আজও বাঙালি মানসে ডি এল রায় অবহেলিত – দীপক সাহা

আজও বাঙালি মানসে ডি এল রায় অবহেলিত – দীপক সাহা

শেয়ার করুন

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন কবি নাট্যকার এবং সঙ্গীত স্রষ্টা। তাঁর বাবা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান এবং মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত প্রভুর বংশধর। তাঁর ঠাকুরদা মদনগোপাল রায়ের নাম অন্নদামঙ্গলে অন্বিত করেছেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। কার্তিকেয় চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। তাঁর দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবী নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন। তাঁদের পরিবারে বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, দীনবন্ধু মিত্রের মতো মানুষের আনাগোনা ছিল। বংশ সূত্রে এবং রক্ত সূত্রে তিনি ছিলেন সারস্বত সমাজের সামাজিক। কিন্তু ‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!’ অথবা ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’র বাইরে আজকের বাঙালি তাঁকে মনে রাখতে পারেনি।

দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তিলাভ করেন। এফ. এ. পাস করেন কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. করে স্কলারশিপের টাকায় ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি জীবন শুরু করেন। তবে তাঁর চরিত্রের মধ্যে এমন কিছু উপাদান ছিল যা তাঁকে প্রতিনিয়ত বিতর্কে জড়িয়ে ফেলতে উৎসেচিত করত। সৎ, উদার, বন্ধুবৎসল এই কৃতী অকারণে ক্ষণিক উন্মাদনায় মেতে উঠতেন। কখনও বঙ্গভঙ্গের উত্তেজনায় মেতে উঠেছেন, কখনও রঙ্গমঞ্চের আকর্ষণে আলোড়িত হয়েছেন, কখনও তীব্র মাদকাসক্তিতে আত্ম সংবরণ হারিয়েছেন, কখনও সাহিত্যে নীতিবাদ নিয়ে রবীন্দ্রবিরোধী হয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছেন। তাঁর বন্ধু লোকেন পালিত তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন করে বলেছেন ‘দ্বিজু যখন যাই ধরতেন, half heartedly, করতে পারতেন না।’

বিলেত থেকে ফিরে ১৮৮৬ সালে কাজে যোগ দেন। ১৮৮৭ তে স্বনির্বাচিত সুরবালা দেবীকে বিয়ে করেন। ১৮৯৭ সালে সুযোগ্য পুত্র দিলীপ কুমার এবং ১৮৯৮ সালে একমাত্র কন্যা মায়া জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৩ সালে তাঁর বয়স যখন ৪০, স্ত্রী বিয়োগ ঘটে। স্ত্রীর মুত্যু দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীত জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনে। আনন্দ ও হাসির গান রচনার ভুবন থেকে তাঁর বিচ্যুতি ঘটে। প্রেমে ভরপুর এক আদ্যন্ত রোমান্টিক মন ভরে ওঠে নিরাশায়। উচ্ছ্বাসপ্রিয় মানুষটির মাদক সেবন বেড়ে যায়। ক্লান্তিতে ভরে যায় জীবন।

পাশ্চাত্য প্রকরণে মুগ্ধ মানুষটি একদিকে ছিলেন দেশপ্রেমিক, অন্যদিকে ছিলেন ব্রিটিশের কল্যাণকামী ঔপনিবেশিকতায় মুগ্ধ ও আস্থাশীল। ফলে কখন কী ভূমিকা পালন করবেন তা নিয়ে দ্বিধান্বিত থেকেছেন আজীবন। তাই মেদিনীপুরে চাকরি করতে গিয়ে সুজামুঠা পরগণার কৃষকদের দুর্দশা লাঘব করতে তিনি খাজনা কমিয়ে দিয়ে শাসকের কোপের শিকার হন। এদিকে তাঁকে চাষিরা অভিনন্দিত করতে করতে দয়াল রায় নামে বিখ্যাত করে দেন।

দেশপ্রেম ও পাশ্চাত্য বোধে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করতে একের পর এক মঞ্চে সফল পালা উপহার দেন তিনি। পুরাণ ও ইতিহাস মিশ্রিত নাটকের পাশাপাশি সামাজিক পালা এবং প্রহসন মিলিয়ে সংখ্যাটা কম নয়–একুশ। এর মধ্যে ‘সাজাহান’ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্য সৃজন। তেমনি জনপ্রিয় ‘চন্দ্রগুপ্ত’। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘একঘরে’, ‘কল্কি-অবতার’, ‘বিরহ’, ‘সীতা’, ‘তারাবাঈ’, ‘দুর্গাদাস’, ‘রাণা প্রতাপসিংহ’, ‘মেবার পতন’, ‘নূরজাহান’, ‘সিংহল-বিজয়’ ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যে তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। পাঠান-মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে ভারতের অঙ্গরাজ্যের মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মর্মস্পর্শী বিবরণ বার বার তাঁর নাটকগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। নাট্যীয় উৎকণ্ঠা, দ্বন্দ্ব এবং বিক্ষোভ সমাবেশে নাটকগুলি সেকালের দর্শককে রাতের পর রাত মুগ্ধতা দিয়েছে।

১৮৮৮ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর ভাগলপুর ও মুঙ্গেরে থাকার সময় প্রখ্যাত খেয়াল-গায়ক সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের নিকট দ্বিজেন্দ্রলাল সঙ্গীত শিক্ষা করেন। তাঁর সাহচর্যে দ্বিজেন্দ্রলাল একজন দক্ষ সঙ্গীতকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাল্যকালে বাবার কাছেই গানের শিক্ষা। বিলেতে গিয়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও তালিম নিয়েছিলেন। ফলে মুঙ্গেরে গিয়ে তাঁর গানের প্রতিভা স্বপ্ন উড়ান দেয়। সারা জীবনে পাঁচশো মতো গান লিখেছেন। স্বরলিপি সহ ধরা আছে ১৩২টি। তাও ছেলে দিলীপকুমারের যোগ্য প্রয়াসে। বাকি অগোছালো মানুষটির আলগোছে সব এলোমেলো হয়ে আছে ইতি উতি। প্রথমদিকে তাঁর গান ‘দ্বিজুবাবুর গান’ নামে পরিচিতি ছিল; পরবর্তীকালে তা ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ নামে পরিচিত হয়। তাঁর গানের নানা পর্যায়। প্রেম। স্বদেশ। নাটকের গান। হাসির গান। ভক্তিগীতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন হাস্যরসের গানে। সভা সমিতিতে তাঁকে দেখলেই শ্রোতারা দাবি করতেন—‘হাসির গান–দ্বিজুবাবু একটা হাসির গান।’

নন্দলাল কবিতার স্রষ্টা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন যা স্বদেশীদের প্রচণ্ডভাবে উদ্দীপিত করে। পরবর্তীকালে দেশাত্মবোধক গান রচনাতেই তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাঁর রচিত জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য অপ্রাসঙ্গিক হবে না, বন্ধুবৎসল দ্বিজেন্দ্রলাল জগদীশচন্দ্র বসুর অনুরোধে ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার’ সঙ্গীতটির নির্মাণ ও সুরারোপ করেছিলেন।

“ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে” জাতীয় কালজয়ী সৃষ্টিগুলির জনপ্রিয়তা আজও যথেষ্ট। অসাধারণ শিল্পকর্মের মূলতত্ত্ব যে সত্য, সুন্দর ও আনন্দ—দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীতকর্মে তার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে; তাই তাঁর গানে রয়েছে মৌলিকত্বের ছাপ। একটি সুস্থ সঙ্গীতপরিমণ্ডল সৃষ্টিতে তাঁর এ অবদান বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

তাঁকে ঘিরে সমকালের উদাসীনতা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলে তাঁর অকারণ রবীন্দ্রবিরোধীতাকেই দায়ী করা হয়। অভিযোগের মধ্যে সারবত্তা আছে। সারস্বত সমাজে অভিযুক্ত ডি এল রায় তাই আংশিক নির্বাসনে সাজাপ্রাপ্ত। ক্রমাগত ব্যক্তি আক্রমণে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ পালটা আক্রমণে যাননি; ক্ষমাসুন্দর থেকেছেন। অথচ এমন তো হওয়া উচিত ছিল না। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সাধারণভাবে স্বাভাবিক ছিল। ১৩০১ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় কবি রবীন্দ্রনাথ গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আর্যগাথা’ গীতি সংকলনের সপ্রশংস আলোচনা করেছেন। কুষ্টিয়ায় বসবাসকালে দ্বিজেন্দ্রলাল সস্ত্রীক রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। ১৩০৬ সালের ১২ আষাঢ়। নিজের লেখা ‘বিরহ’ নাটক রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছেন (১৩০৪)। তবু নানাভাবে লেখালেখি, সমালোচনা এবং পত্রাঘাতে রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। এমনকি কবিগুরু যখন বিলেতে, তখন ‘আনন্দবিদায়’ নামে প্যারডি-নাটিকা লিখে সাপ্তাহিক বঙ্গবাসীতে প্রকাশ করেন দ্বিজেন্দ্রলাল। শুধু তাই নয় স্টার থিয়েটারে (১৬/১২/১৯১২) তা মঞ্চায়নও করা হয়। যদিও সে নাটক দেখে রবীন্দ্রানুরাগী বাঙালি দর্শক এমন বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন যে, মাঝপথে রঙ্গালয় ত্যাগ করেন দ্বিজেন্দ্রলাল।

কখনও প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনী লেখেন তাঁর বন্ধু দেবকুমার রায়চৌধুরী। সে গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে অনুরোধ করেন রবীন্দ্রনাথকে। বিস্তৃত সেই ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ যা লেখেন, তার সারকথা— ‘দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি এবং আমার লেখায় বা আচরণে কখনও তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি নাই… আর যাহা-কিছু অঘটন ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র।’

‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সূচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল লিখেছিলেন—‘আমাদের শাসন-কর্ত্তারা যদি বঙ্গসাহিত্যের আদর জানিতেন, তাহা হইলে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও মাইকেল পিয়ারেজ পাইতেন ও রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধিতে ভূষিত হইতেন।’ উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ নাইটহুড পান ১৯১৫ সালে আর নোবেল পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালের নভেম্বরে। তারই কয়েক মাস আগে, ১৯১৩ সালের ১৭ মে প্রয়াত হন দ্বিজেন্দ্রলাল।

অবজ্ঞা সয়েছেন আজীবন৷ মৃত্যুর পর একশ বছর কেটে গেলেও এতদিন প্রাপ্য মর্যাদা পাননি ডি এল রায়৷ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ–বাঙালিদের এই দুই আবাসেই তাঁর চর্চা, তাঁর সমাদর খুবই কম৷ কলকাতা শহরে রবীন্দ্র সদন আছে, নজরুল মঞ্চ আছে, মধুসূদন মঞ্চ, গিরিশ মঞ্চ আছে, কিন্তু কোথাও দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের মঞ্চ বা অতুল প্রসাদ সেনের সদন বা রজনীকান্ত সদন এখনও তৈরি হয়নি৷

ঋণস্বীকার – আন্তর্জাল ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২