জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে রাষ্ট্রের অনিবার্য সংঘাত ডেকে আনছে – চয়ন ভট্টাচার্য
নয়া উদারবাদের প্রভাবে শ্রমিক ও কৃষকের জীবন-জীবিকার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে বলেই “মে দিবস” উদযাপন আজ আর কেবল আট ঘণ্টার লড়াইয়ের স্মৃতিচারণে সীমাবদ্ধ নেই। কারণ, উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কৃষক, শ্রমিক উভয়েই জানেন, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোর যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে তবেই টিকে থাকা যাবে। শুধু তাই নয়, দুজনকেই প্রমাণ করতে হয় কর্পোরেট সংস্থা নির্ধারিত মূল্যে পণ্য ও শ্রম বিক্রি করে তাঁরা জীবনধারণ করতে পারেন। তাই ঠিক এই মুহূর্তে শ্রমিক যেমন রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার আইন চেয়ে আন্দোলন করেন তেমনি কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করার অধিকার চেয়ে আন্দোলন করেন। উভয়ক্ষেত্রেই, উদার অর্থনীতির সমর্থক সরকার মজুরি ও কৃষি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব কর্পোরেট সংস্থার হাতেই সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত থাকেন। এখনকার “মে দিবস” তাই শ্রমিক-কৃষকদের আর্থসামাজিক অস্তিত্ব আন্দোলন টিকিয়ে রাখার শপথের দিন। সংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যবস্থায় একজন শ্রমিক এখন কার্যত তিনজন শ্রমিকের কাজ করেন এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে একজন শ্রমিককে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় অস্থায়ীভাবে ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াই। রাষ্ট্র শ্রমিকের মজুরি, চিকিৎসা ও অবসরকালীন সুযোগসুবিধার চেয়ে কর্পোরেট মালিকের মুনাফার অধিকার রক্ষায় অনেক বেশি দায়বদ্ধ। শ্রমিক-কৃষকের সমর্থন নিয়ে তাঁদের শোষণ ও বঞ্চনার যাঁতাকলে পিষে ফেলাই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির মূল লক্ষ্য! ততক্ষণই কর্পোরেট প্রভুরা সফল হবে যতক্ষণ শ্রমিক ও কৃষকদের বৃহত্তম অংশ মেনে নেবেন তাঁদের জীবন কর্পোরেট মালিকদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। মগজ ধোলাই করার উদ্দেশ্যেই কর্পোরেট কর্তারা শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনকে কেবল দরকষাকষির অধিকারের বাইরে বেরোতে দিতে রাজি থাকেন না। পরিযায়ী শ্রমিকরা অতিমারি পরিস্থিতিতে ডাকা লকডাউনে কাজ না হারালে হয়তো সরকারি রিলিফের শিকেটুকুও তাঁদের কপালে জুটত না। আজও পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা না জেনেই সরকার চলছে। সরকারি ক্ষমতায় থাকা দলগুলি ভোটে লড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতি প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি না দিয়েই।
ফেলে আসা বিশ শতকের শেষ ধাপে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিপর্যয়ের পিছনে কতটা জনগণের স্বাভাবিক বিদ্রোহ আর কতটা বিশ্বের পুঁজিবাদি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের চক্রান্ত কাজ করেছিল তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিপর্যয় ছাড়া বিগত শতাব্দীর নয়ের দশকের মাঝামাঝিই উদার অর্থনীতি তার প্রভাব পৃথিবী জুড়ে এতখানি প্রসারিত করতে পারত না। তার আগে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উন্নততর দেখানোর জন্য, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি কল্যাণ রাষ্ট্রের আদর্শ প্রচার করত যেখানে শ্রমিকের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, চিকিৎসা-বিমার মতো সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করা হত, কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া হত। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি পুঁজিবাদের সমর্থক রাজনীতির গ্রাসে চলে যাওয়ার পরেই ফিনান্স পুঁজি স্বাধীন বিকাশের জন্য বেছে নিল বাজার নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বাজার কৃষি ও কলকারখানার পণ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করবে ও সেই সব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে। উদার অর্থনীতির নামে অবাধ প্রতিযোগিতার কথা বললেও বাজার অর্থনীতির রাশ থাকে বৃহৎ পুঁজির কর্পোরেটকর্তাদের হাতে। বেশি মুনাফার প্রয়োজনে ধীরে ধীরে কর্পোরেট ব্যবস্থায় শ্রমিকরা অসংগঠিত ক্ষেত্রেই জীবন-জীবিকার সন্ধান করতে বাধ্য হয়েছেন তেমনি কৃষকরাও উৎপাদিত কৃষিপণ্যকে বাজারজাত করার প্রয়োজনে কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতবর্ষেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
ভারতবর্ষ বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও ফরাসি বিপ্লব বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো গণতান্ত্রিক বিপ্লব আমাদের দেশে হয়নি। ফলে সময়ের পরিবর্তনের ধারায় দুটি মহাযুদ্ধের মাঝে গড়ে ওঠা বৃহৎ ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় ব্যবসায়ী সংস্থাগুলির সহায়ক হিসাবে ভারতীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলি স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশের সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায় পণ্য আমদানি-রফতানির ওপর শুল্ক নিয়ে দরদস্তুর করার বাইরে নিজেদের দায়বদ্ধতা বিস্তৃত করেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় থেকে যে ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে মধ্যস্বত্বভোগী থেকে উৎপাদক সংস্থার মালিক হিসাবে রূপান্তরিত হচ্ছিলেন এঁরা তাঁদেরই উত্তরসূরী। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করতে তাঁরা তখন থেকেই ব্যস্ত ছিলেন। আর্থ-সামাজিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করতে এই ব্যবসায়ীরা আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। ফলে গ্রামের জোতদার পরিবারই শহরে শিল্পপতি এমনটা আজও দেখা যায়। যে কৃষক বা খেতমজুর গ্রামে “হুজুর মাই বাপ” বলতে অভ্যস্ত তিনি কৃষিজমির কাজ হারিয়ে শহরে কারখানার শ্রমিক হিসাবে মালিককে “ইউনিয়নবাজি” করে বিব্রত করার চেয়ে মালিককে অন্নদাতা হিসাবে শ্রদ্ধা করে তাঁর সিদ্ধান্তে জীবন সঁপে দেওয়া নিরাপদ বোধ করেন। স্বাধীনতার আগে-পরে তেভাগা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক সাফল্যের কৃষক আন্দোলনের প্রভাব যেমন ধরে রাখা যায়নি তেমনি মহারাষ্ট্রের কামাগার আন্দোলনের প্রভাব দেশজুড়ে শ্রমিক আন্দোলনে পড়েনি। উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যদি বিগত দু’দশক ধরে পরিকল্পনা মাফিক ভারতবর্ষের শ্রমিক ও কৃষকদের জীবন-জীবিকার স্থায়ীত্বের গোড়া ধরে টান না মারত তাহলে হয়তো ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবি নিয়ে কৃষকের লং মার্চ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বেসরকারিকরণ করার বিরুদ্ধে এবং ন্যায্য মজুরি ও সামাজিক নিরাপত্তার দাবি নিয়ে পর পর সর্বভারতীয় ধর্মঘট ও অবস্থান বিক্ষোভ এতখানি সফল হত না।
কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম আইনের সংশোধনী এবং কৃষি আইন দুটিই সংসদে পাশ করা হয়েছে অতিমারির পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে। কৃষি আইন যেমন কর্পোরেটের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে ফসল উৎপাদন করে কর্পোরেটের নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে কৃষকদের বাধ্য করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে তেমনি শ্রমিক আইনের সংশোধনীতেও কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিক সংগঠন করার বিষয়ে কঠোর শর্ত চাপিয়ে বলা হয়েছে মালিক শ্রমিককে ছাঁটাই করলেও শ্রমিক সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারবেন না। ফলে সরকার এবং কৃষক-শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে।