আমার মে দিবস – কিন্নর রায়
আমার মে দিবস একেবারেই স্বতন্ত্র। কেননা হে-মার্কেটের শ্রমিকদের লড়াই, ফিলাডেলফিয়া জুতোর কারখানায় ধর্মঘট, ৮ ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকদের লড়াই, এসব কথা ইন্টারনেট ঘাঁটলে খুব সহজেই পাওয়া যায়। আমাদের বাল্যকালে ইন্টারনেট ছিল না। বই ছিল। ‘মে দিবসের ইতিহাস’ নামে বই পাওয়া যেত। সে ইতিহাস পড়ে রোমাঞ্চিত হতে হয়। এত বড়ো মানুষের লড়াই!
১লা মে ভারতবর্ষের সমস্ত বামপন্থী সংগঠন, কমিউনিস্ট পার্টি, যে কটা কমিউনিস্ট পার্টি আছে (ভেঙে ভেঙে তো অনেক কমিউনিস্ট পার্টি হয়েছে!), তাঁরা, সোশ্যালিস্টরা, এমনকি চরম দক্ষিণপন্থী ট্রেড ইউনিয়নরাও মে দিবস পালন করার কথা ভাবে। নিজের নিজের পতাকা উত্তোলন করে। এবং শ্রমিক দিবসকে সম্মাননা জানায়। আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে এই যে লড়াই তা একটু একটু করে ছড়িয়ে ছড়িয়ে মানুষের চিন্তা ও চেতনায় গেঁথে গেছে এবং তা শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর সোভিয়েতের বিপ্লবকে, কখনও-বা ১৯৪৮ এর ১লা অক্টোবর চীনের বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছে বা ভাবিয়ে তুলেছে।
কিন্তু আজকের দিনে বড়ো কারখানা হচ্ছে না, কারণ পুঁজিবাদ বড়ো কারখানা করবে না, সে ছোটো ছোটো জায়গায় উৎপাদনকে ভেঙে দিচ্ছে। আই টি সেক্টরে যে কাজ হচ্ছে, রাতদিন ছেলেমেয়েরা কাজ করছে, তারমধ্যে একটা অন্যরকম শোষণ আছে। SEZ–স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরি হচ্ছে।
ভাবলে খানিকটা দুঃখই হয়। চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে নিজেদের দাবি করে। রেড ফ্ল্যাগটা রাখে। তারাও SEZ বা স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরি করছে। সেখানে একজন মজুর নতুন করে ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছে। একজন শ্রমিকের উঠে মূত্রত্যাগ করারও উপায় নেই। মূত্রত্যাগের সময়টাও যদি খরচ হয়, তার জন্য কাজের সিটেই মূত্রত্যাগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই SEZ এর ফলে নতুন নতুন দাস তৈরি হচ্ছে পৃথিবীতে।
মার্ক্স লক্ষ করেছিলেন যে পৃথিবীতে দাসরা আছে, সামন্তপ্রভুরা আছে, পুঁজিবাদ আছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের বিপ্লব আছে। মার্ক্স বলেছিলেন সবচাইতে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে বিপ্লব হবে। তিনি ফ্রান্সের কথা ভেবেছিলেন। জার্মানির কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু লেনিন বিপ্লব করলেন রাশিয়াতে। একটা পিছিয়ে পড়া দেশ, কুলাক শাসিত দেশ। লেনিন বললেন, ‘the weakest link of the Imperialism’, ‘সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম অংশ’টাকে আমরা ভেঙে দিলাম। সোভিয়েত তৈরি হল। সোভিয়েত বিপ্লবের পদ্ধতিতে কোনো ভুল ছিল কিনা, জার বা জারের পরিবারকে হত্যা করার কোনো কারণ ছিল কিনা বা এই বিপ্লব ত্বরান্বিত করার ফলে সোভিয়েতের পতন পরবর্তীকালে হয়েছে কিনা এই নিয়ে বিপুল তর্কবিতর্ক আছে। কেন একটা পিছিয়ে পড়া কুলাক শাসিত দেশে হঠাৎ করে বিপ্লব হয়ে গেল! যদিও মানুষ খেতে পারছিল না। মানুষের স্বপ্ন ছিল বিপ্লব। সবটাই মে দিবসের সঙ্গে যুক্ত। সারা পৃথিবী জুড়ে মে দিবস আজও পালিত হয়।
মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর মে দিবসের ছুটি ঘোষিত হয়। সেটাকে অনেকে ব্যঙ্গ করে বাঙালিদের ছুটি কালচার বলে। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী, তিনি মে দিবসের ছুটি ঘোষণা করলেন রাজ্যে। ট্রাম কোম্পানিকে জাতীয়করণ করা হল। এরকম নানা কাজ যা মানুষ ভুলে গেছে এখন। মে দিবসের ছুটি বাঙালির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। যদিও পরবর্তীকালে অনেকে বলেন, মে দিবস মানে মাংস ভাত, মে দিবস মানে দুপুরের ঘুম, মে দিবস মানে একদিনের সবেতন ছুটি। কিন্তু তা তো নয়। মানুষের লড়াই মানুষের সংগ্রাম কখনও ফুরোয় না। এ লড়াই-সংগ্রাম চলতেই থাকে। আজকে সোভিয়েত ধ্বংস হয়ে গেছে বা সোভিয়েতের সাময়িক ভাবে বিলুপ্তি ঘটেছে। চীন মার্কেট ইকোনমি নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের সমাজতান্ত্রিক যে বোধ ও লড়াইয়ের ভাবনা তা কিন্তু দূরে সরে যায়নি। ফলে কিউবা এবং লাতিন আমেরিকা নতুন করে ভাবছে কীভাবে সমাজতান্ত্রিক চেতনা, চৈতন্যর মধ্য দিয়ে পালটা অর্থনীতি তৈরি করা যায়। এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়। এই সবটারই পিছনে আছে মে দিবসের লড়াইয়ের ইতিহাস।
অ্যালবার্ট পারসন্স, অ্যাডলফ ফিসার, অগস্ট স্পাইস, জর্জ, প্রমুখ যোদ্ধাদের ফাঁসি হয়েছিল। গুলি চলেছিল। গুলিবিদ্ধ শ্রমিকদের যে শার্ট, সেই শার্ট লাল হয়ে যায়। সেই রক্তাক্ত শার্ট থেকে তৈরি হয় রক্তপতাকা। যা কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্টরা অনেকে নিজেদের পতাকা হিসেবে মান্য করেন।
আমরা আমাদের কৈশোরে রাজনীতির সূত্র ধরে মে দিবস অত্যন্ত গুরুত্ব এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করতাম। শহিদ বেদিতে মালা দেওয়া হত। মিছল হত। মে দিবসের স্কোয়াড বেরোত। যে সমস্ত কারখানায় লড়াই হচ্ছে, যেমন বালিতে ইন্দো-জাপান বলে একটা ফ্যাক্টরি ছিল, বা বালি জুট মিল, তার গেটের সামনে আমরা সভা করতাম। বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল নিজের মতো করে মে দিবস পালন করত। র্যাডিক্যাল লেফট যাঁরা, নক্সালপন্থী যাঁরা, যাঁদের সংগঠন শক্ত ছিল তাঁরাও মে দিবস পালন করত। মে দিবসকে মনে রেখে সভা হত, প্রচার হত, শহিদ বেদিতে মালা দেওয়া হত। মিছিল হত, বক্তৃতা হত। পথ-নাটক হত। গান হত। একটা উৎসবের মতো। প্রত্যেকটা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রে মে দিবস নিয়ে স্পেশাল ইস্যু বেরোত। ‘দেশব্রতী’, ‘দেশহিতৈষী’, ‘দক্ষিণ দেশ’, ‘গণশক্তি’, ‘কালান্তর’, ‘গণবার্তা’, ‘গণদাবি’, ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’ প্রভৃতিতে।
কোথাও আমার মনে হয়, মানুষের লড়াইয়ের যে চিন্তা, চেতনা তার স্ট্রাটেজি খানিকটা বদলেছে। কারণ পুঁজিবাদ এখন আর বড়ো কারখানা করছে না। Imperialism is the highest state of capitalism—সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ। সেই ব্যাপারটা আজকে এখন নানা ভাবে গুলিয়ে গেছে। কিন্তু লড়াই হচ্ছে। তা কখনও শান্তিপূর্ণ থাকছে, কখনও বিদ্রোহ বা বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সশস্ত্র ভাবে হচ্ছে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, ওরা নিজেদের মতো করে একটা আর্থিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। ঠিক ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ না হলেও একটা নতুন করে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই চেষ্টা বা অবিরাম লড়াই মানুষকে নিজের মতো করে সংহত করে রাখে।
আমরা হয়তো ভাবছি কিচ্ছু হচ্ছে না। চারিদিকে হতাশা। কারখানার গায়ে লাল পতাকাগুলো ক্রমশ বেঁকে গিয়ে মলিন হয়ে যাচ্ছে। শহিদ বেদিতে শহিদের নামগুলো মুছে যাচ্ছে। যাদের আক্রমণে এদের শহিদ হতে হয়েছিল, তাদের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা হচ্ছে। একসঙ্গে এক মঞ্চে কথা বলা হচ্ছে। এটা দুঃখের। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিবাদ করেন, খেটে খাওয়া মানুষ, তাদের পেটে টান পড়ে যায়। আমি নিজে বালি জুট মিলে দীর্ঘদিন শ্রমিক সংগঠন করতে গিয়ে দেখেছি মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে। শ্রমিক এলাকায় শৌচালয়ে যে এমন বিশাল লাইন হতে পারে, আমার তার কোনো ধারণাই ছিল না! হাতের জলের পাত্র, বিড়ি সমেত মহিলা-পুরুষ সব একসঙ্গে। কীভাবে যে তারা প্রাকৃতিক চাপকে আটকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন! অবাক লাগত! অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এখন অবস্থার পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়েছে, সেই ধরনের শৌচালয় এখন আর নেই, সেটাও হয়েছে লড়াইয়ের ফলে।
আজকের বিশ্বায়ন হোক বা গ্যাট চুক্তি হোক সবই মানুষকে ক্রমশ দাসত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে মানবিকতা কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা মধ্যবিত্ত, “সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামাফোন” টাইপ, যাদের নিশ্চিত রোজগার আছে, যারা একটু ব্যাঙ্কের সুদ কমে গেলে খুব ঝামেলায় পড়েন, কেননা মদ খাওয়া যাবে না, ভালো জামাকাপড় কেনা হবে না, গাড়িটা বদলানো যাবে না, এরকম যারা ভাবেন, তাদের থেকেও যারা সাধারণ মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়, ব্যাঙ্কে ন্যূনতম টাকা থাকে না, তাদের লড়াইটা কিন্তু দেখার।
আজকে ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে যেভাবে ভারববর্ষকে বিভাজিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত সুচতুর পরিকল্পনা মাফিক—ভারববর্ষকে যদি হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করা যায়, তাহলে আমরা আমাদের আখের গুছিয়ে নিতে পারব, এই ভাবনায়। নীরব মোদি পালিয়ে যাবে, বিজয় মালিয়া পালিয়ে যাবে ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা নিয়ে। আমাদের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রিটায়ারমেন্টের পরে দশ-বিশ লাখ টাকা থাকবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি সরকার দিতে পারছে না। দিনের পর দিন হু-হু করে জিনিসের দাম বাড়ছে, গ্যাসের দাম বাড়ছে, খাদ্য ও জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাড়ছে। তার সঙ্গে চলছে সাম্প্রদায়িক উস্কানি। সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তখন পথ দেখায় ওই মে দিবসের লাল পতাকাটা। এই পতাকাটা যদি আমারা জোরে আঁকড়ে ধরতে পারি! আমি কোনো দলের কথা বলছি না। যে পতাকা তৈরি হয়েছিল, হে মার্কেটে শ্রমিকদের বুকের রক্ত দিয়ে, যে পতাকা তৈরি হয়েছিল রক্তাক্ত শার্ট থেকে, সেই পতাকার ঐতিহ্য এবং ধারাবাহিকতা যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, তবে আগামীর পৃথিবীটা খানিকটা সুন্দর হবে।
আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি সুন্দর একটা পৃথিবীর। মার্ক্স স্বপ্ন দেখেছিলেন, লেনিন স্বপ্ন দেখেছিলেন, চে গেভারা স্বপ্ন দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, মহাত্মা গান্ধি, পণ্ডিত নেহেরু, রামমোহন রায়, প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে চেয়েছিলেন একটা সুন্দর সমাজ তৈরি হোক। মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে কার্ল মার্ক্সের ভাবনায় পদ্ধতিগত দূরত্ব আছে। কিন্তু তাতে গান্ধিবাদের কী ত্রুটি আছে, মার্ক্সবাদের কী জয় আছে, সেই তত্ত্বে যাবার কোনো দরকার নেই। কিন্তু এরা কেউ ভাবেননি যে ভারতবর্ষের রেল, ভারতবর্ষের বিমা, ভারববর্ষের ব্যাঙ্ক, তেল কোম্পানি ও এন জি সি, সব বিক্রি হয়ে যাবে দেশীয় কর্পোরেটদের হাতে। আর তার ফলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে। এটা মহত্মা গান্ধিও ভাবেননি, পণ্ডিত নেহেরুও ভাবেননি। বরং পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু রাষ্ট্রীকরণের কথা বলেছিলেন। সেই রাষ্ট্রীকরণ হয়তো পুঁজিবাদের একটা চেহারা, সমাজতান্ত্রিক চেহারা নয়। তা সত্ত্বেও মানুষের খানিকটা একটা বল-ভরসা ছিল। ‘Welfare state’ এর কথা ভাবতে চেয়েছিলেন পণ্ডিত নেহেরু। তার কর্মপদ্ধতিতে হয়তো কিছু ভুল-ত্রুটি ছিল, যা তখন সমলোচিত হয়েছে। কিন্তু আজকে দেখা যাচ্ছে তিনি যে ভারতবর্ষের কথা ভেবেছিলেন, তা অন্তত জাতপাত, ধর্ম ভিত্তিক ভারতবর্ষর কথা ভাবেননি। তিনি চেয়েছিলেন এ দেশ হিন্দুধর্মের যেমন, তেমনি ইসলাম ধর্মের, এ দেশ খ্রিস্ট ধর্মের মানুষদের যেমন, তেমনই শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসিক, সবার। যে যে আদিবাসী উপধর্মগুলো আছে, সব নিয়ে এই দেশ। এছাড়াও ছোটো ছোটো যে ধর্ম আছে, মতুয়া, বলাহড়ি সম্প্রদায়, সাহেবধনি, এই সব লোকাচার-দেশাচার নিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা। যার যার নিজের মতো বাঁচা।
আজকে এই বহুত্ববাদ ধ্বংস হতে চলেছে একটা রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ মদতে। তারা চাইছে ভারতবর্ষকে এক ছাঁচে ফেলে একটা নষ্ট-ভ্রষ্ট-পচা ভূখণ্ড তৈরি করতে। আমরা ভারতবর্ষের মাটিতে চিরকাল বেঁচেছি, বাইরে থেকে আসা খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম ধর্ম নিয়ে। ইহুদি ধর্মও সামান্য সামান্য এসেছে, বৌদ্ধরা প্রভাব বিস্তার করেছে। আমরা কিন্তু পাশাপাশি বাস করেছি। হয়তো ছোটোখাটো ঝগড়া হয়েছে। সে তো বাড়িতে দুই ভাই থাকলেও ঝগড়া হয়, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়। কিন্তু এইভাবে যে একটা সম্প্রদায়কে উৎখাত করতে হবে, ভয় দেখাতে হবে ইসলাম ধর্মের মানুষদের, খ্রিস্ট ধর্মের মানুষদের, সেটা কিন্তু ভারতবর্ষের আগেকার শাসকরা ভাবেননি। জওহরলাল নেহেরুও যে ভারতের কথা ভেবেছিলেন সেখানেও এমন কথা ভাবা হয়নি।
তাই আজকে মে দিবস অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটা কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। যারা সামগ্রিক ভাবে মানুষকে ভালোবাসতে চান, মানুষের কল্যাণ চান, সমভাবে পৃথিবীতে বাঁচতে চান অর্থাৎ মনে করেন এদেশ যদি সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের হয়, তবে এ দেশ ইসলামকে যারা কবুল করেছেন তাদেরও, খ্রিস্ট ধর্মেরও, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মেরও। বিভিন্ন উপধর্মেরও সহাবস্থান এখানে। ভারতবর্ষ কখনও কারও একার হয়নি। কেননা ভারতবর্ষের চেতনা ও চৈতন্য অনেকটাই বাঁধা আছে সঙ্গীতকলার মধ্যে। আজকে আমরা দেখছি বাংলাদেশে হেফাজত বলে একটা সংগঠন, তারা এবং আরও কয়েকটা দল, বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করছে। আগুন দিচ্ছে। একই কাণ্ড হচ্ছে এখানে, আর এস এস বা বজরং দল, বিশ্বহিন্দু পরিষদ, হিন্দু সংহতির মাধ্যমে। একই কাজ করতে চাইছে, অর্থাৎ ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করো। ভয়ের পরিবেশ তৈরি করো। ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করো। গরিব মানুষকে পায়ের নীচে রাখো। প্রত্যেকটি মৌলবাদী সংগঠন, ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে যারা এগোয় এবং সহজেই মানুষকে বশ করার চেষ্টা করে, তারা এই অন্যায়টাই করে বেড়ায়। সেখানে একজন তথাকথিত সনাতন ধর্মী বা হিন্দু মৌলবাদীর যে চরিত্র, ইসলাম ধর্মের মৌলবাদীর যে চরিত্র তার কোনো ফারাক নেই। এই বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক হয়ে থাকতে হবে। এই উপমহাদেশ, ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ দুজনেই এবং পাকিস্তান তো বটেই, একটা সময় পর্যন্ত যা একটা গোটা দেশই ছিল, পরে ধর্মীয় আর রাজনৈতিক কারণে আলাদা হয়ে গেছে, সেই পুরো উপমহাদেশটাই বিপন্ন। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা অসম্ভব বিপন্ন। সেখানেও শিখ বা সনাতন ধর্ম নেই-ই প্রায়, বিতাড়িত তারা। আমাদের দেশেও এখানে গোরক্ষক নামে একদল পাষণ্ড ইসলাম ধর্মের মানুষ দেখলেই লাঠিপেটা করছিল। হত্যা করছিল। কে কার ফ্রিজের মধ্যে কীসের মাংস রাখবে, সে তো তার সিদ্ধান্ত! আমি আমার ফ্রিজে শুয়োরের মাংস রাখব, না গরুর মাংস রাখব নাকি মুরগির মাংস বা খাসির মাংস রাখব বা কিছুই রাখব না, শুধুমাত্র ভেজিটেরিয়ান জীবনযাপন করব, তা আমার সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্র কেন তাতে হস্তক্ষেপ করবে! দাদরিতে আখলাক বলে একজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে, তার ফ্রিজে গরুর মাংস আছে বলে। গোমাংস তো খাদ্য। কী অসুবিধা আছে? যার ইচ্ছে হবে খাবে। যার ইচ্ছে হবে না, খাবে না। কে কী খাবে, কে কী পোশাক পরবে, তার ওপর হস্তক্ষেপ হচ্ছে। এই যে ‘অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড’ তৈরি হল, যদি কোনো মহিলাকে কোনো পুরুষ প্রকাশ্যে চুম্বন করতে চান বা কোনো মহিলা যদি কোনো পুরুষকে চুম্বন করতে চান, তাতে অসুবিধা কী! সেখানে কেন অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড থাকবে! যেমন উত্তরপ্রদেশে কোট-আনকোট যোগীর সরকার করতে চাইছে।
ফলে আমরা একটা সার্বিক বিপন্নতার মধ্যে আছি। এই মে দিবসের যে সময় আসছে যেখানে রক্ত পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা দরকার বহুত্ববাদের প্রতীক হিসেবে এবং রক্ত পতাকার সঙ্গে অন্য পতাকাও থাক, যারা ধর্ম-নিরেপক্ষতায় বিশ্বাসী, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, যারা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, তারাও সবাই আসুন। কেননা এখন একটা ভয়ংকর বিপদের সামনে আমাদের দেশ এবং এই উপমহাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কোথায় যাব!
আজকে যাঁরা প্রকৃত অর্থে সেকুলার বা ধর্মনিরেপক্ষ বা সব ধর্মকে যাঁরা সমান চোখে দেখে, তাঁরা তো সংখ্যালঘু। তাঁদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই প্রায়। তাঁরা ক্রমশ আরও সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন, বিভেদ-বুদ্ধি এবং বিচারের কাছে। তাঁরা তো বাজে কথা শুনবেন না। বাজে কথা মানবেন না। তাঁরা তো গুজবে কান দেবেন না। তাঁরা পড়াশোনা করবেন। তাঁরা কথা বলবেন। সেই বোধ এবং বোধির ওপর আক্রমণ আজকে চতুর্দিকে নেমে আসছে। এটা বহুদিন ধরে হয়ে আসছে। নগ্ন সরস্বতী, কেন হুসেন এঁকেছেন, সেই নিয়ে আক্রমণ! মীরা নায়ারের ‘ওয়াটার’ বলে একটা ছবি হয়েছিল। সেই ছবিকে আক্রমণ। এটা বজরং দলের লোকেরা বহুদিন ধরে করে আসছে।
এখন এই সংকট আরও তীব্র হবে কারণ রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাঁরা আছেন তাঁরা কিছুতেই চায় না ব্যক্তি স্বাধীনতা।
তাঁরা নাথুরাম গডসের মন্দির তৈরি করতে চায়, যে নাথুরাম গডসে ছিলেন মহত্মা গান্ধির হত্যাকারী।
এরকম সংকটময় মে দিবস আমি বহুদিন দেখিনি। সত্তর দশক হল মুক্তির দশক এবং লেনিন সেন্টিনারির সময় সাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপধ্যায় একবার বলেছিলেন আগামী শতাব্দীতে মানুষ চাঁদে গিয়ে লেনিন শতাব্দী পালন করবে। তা তো হয়নি। সোভিয়েত ভেঙে গেছে। চীন মার্কেট ইকোনমি করছে।
ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর কিউবার খবর পাই না। রাউল কাস্ত্রো আছেন বেঁচে। রাউল কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর কী হবে বলা যায় না৷ তবু আশার আলো লাতিন আমেরিকার দেশগুলো বা আমাদের দেশে যখন দেখি কিছু মানুষ পাহাড় বাঁচানোর জন্য, অরণ্য বাঁচানোর জন্য, সমুদ্র বাঁচানোর জন্য লড়াই করছেন। প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য লড়াই করছেন। তার সঙ্গে আছে রাজনৈতিক বোধের মানুষরা। এই বোধের মানুষরাই হল মে দিবসের ফসল। মে দিবসের যে লড়াই আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে বহুবছর ধরে, সেই লড়াইয়ের ফলাফল হচ্ছে এইসব মানুষেরা যাঁরা আমাদের সমুদ্র, আমাদের নদী, আমাদের অরণ্য, আমাদের ভূমি, সমস্তকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে। আমি মে দিবসকে এভাবেই দেখি।
খুব ভাল লেখা।