দ্বিরাগমন – অতনু চট্টোপাধ্যায়
আমরা, যারা অপ্রাচীন বুদ্ধি, মূঢ় অথচ মফস্বলীয় আনুষ্ঠানিকতায় যাদের শ্রীবৃদ্ধি, আমাদের যাদের প্রতিশোধস্পৃহা কালো পলিথিনে লেগে থাকা মাছের রক্তের মতো আঁশটে ও চটুল, যাদের নৈঃশব্দ্য ক্রমাগত অস্থির করে তোলে, কপালে জমে ওঠে বিন্দু বিন্দু স্বেদ, যাদের বুকপকেটে ধুকপুক করছে মোবাইল আর আত্মায় বিঁধে আছে রাষ্ট্র, তাদের থেকে তোমাকে আড়াল করে রাখে সুপুরুষ্ট তিনটি অলীক গাছ।
আমাদের পরিচয়ের প্রারম্ভে রয়েছে একটি পাড়া, কয়েক ঘর পুরাতন ভিটা, মধ্যবিত্ত decadence -এর এক উপবীত্য ভূমি, তার নিজস্ব ঠাট্টা, বিদ্রুপ, ক্রোধ ও প্রগতিশীল CPIM। “নেতাজি ফিরে এসো” বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের শৈশব আর উৎসব মুখরিত সেই প্রাঙ্গণে হঠাৎই খসে পড়েছে চুনসুরকির পুরোনো প্লাস্টার। পুজোর দালান থেকে উড়ে গেছে গোলা পায়রার ঝাঁক আর তাদের বিষ্ঠার ছাপ পায়ে পায়ে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে গেছে, আমাদের অপরিচ্ছন্ন স্মৃতির মতো। তবু এই মেদুরতা থেকে তোমাকে আড়াল করে রেখেছে সুপুরুষ্ট তিনটি অবান্তর বনস্পতি।
দিবাস্বপ্নের মতো অপ্রতুল, প্রকল্পের মতো স্বঘোষিত, একটি প্রাঙ্গণ ছিল, উজ্জ্বল। খর রৌদ্রে কিংবা দমকা হাওয়ায় মাথা নত সেই তিনটি গাছ অলীক কিন্তু মই বেয়ে তরতর করে উঠে গেল, যেন রঙের মিস্ত্রি।
অবশ্য এই কুঞ্জ আদতে একটি আইডিয়া মাত্র, যেমন স্বর্গ-উদ্যান ও তার থেকে চিরনির্বাসন। ঠিক একইভাবে চিত্রকূট, দণ্ডকারণ্য, কিংবা অশোকবন। আমাদের নন্দনতত্ত্বের মূলে এই যে কানন এবং কখনও তার আশ্রয়ে গ্রাসাচ্ছাদন, কখনও তার পরিচর্যায় সিদ্ধিলাভ, কখনও আবার তার বিরহে কাতর সম্ভাষণ। এমনকি কখনও কখনও তার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির চিরবাসনা — এ যেন সভ্যতার আবহমান কালের এক ধারা। পতিগৃহে যাত্রাকালে শকুন্তলা যে বনতোষিণী সহ সকল নবমালিকা ও সকল তরুবরের কাছে সজল নয়নে বিদায় প্রার্থনা করবে এতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
যেমন আশ্চর্যের কিছুই নেই যদি বলি আমার মাতুলালয় অর্থাৎ আমার মামারবাড়িটি ছিল একটি ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ি। তার সংলগ্ন একজোড়া মন্দির ও একটি যথাযথ শান-বাঁধানো ঘাটও ছিল বৈকি! একবার হল কি, আমার মাতামহ, গ্রীষ্মের দুপুরে সেই ঘাটে স্নানরত। কিছু আত্মীয়পরিজন, দু-একটি ঝি-চাকর এবং এক ভাড়াটিয়াও স্নানার্থে উপস্থিত সে সময়ে। ভাড়াটিয়াটি ছিল কলকাতা-নিবাসী, ফলে আপাত স্মার্ট। কথায় কথায় তার সাথে দাদুর তর্ক বেধে যায় এই বলে যে, “ সকল আবরণই আদতে Vanity ”। সেই তর্কের জল গড়ায় অনেক দূর । এমনকি সেই ভাড়াটে উত্তেজিত হয়ে বাজি ধরে বসেন যদি দাদু সম্পূর্ণ নিরাবরণ অর্থাৎ উদোম উলঙ্গ হয়ে ঘাট থেকে ঘরে ফিরে যেতে পারেন তবে তিনি তাকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা খাওয়াবেন। আর যায় কোথায়! উন্মার্গদর্শিতায় আক্রান্ত আমার দাদু, তখন দুই সন্তানের পিতা, এক মুহূর্ত কালক্ষেপ না করে, নির্দ্বিধায় গামছা কাঁধে ফিরে যান তাদের ভগ্নপ্রায় অট্টালিকায় — সম্পূর্ণ নিরাভরণ। ঘাট ভর্তি, বউ-ঝি, সেই সঙ্গে ভাড়াটিয়া সকলেই বাকরুদ্ধ হয়ে সেই অপরূপ দৃশ্যের সাক্ষী থেকে যায়। এমনকি আমার বড়মাসিও রেহাই পাননি সেই মধুর রস আস্বাদন থেকে — যদিও তখন তিনি কিশোরী মাত্র। অবশ্য রসগোল্লার হাঁড়ি আমার মাতামহের অর্জন হয়েছিল কিনা জানা যায় না, তবে গল্পটি কিসসা-কাহানির মতো থেকে যায় বংশ পরম্পরায় ।
ধান ভানতে শিবের গীত — এ আমাদের প্রাচীন অভ্যাস, সুতরাং ত্রুটি মার্জনীয়। তবে যেটি বলার জন্য এত আয়োজন সেটি হল এই দৃশ্যের আরও কিছু সাক্ষী বোধহয় ছিল, যেমন ওই তিনটে অবোধ গাছ।
আর আজ যখন তুমি বিবস্ত্র, উন্মাদ, পাড়ার অকর্মণ্য ছোকরাও চমকায় তোমাকে ‘পাগলা’ বলে, আর এদিকে যখন শৈশবের রাম, সীতা, হনুমান সকলেই ফিরে ফিরে আসছে নতুন নতুন অর্থে এই গাঙ্গেয় উপত্যকায়, যখন অযোধ্যা, হাওড়া, হুগলি, নিশ্চিন্তপুর সকলই পরভূমি, তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি, এই মালিন্য থেকে, এই লাচারি থেকে ফিরে তাকাই কখনও-সখনও। নিশ্বাস নিতে অতীত হাতড়িয়ে দেখি কিছু উজ্জ্বল রং, একটি প্রাঙ্গণ আর আজও দেখি তার পাহারায় আছে তিনটি অকৃতি, নাছোড়, দিগম্বর শাল গাছ।
মূল চিত্র- ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
আলোকচিত্র- অতনু চট্টোপাধ্যায়
খাসা লেখা।
বা! অন্য লেখাগুলোর তুলনায় কিছুটা বিমূর্ত। গদ্যটাও সুন্দর।