গোর্খাল্যান্ড ও জাতিসত্তা – অমিত ভট্টাচার্য্য [ প্রথম অংশ ]
গোর্খা নেপাল ও উত্তর ভারতের একটি জাতিগোষ্ঠী। গোর্খা নামটির উৎপত্তি অষ্টম শতাব্দীর হিন্দু যোদ্ধা-সন্ত গুরু গোরক্ষনাথের নাম থেকে। তাঁর শিষ্য বাপ্পা রাওয়াল (জন্মগত নাম যুবরাজ কালভোজ বা যুবরাজ শালিয়াধীশ) রাজপুতানার মেবার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। বাপ্পা রাওয়ালের পরবর্তী উত্তরাধিকারগণ আরও পূর্বে চলে এসে গোর্খা বংশের প্রতিষ্ঠা।
গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বুঝে নিতে হবে আধুনিক নেপালকে, জানতে হবে নেপাল এবং দার্জিলিঙের ইতিহাস।নেপাল দেশটি গঠন এবং আর্থসামাজিক অগ্রগতির দিক দিয়ে মোটামুটি চার ভাগে বিভক্ত:
১) প্রথম ভারতবর্ষের সীমানা পার্শ্ববর্তী তরাই অঞ্চল,দক্ষিণ দিক। সাধারণভাবে সমতল এবং উর্বর। এটাই নেপাল দেশের শস্যভাণ্ডার।
২) তরাই এর উত্তরে শিবালিক। ছোটো, মাঝারী পর্বতমালার মধ্যে সবথেকে উঁচু পর্বতমালা ১৫০০ মিটার এর মধ্যে। শিবালিক এর পরে মহাভারত রেঞ্জ, এখানে পর্বতমালার উচ্চতা ৩০০০ মিটার অবধি। এই এলাকাতে অনেক মানুষ থাকে।
৩) এর উত্তরে উপত্যকা। খুব উর্বর এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু অবস্থিত।
৪) এর উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। এখানে মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা , সবই অবস্থিত।
নেপাল এর অর্থনীতিতে শুধু নয়, এখন সেখানকার রাজনীতিতে ওই তরাই অঞ্চল বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখানে অনেক বড় সংখ্যার মানুষ বাস করেন এবং এদের বেশি ভাগই হচ্ছে ভারতের বংশোদ্ভূত। সাধারণত এদের মদেশীয় বলা হয়। এদের একটা অংশ তরাই কে নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন করার নীতিতে বিশ্বাসী এবং উদ্যোগী।এমনিতেই তরাই নেপালের সিংহদুয়ার, অন্যতম প্রধান উন্নত এলাকা। ওই দেশে শিল্প যা আছে, তার প্রধান অংশ ওই তরাইতে । এর সাথে নেপাল এর রাজনীতিতে তরাইয়ের এর হস্তক্ষেপ, একটা বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। অবশ্য নেপাল এর অভ্যন্তরে অনেক কাল ধরে ভারত বিরোধী শক্তি সক্রিয়। নানান ছুতোয়, তারা ভারত-নেপাল সম্পর্ক খারাপ করতে চায়। এইরকমই একটা শক্তি গ্রেটার নেপাল এর দাবিতে সোচ্চার। সি পি আই (এম) এর কোয়েম্বাটোরে, ১৯ তম পার্টি কংগ্রেসে, এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা হয় যে, এর মধ্যে তরাই অঞ্চলে জঙ্গি মদেশীয় আন্দোলন গড়ে উঠেছে যারা ভবিষ্যতে সমস্ত সরকারী গণতান্ত্রিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার দাবি তুলেছে। গণতন্ত্রে উত্তরণের শক্তি প্রক্রিয়াকে বিপথে পরিচালিত করতে এই ঘটনাকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, জনজীবনে বিভাজন ঘটানোর লক্ষ্যে ব্যাবহার করে চলেছে।
১৮১৬ তে ব্রিটিশ এর সাথে নেপালের সুগাউলি চুক্তি অনুযায়ী, এদের দাবী মত হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, সিকিম, পশ্চিম বঙ্গের দার্জিলিং জেলা (শিলিগুড়ি নিয়ে) অনেকটা এলাকা নেপাল এর হাত থেকে ব্রিটিশের হাতে চলে যায়। ভারত স্বাধীন হবার পরে ১৯৫০ সালে নেপালের সাথে চুক্তি হয়। ওদের বক্তব্য, পুরনো ব্রিটিশদের চুক্তির কোনও অর্থ নেই, অতএব ২০০ বছর আগের সব জায়গা ফেরত দাও, আর না ফেরত দিলে, ওদের এক নেতার কথায়, কাশ্মীরের থেকেও বেশী আগুন জ্বলবে এই সব অঞ্চলে। ওদের এক নেতার কথায়, “I have visited these areas and found that Nepalese of Indian origin as well as Nepalese forced to seek menial jobs in India support the demand”
গ্রেটার নেপাল গড়ার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে ইউনিফাইড নেপাল ন্যাশনাল ফ্রন্ট (UNNF), এই ফ্রন্ট এর পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গ্রেটার নেপাল এর ম্যাপ প্রকাশিত করা হয় আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং ইংল্যান্ড এর রানীর কাছে দাবী-সনদ পেশ করা হয়।গ্রেটার নেপাল এর ম্যাপ এ পশ্চিমবঙ্গ( শিলিগুড়ি এবং ডুয়ার্স নিয়ে) আর গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে জঙ্গি আন্দোলনকারী হুমকি দেওয়া গোষ্ঠীর ম্যাপ, কাকতালীয় ভাবে এক। গ্রেটার নেপালের প্রবক্তাদের মূল কথা হচ্ছে, ১৮১৬ সালের সুগাউলি চুক্তি বে-আইনি, জোর করে ব্রিটিশ নেপালের কাছ থেকে এলাকা নিয়ে নিয়েছিল, এখন ব্রিটিশ চলে গেছে, তাই ভারতকে নেপালের জায়গা ফেরত দিতে হবে। অর্থাৎ মামলা ভারতের মধ্যে শুধু আলাদা গোর্খাল্যান্ড রাজ্য নয়, ভারত থেকে বেরিয়ে নেপালে যুক্ত হওয়া। মামলা শুধু দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার দেওয়া নয়, সিকিম, উত্তরাঞ্চল দিয়ে দেবার।
ইতিহাসের দিক থেকে বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যায় যে দার্জিলিং কোনোদিনই নেপালি দের নিজস্ব জায়গা বা (place of origin) ছিল না। দার্জিলিংয়ের ইতিহাস নিয়ে বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সাড়ে তিন শতাব্দী আগে। নেপালের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারবার শুরু হয় ১৭৬৭ তে। কাঠমান্ডু উপত্যকাতে চারটি ছোট ছোট নেওয়ারি বা মাল্লা রাজার সাম্রাজ্য ছিল তখন। মাল্লা রাজাদের রাজত্বের অন্তিমকালে ভেঙ্গে যাওয়া এবং দুর্বল হয়ে পড়া ঐক্যবদ্ধ নেপাল সাম্রাজ্যকে পুনর্গঠনের কথা বলে গোর্খা রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহ সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করেন, গিলে নেন ওই চারটি ছোট রাজ্যকে। এই চার রাজা ১৭৬৭ তে ব্রিটিশের কাছে সাহায্য চাইলে ব্রিটিশরা সাহায্য পাঠায়, এবং প্রাথমিকভাবে পৃথ্বীনারায়ণ শাহকে রুখে দিলেও দুবছর বাদে ব্রিটিশ সাহায্য প্রত্যাহৃত হয়, এবং পৃথ্বীনারায়ণ শাহ তার রাজধানী স্থাপন করেন কাঠমান্ডুতে। শুরু হয় তার বিজয়যাত্রা। পশ্চিমে পাঞ্জাব থেকে পূর্বে সিকিম পর্যন্ত বিস্তৃত হয় সেই সাম্রাজ্য। বিভিন্ন সময়ে এই সব রাজ্য জয় করতে গিয়ে ব্রিটিশের থেকে অস্ত্র বা পরামর্শ যেমন তিনি নিয়েছিলেন, তেমনি শান্তিপূর্ণভাবে এক দূরত্বের সম্পর্কও বজায় রেখেছিলেন, সুরক্ষিত রেখেছিলেন তার সাম্রাজ্যের সীমানাকে।
১৭৭৩ সালে তিনি জয় করেন বিজয়পুর রাজ্য, যা বিস্তৃত ছিল পূর্বে তিস্তা নদী পর্যন্ত। আজকের দার্জিলিং, কার্শিয়াংয়ের মত এলাকাগুলো, যা তিস্তার পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত, সেগুলোও এই বিজয়পুর রাজ্যের মধ্যেই ছিল। ১৭৮৮ তে বিভিন্ন এলাকার সাথে এই পাহাড়ের অঞ্চলও পৃথ্বীনারায়ন শাহের সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
তিস্তার পূর্ব পাড়ে অবস্থিত কালিম্পং অবশ্য প্রথমে সিকিমের রাজা এবং পরে ভুটান রাজার অধীনে ছিল। ১৭০৬ তেই সিকিমের রাজাকে হারিয়ে ভুটানের রাজা কালিম্পং দখল করেছিল। তিস্তার পশ্চিমপাড়ে প্রধানত লেপচা, মুর্মি ও লিম্বু উপজাতির মানুষ বাস করতেন, ছিলেন নেপালিরাও, তাদের বিভিন্ন উপজাতি— যাদের সংখ্যা প্রথমে কম ছিল, পরে ক্রমশ বাড়তে থাকে গোর্খা সাম্রাজ্যের এই বিস্তারের পর। অন্যদিকে তিস্তার পূর্ব পাড়ে আদি বাসিন্দা লেপচাদের পাশাপাশি বাইরে থেকে এসেছিলেন ভুটিয়া ও লিম্বুরা। ১৭৮০-র পর আসতে শুরু করে গোর্খারাও। ফলে একটু আগে-পরে হলেও এই অঞ্চলে এরকম বিভিন্ন জাতির মানুষদের বসবাসের ইতিহাসটা অনেক পুরনো।
উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাহাড় সম্পর্কে খুব আগ্রহী হয়ে পড়ে, এবং ১৮৩৫ থেকে ১৮৬৫— এই তিরিশ বছরের মধ্যে নানা ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে তা হস্তগত করে তারা।অন্তুডাঁরা বলে একটা জায়গা নিয়ে একটা বিবাদের সময়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুই অফিসার জর্জ অ্যালিমার লয়েড ও জে ডব্লিউ গ্রান্ট ১৮২৯-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘দোর্জিলিং’ নামের এক পাহাড়ি অঞ্চলে কিছুদিন থাকেন এবং সেখানে সম্ভাব্য স্বাস্থ্যনিবাস তৈরির প্রস্তাব দেন। সেই অনুযায়ী ব্রিটিশরা এগোয় এবং ১৮৩৫ সালে তাদের তৈরি করা চুক্তিপত্রের ওপর সিকিমের রাজার সিলমোহর আদায় করে নেয়। এই আদায় করা অঞ্চল দার্জিলিং ট্র্যাক্ট নামে পরিচিত হয়, যার জন্য বছরে ৩০০০ টাকা দেওয়ার শর্ত হয়, পরে যা বেড়ে ৬০০০ টাকা হয়। প্রথমে যে চুক্তিপত্রটা দেখানো হয়েছিল, তাতে শুধু দার্জিলিং শহরের কিছুটা অংশ বলে উল্লেখ থাকলেও, পরে যে চুক্তিপত্রটাতে ব্রিটিশরা রাজার সিলমোহর আদায় করে তাতে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩০ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৬-১০ মাইল এলাকার কথা বলা হয়। চুক্তিপত্রটি লয়েড পেশ করেছিলেন লেপচা ভাষায়, যা সিকিমের রাজা বুঝতেন না। সিকিমের রাজার বোঝাপড়ায় ছিল যে এই চুক্তি মোতাবেক তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন, কিন্তু তাও তিনি পাননি। পরে ব্রিটিশরা ওই অঞ্চলে রাস্তাঘাট-বাড়িঘর তৈরি করতে শুরু করলে সিকিমের রাজা আরও জোরালো প্রতিবাদ করতে শুরু করেন এবং ব্রিটিশরা বোঝে যে এখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, তাই তারা ক্ষতিপূরণ বাবদ একটা দো-নলা বন্দুক, একটা রাইফেল, কুড়ি গজ লাল কাপড় এবং দুটো শাল সিকিমের রাজাকে পাঠিয়ে দেন! নানা কারণে এই চুক্তিটি অবাস্তব হলেও, তার শর্তগুলো পূরণ করা অসম্ভব হলেও, ব্রিটিশদের পক্ষে এই অঞ্চল ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ অনেক টাকা তারা ইতিমধ্যেই খরচ করে ফেলেছে, অনেক জমি বিক্রি করে দিয়েছে কলকাতার প্রভাবশালী লোকদের এবং সর্বোপরি পূর্ব ভারতে এরকম একটা স্বাস্থ্য নিবাস— যাকে তারা বলে ‘হোম ওয়েদার’, সেটা যেকোনো মূল্যে তাদের দরকার ছিল। চুক্তিটা এমনভাবে হয়েছিল যাতে দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তাটা তখনো ব্রিটিশের হাতে আসেনি। ১৮৪৯ সালে সিকিম রাজ্যের গহীন অঞ্চলে ঢুকে যাওয়ার জন্য দুই ব্রিটিশকে সিকিম রাজা বন্দী করে। এই অজুহাতে ব্রিটিশ সেনা সিকিমে ঢোকে, এবং সেখানে কিছুদিন থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জানিয়ে দেয় যে, এই অঞ্চল এখন থেকে ব্রিটিশদের দখলে থাকবে। ১৮৫০-এ এভাবেই শিলিগুড়ি দার্জিলিংয়ের অংশ হয়ে যায়। আজকের কালিম্পং মহকুমা ও ডুয়ার্স সহ সমগ্র অঞ্চল ব্রিটিশদের হাতে আসে ১৮৬৫-র নভেম্বরে ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।
এই অঞ্চলকে প্রথমে পশ্চিম ডুয়ার্সের মধ্যে রাখা হলেও ১৮৬৬ তে দার্জিলিংয়ের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়, জেলা হিসেবে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় দার্জিলিং। প্রথমে এই নবগঠিত জেলাকে ‘নন-রেগুলেশন ডিস্ট্রিক্ট’ বলে চিহ্নিত হয়, অর্থাৎ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কোন আইন-বিধি এখানে (বিশেষ উল্লেখ না থাকলে) প্রযোজ্য নয়। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ হলে দার্জিলিংকে ঠেলে দেওয়া হল বিহারের ভাগলপুর সাব-ডিভিশনে। ১৯১৯ সালে আবার বদলে দিয়ে এরকম করা হল যে, বাংলার সরকারের তৈরি করা কোন আইন, রাজ্যপাল খারিজ করে দিলে, তা আর এই জেলায় প্রযোজ্য হবে না। এভাবে চলল ১৫ বছর, এবং তারপর দার্জিলিংয়ে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের শততম বছরে তা জুড়ে নেওয়া হল বাংলার ভিতরে, এখান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি গেল বাংলার বিধানসভায়। প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হলেন ডম্বরসিং গুরুং। ‘হোম ওয়েদারের’ লোভ ছাড়াও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দার্জিলিংয়ের ব্যাপারে আগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ ছিল। স্থলপথে তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের প্রয়োজনে চীন ও তিব্বতের থেকে ভারতের উত্তর সীমান্তকে সুরক্ষিত করাটাই ছিল তাদের সিকিম, ভুটান ও নেপাল সম্পর্কিত বৈদেশিক নীতির নির্যাস। সিকিম ছিল বিশেষ গুরুত্বের, তার সীমান্ত ছুঁয়ে আছে চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারতকে। এই ছোট্ট রাজ্যের মধ্যে দিয়েই ছিল ভারত ও তিব্বতের মধ্যের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কালিম্পং-লাসা বাণিজ্যিক পথ।দার্জিলিং ব্রিটিশদের হাতে আসার পর দার্জিলিংয়ের মধ্যে দিয়ে সিকিম, নেপাল ও তিব্বতের সাথে ঘোড়া, কম্বল, চা, আলকাতরা, কয়লা, উল, বাদ্যযন্ত্র, জুতো প্রভৃতি আমদানি এবং চাল, নুন, নীল, তামা ও দস্তা, তামাক রপ্তানির ব্যবসা চলতে থাকে।নেপালি রাজারা ধর্মের দিক থেকে প্রধানতঃ হিন্দু। ফলে তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তিব্বতি ও ভুটিয়াদের সাবেকি শত্রু হবে বলে ব্রিটিশরা মনে করেছিল। ব্রিটিশরা বুঝেছিল যে এরা দলাই লামাদের বিরোধিতা করবে, ফলে ভুটান ও সিকিমে একটা নেপালি জমিদার শ্রেণি তৈরির চেষ্টা করে গেছে ব্রিটিশরা।
দারজিলিং জেলার জনবিন্যাস এবং ভাষাগত আধিপত্যের দিকটাও আমাদের আলোচনায় আনতে হবে। ১৮৬০-এর দশক থেকে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ আবহাওয়ায় কোন রকম বিরোধ ছাড়া গড়ে উঠতে থাকে শহর, শহরের নানা পরিকাঠামো। ইতিমধ্যে চা-বাগান গড়ে উঠেছে দার্জিলিংয়ের চারদিকে, মূলতঃ তিস্তার পশ্চিম পাড়ে। ১৮৩৫ সালে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা ছিল বড়জোর ১০০। কিন্তু এই চা বাগানগুলোতে কাজ, শহর-রাস্তাঘাট গড়ে তোলা, কৃষির প্রসার, সেনাবাহিনীতে কাজের জন্য ব্রিটিশদের প্রয়োজন ছিল অনেক অনেক শ্রমজীবী গরিব মানুষ। ১৮৭২ সালে দার্জিলিংয়ে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ৭৪, যা ১৯০১ সালের মধ্যে বেড়ে হল ১৭০। দলে দলে মানুষ আসতে থাকে, ১৮৭১-৭২ এ জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪৭১২, ১৮৮১ তে ১৫৫১৭৯, ১৯০১-এ ২৪৯১১৭। ১৮৯৮ সালে তৎকালীন সেটেলমেন্ট অফিসার শশিভূষণ দত্ত-র দেওয়া রিপোর্ট অনুসারে দার্জিলিং ও তরাইয়ে বিভিন্ন জনজাতির বিন্যাসটা দেখা যাক। কোচ-১১১৩৩, নেপালি-১০৩৫৪, শেক-৬৩০১, ওরাওঁ-৪৬৩২, লেপচা-১১২২, ভুইমালি ও মেহেতার-১০৭৯, বুরা-৬৪৪, রাজপুত-৫০৯, ভুটিয়া-৪২০, মুন্ডা-২৫৫।
এখন এই তথ্যকে ঘিরে নানারকম মতামত-সংশয় আছে। অনেকের মতে, এই নেপালি মানুষদের বেশিরভাগটা নেপাল থেকে এসে এখানে থাকতে শুরু করেছে। অনেকের মতে, তারা এখানকারই বাসিন্দা। চা বাগানের কাজে যারা যুক্ত ছিল তাঁদের দুটো অংশ— যারা স্থায়ী বাসিন্দা তারা সারা বছর কাজ করতেন, আর একদল শীতের সময়ে আসতেন পশ্চিমের নেপাল থেকে যারা কিছুদিনের জন্য চুক্তিভিত্তিক কাজ করে আবার চলে যেতেন। এই মতের ঐতিহাসিকরা বলছেন, ব্রিটিশরা নেপাল থেকে বন্দী শ্রমিকদের নিয়ে আসেনি, নেপালি শ্রমিকরা এখানে আদি বাসিন্দা হিসেবেই ছিল, বন্দী করে আনা হয়েছিল ছোটনাগপুর থেকে আদিবাসী শ্রমিকদের, যারা এখানে কাজ করতে এসে আবহাওয়ার সাথে এঁটে উঠতে না পেরে তরাইয়ের জঙ্গলের দিকে নেমে চলে যায়, পরে তরাই-ডুয়ার্সে চা বাগান গড়ে উঠলে তারা সেখানে কাজ করতে শুরু করে।
যাই হোক, এটা স্পষ্ট যে এই বিশাল নেপালি জনসংখ্যাটা বহুদিন ধরেই এখানে আছে, যদি ধরে নেওয়া যায় তারা বাইরে থেকে এসেছেন, তাহলেও সেটা বহুযুগ আগের কথা। ওই সেটেলমেন্ট অফিসারের তথ্য থেকে আর একটা জিনিসও স্পষ্ট যে বাঙালিরা এখানে ছিলই না। নেপালি বসতি বেড়ে চলার সাথে সাথে খুব কম সংখ্যায় হলেও বাঙালি মধ্যবিত্তরাও সমতল থেকে পাহাড়ে প্রশাসনিক কাজে ও চা বাগানের ম্যানেজার ও কেরানি পদে আসতে থাকে, এবং মূলতঃ পাহাড়ের শহরাঞ্চলগুলোতে বসবাস শুরু করে। আর আসে বিহারী ও মারোয়ারী ব্যবসাদাররা, তাদের হাতে যেতে থাকে খুচরো ও পাইকারি ব্যবসা। ১৯৪১ সাল নাগাদ জনসংখ্যার হিসেবে পাহাড়ের তিনটি মহকুমায় বাঙালি, বিহারী, মারোয়াড়ি মিলিয়ে ছিল ৫.১%, এবং ৮৬.৮% মানুষ নেপালি-ভাষী। অন্যদিকে, শিলিগুড়ি মহকুমায়, যার বেশিরভাগটাই সমতল, এবং লাগোয়া তরাইয়ের জঙ্গল ও চা বাগান, সেখানে বাঙালি সংখ্যাধিক, যা আরও বেড়ে গেল ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে।
যে নেপালি ভাষা প্রচলিত হতে থাকলো, সেটা সপ্তদশ শতকের শেষে নেপালে ‘খাসকুরা’ বা ‘গোর্খা’ ভাষা বলে পরিচিত ছিল। যদিও নেপালে এই ‘খাসকুরা’ ভাষা মূলতঃ উচ্চবর্ণীয় বাহুণ-ছেত্রী (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়) দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি পৃথ্বীনারায়ন শাহের নেতৃত্বে গোর্খা জাগরণের পরও এই ভাষা নিম্নবর্ণের তিব্বতি-বর্মী (টিবেটো-বার্মীজ) ভাষাভাষী আদিবাসী-জনজাতির মানুষদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছিলো না। কিন্তু দার্জিলিংয়ে ব্যাপারটা অন্যরকম হলো। এখানে চলে আসা তিব্বতি-বর্মী ভাষাভাষী রাই, লিম্বু, প্রধান, গুরুং, তামাং, কিরাতরা তাদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উচ্চবর্ণীয়দের ‘খাসকুরা’কে গ্রহণ করতে লাগলো। এটাই পাহাড়ের জন্য লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা অর্থাৎ যোগাযোগের মূল ভাষা হয়ে ওঠে। অন্যান্য ভাষা, বিভিন্ন উপজাতির ডায়ালেক্টগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। এমনকি লেপচা ও ভুটিয়ারাও ধীরে ধীরে এই ভাষাকে গ্রহণ করার দিকেই এগিয়েছে।
আর একটা দিক ছিল নিম্নবর্ণের নেপালি অভিবাসীদের ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতকরণ। হিন্দু ধর্মস্থান বাড়তে লাগলো এবং অচিরেই বৌদ্ধ ধর্মস্থানের তুলনায় তা অনেক বেড়ে গেল। অন্যদিকে, বাড়তে লাগলো অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশের সংখ্যা, যারা ব্রিটিশের ‘অনুগত’ হিসেবে পরিচিত। এভাবেই একটা মিশ্র নেপালি সংস্কৃতির সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করে, যা অর্থনীতির হিসেবে আড়াআড়িভাবে ভাগ হয়ে আছে। একদিকে জমিদারশ্রেণি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা-পুলিশ আর অন্যদিকে মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবী, ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চা বাগানের শ্রমিক, নির্মাণ কর্মী, ছোট চাষি ও খেতমজুররা।
একদিকে জনজাতির বিন্যাসে পাহাড়ের ওই অঞ্চলে সংখ্যাগতভাবে নেপালিদের প্রাধান্য আর অন্যদিকে দার্জিলিংকে জেলা হিসেবে ঠিক কী স্ট্যাটাস দেওয়া হবে, তা কোথায় যাবে সে ব্যাপারে ব্রিটিশদের খামখেয়ালিপনার প্রতিক্রিয়ায় ১৯০৭ সালে পাহাড়ের একটা অভিজাত অংশ— তাদের মধ্যে আছে অবসরপ্রাপ্ত নেপালি পুলিশ ও সেনারা, আছে ধনী ব্যবসায়ীরা, আছে অবস্থাপন্ন তিব্বতি ও ভুটিয়ারাও— ‘হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে প্রথম মেমোরান্ডাম জমা দিলো সরকারের কাছে। তারা দাবি করল বাংলার বাইরে ‘একটা পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা’। যদিও এই ১৯০৭ থেকে শুরু করে তার পর থেকে কিছু বছর অন্তর অন্তরই এই ‘হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশন’ পৃথক ব্যবস্থার দাবি পেশ করতে থেকেছে সরকারের কাছে। তার বিশদে যাওয়ার দরকার নেই। শুধু এটুকু বলার যে, এই ‘হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশন’ তাদের বক্তব্যে ব্রিটিশের প্রতি তাদের আনুগত্য এবং ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের’ প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছে। তাদের দাবিপত্রগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করছে।এই দাবিদাওয়ার পথে দ্বিতীয় ঘরানাটা তৈরি হয় দার্জিলিংয়ের একটা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত অংশের হাত ধরে। এই মানুষদের একজোট হওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা নেয় ভাষা। শিক্ষার উদ্দেশ্যে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসা নানা অংশের ভূমিকা ছিল এতে।এই অংশের অনেকের সাথে যোগাযোগ ছিল স্বদেশী আন্দোলনের, এমনকি অনেকের সম্পর্ক ছিল বাংলার চরমপন্থীদের সাথেও। পরশমণি প্রধান, সূর্যবিক্রম ঘেওয়ালি, ধরণীধর শর্মা সহ অনেকে গড়ে তোলেন নেপালি সাহিত্য সম্মেলন, নেপালি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের লক্ষ্যে। ভাষার স্বীকৃতির নানা দাবিদাওয়া রাখতে থাকেন তারা। তারা হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশনের দিক থেকে রাখা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবির বিরোধিতা করে বলেন যে এটা গরীব নেপালীদের পশ্চাদপদতাকে বাড়াবে মাত্র, এবং ১৯২০ সালে একটা পৃথক দাবিপত্রে তারা বাংলার মধ্যে পৃথক স্বশাসনের দাবী রাখেন।ভাবে চলতে চলতেই ১৯৪৩ সালে ডম্বরসিং গুরুংয়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হল সারা ভারত গোর্খা লীগ। গোর্খা লীগ এক অর্থে হিলমেনস অ্যাসোশিয়েশনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে। তারা কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে পাহাড়ের মানুষের অসন্তোষ নিয়ে কথা বলা শুরু করলো। একই বছরে গড়ে উঠলো ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দার্জিলিং শাখা, যার সদস্যরা প্রথম দিকে গোর্খা লীগের মধ্যে কাজও করতেন।
১৯৪৩-এ বাংলায় দেখা দিল মন্বন্তর। অন্যদিকে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। একদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি তখন কমিউনিস্ট পার্টি কালোবাজারি-মজুতদারির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জোরদার করার চেষ্টা করছে, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তখন জনগণের রিলিফ কমিটি তৈরির উদ্যোগ চলছে। পাহাড়ে নবগঠিত গোর্খা লীগ বা পুরনো দল জাতীয় কংগ্রেস এই নিয়ে কিছু করেনি। সেই সময় শিলিগুড়ি এলাকার কাজ পরিচালিত হত জলপাইগুড়ি থেকে, পাহাড়ের সাথে তার যোগাযোগ ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির পক্ষ থেকে দার্জিলিংয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় সুশীল চ্যাটার্জীর ওপর। রতনলাল ব্রাহ্মণ নামে একজন ড্রাইভার, যিনি মাইলা বাজে (মেজ ঠাকুরদা) নামে বিশেষ পরিচিত ছিলেন, তার বন্ধুদের নিয়ে গুদাম লুঠ এবং জনগণের মধ্যে তা বিতরণের কাজ করছিলেন বলে সুশীল চ্যাটার্জি শুনতে পান, এবং তার সাথে যোগাযোগ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শের কথা শুনে রতনলাল ব্রাহ্মণ প্রভাবিত হন এবং দ্রুতই তার নেতৃত্বে প্রথমে ড্রাইভার ইউনিয়ন, তারপর তার উদ্যোগে একের পর এক গাড়োয়ান ইউনিয়ন, রিকশাওয়ালা ইউনিয়ন, দিনমজুর ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, মহিলা সমিতি এবং কিষাণ সভা গড়ে ওঠে। রতনলাল ব্রাহ্মণের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল গোর্খা দুঃখ নিবারক সম্মেলন। দার্জিলিংয়ে পার্টির একটা জেলা সংগঠনী কমিটি গঠন করা হয়, যার সদস্য ছিলেন সুশীল চ্যাটার্জি, রতনলাল ব্রাহ্মণ, গনেশলাল সুব্বা, ভদ্র বাহাদুর হামাল ও চারু মজুমদার। গনেশলাল সুব্বা ছিলেন তৎকালীন সেই কমিটির সম্পাদক। ১৯৪৬-এ ব্রিটিশ ভারতের শেষ নির্বাচনে দার্জিলিংয়ে দুটি নির্বাচনী কেন্দ্র হল। সাধারণ কেন্দ্রটিতে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে আগেরবারের মতই ডম্বরসিং গুরুং জিতলেন। অন্যটি ছিল বারোটি চা বাগান সম্বলিত শ্রমিক নির্বাচনী কেন্দ্র। চা বাগান মালিকদের মদতপুষ্ট কংগ্রেসের প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচনে জিতলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ। সারা রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টির জেতা তিনটে সিটের মধ্যে একটা এখান থেকেই। প্রথম জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল দার্জিলিংয়ের জলাপাহাড়ে স্নেহাংশু কান্ত আচার্য্যর বাড়িতে। প্রাদেশিক কমিটির পক্ষে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সরোজ মুখার্জী ও ভবানী সেনগুপ্ত।’৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর, তার পরের মাসেই অনুষ্ঠিত হয় কম্যুনিস্ট পার্টির চতুর্থ প্রাদেশিক সম্মেলন। তারপর ১৯৫১-র কলকাতা কংগ্রেসে স্পষ্টভাবে উঠে এল দেশ বা রাজ্য নয়, জেলাগত স্বায়ত্তশাসনের কথা। সেই সময়ে কম্যুনিস্ট পার্টির যারা গোর্খা জনজাতির মানুষদের মধ্যে কাজ করতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সত্যেন্দ্রনারায়ন মজুমদার, তিনি দার্জিলিংয়ের জাতি সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন বইও লেখেন। গোর্খা লীগের সাথে পার্থক্যরেখাকে স্পষ্ট করতে গিয়ে তিনি যা লেখেন, তাতেও স্বায়ত্তশাসনের বক্তব্যই যে কম্যুনিস্ট পার্টির ছিল, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়—
“গোর্খা লীগের দাবী হল যে দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়িকে আসামের সঙ্গে মেলাতে হবে নতুবা দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা মিলিয়ে গড়তে হবে একটি গোর্খাপ্রদেশ। আর আমাদের আওয়াজ হল দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত জেলা গঠন। শুধু এই আওয়াজের দ্বারা গোর্খা লীগ নেতৃত্বের উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সফল লড়াই সম্ভব নয়। নেপালি (গোর্খা) জনগণের সামনে তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবির মূল প্রকৃতি বিশ্লেষন করে দেখানো চাই। আর চাই সেই দাবী পুরণের পথনির্দেশ। ’’
পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়া যাই হোক না কেন, তা ধীরগতির হোক বা বিকৃত, সীমাবদ্ধ— তবু বিভিন্ন জাতি, অগ্রণী থেকে শুরু করে পশ্চাদপদরাও ক্রমান্বয়ে এগিয়েছে, সংহত হয়েছে তাদের আত্মপরিচয় ও বিকাশের আকাঙ্ক্ষাগুলো। ফলে দ্বন্দ্ব নতুন নতুন চেহারায় মাথাচাড়া দিয়েছে। এমনকি সেসব জায়গাতেও এই প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যেখানে এই সমস্যা সমাধান হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়েছিল। বিশ্বের নানা প্রান্তে জাতিদাঙ্গা, জাতি-বর্ণগত ভেদাভেদের অসংখ্য ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করছে।
আমরা যে আলোচনায় ছিলাম, সেই গোর্খাল্যান্ডের দাবির প্রশ্নেও একই কথা সত্যি। যত দিন গেছে, ততই সংহত হয়েছে গোর্খাল্যান্ডের আওয়াজ। পুঁজির ক্রমপ্রসারিত হাত পাহাড়ের মানুষের মধ্যে আরও বেশি বিপন্নতার বোধ তৈরি করেছে, সংহত চেতনা সংগঠিত করেছে অধিকারের প্রশ্নকে। পাশাপাশি ডুয়ার্সের আদিবাসী জনগণের আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষাও আগের তুলনায় অনেক সংহত চেহারায় হাজির হয়েছে ।
কমিউনিস্ট পার্টির দার্জিলিং জেলা কমিটি ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে রাজ্যের মধ্যেই আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার দাবী জানিয়ে স্মারকলিপি পাঠায় এবং তার অনুলিপী দেওয়া হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীসহ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে। ১৯৫৫ সালের ৯ই ডিসেম্বর রাজ্যের বিধানসভায় জ্যোতি বসু প্রস্তাব তোলেন নেপালী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির, দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার জন্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও চা বাগান শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্যে।
এই সময়ে বহুবার স্বায়ত্তশাসন এবং নেপালী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য সাংসদ হীরেন মুখার্জি, সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার , সমর মুখার্জি, সোমনাথ চ্যাটার্জি, রতণলাল ব্রাহ্মমিন, আনন্দ পাঠক বারবার দাবি জানিয়ে এসেছেন। ১৯৭৭ সালে যুক্তফ্রন্ট ইশ্তেহারেও এই দাবি ছিলো অন্যতম। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর সি পি আই (এম) বিধায়ক বীরেন বসু বিধানসভায় এই দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫৫ সালে নেপালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, দার্জিলিং পাহাড়ের জন্য স্বশাসন ও চা শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির কথা বিধানসভায় পেশ করেন জ্যোতি বসু। ওই বছরই দার্জিলিং পাহাড়ের মার্গারেটস হোপ চা বাগানে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠলে তার ওপর গুলি চালায় পুলিশ। গোর্খা লিগের ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক সংঘ এবং কমিউনিস্ট পার্টির মজদুর ইউনিয়ন ১৯৫৫-র ৮ই মার্চ চা বাগান মালিক ও সরকারের কাছে একটি দাবিপত্র পেশ করে। তাদের প্রধান দাবি ছিল ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের সমান বেতন, লাভের ভিত্তিতে বোনাস দান, স্ট্যান্ডিং অর্ডারে সংশোধন আনা, ম্যানেজমেন্টের খেয়ালখুশি মত শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের নিয়ম বাতিল ইত্যাদি। ম্যানেজমেন্ট বা সরকারের যথারীতি কোন হেলদোল নেই। সরকারে তখন বিধানচন্দ্র রায়ের কংগ্রেস। ৯ই জুন গোর্খা দুঃখ নিবারক সম্মেলনে একটা মিটিং করে ইউনিয়ন দুটি সিদ্ধান্ত নেয় যে ২২শে জুন থেকে লাগাতার স্ট্রাইক শুরু করা হবে। নানা আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু তার কোন সদর্থক ফল হয়নি। ২০শে জুন সমস্ত নেতাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরোয়। অনেকে গ্রেফতার হন, কেউ কেউ আত্মগোপন করেন। ২৫ জুন ৩টের সময় মার্গারেটস হোপ চা বাগানে শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়— অমৃতা কামিনি (১৮), মৌলিশোভা রাইনি (২৩ বছর এবং তিনি গর্ভবতী ছিলেন তখন), কাঞ্চা সুনুয়ার (২২), পদমবাহাদুর কামি (২৫), কালে লিম্বু (১৪), জিতমান তামাং শহিদ হন। ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে ২৭ জুন তাদের শবযাত্রায় তিরিশ হাজার মানুষ একত্রিত হন।
১৯৫৮-র মার্চে যখন এরাজ্যের জন্য বাংলাকে সরকারী ও প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার জন্য বিল পেশ হয়, তখন কমিউনিস্ট পার্টির বি বি হামাল পাহাড়ের সরকারী ভাষা হিসেবে নেপালির স্বীকৃতির দাবি তোলেন। এন বি গুরুংও তার পক্ষে জোরদার সওয়াল করেন, এবং অবশেষে ওই বিলে পাহাড়ের সরকারী ভাষা হিসেবে নেপালিকে স্বীকৃতি দেয়। ভাষার স্বীকৃতি তো হল, কিন্তু স্বশাসন? দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব,অন্যান্য স্থানীয় দলগুলো লাগাতার আলাদা রাজ্য, স্বশাসন ইত্যাদি দাবি করে গেলেও তাদের উচ্চতর নেতৃত্ব হয় সেটা নাকচ করেছে, দাবী নিয়ে টালবাহানা করেছে এবং সমস্ত সরকারই নস্যাৎ করে দিয়েছে। ১৯৬৭তে যুক্তফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরও তার কোন অন্যথা হয়নি। পাহাড় থেকে নির্বাচিত গোর্খা লীগের নেতা ডি পি রাই এই সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯-দুবারই। ১৯৭৩-এ সিপিএম ও গোর্খা লীগ একটি দলিল রচনা করে ‘প্রোগ্রাম এন্ড ডিমান্ড অফ অটোনমি’, যা একটা স্বশাসিত জেলা পরিষদের দাবীকে রাখে।১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পর গড়ে উঠেছিল ‘প্রান্ত পরিষদ’ কংগ্রেসের চক্রান্তের একাংশ । পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে তারা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্মারকলিপি জমা দেয়। ১৯৮১-র ৭ই সেপ্টেম্বর দার্জিলিংয়ের চকবাজারে গুলি চলে তাদের হিংসাত্মক আন্দোলনে। ঐ সময়ই গড়ে ওঠে কংগ্রেসের ব্রেনচাইল্ড সুভাষ ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনএলএফ)। যাদের মূল দাবী ছিল পৃথক রাজ্য। ১৯৮৫ তে সিপিএমের পাহাড়ের সাংসদ আনন্দ পাঠক একটা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন সংবিধান সংশোধন চেয়ে, যাতে একটা স্বশাসিত পর্ষদ গড়া যায়।প্রস্তাবটি ৪৭-১৭ ভোটে পরাজিত হয়। প্রান্ত পরিষদের তোলা আলাদা রাজ্যের দাবি সফলভাবে ঢেউ তুললো জিএনএলএফের হাতে, ১৯৮৬তে । কখনও কংগ্রেস কখনও বিজেপী যে দল যখনই কেন্দ্রে ক্ষমতায় থেকেছে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিকে মদত দিয়েছে এই রাজ্যের বামপন্থী শক্তিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে । ১৯৪৭ সালের একটি সরকারী নথিতে বলা হচ্ছে, বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার ফলে ডম্বর সিং গুরুং কংগ্রেস সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে বাংলার এবং কেন্দ্রীয় আইনসভার (কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে) সদস্যপদে নির্বাচিত হয়েছেন। খুব সম্ভবত কমিউনিস্ট রতনলাল ব্রাহ্মণকে কাউন্টার করার জন্য বাংলার কংগ্রেসের এই কৌশল। আরআমাদের পাড়াতুতো দিদিভাইয়ের কীর্তি কাহিনীতে পরে আসছি। বামপন্থীদের দুর্বল করা নিশ্চিহ্ন করার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত আজকের নয়, আর সেই চক্রান্তের অঙ্গ হিসাবেই ঢালো ডলার, যে করেই হোক, পশিমবঙ্গকে ছিন্ন-ভিন্ন করো। যাতে বামেরা দুর্বল হয় আর কেন্দ্রে শ্যামচাচাদের স্ট্র্যাটেজিক ভাতিজারা ক্ষমতায় আসে। এই অভিপ্রায়ে, তাই ডলার ঢালা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সব বিচ্ছিন্নতাকারী এবং প্রতিক্রিয়াশিল শক্তিগূলোকে উজ্জিবিত করার জন্যে। এই ডলারের ইঞ্জেকশন শুধু আমাদের দেশেই নয়, নেপালে, মদেশীয়দের মধ্যেও দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দিদিভাইও এই ইঁদুর দৌড়েই ফললাভ করেছেন সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। সুপরিকল্পিত বাঙালী বিদ্বেষী প্রচারাভিযানের অনিবার্য ফলস্বরূপ গোর্খা লীগের নেতৃত্বে ১৯৭০-এ দার্জিলিংয়ে একেবারে পুরোপুরি বাঙালী বিরোধী দাঙ্গা শুরু হ’ল৷ বাঙালীদের যে সম্পত্তি দখল করা হয়েছে তার একটা আংশিক তালিকাঃ
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণাগার (দার্জিলিংয়ের) ও তৎসংলগ্ণ প্রশস্ত কম্পাউণ্ড, চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ী, বাসন্তী এনেক্স ও তাঁর বিশাল জমি, কোচবিহার মহারাজের সুরম্য গৃহ ও ক্যাপিট্যাল হল ও তাঁর লালকুঠি (এটা সুবাস ঘিসিংদের ডি.জি.এইচ.সি.) কার্যালয় হয়েছিল৷
বর্ধমান হাউজ ও তৎসংলগ্ণ স্টেট, ভিক্টোরিয়া ফলসের ব্রীজের নীচে বিশাল জমি যেখানে বীরেন ঘোষের নার্সারি ছিল, ফলসের ওপরে ও বাঁদিকের জমি জুড়ে থাকা কুশারীদের বাড়ী, মহারাণী গার্লস্ স্কুল, রামকৃষ্ণ শিক্ষা পরিষদ, স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ বেদান্ত আশ্রম ও তৎসংলগ্ণ বিরাট স্কুলবাড়ী৷
লুই জুবিলি সেনিটোরিয়ামই হোক বা রেল ষ্টেশন সর্বত্রই অফিসার ও কর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন বাঙালী৷ একই চিত্র দেখা যেত চা-বাগানেও৷ সেখানেও ম্যানেজার, টেকনিক্যাল কর্মী ও করণিকদের প্রায় সকলেই ছিলেন বাঙালী৷ দার্জিলিং শহরের কাছে সোনাদায় এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ডেয়ারী ফার্মও ছিল বাঙালীদের, ফার্মের মালিক ছিলেন গাঙ্গুলীরা৷ ভগিনী নিবেদিতার স্মৃতিধন্য বাড়ীটি আজ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার লেঠেল বাহিনী জি.এল.পি.-র হস্তগত, জে জি.এল.পি আজকের দার্জিলিংয়ে সমান্তরাল বা বলা ভাল প্রকৃত অর্থে পুলিশ বাহিনী৷(তথ্যসূত্রঃ উত্তরবঙ্গের গোর্খায়ন – এক জাতীয় সংকট, দেবপ্রসাদ ধর)। ১৯৮৩তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক অপসৃত হাবিলদার, জনৈক সুবাস ঘিসিং মঞ্চে এলেন। জি এন এল এফ তাণ্ডব শুরু করল। বাঙালি বিতাড়ন ইতিমধ্যেই প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছিল, জি এন এল এফ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে ক্লিনজ করেছিল এই সময়। একবার এক সিপিএম সমর্থকের কাটামুণ্ডুও ঝুলিয়ে দেওয়া হয় প্রকাশ্যে । তারপর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর্ব। ২৫০ জনের বেশী সি পি আই (এম) নেতা-কর্মী শহীদ হলেন এবং বাস্তুচুত হলেন অনেক পার্টির নেতা ও কর্মীরা। এনারা সবাই ছিলেন কিন্ত পাহাডের মানুষ। এখনকার মতই অন্য কোনো দল কিন্ত আক্রান্ত হয় নি। রাজ্য সরকার সবরকমের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করে শান্তিপুর্ণ ভাবে কিন্ত ঘিসিং এর গঠিত জি এন এল এফ (GNLF) সমস্তরকমের শান্তিচুক্তি বাতিল করে দেয়। সাম্প্রদায়িক আচরণ এর সাথে সরকারের সম্পত্তি নষ্ঠ করে তারা। শেষমেশ রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আলোচনা করে এই ধংসাত্বক কর্মসুচি কে প্রশাসনিক তৎপরতায় শান্তি ও সম্প্রীতি আনার চেষ্ঠা হয় কিন্তু GNLF ১৯৮৯ সালের ভোট বয়কট করে । সেই সময়ে কংগ্রেসের আসল রুপ প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং এই কংগ্রেস লোক সভা নির্বাচনের কিছু মাস আগে জি এন এল এফ কে সমর্থন করে, পাহাড়ে সি পি আই এম এর সাংসদ আনন্দ পাঠক কে হারাবার জন্যে। কংগ্রেস তারা শ্রেনী চরিত্র অনুযায়ী জি এন এল এফ কে সমর্থন করে এবং আনন্দ পাঠক হেরে যান।নীতিগত প্রশ্নে সি পি আই এম কখনও ক্ষুদ্র বা স্বল্পমেয়াদী স্বার্থের দিকে তাকিয়ে আপস করেনি।১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে দার্জিলিং জেলা কমিটির ২৫ জন দল ত্যাগ করে পাহাড়ে সি পি আর এম (কম্যুনিস্ট পার্টি অফ রেভলিউশনারি মার্কসিস্টস)।অথচ পাহাড় প্রশ্নে যারা সি পি আই এমের সমালোচনা করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই দার্জিলিং জেলা কমিটির ৪২ জন সদস্যের ২৯ জন ছিলেন পাহাড়ের। জাতিসত্তার প্রশ্নে সিপিএমের দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত — এই অভিযোগ
তুলে তারা গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে তুলতে থাকেন।সিপিএমের সাথে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও, সামগ্রিক রাজনীতির নিরিখে তারা অবশ্য কোন স্পষ্ট ভিন্ন অবস্থান হাজির করেনি।এই নতুন গড়ে ওঠা সিপিআরএমের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে নিপীড়িত জাতির জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ।পরিস্থিতির প্রতিকূলতা নিশ্চয়ই ছিল, এখনো আছে— কিন্তু তাদের বাস্তব কার্যক্রমে শ্রেণির লড়াইকে ছাপিয়ে বারম্বার বেশি দেখা গেছে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে দাবিদাওয়ার প্রাধান্য। ফলে একদা বামপন্থী আন্দোলনের জোরালো ভিত্তি গড়ে উঠেছিল যে দার্জিলিংয়ে, সেখানে দমনকারী জাতি ও অবদমিত জাতির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের যে বিপদ সম্পর্কে মার্কসবাদের শিক্ষকরা বারবার সতর্ক করেছেন, অনেকটাই সেই বিচ্যুতিগুলোর শিকার হল বামপন্থী পরিচয়ের এই দলগুলো।
[ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য ]
অসাধারণ একটা ইতিহাস । একটা জাতির সংগ্রাম । এত তথ্যাবলি কোথায় দেখা যায়নি বা এই ধরনের বিশ্লেষণ আগে কোন লেখায় এত সুন্দর ভাবে বলা হয়নি । ইতিহাস বিকৃত করে অনেক রাজনৈতিক ফায়দা লোটা হয় কিন্তু প্রকৃত ঘটনার কথা কেউ বলে না । এখানে প্রকৃত তথ্যের শুধু উপস্থাপনাই নয় তার সঠিক প্রয়োগ আছে । গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলন এবং তার পটভূমি খুবই সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে । পড়তে পড়তে যেন একটা সময়ের দলিলে চোখ রেখেছি । পরবর্তী অংশ পড়ার জন্য চাতকের প্রতীক্ষায় থাকলাম …
অসাধারন তথ্যনির্ভর এক রচনা। আগামী কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
হরফ-এর পাশে আছি’র কাছে কৃতজ্ঞ।পত্রিকার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। তৃষ্ণা বাড়ল, বন্ধুরা।