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ৩)

শেয়ার করুন

৭.

মালিনী পলি রেখে গেছে পাশে। গরু দুয়ে তাদের ছেড়ে আসবে মাঠে। ফিরে এসে পঞ্চুর মাটির কাজে হাত লাগাবে। দুটো গরু আর বাছুর নিয়ে গোয়াল থেকে বেরিয়ে প্রথমে কিছুটা অবাক, পরে চটে গিয়ে গরুর দড়ি ছেড়ে সোজা এসে দাঁড়াল পঞ্চুর ঘোরে।—কত কাজ পড়ে আছে, সে খেয়াল আছে নাকি ভাবের ঘরে বসে বসে ধ্যাঙড় লাচ দেখলেই হবে? আমি ভোর থেকে উঠে খেটে মরি, আর উনি বাবু রাতদিন আঙুলের দিকে চেয়ে চেয়ে রূপ দেখবেন। 
লতাক করে পড়ে গেল পঞ্চু। নির্বল হয়ে শুধু বসে বসে ভাবনার মানুষ সে নয়। তবু… আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ভারী শ্বাস ছাড়ে সে। বাম ঊরুর অনেকটা অংশ খোলা থাকতে দিয়ে মালিনী কাপড় গুঁজে নেয় কোমরে। খর পায়ে গিয়ে দড়ির টান দেয় গরুতে।
—মাটি পুড়িয়ে পুড়িয়ে এখন আমার কপালটাই পুড়াচ্ছে… দিন রাত কিসের এত ভাবনা জানিনি…

৮.

পঞ্চুর ঘর। ভিজে মাটির দুয়ার। কাঁথের দেওয়াল। হঠাৎ একবার চোখ মেলে দেখলে মনে হয়, পা মেলে বসে আছে টানটান মেরুদাঁড়ার এক লোক কিংবা এক মেয়ে, দুয়ারের মতো কোল মিলিয়ে। বাম হাত মাটিতে রাখা। দুটি কামরা এখনও অন্ধকারপ্রায় অথবা বাইরের আলো দেখে ঝলসা চোখে অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। সামনে ঘামে ভেজা পায়ের মতো দুয়ার দক্ষিণমুখো। আর বামহাতে এককালে দুয়ার ছিল হয়তো, এখন গলি। রোগা। জিনিসে গন্ধে ঠাসাঠাসি। একের মুখ আর অন্যের পেছন জড়াজড়ি করে থরে থরে সাজানো আছে পোড়া মাটির হাঁড়ি। পাশাপাশি দুটো হাঁড়ির বগল ফাঁকে অজস্র চোখ। সে চোখের গভীরতা পেছনের বেড়া দেওয়া দেওয়াল পেরিয়ে নগ্ন নির্জন মাঠে গিয়ে অগভীর হয়ে পড়ছে।
চাকে বসবে পঞ্চু। বাবলা কাঠের চাক। রামচক জানে না ঘুণের ক্ষত। ক্ষতের কোনো ইতিহাস নেই রামচকে। ঘুণের গোপন কর্মকে প্রশ্রয়ের প্রশ্ন নেই। তবু মাটির ক্ষত থেকে তারা বোঝে, আত্মাকেও ধুয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করার নিরলস তাগিদ। কেবল শক্ত আর মাটির আদরে নরম নেতিয়ে যায় না বলে পঞ্চুর পূর্ব পুরুষেরা বাবলায় শেষ পিন পুঁতেছিল। বাবলা কাঠের চাক দেখলে মনে হয়, এই চাকা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, এই চাকা তুলতে গিয়ে কোনোদিন কাউকে তির নিতে হয়েছিল বুকে—ভাবা যায় না। যা ভাবা যায় তা রামচককে ভাবানো যায় না। এক আঙুলে তুলে এই চাকাকে শূন্যে ঘোরালে যেমন মনে হয়, ঠিক তেমন দেখাচ্ছে পঞ্চুর চাক।
পঞ্চুর ঘরের নৈর্ঋত কোণের আমগাছটায় ডেকে ডেকে সারা হয়েছে কাকের বাচ্চারা। মা উড়ে গেছে কোন্ সকালে। পঞ্চু উঠে দাঁড়ায় চিটচিটে ভাবনা নিয়ে। হাতে চিটালো কাদার মণ্ড। লুঙ্গিটা এখনও হাঁটু অবধি নামেনি। গুটিয়ে আছে পাছার মায়ায়। জোয়ান রোদের জন্য ছানাদের দিকে আর চোখ নিয়ে যাওয়া হয় না পঞ্চুর। তাছাড়া এখুনি গিয়ে চাকে না বসলে, মালিনীর অভিমান হবে। লাউগাছে মোড়া ঘরের উঠোনের ঘোমটা পেরিয়ে পঞ্চু আধো অন্ধকারে যেন আরও অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। গিয়ে বসে চাকের কাছে রাখা গাছের কাটা গুঁড়ির ওপর। ময়লা। বয়সের দাগ গেছে মুছে। জায়গা করে দিচ্ছে এক সৃষ্টিকর্তাকে। 

পঞ্চুর পায়ের পেশি প্রস্থে দ্বিগুণ হয়ে ওঠে ভাঁজের ভারে। সামনের লুঙ্গি লুটিয়ে থাকে। ঘষা খায় চাকের গতি। কাদার তাল মাঝে রেখে চাক ঘোরায় পঞ্চু। নিজের আঙুলগুলো রাজহাঁসের পেটের মতো নরম মনে হয় তার। মেপে মেপে ঘোরাফেরা করে হাঁড়ির গলায় ঠোঁটে পেটে। বামহাতের পেশী উঁচিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেয় সে। ভাঁড়ে রাখা কাদাজল মেখে হাত বুলিয়ে দেয় হাঁড়ির মালিনী দেহে। এই কাজ সে করে দরদ দিয়ে। মুখে চোখে সৃষ্টির রহস্য। চোখ জ্বলে উঠছে। পাশে রাতদিন স্থির বসে থাকা ভাঁড়ের কানে ঝোলানো সুতো দিয়ে কেটে নেয় হাঁড়ি। কাকের ছানারা শান্ত হয়েছে, টের পায় পঞ্চু। আবার একটা হাঁড়ি উঠবে। তারপর আবার। আজ শেষের হাঁড়িটা একটু বেশি সময় নিয়েই বানায় পঞ্চু। ঘূর্ণিচাকের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। দু’ হাত অসহায়ের মতো হাঁড়ির গলায় স্থির।
—বাইরে যেতে চাই রামচকের,
—আরো রকম উঠে আসবে হাত থেকে,নন্দবাবা—সেই সন্ধ্যা—আগুন—জোনাকি—তাদের পেটের নির্মল আলো…দিনের এত প্রখর আলোয় সেদিনের সন্ধ্যা পঞ্চুর কাছে একটা প্রবঞ্চনা মনে হল। এক দমকা বাতাসে আমগাছের শুকনো পাতাগুলো ঝরে পড়ছে শব্দ করে। সেই সন্ধ্যা মুছে যাচ্ছে, আগুন জোনাকি সব মুছে যাচ্ছে পঞ্চুর ক্যানভাস থেকে। আছে কেবল তার স্বপ্ন আর নন্দবাবা। পঞ্চু অনেক বড়ো মাটির শিল্পী হতে চায়, এই কথাটি মনে মনে চাকের ওপর থাকা হাঁড়িটায় জমে যায়। ঘুরছে।

কাটে না। তোলে না। মালিনীর কাপড়ের ঝপঝপ আর রামচকের সবথেকে সুখী কাকটার কা কা শুনে হাত খসে পড়ে পঞ্চুর। যত্ন করে কেটে তোলে হাঁড়িটা। তেলতেলে। মোলায়েম। আদর মেশানো। মালিনীকে লুকিয়ে হাঁড়িটা বসে আছে তক্তপোষের তলায়। অন্ধকার। কাঁচা দগদগে একটা স্বপ্ন হেঁটে বেড়ায় হাঁড়ির গা ধরে।


৯.

অনেকগুলো পড়ন্ত বিকেল পাশাপাশি রাখলে একটা আধটা আনকোরা মুহূর্ত সামনে আসে। উঁকি দেয় নতুন ভাবনার। অবকাশ করিয়ে নেয় ঘাড়ে ধরে। আজ বলাই ঘর ছেড়েছে অবকাশ সঙ্গে করে—নতুন করে ঘর পাবে তাই। প্রতিটি মানুষ আসলে ঘর ছাড়ে—নতুন করে ঘরের মর্ম বুঝবে বলে। ঘরে ফেরার আনন্দ বুঝতে। সন্ধ্যায় ফিরে একঝাঁক অন্ধকার মেশানো ঘর তাকে কী দিতে পারে, এই ভাবনা খুঁড়তে খুঁড়তে পথ হাঁটতে থাকে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে পূর্বে মুখ। কিছু দূর গিয়ে দক্ষিণে। পায়ে পায়ে যেন কত ভালোবাসা জড়িয়ে আছে বলাইয়ের। এই রামচক তার কাছে স্বপ্ন। উপুড় করা এক কচ্ছপের ছবি প্রায়ই ঘুমচোখে ভেসে ওঠে তার। পা ছুঁড়ছে শূন্যে। ঘামজল কপাল থেকে ঢাল বেয়ে নেমে যায় কুঁরগির মতো সুন্দরীতে। ভুল দেখছে সে। স্বপ্নের ভেতর ঘাড় কাত করে দেখতে পায় জটিল জল এঁকে বেঁকে নিষ্ঠুর হাসি তুলছে। ধারালো দা নিয়ে একজন এগিয়ে আসে। হাত জোড় করে গলার শিরা ফুলিয়ে… না, তার শব্দে কোনো হেলদোল নেই ঘাতকের। স্বপ্ন কেটে যায়। কিছুই করার নেই তার। কিছু করার ছিল না। ভিজে চোখ আর ঘুম ঘুম মুখের ওপর দিয়ে অনেকটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। এরকম স্বপ্ন প্রতিবার স্বপ্ন হয়েই থেকে যায় বলেই বলাই এখন অবকাশে পথ হাঁটছে কুঁরগির দিকে। —কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে না। তবে এই ভেজা বাতাস? সেই ভুল করে ভাবা কুঁরগির ঢেউ খেলানো মায়াচোখ থেকে নয় তো? 
চোখে মুখে জল নিয়ে ভুল মেনে নেয় বলাই। এমন স্বপ্ন সে আকছার দেখতে থাকে। তাড়া করে। মাড়িয়ে চলে মনটাকে। এখন সে আর ভাবে না। বাস্তবে এমন কিছু হয় না। হতে পারে না। তাই এ নিয়ে না ভাবাই ভালো মনে করে বলাই। তাছাড়া সে সুখী থাকে এক কাপড় ঘেরা আচ্ছাদনের ভেতরে আছে—এই ভেবে। এই আচ্ছাদন কুঁরগি। স্বপ্নের নিষ্ঠুর সুন্দরী নয় সে। রামচকের ভেতর গা এলিয়ে একটা অমৃতধারা শুয়ে আছে যেন। 

নরম চোখ মেলে রামচক দেখতে দেখতে বলাই এগিয়ে চলে কুঁরগির বুকে। পরমা রামচকের হিসাবে সুন্দরী। পরমার গায়ে মনে মাখামাখি হয়ে বলাই ওই ঝুলে আসা সূর্যের মুমূর্ষু আলোতেও হঠাৎ কোনো নিঃশেষিত নাবিককে ভালোবাসতে শুরু করে। বাতাসকে জানার সুযোগ করে দেয় পরমা তার কাছে কত পরম! রামচকের অশোক, সমীর থেকে শুরু করে রতন, চন্দন, সুকুমার এমনকি বলাইয়ের স্ত্রী আলো—সবাই পরমাপুরাণ সম্পর্কে সব জানে। কারো চোখের ওপর ভ্রূ কোঁচকায় না, কেউ ঠোঁট থেকে ঠোঁট আলতো আলগা করে মনে মনে হাসে না। সবাই জানে, ঘোড়ামাঠের ওই বকুল গাছটার মতো ভালোবাসা সব অন্ধকার শুষে নেয়, আর রাজহাঁসগুলোর নরম পালকের খাঁজে খাঁজে ঢেকে থাকা শরীর সবথেকে বড়ো সত্যি হয়ে প্রায় অদৃশ্য তারা হয়ে আকাশে জেগে ওঠে।

বলাই এখন পরমাকে পেতে পারে কুঁরগির বাহুতে কিংবা কোনো ব্যস্ত পায়ের অচল রাস্তায় মুখোমুখি। তাকে বাম বাহুতে জড়িয়ে খোঁপা কিংবা এলোচুলের স্বাদ নেবে। রাস্তার দুপাশে কেউ কেউ দুজনকেই স্বাগত জানাতে চায়। কেউ মিঠা হেসে কুশল জানতে চায়। শিশুরা খেলার ছলে কাছে ঘেঁষে। বলাই পরমার ফিসফিস সুবাস বোধহয় গোপনে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। কাখ থেকে বছর চারেকের ছেলেকে নামিয়ে মৃদু হাসি উড়িয়ে একটি বউ ঘরে দৌড়ে যায় স্বামীকে জানাতে। ডেকে দেখাতে। ফিরে এসে দেখে, রামচকের আর পাঁচটা যুগলের মতো বরগা কড়ি মুথুন কাঁথ দেওয়া অসংখ্য ছোটো ছোটো সুখী গৃহকোণ বানাতে বানাতে কিংবা বানানোর আশা জাগিয়ে বলাই-পরমা বাস্তুর পর বাস্তু কেটে এগিয়ে যায়। 


১০.

পঞ্চুর ঘর আর খামার পেরিয়ে রাস্তাটা প্রায় দশ পাউড়ি। সারা সকাল মালিনীর মুখ ঝামটা আর সেই চোরাই ভাবনাটার কাছে উবু হয়ে ব’সে জেগে থেকে থেকে পঞ্চু এখন ক্লান্ত। দুপুরে পরিশ্রান্ত কাকের বাচ্চাগুলো আধো তরল খাবার গলায় নিয়ে গাছের উঁচু বাতাসের সঙ্গে নিজেদের মোলাকাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাটিতে মাদুর পেতে এক নতুন মাটির স্বপ্ন গড়েছে পঞ্চু। সেদিনের সন্ধ্যা আর নন্দবাবার কথা সে মানতে পারছে না। কুঁরগি বেয়ে ওপারে যাবেই। হাতের কাজ দেখাবে অনেক মানুষকে। যারা মুগ্ধ হয়ে তালি আর বাহবা দেবে। পঞ্চু হয়ে উঠবে খ্যাত। জন্মে জন্মে বোধহয় এটাই চেয়েছে সে। এ জন্মে এই সুযোগ আর হাতছাড়া করা যায় না। রাজহাঁসের মায়া সে ত্যাগ করবে। ঘোড়ামাঠ, বলাই, নন্দবাবা, মালিনী—পুরো রামচকের মায়া কাটানো মুশকিল। তবু সে যাবে। আত্মার তৃপ্তি। হাতের কাজ। শিল্প। মাদুর ছেড়ে উঠে বসে। লুঙ্গিতে শক্ত গিঁট দেয় যেন এখুনি ভাবা ভাবনাটা খসে না পড়ে। বিকেল হয়েছে বোধহয়। বাইরে বেরিয়ে এসে চোখ দুটো কচলে নেয় সে। আমগাছটার শরীর ভেদ করে কে–কারা যেন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। কী মধুর চলন! মাটি যেন বুক পেতে আছে তাদের ভার নিতে! সামনে এলে পঞ্চু বুঝতে পারে আসলে দুজন অভিন্ন হয়ে পথ হাঁটছে। বলাই-পরমা। এ দৃশ্য রামচকে নতুন নয়। ভালোবাসার সঙ্গী এখানে দিন দিন পালটে যেতে পারে। কারো কোনো মাথাব্যথা নেই তাতে।

পা থেকে লুঙ্গিটা তুলে পাছার ওপর চেপে একটা জোরালো গিঁট দেয় পঞ্চু। আজ এখনই বলাইয়ের কাছে তার স্বপ্ন আর ভাবনার কথাটা পেড়ে ফেলা যায়। এমনিতে সন্ধের সময় ঘোড়ামাঠে বলাই বসে। কিন্তু তখন সঙ্গে থাকতে পারে নন্দবাবা কিংবা কবিও। কিংবা আরও কয়েকজন। পঞ্চু গাঁঠে গাঁঠে শব্দ তুলে এগিয়ে আসে হাসি মুখে। বলাই তাকে দেখে প্রসন্ন। কুশল মঙ্গল সংবাদ দেওয়া নেওয়া হলে পঞ্চু মনের কথাটা পাড়তে গিয়েও নিজের অজান্তেই থমকে যায়। এ সময় বড়ো মধুর। পাশে পরমা।বলাই পরমা হাঁটতে শুরু করে কুঁরগির দিকে।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২