মহুয়া সেনগুপ্তর দশটি কবিতা
১
শত জলকণায় নামগান বাজে।
জন্ম-জন্মান্তর ঘুরে ঘুরে আসে
সীমান্ত লঙ্ঘিত পায়ে।
অতি দূরদেশে তাঁর পথিকসাজ,
মালিনীর দীন কণ্ঠহার বুকে জাগে—
লতা থেকে চ্যুত অশ্রুফুল,
মেঘ থেকে চূর্ণ জলধারা।
দুলে ওঠে অনন্ত পথ, ছুটন্ত অশ্বখুরধার,
তোমার জন্য
সখা, একটি তণ্ডুল আছে
ক্ষুধিতের শাকান্নে ধরা।
২
একটি আলোকিত নদীর পাশে শুয়ে আছি, একবস্ত্রে।
আমার প্রকৃতিজন্ম মাদুর করে
বিছিয়ে দিয়েছি ধুলোয়।
আকাশপথে সুরের পালকি বেয়ে
উৎসব ঘন হয়ে ওঠে।
বুকের ওপর আঁকা আছে
মৃত্তিকাতিলক।
রূপান্তরিত—
কবে, কখনও এ মাটির বুকে
নেমে আসো যদি
নয়নাভিরাম।
৩
পায়ের কাছে শুয়ে আছে পথ।
জানি না শুনতে পাব কিনা,
শুনতে পেলে
ও পথের নীরব আহ্বান
কে পারে ঠেলতে দূরে!
ছায়া ছায়া মেঘলা দুপুরে
একদিন ডেকে নেবে
আনন্দপুরে,
দরজা ঠেলে,
ধূলিময় পথের জগৎ।
ভয় নেই–
তোমার শহরে
আমি কখনও যাব না!
৪
জলের মর্মভাষা জানো?
জলের স্বপ্ন দেখি–
নতমুখে নেমে যাচ্ছি জলের আদরে।
জল আমায় বুকে নিয়ে খেলা করে,
নিরন্তর–
বহু বহু যুগ
আমি কারো স্বপ্নে আসি না।
৫
পাহাড় ডাকে স্বপ্নে
একদিন ঠিক চলে যাব।
পাইন কাঠের ঢালু ছাদ ঘর।
তারপর কোনোদিন মায়াবী জ্যোৎস্নায়
নিজেকে হারাব–
ভাসিয়ে দেব আলতো
সানুদেশে,
অন্তিম ফার্নের শয্যায়!
নিরঙ্কুশ শান্ত জীবনে
ঘন কুয়াশা, মায়াঘর,
আমার অন্যজন্ম আশা!
আমার ইচ্ছামৃত্যু বর!
৬
ক্ষুধার্ত, তুমি শুধু
আলোকবর্ষ দূরের নও,
কালের যাত্রায় একাকী অগ্রগামী মাছ।
প্রাণপণ, তোমাকে টানছি
স্পেস-টাইমের জালে বন্দি
আলোর পাত্র ভেঙে দিয়ে।
চাইছি
এই সিঙ্গুলারিটি বিন্দুর আকর্ষণে
ও সাঁতার পথ বেঁকে চুরে যাক!
৭
তুমি শুধু বয়ে যাও
গতির আবেগে,
অধরার তৃষ্ণা তোমার।
কোন্ ঘর, কোন্ ঘাট তোমাকে
স্থিত রাখবে?
দূরের ডাক তোমায়
পথ ভুলিয়ে নিয়ে যায় বারবার
নিঃসঙ্গতার তীব্র টানে।
ভুলে যাও বিষণ্ণ নদ,
ওই জলে মধুকের ছায়া পড়েছিল
কোনোদিন।
৮
জ্বরের ঘোরে আর্ত
যাকে তুমি শুশ্রুষা ভাবো
সে তোমার অসুখ বিকার।
অবেলার ঘুম ভেঙে
নিরাময়—
জ্বরের পারদ নেমে গেলে
বলো, উন্মাদিনী!
ও কেউ ছিল না আমার!
৯
নীলবর্ণ আলোয় শুয়ে আছি
ধ্বংস হয়ে, অপেক্ষায়—
আকাশের কান্না ঝরে কিনা!
অবশেষে
সমাপনের সুরে
প্রতীক্ষার চাদর জুড়ে
পাপড়ি ঘন হলে
আমার শবাধারের রং
আরও পীত,
আরও একটু ছায়াতুর হল।
১০
এ যাত্রা পরিণামহীন।
অনেক বেদনায়
এ বাসনার রাশ টেনেছি
প্রণতিতে।
বিগ্রহের হাতের ঘ্রাণ
পাব না কখনও।
তাই চন্দন ঘষতে বসে
আমি লম্বা করে শ্বাস টানি,
দুই চোখ বুজে আসে
প্রণয়মঙ্গলে।