প্রেমেন্দ্র মিত্রকে যেমন দেখেছি – কিন্নর রায়

শেয়ার করুন

কিন্নর রায়

প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা পড়ি প্রায় বাল্যকাল থেকেই। তাঁর কবিতা ছিল স্কুলপাঠ্য বইয়ে-

“আমায় যদি হঠাৎ কোনো ছলে
কেউ ক’রে দেয় আজকে রাতের রাজা,
করি গোটাকয়েক আইন জারি
দু’এক জনায় খুব ক’ষে দিই সাজা।”

এসব পড়তে পড়তেই যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন ঘনাদা পড়লাম। পড়ে তো হতম্ভব! দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীতে ঘনাদা গোঁফওয়ালা। এই ঘনাদার শিল্পী প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনে ঘনাদার মেসবাড়ি। সেখানে শিশির, শিবু, গৌর, বাপী দত্ত থাকেন। বাপী দত্ত অবশ্য সেখানে কিছুদিন ছিলেন। শিশিরের কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ঘনাদা অনায়াসে বলেন, এই নিয়ে ৯৭১ টা হল। এই সিগারেট ধার করার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে।

ঘনাদার স্টকে অভিযানের অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প আছে, যার সঙ্গে মিশে থাকে অ্যাডভেঞ্চার ও কল্পবিজ্ঞান। প্রেমেন্দ্র মিত্রর প্রথম ঘনাদা-কাহিনী ‘মশা’, প্রকাশিত হয় দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীতে। তারপর একে একে লিখেছিলেন, ‘ফুটো’, ‘ঢিল’-এর মতো অতিবিখ্যাত ঘনাদা-কাহিনী।

এর অনেক বছর পরে লেখেন ‘মান্ধাতার টোপ’। যেখানে আছে জীবন্ত জীবাশ্ম ‘সিলাকান্থ’। তাকেই টোপ করে হ্রদের গভীর থেকে টেনে বার করে আনা হয় একটি ভয়ানক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীকে। এসব পড়তে পড়তে জেনেছি। যেমন আমাদের ছোটোবেলায় একটা বই ছিল ‘ঘনাদা কে ভোট দিন’। তাতে একটা ক্যাচ লাইন ছিল–

“ সফেদ হবে লাল চীন
ঘনাদাকে ভোট দিন ”

পরে, ১৯৭৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে আমি কালীঘাটের ১৬/১ ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে বড়ো মাসিমার বাড়িতে যখন থাকি, তখন প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে আলাপ গভীর হয়, মূলত, ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’, ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘প্রতিক্ষণ’ ও ‘যুগান্তর’-এর সূত্রে। তখন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ওনার বাড়ির গলিতে ঢোকার মুখে ডানদিকে সরকারি লাইসেন্স-প্রাপ্ত ভাং ও গাঁজার দোকান। উলটো দিকে একটা নবগ্রহ মন্দির এবং একটি অতিবিখ্যাত প্রাচীন বারবণিতালয়। নবগ্ৰহ মন্দিরের আগে তবলা, হারমোনিয়াম, তানপুরার একটি দোকান। তো সেই বড়ো মাসিমার বাড়ি থেকে কালীঘাট বাজারের ভেতর দিয়ে এসে ট্রাম লাইন পেরিয়ে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তাঁর বাড়ি যাওয়ার রাস্তা। মিশতে মিশতে ক্রমশ তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে হয়ে উঠলেন প্রেমেনদা। দুই অসম বয়সের সে এক আশ্চর্য বন্ধুত্ব। এই প্রতিভাবান মানুষটি আদ্যন্ত মোহনবাগান সাপোর্টার এবং যেদিন মোহনবাগানের খেলা থাকত ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েও বসে যেতেন টিভির সামনে, খেলা দেখতে।

তখন চোখে ভালো দেখেন না। ব্লাইন্ড ফোল্ড লিখতেন। ডিকটেশন দিতেন। একটি মেয়ে আসত ডিকটেশন নিতে। কিন্তু তাঁর কাজ প্রেমেনদার পছন্দ হত না। কারণ প্রেমেনদা তখন ভাবছেন ঘনাদাকে নিয়ে যাবেন মিশর অভিযানে, নীল নদের উৎস সন্ধানে।

আমরা একটা ক্লাব তৈরি করলাম ‘শার্লক হোমস ক্লাব’-এর ভাবনা মাথায় রেখে। নাম ‘ঘনাদা ক্লাব’। এবং সেই ক্লাবের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ‘স্টেটসম্যান’-এর সাংবাদিক বিশিষ্ট পড়ুয়া ও লেখক ধরণী ঘোষ, ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’-এর সম্পাদক এবং ‘শৈব্যা প্রকাশন’-এর মালিক অত্যন্ত ভালো মানুষ রবীন বল। ছিলেন গল্পকার ও অনুবাদক সিদ্ধার্থ ঘোষ। জয়ন্ত দত্ত বলেও একজন ছিলেন। তিনি মাস্টারমশাই এবং ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ দপ্তরে রোজ আসতেন। এই ক্লাবে আমি এবং লীলা দি — লীলা মজুমদারও ছিলেন।

ঘনাদা ক্লাবের প্রথম সভাটি হয় প্রেমেন্দ্র মিত্রের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ির দোতলায়। সেখানে লীলাদি মানে লীলা মজুমদারও উপস্থিত ছিলেন। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। সে এক হট্টমেলা! ক্লাব তৈরি হল, কিন্তু ক্লাবের লোগো কি হবে?

লোগোটি আঁকলেন প্রখ্যাত শিল্পী রেবতী ভূষণ। তিনি হচ্ছেন খুব বড় আর্টিস্ট, কার্টুনিস্ট। ‘যুগান্তর’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় কাজ করতেন। তারপর দিল্লিতে ছিলেন বহুদিন ‘শঙ্করস্ উইকলি’-তে। রেবতীদা বেলুড়ের মানুষ। তিনি এক চোখ বোজা দাঁড়কাক সেটাকে লোগো করে দিলেন এবং সবাই সমর্থন করল।

লোগো হয়ে গেল। ঘনাদা ক্লাব হয়ে গেল।

এমন হয়েছে তখন, জেল থেকে বেরোনোর পর সেই সময় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি রোজগারের জন্য। কিছু একটা করতে হবে। তখন মহাশ্বেতা দেবী, প্রেমেনদা, বিষ্ণু দে, অসীম রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, সলিল চৌধুরী এদের অনেকের বাড়িতেই প্রায় নিয়মিত যাতায়াত করতে হত কাজের জন্য এবং আড্ডার কথা মাথায় রেখেও। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবিশ ও পরিতোষ সেনের বাড়িতেও নিয়মিত ছিল যাওয়া-আসা।

তো সেই প্রসঙ্গগুলো থাক। প্রেমেনদার কথাই বলি। প্রেমেনদা কোলকাতা রেস কোর্সে গিয়ে রেস খেলতেন। তিনি রেসের মাঠে যেতেন এবং সেখানে রীতিমতো টাকা লাগাতেন ঘোড়ার পিঠে। তার ফলাফলে তিনি গোয়েন্দা আখ্যান লিখলেন, ‘পরাশর বর্মা ঘোড়া কিনলেন ঘুড়িও ওড়ালেন’। ‘পরাশর বর্মা’ প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্টি করা একটি গোয়েন্দা চরিত্র।

পরের দিকে তিনি ‘মেজোকর্তা’ নামে একটা চরিত্র সৃষ্টি করলেন। এই মেজোকর্তা আসলে একজন ভূত-শিকারি, ভূত শিকার করে বেড়ায়। লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর জবানিতে বলেছেন কীভাবে একটা খেরোর খাতা উদ্ধার হয় এবং তার মধ্যেই মেজোকর্তার ভূত শিকারকে নিয়ে নানা তথ্য পান। তিনি লিখেছেন এই খাতার তথ্য থেকেই মেজোকর্তা এবং তার ভূত শিকারের নানা কাহিনী তিনি পেয়েছেন। মেজোকর্তা এবং তার ভূত শিকারের কাহিনী প্রথম প্রকাশিত হয় ছোটোদের পত্রিকা, ‘সবজান্তা মজারু’-তে। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন অনীশ দেব। আমি এই পত্রিকাটির সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলাম। মাস গেলে সাড়ে চারশো টাকা মাইনে। সেটা ১৯৮০-৮১, হদ্য বেকার। এই চাকরিটি আমায় দিয়েছিলেন বিশিষ্ট সায়েন্স ফিকশন লেখক অনীশ দেব। আর ‘সবজান্তা মজারু’ ও ‘মহানগর’-এর মালিক দিব্যেন্দু সিংহকে আমার যাতে এই পত্রিকায় চাকরি হয়, তার জন্য শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলে দিয়েছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই সত্যজিৎ রায়ের ‘তারিণী খুড়ো’ কিন্তু ‘ভূত-শিকারি মেজোকর্তা’-র পরে বেরোতে থাকে। ‘তারিণী খুড়ো’-ও আমার খুব প্রিয় চরিত্র। ‘তারিণী খুড়োকে’ নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী ব্রাজিলের ‘কালো চিতা’-র কথা এখনও মনে আছে। তবু আমি কাউকে কোনোভাবে ছোটো-বড়ো না করেই বলছি — ‘তারিণী খুড়ো’ ভালো লেখা, কিন্তু ‘ভূত-শিকারি মেজোকর্তা’, অপূর্ব!

প্রেমেনদা চোখে প্রায় দেখন না, এটা আমি ১৯৮০-৮১ সালের কথা বলছি। তাঁর দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। দেখতে না পেলে, ম্যাপ, গ্লোব না দেখতে পারলে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক না পড়লে, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা না দেখলে, প্রেমেনদা ঘনাদা লিখতে পারতেন না। ফলে ঘনাদাকে তিনি মহাভারতের যুগে নিয়ে গেলেন। লিখলেন ‘ঘনাদা-ও-মৌকাসাবিস’। তিনি মহাভারতের কথা এরকম একটু এদিক ওদিক করে শুরু করলেন ঘনাদার নতুন কাহিনী এবং সেই লেখাগুলো লিখতে লিখতে একটা ছোটো উপন্যাস লিখলেন ‘সিলাকান্থ’ মাছকে নিয়ে — ‘মান্ধাতার টোপ’। দুর্দান্ত! একটা হ্রদের ভেতর একটা প্রাগৈতিহাসিক ভয়ানক মাংসাশী প্রাণী আছে। তাকে সিলাকান্থের টোপ দিয়ে হ্রদের ওপরে ভাসিয়ে তুললেন ঘনাদা। সিলাকান্থ নামের এই জীবন্ত জীবাশ্ম সম্পর্কে প্রেমেনদা পড়েছিলেন সোভিয়েত দেশ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়। মাত্র কয়েকটি লাইন প্রকাশিত হয়েছিল খবর হিসাবে। এই লেখাটা দেওয়ার কথা ছিল রবীন বল সম্পাদিত ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকায়। কিন্তু আনন্দমেলা থেকে হঠাৎ করে বেশি আর্থিক মূল্য দিয়ে লেখাটি সংগ্ৰহ করে নেওয়া হল আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীর জন্য। লেখাটা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই হইচই পড়ে গিয়েছিল।

অপূর্ব, অসাধারন গান লিখতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সিনেমার গান। সিনেমা পরিচালনাও করেছিলেন — ‘হানাবাড়ি’। সে ছবি সুপার-ডুপার হিট করল। তারপর করলেন ‘ছায়া কালো কালো’। এবং সব শেষে ‘চুপি চুপি আসে’। সিনেমার স্ক্রিপ্টও লিখতেন, যেমন লিখতেন ওনার বন্ধু ‘কয়লা কুঠি’-র লেখক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। সিনেমার চিত্রনাট্য করার সঙ্গে সঙ্গে, তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রের কাহিনীকার ও পরিচালক। শৈলজানন্দ ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর লেখক ছিলেন, যেমন ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ কুমার সান্যাল, গোকুল নাগ প্রমুখ। প্রেমেন্দ্র মিত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে নানা ধরনের কাজ করেছেন। এই ব্যাপারে তিনি ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ কৃতবিদ্য পুরুষ।

প্রেমেনদার দুই ছেলে, হিরণ্ময় আর মৃণ্ময়। ওনার বড় ছেলের একমাত্র মেয়ের নাম ছিল থিয়া। প্রেমেনদা তাঁর প্রিয় নাতনির জন্য একজন মাস্টারমশাই ঠিক করে দিতে বললেন আমাকে। আমি তখন কালীঘাটে বড়ো মাসিমার বাড়িতে থাকি। আমার বড়ো মাসিমার মেজোছেলে, বাপ্পাদা যাকে আমরা মেজদা বলি সবাই, সেই হিরণ্ময় ভট্টাচার্যকে থিয়ার মাস্টারমশাই হিসাবে প্রেমেনদার বাড়িতে নিয়ে গেলাম। প্রেমেনদা মেজদার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন এবং মেজদা থিয়ার মাস্টারমশাই হয়ে গেলেন। মেজদা থিয়াকে পড়াতে গেলে প্রেমেনদা একটা চেয়ার এনে ওই পড়ানোর জায়গাতেই ঠায় বসে থাকতেন। তারপর ধীরে ধীরে মেজদার সঙ্গে প্রেমেনদার একটা অন্য ধরনের সখ্য তৈরি হল।

মোহনবাগান ক্লাব, বাংলা ও ভারতের ফুটবল, সমরেশ বসু ও মহাশ্বেতা দেবীর লেখা, সবই উঠে আসত এই আলোচনায়। যাইহোক, মেজদা বেশিদিন পড়াতে পারেননি থিয়াকে। বছরখানেক পড়িয়েছিলেন।

থিয়ার মা, প্রেমনদার বড় বৌমা, তাঁর সমস্ত লেখালেখি, বইপত্র, সব গুছিয়ে রাখতেন। প্রেমেনদার মৃত্যুর পর তাঁর ফাইল থেকে দু-চারটে অপ্রকাশিত কবিতাও খুঁজে পাওয়া যায়। এবং সেগুলি পরে ছাপাও হয়। আমার বড়ো মাসিমার ছোটোছেলে বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য তখন বড়ো ফুটবলার। পরে সে নাম করা কোচও হয়েছে। বিশ্বজিৎ মোহনবাগানে খেললে প্রেমেনদার প্রবল উৎসাহ। তিনি মেজদার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্বজিতের খবর নিতেন। আমার কাছ থেকেও নিতেন।

প্রেমেনদার ছোটো বউমা যেদিন প্রয়াত হন, আমার বড়ো মাসিমার বড়ো-জা, যাকে আমরা ‘সুন্দর মা’ বলে ডাকতাম, তিনিও প্রয়াত হন। তখন ঘন শীত। রাতে যখন ক্যাওড়াতলা শ্মশানে আমরা ‘সুন্দর মা’-কে নিয়ে গেছি দাহ করতে তখন প্রেমেনদার পরিবারের সঙ্গে শ্মশানেই দেখা হয় এবং আমি তথ্যটি জানতে পারি ।

প্রেমেন্দ্র মিত্র সবসময় নিজেকে একটা কুহকি আবরণের মধ্যে রাখতেন। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনার জন্ম কোথায়?’ উনি উত্তরে বললেন, ‘আমি তো ঢাকাতেও ছিলাম’। সোজাসুজি উত্তর দিলেন না। ঢাকাতে জন্মেছিলেন না কলকাতাতে এটাও একটা মিস্ট্রি আছে, যদিও অনেক তথ্যে পাচ্ছি তাঁর জন্ম বারাণসীতে। মানে ওরকম একটা রহস্য ও ধাঁধা তৈরি করতে ভালোবাসতেন, অনেকটা ঘনাদার মতো।

আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ঘনাদাকে নিয়ে সবচেয়ে ভালো লেখা ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’। লেখাটি অপূর্ব! এই লেখাটি শ্রী তুষারকান্তি ঘোষ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে বেঙ্গল পাবলিশার্স বই করে। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী রবীন দত্ত। পরে আনন্দ পাবলিশার্স যখন বই করেছে তখন স্বাভাবিকভাবেই মলাট বদলেছে। পুরো লেখাটাই যুক্ত হয়েছে ঘনাদা সমগ্ৰে। দু-খণ্ডে ঘনাদা সমগ্ৰ সম্পাদনা করেছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত।

ঘনাদার পূর্বপুরুষেরা কেমন ছিলেন, কেমন করে কাঠের রথ ব্যবহার করে স্প্যানিশ দস্যু – হার্মাদদের বিরুদ্ধে লড়াই হল, সে এক ইতিহাস! স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদীরা পিজারোর নেতৃত্বে দক্ষিণ আমেরিকায় ঢুকে পড়ে আজটেক ও ইনকা সভ্যতাকে ধ্বংস করে, তার বিবরণ আমরা অনেকেই জানি। এই যে লাতিন আমেরিকা – দক্ষিণ আমেরিকা, পিজারোর অভিযান, তা সমস্ত পেরুকে শ্মশানে পরিণত করে। তাদের পুরোনো পিরামিড – উপাসনালয় ও সমাধিক্ষেত্র নির্বিচারে ধ্বংস ও লুণ্ঠন চালায় পিজারো-বাহিনী। মন মন সোনা লুঠ করে তারা। নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। ইউরোপ থেকে তারা নিয়ে এসেছিল সিফিলিস ও গনোরিয়া নামের কুৎসিত যৌনরোগ। আর এনেছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য নিজেদের উদ্যোগ। রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানি ইসাবেলা ছিলেন পিজারোর সমর্থক। ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, যা-যা কুৎসিত কর্ম ঔপনিবেশিক শাসকরা করে থাকে, পিজারো সবই করেছিল।

‘সূর্য কাঁদলে সোনা’, এই লেখাটির কথা আজকাল তেমন করে কেউ বলে না। অথচ এটা প্রেমেনদার শ্রেষ্ঠ গদ্যকর্ম। তিনি ঘনাদার বিচিত্র অভিযান হিসাবে লিখেছেন ‘মঙ্গলগ্ৰহে ঘনাদা’, ‘তেল দিলেন ঘনাদা’।

ঘনাদাকে নিয়ে বহু শিল্পী তাঁদের পছন্দ মতো ছবি তৈরি করেছেন। এখানে দেব সাহিত্য কুটিরে প্রথম ঘনাদা-কাহিনী ‘মশা’-র ঘনাদার ছবিটি এঁকেছিলেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবিতে ঘনাদার নাকের নীচে পাকানো, মোটা, পেল্লায় গোঁফ।

অজিত গুপ্ত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ঘনাদা-কাহিনীতে যে ছবি এঁকেছেন ঘনাদার সেটিই সবথেকে বেশি পরিচিত। উনি আমার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ইলাস্ট্রেটর ঘনাদার। তাঁর ঘনাদা একেবারে টিপিকাল ঘনাদা। এখানে ঘনাদার গোঁফ নেই। মাথার চুল ব্যাক ব্রাশ করা। এছাড়াও ঘনাদার ছবি এঁকেছেন অহিভূষণ মালিক, সুবোধ দাশগুপ্ত, ধ্রুব রায়, প্রমুখ।

প্রেমেনদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি ঘনাদা চরিত্রটি তৈরি করলেন কেন?’

প্রেমেনদা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দ্যাখো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বাঙালির মধ্যে একটা বোলচাল মারার ব্যাপার তৈরি হল। বাঙালি প্রথম থেকেই মুখে বড়ো বড়ো কথা বলত ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি বাঙালির যৌথ পরিবারে থাকা, সবাই মিলে একসঙ্গে ফুটবল মাঠে বা সিনেমা দেখতে যাওয়া, একই সঙ্গে মেস বাড়িতে থাকা, এসবই ছিল বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য।’

এছাড়া ঘনাদা-কাহিনীতে, ঘনশ্যাম দাস – ঘনাদার পূর্বপুরুষ, ঘনরামের কথা আছে। আছে গানাদোর কথাও।

এর পাশাপাশি প্রেমেন্দ্র মিত্র যে-সব ছোটোগল্প লিখেছেন তা বাংলা সাহিত্যে উজ্বল সম্পদ। ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ দু-বার চলচ্চিত্রায়িত হয়। প্রথমে পূর্ণেন্দু পত্রী করেন, ‘স্বপ্ন নিয়ে’। সেই চলচ্চিত্রায়ন প্রেমেনদার পছন্দ হয়নি। এর বেশ কয়েক বছর পর মৃণাল সেন হিন্দিতে করেন ‘খণ্ডহর’। এই ছবিতে ‘যামিনী’ চরিত্রটি করেন শাবানা আজমি। অসামান্য সেই অভিনয়! এছাড়াও এই ছবিতে অন্নু কাপুর, নাসিরুদ্দিন শাহ-ও অসাধারণ কাজ করেন। তাঁর অন্যান্য গল্পগুলির মধ্যে আছে, ‘শুধু কেরানী’, ‘স্টোভ’, ‘পুন্নাম’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘পোনাঘাট পেরিয়ে’, ‘সংসার সীমান্তে’। অসামান্য সে-সব গল্প! ‘সংসার সীমান্তে’ নিয়ে সিনেমা বানিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। সেই চলচ্চিত্রে ‘অঘোর’ নামের চোরের পাঠটি করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অঘোরের সাগরেদ, আর-এক চোর ‘লুগদি’ করেন সন্তু মুখোপাধ্যায়।

ছায়াদেবী করেছিলেন বেশ্যাবাড়ির মাসির চরিত্রটি। সে-ও দারুণ অভিনয়! ছিলেন সন্ধ্যা রায়। তিনি এই ছবির নায়িকা।

প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন উপন্যাস নুট সামসুন অবলম্বনে, ‘পাঁক’। সে উপন্যাস একসময় খুব আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু সে নিয়ে এখন আর কেউ সেভাবে কথা বলে না।

প্রেমেনদার সঙ্গে খুব আড্ডা মারতাম এবং তখন আমার কোনো চাকরি নেই। নানা জায়গায় খেপ খাটি। সেই সময় প্রেমেনদা ‘যুগান্তর’-এর সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরীকে ফোন করে বলেন, ‘অমিত, কিন্নরকে তোমরা চাকরি দাও না কেন?’ একইভাবে, কথাসাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ‘যুগান্তর’-এর অমিতাভ চৌধুরী এবং দেবব্রত মুখোপাধ্যায়কে বলেন, ‘কিন্নরকে একটা চাকরি দিন। আমার ছেলে থাকলে আমি হয়তো তার চাকরির জন্য বলতাম না। কিন্তু কিন্নরের চাকরির জন্য বলছি।’ আশুদার একমাত্র ছেলে, জয় দুরারোগ্য মাসকুলার ডিসট্রফি নামের অসুখে খুব অল্প বয়সে মারা যায়। এরপরে থেকে যায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর একমাত্র কন্যা সর্বাণী মুখোপাধ্যায় – বুলবুল।

প্রেমেনদা ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক প্রশান্ত সরকার, ‘রবিবাসরীয়’-র সম্পাদক কবি কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করে বলেন, ‘কিন্নরকে একটা চাকরি দাও না কেন?’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ফোনে ‘দৈনিক বসুমতী’-র সম্পাদক প্রশান্ত সরকার ও ‘রবিবাসরীয়’-র সম্পাদক কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন, ‘কিন্নরকে চাকরি না দিলে আমি আর তোমাদের শারদীয় সংখ্যায় লিখব না।’ এঁদের দুজনের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

প্রেমেনদা ছোটদের মাসপত্র ‘পক্ষীরাজ’ সম্পাদনা করতেন। কিন্তু সম্পাদক হিসাবে নামটাই শুধু তাঁর থাকত এবং তার বিনিময়ে তিনি সাম্মানিক পেতেন। এই কাগজের পুরো কাজটাই দেখতেন মনোজ দত্ত নামের একজন লেখক ও শিক্ষক। মনোজবাবু খুব বই পড়তেন, নানা ধরনের বই। ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এবং ঘন ঘন সিগারেট খেতেন।

‘পক্ষীরাজ’-এর মলাট এঁকেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। ‘পক্ষীরাজ’-এর মলাটে ছিল কেশর ফোলানো উড়ন্ত এক ঘোড়া, যেন ভারতীয় গল্পকথার, পক্ষীরাজ। তার ভাবনা পূর্ণেন্দুদার মাথা থেকেই এসেছে। বেশ কিছু বছর চলার পর অবশ্য তা বন্ধ হয়ে যায়।

‘যুগান্তর’-এর ছোটোদের পাতা— ‘ছোটোদের পাত্তারি’ বেরোত পত্যেক মঙ্গলবার। বহু বছর আগে এই ‘ছোটোদের পাত্তারি’-র সম্পাদনা করতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তখন তার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। তবু চশমা পড়ে চোখের সামনে মোটা বড়ো আতস কাছ রেখে তিনি পড়বেনই। তাঁর বড়ো বউমা তাঁকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন। ছোটো অক্ষর প্রেমেনদা তখন পড়তে পারেন না। তাই এই শ্রুতি-পাঠ। আমি বহুবার ওনার বাড়িতে গিয়ে দেখেছি প্রেমেনদাকে তাঁর বড় বউমা দৈনিক পত্রিকা পড়ে শোনাচ্ছেন। আর প্রেমেনদা মন দিয়ে শুনছেন। ‘যুগান্তর’-এর ‘ছোটোদের পাত্তারি’-তে আমার একটি ছড়া পড়েছিলেন প্রেমেনদা। ওনার বাড়িতে গেলে আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো ছড়া লিখতে পারো। ‘পক্ষীরাজ’-এর জন্য একটা ছড়া দাও।”

আমি তো বিস্মিত! প্রেমেন্দ্র মিত্র আমার ছড়া কীভাবে পড়লেন! সঙ্গে সঙ্গে প্রেমেনদার গালে সামান্য বাঁকা হাসি। তিনি তাঁর অসম বয়েসি বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন? আমি কি খবরের কাগজ পড়ি না?’

এটাও নেহাৎ ‘প্রেমেন্দ্রীয়-ঘনামি’ ভেবে আমি ভিতরে ভিতরে বিস্মিত হচ্ছি না, কিন্তু মুখে বিস্ময়ের ভাব প্রকাশ করে জানতে চাইলাম, ‘কোথায় পড়লেন?’

প্রেমেনদা বললেন, “কেন, যুগান্তর ‘পাত্তারি’-তে। তুমি তো ছড়া লিখেছ।”

সঙ্গে সঙ্গে ছড়াটা আমার মনে পড়ে গেল। ছড়াটা এরকম–

“সবজে ফড়িং নাচছিল
গলা ছেড়ে গান গাচ্ছিল
পুকুর পাড়ে জংলা ঘাসে
ব্যাঙ বাবাজির বাস ছিল।
গানের চোটে দৌড়ে এসে
ফড়িংটাকে ধরলে ঠেসে
হাওয়ার পানে মুখটি তুলে
বললে, খাসা রাগ ছিল।”

প্রেমেনদা আমাকে বললেন, “তুমি ‘পক্ষীরাজ’-এর জন্য ছড়া দাও। আমার বাড়িতেই দিয়ে যাবে। আমি মনোজকে দিয়ে দেব।” যথারীতি আমি আমার ছড়া নিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে হাজির প্রেমেনদার বাড়ি।

উনি আমার ছড়াটা নিয়ে পড়তে বললেন। আমি পড়লাম।

উনি বললেন, “ঠিক আছে, রেখে দাও।”

এর কয়েকদিন পর ‘পক্ষীরাজ’-এর পাতায় আমার ছড়া ছাপা হল। প্রেমেনদার বাড়িতে গেছি। উনি একটা কপি দিয়ে বললেন, “এই নাও তোমার কপি। পত্রিকা পাওয়ার জন্য তোমায় কলেজস্ট্রিটে ঘুরতে হবে না।” কলেজস্ট্রিটেই ‘পক্ষীরাজ’-এর দপ্তর। তারপর একটু থেমে তিনি বললেন, “এই ছড়াটার জন্য তুমি টাকা পাবে। আমি টাকা এবং ভাউচার আমার কাছে রেখে দেব। তুমি ভাউচারে সই করে টাকাটা নিয়ে যাবে।” আমি বললাম, “কেন? আপনার বাড়ি থেকে কেন? ‘পক্ষীরাজ’ দপ্তরে গেলে হয় না?”

উনি ঘাড়টা সামান্য নীচু করে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “তুমি কিছুই বোঝো না। পত্রিকা দপ্তরে টাকা চাইতে গেলে ওরা তোমাকে ঘোরাবে। একবার নয়, বারবার। কতবার তুমি যাবে? তাই আমি তোমার টাকা এবং ভাউচার আনিয়ে রাখব।” ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি তো লজ্জায় কাঠ। প্রেমেনদা আমাকে এত ভালোবাসেন?

এর কয়েকদিন পর প্রেমেনদার বাড়ি গেলে উনি কড়কড়ে দুখানা দশ টাকার নোট আর একটা হলুদ রঙের ভাউচার এগিয়ে দিয়ে বলেন, “এটায় সই করো।” আমি তখন ভেতরে ভেতরে কাঁপছি। আবেগে।

এত বড়ো একজন লেখক, আমার থেকে বয়েসেও অনেক বড়ো, তিনি আমার জন্য এভাবে টাকা নিয়েছেন! আমার চোখে জল। তখন হদ্য বেকার। কোনো আয়ই প্রায় নেই। এই সময় কুড়ি টাকা অনেক।

আমি ভাউচার সই করে প্রেমেনদাকে ফেরত দিই। উনি ওঁর বড়ো পুত্রবধূকে ডেকে ভাউচারটি গুছিয়ে রাখতে বলেন। এই হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বড় মাপের মানুষ প্রেমেন্দ্র মিত্র।

এরকম একটা মানুষকে দেখেছি বাড়িতে একেবারে টঙের ঘরে থাকতেন। ওখান থেকে জেলখানার পাঁচিল দেখা যায়। আলিপুর জেলের লাল রঙের দেয়াল। পাশে খাল। উলটো দিকে বিখ্যাত বারবণিতালয়, প্রাচীন নবগ্ৰহর মন্দির এবং বাটার জুতোর দোকান। এখান থেকে সারাবছরই রিডাকশন সেলে কম দামে বাটার জুতো পাওয়া যেত। এই টঙের ঘরে বসেই বহু ধরনের লেখা লিখেছেন, গান লিখেছেন, সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, সিনেমা পরিচালনার কথা ভেবেছেন, একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বহুদর্শী মানুষ।

‘সাগর থেকে ফেরা’ তাঁর লেখা কাব্যগ্ৰন্থ। এই গ্রন্থটির জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। কিন্তু প্রেমেনদার কবিতা আমার কাছে এখন আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। যদিও তাঁর কিছু লাইন, ‘আমি কবি যত মজুরের…’ কিংবা ‘…অরণ্য ডাকে যাই’, এখনও কোটেশন-যোগ্য হয়ে আছে। উনি মনে করতেন, জীবনানন্দ কোনো বড়ো কবি নন। এডগার অ্যালান পো-এর কবিতা থেকে জীবনানন্দ ইনফ্লুয়েন্সড। ‘যুগান্তর’-এ ‘রবিবারের পাতা’-য় প্রেমেনদা এডগার অ্যালান পো এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাশাপাশি রেখে এই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতা বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন, সকলকে ছাপিয়ে এক প্রায় অবিনশ্বর বিষাদবিন্দু হয়ে উঠেছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র ‘উটপাখি’ বা ‘অর্কেস্ট্রা’, বিষ্ণু দে-র ‘সন্দ্বীপের চর’, ‘ঘোড়সওয়ার’, ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’, শেষ পর্যন্ত ম্লান হয়ে যায় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘ঝরা পালক’ অথবা ‘বনলতা সেন’-এর কাছে।

জীবনানন্দ সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা কবি। গদ্যকারও। যদিও তিনি প্রথম জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ছায়ায় খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তিনি সেই প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসেন এবং নিজের কাব্যভাষা তৈরি করেন। যেমন যামিনী রায় তাঁর আঁকাআঁকির প্রথম জীবনে ইউরোপীয় মাস্টারদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরে তিনি সরে আসেন ভারতীয় গড়নে। এখানে আশ্চর্য মিল দুজনের। বরিশাল থেকে আসা কবি জীবনানন্দ দাশ এবং বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় বা বেলেতোড় থেকে আসা যামিনী রায় নিজেদের পালটে ফেলেন। যামিনী রায় নিজেকে “যামিনী পটুয়া” বলতেন। পরবর্তীকালে তাঁর অঙ্কনে উঠে এসেছে বাংলার পট ও লৌকিক আঙ্গিক। যিশু খ্রিস্ট ও মেরি-মা, যোসেফ, সবই পট আঙ্গিকে।

প্রেমেনদা নানারকম অ্যাডভেঞ্চারে বিশ্বাস করতেন। তখন তার কম বয়েস। হঠাৎ পরিকল্পনা করলেন হাঁটতে হাঁটতে কলকাতা থেকে গঙ্গার পার ধরে চলে যাবেন হিমালয়ে গঙ্গার উৎসমুখ পর্যন্ত। কলকাতা থেকে গঙ্গোত্রী এই অভিযান স্বপ্ন শুধুমাত্র স্বপ্নই থেকে গেছে। বাস্তবায়িত হয়নি। তার নানা কারণ ছিল। মূলত, স্পন্সরশিপের অভাব এবং খানিকটা প্রেমেনদার গেঁতোমি ব্যাপারটাকে সফলতার জায়গায় নিয়ে যেতে পারেনি।

আমরা কেউ গেলে ’পরে উনি জিজ্ঞাসা করতেন যে “তোমার পদবি কি?” তারপর বলতেন, “তোমার মেল কি, গোত্র কি, গাঁই কি, প্রবর কি?” আমি তো সব জানি না। গোত্রটা হয়তো জানি। কিন্তু প্রবর তো জানি না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি এসব জিজ্ঞাসা করলেন কেন? আপনি কি খুব জাত-পাতে বিশ্বাস করেন?” বললেন, “না আমি এসব কিছুই মানি না, কিন্তু আমি জানতে চাই একটা মানুষের শিকড় কোথায় আছে। সেই শিকড়টা কে আমি খুজে পেতে চাই। এজন্য ঘনাদার বংশতালিকা আমি তৈরি করি ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’-তে। তুমি তো পড়েছ।” উনি তো আমাকে খুব পছন্দ করতেন, আমি খুব দ্রুত পড়তে পারতাম এবং পড়ে বলতে পারতাম বলে। উনি অনেক বই উপহারও দিয়েছিলেন আমাকে।

‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর লেখকেরা ‘বোহেমিয়ান’ হতে চাইতেন। কোলকাতা ও চন্দননগরের বেশ্যাপল্লী, পানশালা, বিবিধ এলোমেলো কাজ করা, এ-সবই ছিল তাঁদের জীবনযাপনের অঙ্গ। কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকেরা মনে করতেন, এলোমেলো, বোহেমিয়ান জীবনযাপন না করলে লেখাটি লেখা হয়ে ওঠে না। তাই তাঁরা কলকাতা ছেড়ে কখনও কখনও চলে যেতেন চন্দননগরে। ফরাসিনী বারবণিতা এবং ফরাসি সুরার আকর্ষণে।

একইভাবে, ‘কৃত্তিবাস’-এর তথাকথিত ‘বোহেমিয়ান’-রা কোলকাতার শ্মশানঘাট, জুয়ার ঠেক, বাংলা মদের আড্ডা, বেশ্যাপল্লী, সমস্ত জায়গায় নিজেদের গতিবিধি অবাধ করে, হঠাৎ হঠাৎ চাইবাসা ইত্যাদি জায়গায় চলে গিয়ে নিজেদের লেখাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন। যদিও ‘কল্লোলীয়’-দের তুলনায় তাঁদের এই জীবনযাপন নেহাতই ‘বামন’ বলে মনে হয়। সমকামী কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও তাঁর পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে কৃত্তিবাসি ও হাংরিরা টানাটানি শুরু করেন। ফলে ‘কৃত্তিবাসী’-দের লেখা একটি জায়গায় গিয়ে আটকে যায়।

প্রেমেন্দ্র মিত্র এক বহুমুখী প্রতিভা। নানা বিষয়ে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কল্লোল গোষ্ঠীর তিনি শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি। তাঁর তুলনায় বাকিরা — প্রবোধ কুমার সান্যাল, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, সকলেই খানিকটা স্তিমিত। প্রবোধ কুমার সান্যাল যখন ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকায় তাঁর আত্মজীবনী ‘বনস্পতির বৈঠক’ লিখতে শুরু করেন, তখন কোনো এক প্রসঙ্গে তিনি প্রেমন্দ্র মিত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এর ফলাফলে প্রেমেনদা তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার মার্কশিট ও সার্টিফিকেট পেশ করেন ‘দেশ পত্রিকা’-র পাতায়। ‘কল্লোল’ যুগের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা প্রেমেন্দ্র মিত্র। কতরকম কাজ করেছেন তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র নির্মাণ, এসবের কথা আগেই বলা হয়েছে। বাচ্চাদের জন্যে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ ধরনের একটি প্রাইমার তৈরি করেন। সেটি অপূর্ব! রবীন বল সম্পাদিত শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ থেকে এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল এবং আমার দেখার সৌভাগ্যও ঘটেছিল। দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।

এরপর একসময় যখন ‘কল্লোল’ বন্ধ হয়ে গেল, ‘কল্লোল যুগ’ লিখে ফেললেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। প্রেমেনদা আবার ‘কালি কলম’ পত্রিকা সম্পাদনা করলেন। তখন সেই ‘কালি কলম’ একটা মোটামুটি জায়গা করে নিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে। প্রেমেন্দ্র মিত্র সবসময় তরুণদের উৎসাহ দিতেন।

ওনার বাড়িতে প্রায় বাড়ির লোকের মতোই অ্যাডাপ্টেড হয়ে গেছিলাম। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তাঁর বাড়ির মধ্যে ঢুকে একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা টঙের ঘর, যেটার কথা ঘনাদায় উনি বারবার বলেছেন, সেটাতেই উনি থাকতেন। ঘরে একটা দেয়াল আলমারি মধ্যে রবীন্দ্ররচনাবলী একেবারে ভর্তি। বাড়িতে সাদা পাট করা কাপড় বা লুঙ্গি, তার উপর একটা সাদা হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরতেন। পরিষ্কার, টিপটপ, দাড়ি কামানো। এলেবেলে বিচ্ছিন্নভাবে কখনও দেখিনি ওনাকে। রূপবান ছিলেন কিন্তু খর্বকায়। তখন স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি থাকত টেবিলের ওপর। নিজেরও একটা ছবি থাকত। এরকম একটা মানুষ আমার মতো একটা অগুরুত্বপূর্ণ লোককে কতখানি গুরুত্ব দিতেন, বসে বিস্তীর্ণ গল্প করতেন, নিজের কথা বলতেন।

তখন পরিমল নস্যি বলে একটা সুন্দর সুগন্ধি নস্যি পাওয়া যেত। সেটা বাজারচলতি অন্য নস্যির থেকে আলাদা। প্রেমেনদা লেখার সময় কিংবা সভাসমিতিতে গেলে সুগন্ধি পরিমল নস্যি রাখতেন তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের টিপে। প্রায় সময়ই নস্যি নিতেন না। কিন্তু টিপটা ধরা থাকত। তার টঙের ঘরে পায়চারি করার সময়ও কখনও কখনও হাতে নস্যির টিপ ধরে রাখতেন।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা বাঙালির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। পড়তে গেলে একটা মস্তিষ্কে চর্চার প্রয়োজন হয়। সেটা চট করে বা হালকাভাবে হয় না। ঘনাদা ব্রিলিয়ান্ট! তার যে বৈজ্ঞানিক ভাবনা, সেটা তো অপূর্ব!

প্রেমেনদা যেদিন মারা যান, সেটা ছিল কোনো একটা গরমের দিন। তখন আমি ‘যুগান্তর’-এ। খবর পেয়ে ওনার বাড়িতে আসি এবং সেই শেষযাত্রায় অংশ নিই। প্রেমনদার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি থেকে ক্যাওড়া তলা মহাশ্মশানের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু অনেক পথ ঘুরে আমরা সবাই শ্মশানে পৌঁছই। খুব যে ভিড় হয়েছিল, এমন নয়। নিমাই ভট্টাচার্য ছাড়া কোনও নামীদামি লেখককে প্রেমেনদার এই শেষযাত্রাপথে দেখিনি। নিমাইদা সারাক্ষণই ছিলেন। ‘এষোণা’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন এবং আরও দু-একটি ছোটোখাটো পত্রপত্রিকা তাঁর বুকের উপর রাখা ছিল।

আমার সৌভাগ্য যে আমি প্রেমেনদার স্নেহ পেয়েছিলাম। অকৃপণভাবে স্নেহ করতেন তিনি। সুভাষদা – সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, অসীম রায়, মহাশ্বেতা দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, এরকম অনেকের কাছেই একটা সময় নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিল।

এত স্নেহ পেয়েছি এনাদের কাছে যে এখন আর সাহিত্য জগতের ‘সেলিব্রিটি’-দের সঙ্গে মেলামেশা করার কথা ভাবতেই পারি না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, পূর্ণেন্দু পত্রী, এঁদেরও অকৃপণ স্নেহ পেয়েছি আমি।

প্রেমেনদার কথা এত বছর পরেও মনে পড়ে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তাঁর হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ওই বাড়িতে চলে যাই। বাড়িতে ঢুকেই বাঁ দিকে ঘোরানো সিঁড়ি। সেখানে উঠে বন্ধ দরজায় টকটক করলে কেউ না কেউ এসে দরজা খুলবেই। কোনো কোনোদিন হয়তো প্রেমেনদা। সেই বাড়িতে অনেকগুলো পোষা সুন্দর সুন্দর বেড়াল ছিল। বেশিরভাগই প্রেমেনদার বড়ো পুত্রবধূ এবং তাঁর একমাত্র নাতনি, থিয়ার পোষা। এদের নানারকম নাম ছিল, আলাদা আলাদা। সেসব নাম আর মনে নেই। কিন্তু ওই টঙের ঘরে আবার পৌঁছতে ইচ্ছে করে যেখানে থাকেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।

শেয়ার করুন

Similar Posts

6 Comments

  1. আমার প্রিয় লেখকদের অন্যতম প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর সম্পর্কে কিন্নর রায় মহাশয়ের এহেন অসাধারণ সুন্দর সাবলীল স্মৃতিচারণ আমায় মুগ্ধ করলো। আনন্দ পেলাম। শুভেচ্ছা।

      1. আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র অন্যতম। প্রবন্ধটি পড়ে অনেককিছু জানতে পারলাম, ভালো লাগলো।

  2. আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে পড়লাম লেখাটা, পাক্ষিক পক্ষীরাজ একসময় আমিও পড়তাম আমার কিশোরবেলায়। শুকতারার মতো প্রচ্ছদে একটা দিলীপ দাসের কমিকস থাকতো। ধন্যবাদ কিন্নর বাবুকে আমার ফেভারিট লেখককে নিয়ে এই লেখার জন্য, ভালো থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *