শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা – এল. বীরমঙ্গল সিংহ (পর্ব ২)

শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা – এল. বীরমঙ্গল সিংহ (পর্ব ২)

শেয়ার করুন

সিলেট ভ্রমণ শেষে ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে কবি আগরতলায় আসেন ২৩ কার্তিক (৯ই নভেম্বর ১৯১৯)। তিনি মহারাজাকে অনুরোধ করেন, ত্রিপুরা থেকে একজন অভিজ্ঞ মণিপুরি নৃত্যগুরুকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। এ বিষয়ে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, “মহারাজাকে অনুরোধ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষার জন্য একজন মণিপুরি নর্তককে দেবার জন্য। মহারাজা প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে তাঁর দরবার থেকে নর্তক বুদ্ধিমন্ত সিংহকে পাঠালেন, মাঘ মাসের প্রথম দিকে।” (গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, পৃ : ৯)
শান্তিদেবের কথা অনুযায়ী বুদ্ধিমন্ত শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন ১৯২০ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে। কিন্তু ‘রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা’-য় রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্থের কথা উল্লেখ করে লেখা হয়েছে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত অগ্রহায়ণ ১৩২৬ অর্থাৎ ১৯১৯ সালের নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ থেকে শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা দিতে শুরু করেছেন। 
“বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হইলে শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের মধ্যে মণিপুরি নৃত্য প্রবর্তনের চেষ্টা হইয়াছিল। ত্রিপুরা থেকে বুদ্ধিমন্ত সিংহ নামে এক বিখ্যাত নৃত্য শিল্পীকে আনানো হয়, বালকরা তাহার খোলের বোলের সঙ্গে নৃত্যশিক্ষা শুরু করে (১৩২৬ অগ্র:)।” (রবীন্দ্রজীবনী ৩য় খণ্ড, পৃ – ২২১)
প্রশান্ত পালও তার ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থে এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন, “সিলেটে মণিপুরি নৃত্য দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বীরেন্দ্রকিশোরকে অনুরোধ করেন একজন মণিপুরি নৃত্যশিল্পীকে শান্তিনিকেতনে পাঠাবার জন্য। এই অনুরোধ রক্ষা করে মহারাজ কিছুদিনের মধ্যেই ত্রিপুরাবাসী মণিপুরি নৃত্য ও কারুশিল্পী কুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহকে সেখানে প্রেরণ করেন (রবিজীবনী, ৭ম খণ্ড, পৃ : ৪৪৮)। তাই বলা যায়, অগ্রহায়ণ ১৩২৬ অর্থাৎ ১৯১৯ সালের নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা চালু হয়েছিল। শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষক পাঠানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯শে মাঘ ১৩২৬ (২রা ফেব্রুয়ারি ১৯২০) মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোরকে একটি পত্র লেখেন—“মহারাজ বুদ্ধিমন্ত সিংহকে আশ্রমে পাঠাইয়াছেন সেজন্য আমরা আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হইয়াছি। ছেলেরা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার নিকট নাচ শিখিতেছে। আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মণিপুরি শিল্পকার্য্য শিখিতে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছে। মহারাজ যদি বুদ্ধিমন্ত সিংহর স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে। আমাদের দেশের ভদ্রঘরের মেয়েরা কাপড়বোনা প্রভৃতি কাজ নিজের হাতে করিতে অভ্যাস করে ইহাই আমাদের ইচ্ছা। এইজন্য আসাম হইতে একজন শিক্ষয়িত্রী এখানকার মেয়েদের তাঁতের কাজ শিখাইতেছে। কিন্তু সিলেটে মণিপুরি মেয়েদের যে কাজ দেখিয়াছি তাহা ইহার চেয়ে ভাল। আমি বুদ্ধিমন্তের নিকট আমার প্রস্তাব জানাইয়াছি। সে মহারাজের সম্মতি পাইলেই তাহার স্ত্রীকে এখানে আনাইয়া এখানকার মহিলাদিগকে মণিপুরি নাচ ও শিল্পকার্য্য শিখাইবার ব্যবস্থা করিতে পারিবে এরূপ বলিয়াছে। এইজন্য এসম্বন্ধে মহারাজের সম্মতি ও আদেশের অপেক্ষা করিয়া রহিলাম। 
ভগবান আপনার কল্যাণ করুন এই কামনা করি। ইতি—১৯ শে মাঘ, ১৩২৬।” (রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ : ৩১৪)
বুদ্ধিমন্ত ও তার সঙ্গী গরমের ছুটিতে বাড়িতে আসার পর আর শান্তিনিকেতনে ফিরে যাননি। মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর তাঁকে রাজ্যের কারুশিল্প শিক্ষা সংস্থা ‘শিল্পাশ্রম’-এর সিনিয়র সুপারিটেন্ডেন্ট পদে নিয়োগ করেন। ফলে বুদ্ধিমন্তের স্ত্রীর আর শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি। বুদ্ধিমন্ত শান্তিনিকেতন থেকে নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি মহারাজা ব্রজেন্দ্রকিশোরকে বলেছেন, “প্রথম দিকে মেয়েরা বুদ্ধিমন্তের নির্দেশ মত তাহার সঙ্গে পদক্ষেপ ও অঙ্গসঞ্চালন করিতে স্বীকৃত হইতেছিল না। রবীন্দ্রনাথ তখন বয়োবৃদ্ধ। তিনিই অগ্রণী হইয়া বুদ্ধিমন্তের নির্দেশ অনুযায়ী অবলীলাক্রমে নৃত্য শুরু করেন—তখন মেয়েদের লজ্জা ভাঙে। ইহাই বাংলায় মেয়েদের নৃত্যশিক্ষায় প্রথম পদক্ষেপ”(তদেব, পৃ : ৮০)।
শান্তিনিকেতনের প্রথম নৃত্যগুরু চলে যাওয়ার বছর পাঁচেক পর রবীন্দ্রনাথ স্থির করলেন বিশ্বভারতীর শিক্ষা ব্যবস্থায় নৃত্যচর্চাকে স্থায়ীভাবে স্থান দেবেন। তিনি আগরতলায় মণিপুরি মেয়েদের নাচ দেখেছিলেন। তাই তিনি মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরকে খবর পাঠালেন একজন মণিপুরি নৃত্যগুরুকে পাঠাবার জন্য। “ব্রজেন্দ্রকিশোর, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে নবকুমার সিংহ এবং তার ভ্রাতা বৈকুণ্ঠনাথ সিংহকে পাঠিয়ে দেন।” (গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, পৃ : ২০)। নবকুমার বাছাই করা একদল ছাত্রী নিয়ে আড়ালে নাচের শিক্ষা দিতে শুরু করেন। নভেম্বর মাসে সে সময়ের বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করতে শান্তিনিকেতনে আসেন। “তাঁকে (গভর্নর) অভ্যর্থনা জানানো হয় নবকুমারের শেখানো মণিপুরি নাচের এক অনুষ্ঠানের দ্বারা। ছাত্রীরা সেদিন মণিপুরি রাসলীলার কিছু অংশ দেখিয়েছিলেন।” (তদেব, পৃ : ২০)।মণিপুরি নৃত্যধারায় ও বাংলায় নৃত্যচর্চার ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। এই নিবন্ধে আগেও উল্লেখ করেছি, মণিপুরি নৃত্যমণ্ডপ ও মন্দিরকেন্দ্রিক এবং ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গিত। মঞ্চে লোক মনোরঞ্জনের জন্য এই নৃত্য প্রদর্শিত হত না। ঠিক তেমনি সে সময় বাংলায় শিক্ষিত ভদ্রঘরের মেয়েরাও নৃত্যচর্চায় অংশ নিত না। রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় নবকুমারের উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে বাংলার গভর্নরের আগমন উপলক্ষ্যে সেদিন সামাজিক নিষেধের এই লক্ষণ রেখা মুছে ফেলা হয়েছিল। মণিপুরি নৃত্যকে প্রথম মঞ্চে বিনোদনের জন্য উপস্থাপিত করা হল। এর পথিকৃৎ হলেন ত্রিপুরার স্বনামধন্য নৃত্যগুরু পাঙনবম নবকুমার সিংহ। এ ঘটনার একযুগ পরে চল্লিশ দশকের পর থেকে মনিপুরের নৃত্যকে মঞ্চে উপস্থাপন করা শুরু হয়।
প্রতিমা দেবী স্থির করেছিলেন, ১৯২৬ সালে ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ৬৫তম জন্মদিনে ছাত্রীদের দিয়ে ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূজারিণী’ কবিতাটির গল্প অবলম্বনে নবকুমারের সহযোগিতায় নৃত্য সহযোগে একটি মূকাভিনয় করাবেন। কবিগুরু সে কথা শুনে কবিতাটির পূর্ণাঙ্গ নাট্যরূপ দিয়ে নাম দিলেন ‘নটীর পূজা’। নিজে ছাত্রীদের নির্বাচন করে তাদের অভিনয় শেখানো এবং মহড়া পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। গানের সঙ্গে নৃত্য রচনার ক্ষেত্রে নবকুমার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন। কবির জন্মদিনে প্রথম অভিনীত হল ‘নটীর পূজা’। নটীর পূজা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, “নাটকটি শেষ অংশে ভৈরবী রাগিনীতে রচিত ‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো’ গানটির সঙ্গে শ্রীমতী গৌরী দেবীর মণিপুরি নৃত্য সহযোগে শ্রীমতি’র আত্মনিবেদনের অভিনয় সেদিন শিশু থেকে বয়স্ক দর্শকদের সকলের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে আত্মনিবেদনের উচ্চভাবকে গানে এবং নাচেও যে প্রকাশ করা সম্ভব এবারেই দর্শকরা প্রথম অনুভব করলেন। কলিকাতা থেকে আগত মুগ্ধচিত্ত দর্শকেরা বারে বারে গুরুদেবকে অনুরোধ করে গেলেন, নাটকটি কলকাতায় মঞ্চস্থ করবার জন্যে।” (তদেব, পৃ : ২২)
১৯২৭ সালে কলকাতায় আবার অভিনীত হল ‘নটীর পূজা’। নৃত্যের ভাব মাধুর্য, লালিত্যময় অঙ্গভঙ্গি তখন শিক্ষিত ভদ্রসমাজকে তখন মুগ্ধ করে। সকলের সামনে মঞ্চে শিক্ষিত ভদ্র পরিবারের মেয়েদের নৃত্যানুষ্ঠান সম্ভবত এটিই প্রথম। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী দেবী এর সূচনা করলেন নৃত্যগুরু নবকুমারের কাছে তালিম নিয়ে। ‘নটীর পূজা’-র অভিনয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’ বইয়ে লিখেছেন, “নটীর পূজার অভিনয় বাংলার সামাজিক ইতিহাসে একটি নতুন পরিচ্ছেদের সূচনা করল। কলকাতার জনগণের সম্মুখে বোধহয় এই প্রথম কোনো ভদ্র গৃহস্থ ঘরের কন্যা ও বধূ নৃত্যকলার সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হল। নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী সদ্যবিবাহের পর নটীর ভূমিকায় নামলেন। সেদিন থেকে বাঙালি মেয়েদের পদযুগলে নূপুর নিক্কনের… ধ্বনি উন্মোচিত হল নৃত্যের তালে।” (পৃ : ১৩৬)
রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নবকুমারের নৃত্য সংযোজনা সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, “নবকুমার সিংহ গুরুদেবের গানের সঙ্গে মণিপুরের নৃত্যের ‘গমক’ প্রথাটির উপরেই বিশেষ জোর দিয়েছিলেন এবং খোলের বোলের সঙ্গে দলবদ্ধ নাচও শিখিয়েছিলেন। এইভাবে গুরুদেবের গানের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র নৃত্য প্রথা নবকুমারের শিক্ষকতায় নটীর পূজার অভিনয় থেকে শান্তিনিকেতনে প্রথম প্রবর্তিত হয়।” (পৃ : ২৭ )। এখানে উল্লেখ্য, ‘গমক’ হচ্ছে সাংকেতিক অভিনয়। গানে যা ব্যক্ত হল তা নৃত্যের মাধ্যমে সংক্ষেপে সংকেত করাই এর কাজ। নবকুমার সিংহ সফলভাবে শান্তিনিকেতনে নৃত্যচর্চার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন।                         (শেষাংশ ওয়েবজিনের আগামী সংখ্যায় )

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২