মধু রাঘবেন্দ্র-র পাঁচটি কবিতা – অনুবাদ : শুক্লা সিংহ
মূল ইংরেজি থেকে অনূদিত
[মধু রাঘবেন্দ্র কবি, সমাজকর্মী, আর্ট ইভেন্ট কিউরেটর এবং ভারতবর্ষে কাব্য-চর্চার অন্যতম বৃহৎ উদ্যোগ ‘Poetry Couture’-র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তাঁর কাব্য আন্দোলনের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব সহ ভারতের অন্যান্য শহরে কবিতা-পাঠের মুক্তমঞ্চ তৈরি করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘Make Me Some Love to Eat’ পাঠক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘Stick No Bills’ মুম্বই সাহিত্য মেলায় শ্রেষ্ঠ পাণ্ডুলিপি নির্বাচিত হয়। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘Being Non-Essential’ ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়। মধু ২০২১ সালে IOWA International Writers-in-residence ফেলোশিপ লাভ করেছেন। ২০২২ সালে তাঁর চতুর্থ কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।]
নদী কাব্য
আমার কবিতা
নদী তীরের নুড়িপাথর নিয়ে।
আমাদের মাথার মুকুটগুলো যাদের পালক দিয়ে সজ্জিত,
যাদের শেষ গানগুলো কেবল আমরাই শুনব,
সেসব বিপন্ন পাখিদের নিয়ে।
নতুন বাড়ি করার সময় বাগান থেকে যার ঘ্রাণ হারিয়ে গেছিল,
আমার কবিতা সেসব জুঁইফুলদের নিয়ে।
শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরগুলো থেকে নির্গত “অরগ্যানিক” জেসমিন মোমবাতির
গা গুলিয়ে যাওয়া গন্ধ নিয়ে।
আমি যেসব কৃষকদের সঙ্গে দেখা করি, আমার কবিতা তাদের নিয়ে;
যে হাত কঠোর পরিশ্রম করতে পারে,
যারা গবাদি পশুদের ভালোবাসে,
ভালোবাসে বৃষ্টি, সূর্যোদয়, নিজের পোড়া জমি,
আমার কবিতা তাদের নিয়ে।
আমি ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে লিখি;
কোনোদিন অজানা অচেনা কোনো গ্রামে আগুনের পাশে খাবার খেতে বসে
ছোট্ট শিশুরা যদি আমায় বলে—“একটি কবিতা পড়ুন”
আমি ওদের এটা বলতে চাই না যে
ওরা আমার কবিতা বুঝতে পারবে না।
আশ্রয়
(তেনজিং সুন্দু-র জন্য লেখা)
গৌহাটিতে তখন রাত এগারোটা—
আনিস-উজ-জামান অতিথিশালার লোকটি
আমাদের সামনে সুস্বাদু ‘আসাম-টি’ নিয়ে হাজির।
তাঁর কপালে লাল রং-এর বন্ধনী; তিনি মাদুরে বসে
চিনামাটির চায়ের পাত্রটি থেকে সযত্নে
আমাদের চা পরিবেশন করছিলেন।
তাঁকে দেখতে সেই লোকগুলোর মতো যারা তাদের প্রিয় সব বস্তু,
স্বপ্ন ও স্বজন হারানোর যন্ত্রণা আজও ভুলতে পারেনি।
তিনি যখন জামার হাতা গুটিয়ে উপরে তোলেন, তাঁর বাহুতে
লবঙ্গের সুগন্ধিযুক্ত গুদাং গরম সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ দেখা যায়।
যাদের বয়স কুড়ির কোঠায়, তাদের রক্ত গরম থাকে,
অন্যায় সহ্য করতে পারে না;
তাদের শরীর তখন ডিনামাইট, প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করে বেঁচে থাকাই তাদের কাজ।
“Free Tibet” লেখা পতাকাটি নিজেকে মেলে ধরে, বিক্ষোভ দেখায়,
মুম্বই শহরের মধ্যে আবদ্ধ বন্য তৃণভূমির মতো ছটফট করতে থাকে।
সেই নিষিদ্ধ দেশের শান্তি ধরমশালায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তাঁর নির্বাসন-বাড়ির কোনো ঠিকানা নেই।
তিব্বতের স্বাধীনতার লড়াই যেন তাঁর নিজেরই মুক্তিযুদ্ধ,
নিজের দেশকে নিজের বলে দাবি করে জেলবন্দি হবার উন্মাদনা,
নিজের বাড়ি ফিরে যাবার উন্মাদনা।
তিব্বতের মতো তাঁর চামড়াও পুড়তে থাকে—
পুড়তে পুড়তে ফোঁড়ায় পরিণত হয়; পুঁজ জমে, পচন ধরে;
সেই হারিয়ে যাওয়া বাড়িটি কবিতায় ভেসে ওঠে।
কৃষকদের জন্য একটি গান
(২০১৭ সালের গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে যে তামিল কৃষকেরা যন্তরমন্তরে একচল্লিশ দিন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন)
শুকিয়ে যাওয়া ক্ষেতগুলো সব দাহ্য।
যন্তরমন্তরের ব্যারিকেডের পেছনের পিচঢালা
পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া রাস্তায়
খরার ফসলের মতো শুকিয়ে গেছে কৃষকেরা।
লোকেরা এসে দেখে যায়, ছবি তুলে চলে যায়।
“হিন্দি জানো?”
“না, শুধু তামিল”
লোকেরা এসে দেখে যায়, ছবি তুলে চলে যায়।
“ইংরেজি জানো?”
“কিছুটা”
লোকেরা ভান করতে থাকে; অটো, বাস, গাড়ি–সব পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যায়।
মহাপুরুষ, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, কবিগণ, যাতায়াত করতে থাকেন।
সরকার, কর্পোরেট, রাস্তার কালো পিচ–কারো মধ্যে বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা নেই,
যদিও আমি দেখেছি এপ্রিল মাসে দিল্লির প্রচণ্ড গরমে
কীভাবে পিচঢালা রাস্তা গলতে থাকে।
মৃতপ্রায়, অর্ধনগ্ন, ষাট বছর বয়সি নাচাম্মা কাঁদছে,
কিন্তু তাঁর চোখে জল নেই।
“এর পরিণতি যদি মৃত্যু হয়,
আমি বরং প্রতিবাদ করে মারা যাব।”
মেঘের কালো স্তনগুলো শুকিয়ে গেছে।
বরষার জলে সিঞ্চিত মাতৃসম কাবেরী নদী,
যিনি বহু শতাব্দী ধরে আগলে রেখেছেন আকাশ,
মানব ইতিহাসে বর্ণিত সমস্ত মায়েদের মতো বা মেয়েদের মতো
তিল তিল করে লালন করেছেন মুক্তো, ডোরাকাটা বাঘ, রক্ত, মানুষ, শহর,
তিনি আজ মারা যাচ্ছেন ।
নিমোখিয়া-চা
তিনি হার্ভার্ড কিংবা ইমোরি থেকে এসেছেন;
‘নিমোখিয়া’ চায়ে ডুবে থাকা
চা বাগানের বাঁদীদের নিয়ে
গবেষণাপত্র লিখবেন বলে
একটি টয়োটা ইন্নোভা চড়ে তেজপুর রওয়ানা হন।
তিনি পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছিলেন;
‘অনুসন্ধান’ ও ‘নিয়ন্ত্রণ’ নামে দুই দলে
মহিলাদের ভাগ করে দেন।
তিনি যখন হ্যান্ড-সেনিটাইজার দিয়ে হাত মুছতে মুছতে কথা বলেন,
ওদের চায়ে লবণের পরিমাণ অর্ধেক কমে যায়।
স্মৃতিচারণের খাতিরে উপত্যকার ছবি তুলে
মহিলাদের সঙ্গে সেল্ফি নিয়ে
হোটেলে ফিরে তিনি গবেষণাপত্র লেখার কাজ সম্পূর্ণ করেন।
তিনি লিখলেন: অতিরিক্ত লবণ সেবনের কারণে রক্তাল্পতা,
উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং প্রসূতি মায়ের মৃত্যু।
চায়ের ড্রাম ফুটতে থাকে
চা বাগানের মহিলাটি এখন ক্লান্ত,
লোহা ও আর্সেনিকে তাঁর দেহ বিষাক্ত হয়ে উঠছে;
তিনি এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে তাতে লবণ ভরে
শাড়ির আঁচলে বেঁধে নেন, এবং সুযোগ বুঝে
চুপচাপ পোঁটলা থেকে সব লবণ চায়ের কাপে ঢালেন। লবণ ছাড়া
তাঁর আর কিছুই নেই।
[নিমোখিয়া-চা – লবণ-চা
ইংরেজ আমল থেকেই চা বাগানের শ্রমিকদের ব্ল্যাক-টি বা কালো চা খাওয়ানোর চল রয়েছে। বহু বছর ধরে চলে আসা এই নিয়মটি এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার ফলে চা শ্রমিকরা রক্তাল্পতা, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি নানা রোগের শিকার হচ্ছেন এবং প্রসূতি মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।]
একটি মরু-গান
ভাবরি দেবী যখন ‘তানে কট্টে’ গান,
এই পৃথিবী তার ভাষা হারিয়ে ফেলে।
এটি শুধুমাত্র একটি গান নয়, নারী কণ্ঠে যুদ্ধের দামামা,
যা তাদের কণ্ঠনালীতে সেলাই করে দেওয়া হয়েছে।
এ গানে পৃথিবী ঝলসে যায়, জন্মায় অগণিত ক্যাকটাস
যার কাঁটাগুলো উইপোকার মতো, যার ফুলগুলো সব ছলনা।
তাঁর মাথার ঘোমটা নিয়ম-শৃঙ্খলার রক্ষক,
নিজেকে এবং এই নিষ্ঠুর শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখার উপায়।
পিতৃতন্ত্র লোহার তৈরি একটি মুষ্টি, যা কেবল ধ্বংসে বিশ্বাসী;
এটি গান-পাখিদের গিলে খায়, এতে কণ্ঠস্বরগুলো চিরতরে হারিয়ে যায়।
কিন্তু তাঁর গান যখন বাড়ির উঠোন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে,
শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলে আকাশ, পুরুষদের অশ্রুজলে সিক্ত হয় ইতিহাস।
আসলে ভোপীদের গান শরীরের হাড়-মজ্জার সীমানা ছাড়িয়ে,
ঘোমটার শৃঙ্খলে জমে থাকা কান্না এবং পাথরের তৈরি প্রাসাদের ঊর্ধ্বে চলে যায়।
বিষাদের একটি সুদীর্ঘ সুর সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দেয়,
এবং নিয়মগুলো ধ্বংস হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।
(ভোপা রাজস্থানের স্থানীয় একটি সম্প্রদায় যারা দেবদেবীদের নিয়ে লোকগান করেন; এখানে ভোপা সম্প্রদায়ের নারীদের ‘ভোপী’ বলা হয়েছে)