সাহিত্যাকাশে নারী জ্যোতিষ্ক- আশাপূর্না দেবী-সুনন্দ মন্ডল

শেয়ার করুন

        চিরকালের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের স্নেহ-প্রেম ও দুঃখময় জীবনকে যিনি বাংলা সাহিত্যে পরিস্ফুট করেছেন–তিনি আশাপূর্না দেবী। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখিকা। রক্ষণশীল সমাজে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তৎকালীন(১৯০৯) পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের স্বাধীনতা ছিলনা স্কুল-কলেজে পড়ার। সেই রক্ষণশীল পরিবারেই তাঁর বিয়ে হয়। পুরুষশাসিত সমাজ-সংসারে চার দেয়ালের মধ্যে বন্ধ থেকেও, এমনকি বাইরে ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় না করেও লেখালেখি চালিয়ে গেছেন।

‎বৈবাহিক সূত্রে শ্বশুরবাড়ি এসেই পেয়ে যান লাইব্রেরী। যেখানে সংরক্ষিত থাকত মাসিক পত্র-পত্রিকা। এছাড়াও মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র রচনাবলী ছিল। সেইসব পাঠ করে তিনি মনের সাহিত্য ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে শুরু করে ছিয়াশি বছরেও যার কলম থামেনি–তিনিই তো বাংলা সাহিত্যে অনন্যা স্বয়ংসিদ্ধ- আশাপূর্না দেবী।

           আশাপূর্না দেবী এমন একজন প্রতিভা, যিনি বদ্ধ থেকেও মুক্ত মনে নারীদের জীবনদর্শন, রক্ষণশীল সমাজের ভূমিকা এবং স্নেহ-প্রেম-দুঃখময় জীবন সম্পর্কে যে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন সাহিত্যের পাতায়, তা একরকম যথার্থ শিল্পী হওয়ার দাবি রাখে। সময় সমাজ ও তার চারপাশে বয়ে যাওয়া জীবনস্রোতই আশাপূর্না দেবীর একমাত্র শিক্ষক। তাছাড়া সাহিত্যকীর্তির পথে সবচেয়ে অবদান তাঁর মা। এমনকি এব্যাপারে সবসময় উৎসাহ পেতেন স্বামী কালীপদ সেনগুপ্তের কাছেও।

মাত্র তেরো বছর বয়সে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতা ‘বাইরের ডাক’। পনেরো বছর বয়সে ‘খোকাখুকু’ পত্রিকায় ‘স্নেহ’ নামে কবিতা লিখে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। আর আশাপূর্না দেবীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ছোটদের জন্য ‘ছোট ঠাকুরদার কাশীযাত্রা'(১৯৩৮) এবং বড়দের জন্য প্রকাশিত প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘জল আর আগুন'(১৯৪০)। সেইসঙ্গে প্রথম উপন্যাস ‘প্রেম ও প্রয়োজন’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে।

           ১৯০৯ থেকে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবনকালে তিনি পাঠকবর্গকে উপহার দিয়েছেন প্রায় ১৭৬ টি উপন্যাস, ৩০টি গল্পসংকলন, ৪৭টি ছোটদের গ্রন্থ ছাড়াও রয়েছে নানাবিষয়ে অজস্র গ্রন্থ। বেশিরভাগ ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যে তাঁর অমরত্বের কারন হল–চিরকালীন বাঙালি জীবনের ছবি। তিনি বলেছেন,”যা দেখেছি আর দেখে যা মনে হয়েছে সেটাই লিখে চলেছি।” এজন্য তিনি পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার। পদ্মশ্রী, দেশিকোত্তম, জ্ঞানপীঠ এবং ডি.লিট উপাধি।

         আশাপূর্না দেবী যখন সাহিত্যকর্মে আবির্ভুত হন তখন নানা জ্যোতিষ্কের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে সাহিত্যের আকাশে জ্বলজ্বল করে ওঠেন এই নারী জ্যোতিষ্ক। যিনি আমার চিরকালীন প্রেরণার। তিনি নারীবাদী নন, কিন্তু নারীর স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছেন স্পষ্টভাবে। পরিবর্তিত সমাজ ও পরিবর্তিত মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাল্টে নিয়েছেন নিজেকে। পরিপূর্ণ অখন্ড জীবনবোধ ছিল তাঁর শিল্পসত্তার মূলে।

          নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম আশাপূর্না দেবী। তিনি যেসব উপন্যাস লিখে গেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয়তার দাবি রাখে এমন কয়েকটি হলো–‘মিত্তির বাড়ি'(১৯৪৭), ‘বলয়গ্রাস'(১৯৫২), ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘কল্যাণী’, ‘শশীবাবুর সংসার’, ‘নেপথ্য নায়িকা’, ‘যোগবিয়োগ’, ‘ছাড়পত্র’, ‘উত্তরলিপি’, ‘আংশিক’ ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প সংকলন হলো–‘শ্রেষ্ঠগল্প’, ‘গল্পসমগ্র’, ‘নায়িকা পঞ্চবিংশতি’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত ‘ছিন্নমস্তা'(১৯৪৯) একটি অসামান্য শ্রেষ্ঠ গল্প।

             তাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে তুলে ধরতে হলে বেশকিছু রচনার বিশ্লেষণ ও আলোচনা প্রয়োজন। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কয়েকটি প্রধান প্রধান রচনার ওপরে আলোকপাত করা হচ্ছে।

            এক যৌথ পরিবারের জীবনকাহিনী বিবৃত হয়েছে ‘মিত্তির বাড়ি’ উপন্যাসে। সেখানে হেমলতা, অলকা, মীনা চরিত্রগুলি জীবন্ত। ‘শশীবাবুর সংসার’এ শশীবাবু, মন্দাকিনী, সুমিত্রা, পরেশ প্রমুখ চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত ও সমস্যার কথা বর্ণিত হয়েছে।

           সুরুপা ও অনিমেষের জীবন কাহিনী, সমস্যা, টানাপোড়েন গুরুত্ব পেয়েছে ‘নির্জন পৃথিবী’তে। নায়িকা মাধবীর মানসিক টানাপোড়েন, বোনের স্বামী বাসুদেবের প্রতি আকর্ষণ মনস্তত্ত্ব সম্মত ‘নেপথ্য নায়িকা’। ‘অগ্নি পরীক্ষা’য় বুলু ও তাপসীর প্রেম। ভারতের প্রচলিত আদর্শ ফুটে উঠেছে। একান্নবর্তী পরিবারের ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাত চিত্রিত হয়েছে ‘যোগ বিয়োগ’ উপন্যাসে।

            আশাপূর্না দেবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি'(১৯৬৫)। এর পরবর্তী খন্ড হল ‘সুবর্নলতা'(১৯৬৬) এবং ‘বকুলকথা'(১৯৭৩)। যা আলোচনা না করলে সমগ্র সাহিত্য জগৎ বৃথা। এই উপন্যাস তিনটিকে একত্রে ‘ত্রয়ী’ উপন্যাস বলে। উনিশ শতকে কলকাতায় মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা হলেও গ্রাম ছিল অন্ধকারে। সেই গ্রামগুলিকে বদলাতে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন লেখিকা তাঁদের স্মরণ করেছেন এই গ্রন্থে। ট্রিলজি উপন্যাস প্রধানত তিন প্রজন্মের তিনটি নারী। মা,মেয়ে ও নাতনির দুঃখময় ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠেছে।

                 ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র নায়িকা সত্যবতী। যার বয়স মাত্র আট। পিতার কাছেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখেছে সে। সে স্বামীকে বলে, “বাবা-মায়ের হাতে পায়ে বেড়ি হয়ে থাকাটা কোন কাজের নয়।” সত্যবতী চিরকাল অবিচার ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। ষোল বছরের আগে বিয়ে দিতে চায়নি সুবর্নর। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছে সত্যবতী।

              ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র শিক্ষিতা বধূ সত্যবতী কন্যা সুবর্নলতাকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চাইলেও শাশুড়ি ও স্বামীর জন্য তা পারেনি। ন-বছরের সুবর্নর বিয়ে হয়ে গেলে অভিমানী সত্যবতী এক নিঃস্ব জীবন অতিবাহিত করে।

              ‘সুবর্নলতা’ হল সত্যবতীর কন্যা সুবর্নর কাহিনী। সেও পিতা-মাতা-স্বামী ও সন্তানদের কাছ থেকে শুধু অবহেলায় পেয়েছে। আর ‘বকুলকথা’ হল সুবর্নলতার ছোট মেয়ে বকুলের কথা। সত্যবতীর মতো সুবর্নলতা তেজ না পেলেও নীরবে সেই নারীমুক্তির আকাঙ্খাকে লালিত করেছে। তা ফলবতী হয়েছে বকুলের জীবনে। এই ট্রিলজি উপন্যাসে লেখিকা আশাপূর্না দেবীর আত্মদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।

             উপন্যাস আশাপূর্না দেবীকে অনেক প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে কিন্তু ছোটগল্পও তার অবদানে উল্লেখযোগ্য দাবি রাখে। নারী জীবনের গভীর অনুভূতি আশাপূর্ণার গল্পে ব্যক্ত হয়েছে। জীবনের নিষ্ঠুরতম সত্যগুলি, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, বিড়ম্বনার কাহিনী গুলি তিনি যেন স্পষ্ট ও নিপুণ দক্ষতায় খোদাই করে কালস্রোতে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

                 ব্যক্তি আশাপূর্না ছিলেন সকলের বড়। তাঁর আচার ব্যবহার উল্লেখ করার মতো। স্নেহ-মায়ায় পূর্ণ ছিল তাঁর মন। মানুষকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। কোন কৃত্রিমতা ছিলনা, তাই তিনি একজন খাঁটি মানুষ।

সুদীর্ঘ ষাট বছর ধরে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে ঘুরে বেরিয়েছেন স্বচ্ছন্দে। জীবনকে সম্পূর্ণরূপে দেখানোই ছিল তাঁর শিল্পী জীবনের ব্রত। তিনি সাহিত্যে চরিত্র গুলি নিপুণ ভাবে এঁকেছেন। তাঁদের জীবন যেমন কোমল তেমন কঠোর, যেমন মসৃন তেমন কর্কশ, যেমন মধুর তেমন তিক্ত, যেমন সুন্দর তেমন ভয়ংকর।

                আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে বিশেষ তথ্য উঠে আসে, যা বলতেই হয়। অবশ্য এগুলি তাঁর সাহিত্য রচনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য স্বরূপ। যেমন
‎১) গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে বহির্জগতের আকর্ষণ কিছুটা বিসদৃশ ভাবে মিশেছে। কোথাও রোমান্স জীবনে বৈচিত্র্য এনেছে।
‎২) যৌথ পরিবার ও ভেঙে যাওয়া পরিবার জীবনের সমস্যা চিত্রিত হয়েছে।
‎৩) সাধারণ কথা তিনি অসাধারন করে তুলেছেন।
‎৪) হাস্য ও করুন রস সৃষ্টিতেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন আশাপূর্না দেবী।

            সবশেষে বলতে পারি জীবন ও জগতের জটিল ও বৈচিত্র্যময় পরিস্থিতিতে নারী জ্যোতিষ্ক হিসাবে আশাপূর্না দেবী কৃতিত্বের শিখরে পৌঁছেছেন। যার কারনে তিনি সকল প্রিয় পাঠকদের মনের অঙ্গনে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে থাকবেন- মহিয়সী ও অনন্যা রূপে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *