যদি আর বাঁশি না বাজে… – সুমন চক্রবর্তী

যদি আর বাঁশি না বাজে… – সুমন চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

আমার মামাবাড়ি আপার আসাম অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মৌঝুমরি বলে একটা ছোট্ট, অনামী গ্রামে। ট্রেনে তিনসুকিয়া জংশন। সেখানে থেকে কিছু একটা চেপে মৌঝুমরি।

তখনও পর্যন্ত মৌঝুমরি ছিল বুড়ি দিঘঙের ধারে পড়ে থাকা সবুজে ঘেরা এক বিচ্ছিন্ন, অরক্ষিত দ্বীপের মতো। শাল, সেগুন, শিমুল, তমাল, পলাশ, শিরিষের সারিতে ঘেরা ছিল দিঘঙের এক দিকের কূল। অপ্রতিহত সেই আকাশচুম্বী বৃক্ষরাশি যেন বীর সেনানীর ঔদ্ধত্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদকে রক্ষা করার অবিচল সংকল্প নিয়ে! মনে হত, কত ধরনের সবুজের ছায়াচ্ছন্নতায় জিরিয়ে নিতে যেন শুয়ে আছে মৌঝুমরি গ্রামটা! পাখির কলকাকলি আর দিঘাঙের কলতান যেন গ্রামটার শব্দপটকেই দিত এক অন্য মাত্রা। পৃথিবীর কোনো ব্যস্ততাই যেন ছুঁয়েও ছুঁতো না একক নিঃসঙ্গের গানের মতো পড়ে থাকা মৌঝুমরিকে… মেঠো চাঁদই ছিল তার নিঃসঙ্গতাময় যাপনের একমাত্র সাক্ষী…

মেঠো চাঁদ আজও বুঝি রয়েছে তাকিয়ে, তোমারই মুখের দিকে, আর ভোরের শিশিরের জল ধুয়ে দেয় তোমাতে জমে থাকা দিনান্তের ম্লানিমাকে। কাস্তের মতো বাঁকা, মেঠো চাঁদের নীচে কুয়াশায় মোড়া ধূসর বুড়ি দিঘাঙের বুক চিরে অস্ফুট দাঁড়ের শব্দে আজও কি নৌকোর দল  উজান ঠেলে বেয়ে যায় দূর কোনো লোকালয়ে অনুপম, উর্বর মৃত্তিকার উদ্দেশ্যে? যেখানে আজও আসরের নামাজ আর আটচালার সংকীর্তন একই সুরে, স্বরে বাঁধা। 

ওই বুড়ি দিঘাঙের পারেই ছিল খাইরুল চাচার খাপরার চালের ঘর। খাইরুল চাচা দাদুদের কোনো এক সময়ের কায়েমি প্রজা হওয়ার সুবাদে, ওর বাড়িতেই ইজারায় দেওয়া তাল-খেজুর গাছের রস রেখে যেতেন গাছুইয়ের দল। মামাবাড়িতে থাকাকালীন নিয়ম করে একদম সূর্যোদয়ের সময়ে দাদুর হাত ধরে পৌঁছে যেতাম খাইরুল চাচার বাড়িতে শরিকি পাওনা খেজুর রসের বরাদ্দটুকু বুঝে নিতে। খাইরুল চাচা আড়বাঁশি বাজাতেন। শাল, শিমুল, তমালে ঘেরা নদীর পার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর থেকে শুনতে পেতাম খাইরুল মিঞার বাঁশির শব্দ। দাদু হাঁটতে হাঁটতে বলতেন, “বুঝলে ভাই, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বড়ো অভিমানী। আপন মনের মাধুরী মেশানোর জো’টি পর্যন্ত নেই… মিশেল সে মোটেও বরদাস্ত করে না… যেই না শুদ্ধের পরিবর্তে কড়ি মা’টি  লাগিয়েছো, অমনি অভিমানী ভৈরব নিজেকে গোত্রচ্যুত করে আহিরি আর কাফির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে হয়ে ওঠে আহির ভৈরব… এ এক মহা ফ্যাসাদ! জানি না খাইরুল জেনে করছে কিনা, ওই যে কড়ি মা’খান লাগাল, পর্দাটাই গেল পালটে। নতুন সুর, নতুন পর্দা, জন্ম দিল এক ভিন্নতায় ভরা শব্দপটের… দাদুভাই, দ্যাখো, গাছ ভরা পাখি স্তব্ধতার ভাষায় গান বেঁধে খাইরুলের সুরকে যেন স্বীকৃতি জানাচ্ছে।”  

একটু পরেই পুবাকাশকে ক্রমশ লাল হয়ে উঠতে দেখতাম… যেন অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে বুঝে ওঠা… রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য জানায় অনুপেক্ষণীয় আহ্বান… এমন সময় সর্বব্যাপী নৈঃশব্দকে ছিন্নভিন্ন করে, দাদু তার সেই দরাজ ও সুরেলা গলায় উদীয়মান সূর্যের দিকে সর্বাত্মক নিবেদনের ভঙ্গিতে গেয়ে উঠতেন—

“অসতো মা সদ্‌গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময় 
মৃত্যোর্মামৃতম গময়
ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তি 
ওম হরি ওম তৎ সৎ”

এরপর দাদু বোধ্য বাংলায় বলতে থাকতেন, “পথচলা অসত্য থেকে সত্যের পথে হোক ধাবিত, আঁধার ঘুচে আকাশ হোক আলোয় আলো, সহস্র তারায় খচিত আকাশের গায়েই আঁকা হোক সৌহার্দ্য, শান্তি, ঋদ্ধি, ভ্রাতৃত্বের অমোঘ জ্যামিতি আর জোনাকি বয়ে বোড়ানো পাগলপারা বাতাসের ঝাপটায় উড়ে যাক যত গ্লানি, ক্লেদাক্ত বেঁচে থাকার আবর্জনা।”

মৌঝুমরিতে ছিল একটা মস্ত আটচালা। সেখানে বছরে বেশ কয়েকবার ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’, ‘ধর্মাশোক’ প্রভৃতি যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হত বলে শুনেছি। লাখিমপুর, ডিব্রুগড়, এমনকি কোলকাতার দলও নাকি গিয়ে কল শো করে এসেছে। এগুলো দেখার সুযোগ আমার কখনও হয়নি। যেটা হয়েছিল সেটা হল দোল উপলক্ষে অষ্টপ্রহর কীর্তনের আসর দেখার। সেই কীর্তনের আসরে ভোগ-আরতির সময় গুণনিধি মামার গানের সাথে দেখেছি কপালে রসকলি এঁকে এক মুখ দাড়ি নিয়ে খাইরুল চাচা তন্ময় হয়ে দোহারগুলো বাজিয়ে যাচ্ছেন কি অনায়াস সাবলীলতায়! সেখানে শুদ্ধ, কোমল, কড়ি—সব স্বর মিলেমিশে একাকার হয়ে রাধার অভিসারে সুরের বহতা যমুনায় অবগাহন করে যেন অন্য স্নিগ্ধতার আস্বাদন পেত।

এটা ছিল সেদিনের কথা। গত পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের মধ্যে আর তিনসুকিয়ার পথ মাড়ানো হয়নি। দাদুর মৃত্যুর পর মৌঝুমরির প্রতি আকর্ষণটাই যেন কমে গেল। তারপর প্রাদেশিকতার জিগির তুলে, জাতিসত্ত্বার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে শুরু হল বাঙালি খেদাও অভিযান। মামারা জীবন-জীবিকার কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মৌঝুমরির সাতমহলা বাড়িটা রইল, কিন্তু বাসিন্দা বলে আর রায় চৌধুরী বাড়ির কেউ রইল না। ইতিমধ্যে আমিও স্কুল কলেজের গণ্ডি ছাড়িয়ে দিল্লির সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছি।

উত্তর পূর্ব ভারতের আসাম সহ আরও দুটো রাজ্যের নাগরিকপঞ্জী তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের আমি একজন। আপার আসামের প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে নয়া নাগরিকপঞ্জী থেকে। তাদেরকে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হল। আমার ঊর্ধ্বতন আধিকারিক আমাকেই দিলেন লাখিমপুর, মাজুলি, তিনসুকিয়ার দায়িত্ব। অগত্যা যেতেই হল তিনসুকিয়া। স্থানীয় জেলা শাসকের সাথে কথা বলে, ডিটেনশন ক্যাম্পের হালহকিকত সরেজমিনে পরীক্ষা করার পর ডিপোর্টমেন্ট অর্থাৎ স্থানান্তরণের একটা পরিকল্পনা আমলা পর্যায়ে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হল। একরকম জেলা শাসকের পরামর্শেই আমি ডিপোর্টমেন্ট অপারেশনের সময় সশরীরে হাজির থাকা থেকে বিরত থাকলাম। আধাসামরিক বাহিনী, আসাম রাইফেলসের জওয়ান আর আসাম পুলিশের নেতৃত্বেই চলল স্থানান্তরণের নির্মম প্রক্রিয়া। যখন প্রায় গোটা অপারেশনটাই সুচারুরূপে “সুসম্পন্ন” বলে জানা গেল, তখন ভাবলাম একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। দেখছি গরুর গাড়ির দল বিছানা, বালিশ, বাসন, আসবাবপত্র বোঝাই করে সার বেঁধে ঠুং-ঠাং শব্দ করে এগিয়ে চলেছে। গন্তব্য ডিটেনশন ক্যাম্প। যত দূর দৃষ্টি যায়, ততদূর শুধু গরুর গাড়ি আর গরুর গাড়ি, আর এর পাশে পাশে স্লথ, প্রায় শম্বুক গতিতে চলেছে দুজন সশস্ত্র সামরিক সওয়ারি সহ একটি করে বাইক—শুধুমাত্র যাতে “রাষ্ট্রহীন মানুষের দল” পালিয়ে গিয়ে “নাগরিকদের” সাথে না মিশে যায়, তার নজরদারি করার জন্য।  

এমন সময় হঠাৎ করেই চমকে উঠলাম আড়বাঁশির চেনা শব্দে… যেন বহু যুগের সঞ্চিত ব্যথা-বিরহের পর্দায় বাঁধা সে সুর। বাঁশি বাদককে চোখের দেখা দেখতে কয়েক পা পিছিয়েও গেলাম। দেখি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, প্রায়ান্ধ এক চালচুলোহীন মানুষ আত্মনিমগ্নতার শেষ সীমায় পৌঁছে বাজিয়ে চলেছেন তার বাঁশিখানি। ভাবলাম—আরে ইনিই তো সেই খাইরুল চাচা, যার বাঁশিই ছোটোবেলায় দাদুর সাথে গিয়ে শুনতাম। 

সঙ্গে সঙ্গেই একরাশ অতীত দাঁত-নখ বার করে আমার সামনে এসে হাজির হল, করল প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত। একটা প্রশ্নেরও যথাযথ উত্তর দিতে পারলাম না। ভাবলাম—সহস্র তারায় খচিত আকাশের গায়েই সৌহার্দ্য, শান্তি, ঋদ্ধি, ভ্রাতৃত্বের অমোঘ এই জ্যামিতি আঁকার পাঠই কি নিয়েছিলাম সেদিন দাদুর কাছে থেকে! আমার অবস্থা তখন অসহায় ম্যাকবেথের মতো… দিশেহারা হয়ে সেই প্রেতচ্ছায়াদেরকেই আঁকড়ে ধরতে সূর্যাস্তকালে পৌঁছে গেছি প্রথম সাক্ষাতের প্রাণহীন ঊষরভূমিতে। দুচোখের কোণ ভরে উঠল জলে, গলা হয়ে উঠল আড়ষ্ট। চোখের জলে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া দৃষ্টিতে দেখলাম, খাইরুল চাচার গরুর গাড়ির চালের ভেতরেই যেন সূর্য পাটে যাচ্ছে আর সেই ত্রুটিপূর্ণ উচ্চারণ নিয়ে ধরা গলাতেই গয়ে উঠলাম—

“অসতো মা সদ্‌গময় 
তমসো মা জ্যোতির্গময় 
মৃত্যোর্মামৃতম গময়
ওম শান্তি ওম শান্তি ওম শান্তি 
ওম হরি ওম তৎ সৎ…”

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২