সহোদর – শক্তি চট্টোপাধ্যায় (পুনর্পাঠ)
হাঁড়িচাঁচা খাল সাঁড়াশির মতন গঞ্জটাকে কষে চেপে ধরেছে—তাই খালের গা বরাবর গঞ্জ। তা-ছাড়া কী বুধবার হাট আছে। পেট-ভর-বাজার। জয়নগর-মজিলপুর দুটো গাঁ খেয়ে কূল পায় না। আর খাবারই না কতরকম। শাকসবজির পাহাড়, মাছের আটচালা। গাঁ-ভরতি বাবু কছমের লোকজন। শ্রী-ই আলাদা। হঠাৎ কোত্থেকে যে কী হল। শিয়ালদা থেকে বরাবর ইস্পাত বিছানো হল মাইল বত্তিরিশ দক্ষিণমুখো, তামাম গাঁ উঠে এলো ইস্টিশনে—ইস্টিশন থেকে সোজা, নাকের সোজা খাস কলকাতা। আঁধার থাকতে-থাকতে সেই দুরন্ত সবজির পাহাড় আর মাছের আটচালাও ফাঁকা। বাবু কছমের লোকজন হপ্তায় ফেরে—তাও সিকি ভাগ, বাদবাকি সব জালের বাদুড়—
আজ ভালো মনে নেই। একরত্তি বয়েসে বাপ-মা হারিয়ে আশীব্বাদ—কীভাবে যেন এই এলাকায় ভেসে এসেছিল সেই সুদূর ছাপরা জেলার গণ্ডগ্রাম থেকে। কীভাবে এসেছিল? পুরোটা মনে নেই, অল্প অল্প স্মৃতিতেও ক্ষয় লেগেছে। বয়েসও তো কম হল না! চার কুড়ির কাছাকাছি। আশীব্বাদ হাওড়ায় পা দেয়—তারপর কোন গোলদারের লুরি চেপে সিধে এই গঞ্জ কাকা। সেই থেকে আড়ত, আড়ত থেকে এদিক-ওদিক ঘুরে আবার আড়ত, আড়ত থেকে হাঁড়িচাঁচা খালের চালানি নৌকো, নৌকো থেকে লাফিয়ে পড়ে ধোপার কাজ। গাঁয়ের আশীব্বাদ ধোপা।
কোনোদিনই আপনার বলতে কেউ নেই। আপনার বলতে কেউ থাকারই বা কী দরকার। ভাবে আশীব্বাদ। বাবুদের ছাড়া-কাপড় সময়মতো পেলেই হল। রেলের বিলে জল থাকলেই হল। হাতদুটোয় জরা না-ধরলেই হল। আপনার বলতে কেউ থাকারই বা কী দরকার? নিজে তো আছেই। রোগ-অসুখও নেই। কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত ইস্তিরি করে। আবার ভোর থাকতে উঠে রেলের বিলে চলে যায়। হাঁই হাঁই শব্দ করতে করতে সূর্য মাথায় উঠলে পর হাত থামে। বাড়ি এসে দু-মুঠো চাল ফুটিয়ে খেতে বসতে সেই সূর্য পশ্চিমের পাকুড় গাছটার খোলের ভেতর ঢোকে। আর খুঁজে পায় না আশীব্বাদ—এক সময় আগুন ধরে ওদিকপানের আকাশে। আশীব্বাদ গাঁজার কলকেটায় প্রাণভরে টান মারে গুটিকয়। তারপর কাঁধে কাপড়ের গাঁটরি ফেলে পাড়ায় পাড়ায় চক্কর।
আশীব্বাদের কাজ চোখ বুজে নেওয়া যায়। হিসেবপত্তর না-রাখলেও কীভাবে মনে রাখবে লোকটা ঠিকঠাক। ছোঁড়া ফাঁড়া নেই। কাপড়ে গাঁথা চোরকাঁটা বা পথি নেই। সব নিপুণভাবে বেছে তারপর ইস্তিরি করে। মাপা হাত নীলের, কারোর কিছু বলার জো নেই।
সেই আশীব্বাদেরও একদিন হঠাৎ বয়স হল। হঠাৎ বললুম এই কারণে যে, বয়েস একদিন আচমকা এমনভাবে আসে। একদিনেই মানুষকে ভেঙে দেয়। কোমরে মারে লাঠি। আশীব্বাদেরও একদিন বয়েস হল। খাটাখাটুনি তেমন আর করতে পারে না। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এর বাড়ির কাপড়, তার বাড়ি দিয়ে আসে। চোখের জোর নেই বলেই কাপড়ের খোল ভরতি চোরকাঁটা। সেই নীলের মাপা হাত আজ আর নেই— সাদা কাপড় তো পরাই যায় না। প্রবাদে দাঁড়িয়ে গেছে দু-দিনেই—কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই গ্রামের ছেলেছোকরা বলে ওঠে, তোমায় আশীব্বাদে পেয়েছে।
পসারও কমেছে। নিজে তো তেমন খাটতে পারে না—নতুন ধোপা এসেছে বহু। গঞ্জের ওপরেই দুটো সাইনবোর্ড মারা দোকান। স্টিম না ফিমও এসে গেল বলে। আশীব্বাদ মনে মনে ভাবে—দিনও শেষ হয়ে আসছে, আর কতদিন! নতুনবাবু সব হপ্তায় ফিরছে— তাদের পোশাক-আশাকই বা কীরকম। কেচেই রোদ্দুরে দিলে হল—ইস্তিরি লাগবে না। তাজ্জব কথা! আশীব্বাদ জীবনেই শোনেনি। তাও আবার হয় নাকি কখনও? দরকার নেই বাবু ওইসব খেরেস্তানি এলাক-পোশাকে হাত দিয়ে।
আজকাল সবসময়েই আবোল-তাবোল চিন্তা করে আশীব্বাদ। গাঁজারও মাত্রা বেড়েছে। গাঁজায় দম দিয়ে দাবায় আনমনে বসে থাকে। দীর্ঘ আর ভারী নিশ্বাস ফ্যালে মাঝেমধ্যে। কী যেন করা হয়নি জীবনে, যা করার আজ আর সময় নেই। এখন শুধুই কাছে-দূরে তাকিয়ে থাকা। আপনার বলতে কেউ যদি থাকত আজ। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে রোগ-অসুখও দরজা ধাক্কা দেয়। কাজকর্ম বন্ধ থাকে মাসের মধ্যে কম করেও বিশ-বাইশটি দিন। সেই কটা দিন, আধপেটা, সিকি-পেটা—কোনোদিন আবার আঁজলাভরা জলই মাত্র।
দূরে দাবার এক কোণে দুটো মায়াভারি চোখ দ্যাখে আশীব্বাদকে। সে চোখ পবনের। আশীব্বাদই আদর করে ওর নাম রেখেছিল পবন। পবন মানে হাওয়া, হাওয়ার মতন দ্রুত আশীব্বাদ তার কাপড়ের বোঝা বয়ে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে দৌড়ে বেড়াত। পরনেরও কেউ নেই, একা গ্রামেগঞ্জের হাটে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল একদিন। আশীব্বাদেরও দেখেও পছন্দ হয়েছিল। কতই বা বয়েস তার তখন? আশীব্বাদই বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছিল।
আজ হপ্তাখানেক হল বিছানা নিয়েছে আশীব্বাদ। উঠতে-হাঁটতে পারছে না। অথই জ্বর। জ্বর আর তার সঙ্গে কাশি। এক-একবার কাশে আর পবন মুখ তুলে চায় দরজার ওপার থেকে। তার টানা টানা চোখ সজল। আশীব্বাদেরও কান্না পায়—কেউ যদি অবলা প্রাণীটাকে ছেড়েও দিত। ক-দিন তো দাঁতে কুটোটা পর্যন্ত কাটেনি। ও ঠিকই জানে, টের পেয়েছে আশীব্বাদের পেটেও পড়েনি কিছু। প্রথম ক-টা দিন তবু গড়িয়ে গড়িয়ে জলটা খেতে পারত—এ ক-দিন আবার তাও বন্ধ। চোখ বুজিয়ে মৃত্যু ছাড়া সামনে আর কিছুই দেখতে পায় না আশীব্বাদ। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে পবন। এপারে আশীব্বাদ। অস্ফুটে কী যেন বললও সে। হয়তো বলল—তুই এভাবে দাঁড়িয়ে মরবি কেন। দড়ি ছিঁড়ে পালা। তোর তো আর আমার মতন অবস্থা নয়। দড়ি ছিঁড়তে পারলেই চোখের সামনে ঘাসে-ভরা সবুজ মাঠ পাবি—সেই মাঠে অনন্তকাল ভেসে বেড়া। আজ থেকে তোকে ছুটি দিলুম।
আসলে নিজেই ছুটি পেল আশীব্বাদ। দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল পবন। তার চোখে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তখন।
পরদিন যে সারাহপ্তাতেও একবার আকস্মিকভাবে আসেনি, সে এসে দাঁড়াল আশীব্বাদের দোরগোড়ায়। এসে দেখল, দাবার কানাচে ঝুঁকে শেষবারের মতো শুয়ে পড়েছে পবন টানটান হয়ে—প্রাণহীন, কানাচে একটিমাত্র ঘাসের সবুজ-হলুদ মেশা ব্লেড, তার দিকে জিব কাটাতে গিয়ে সম্পূর্ণ জিবটাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
(কৌরব, ১৯৮৬)