মধুপ্রলেপ – রুমা চক্রবর্তী
চৈত্র মাসের মাঝামাঝি, তবু এখনই গরমটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বৃষ্টি নিরুদ্দেশ। কোনো রকমে ক্লান্ত, ঘামে সর্বাঙ্গ সিক্ত শরীরটকে বহন করে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। স্টেশনে পৌঁছে দেখি, অসংখ্য মানুষের ভিড়। সূর্যের আগুনঝরা তাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে শেডের নিচে সকলে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ বা স্টেশন-সংলগ্ন বেসিনে গিয়ে মুখে, ঘাড়ে, হাতে জল বুলিয়ে নিচ্ছে। আমিও গেলাম তাদের দেখাদেখি। জল হাতে নিতেই মনে হল ফুটন্ত জলেরই এক সংস্করণ। ধীর-পদে এগিয়ে গেলাম। একটু বসতে ইচ্ছা হল। অস্থায়ী বসবার জায়গাগুলিতে উপবিষ্ট মানুষজনকে অনুরোধ করলাম- “আমায় একটু বসতে দেবেন পাঁচ মিনিট?” আশ্চর্য! কেউ যেন আমার কথা শুনতেই পাচ্ছে না। সবাই সবার নিজের নিজের কাজে মগ্ন। কেউ গল্প করছে, কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। কেউ আইসক্রিম, চপ কিংবা বেগুনী খাচ্ছে। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বা বিরক্ত হচ্ছে ট্রেন লেট দেখে। আমি গলায় যথাসাধ্য জোর এনে তারস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলাম- “আমায় একটু বসতে দেবেন? আমায় একটু বসতে দেবেন প্লিজ!?” একবার, দুইবার, বার বার বলতে লাগলাম। কিন্তু এদের চোখে আমি কই? প্রতিটা কথা আমারই কানে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। কেউ আমাকে দেখছে না। দেখছে না! দেখতে পাচ্ছে না? না কি দেখতে চাইছে না?
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনিতে পরিশ্রান্ত আমি পড়ে গেলাম ধুলোতেই। জানি, এবার রাশি রাশি প্রশ্ন আমায় তেড়ে আসবে। “কী হল?”, “পাগল-টাগল না কি?” কিংবা “শরীর খারাপ?” ইত্যাদি আরও কত কী! সব থেকে বড় কথা হল, সবাই এবার আমাকে দেখতে পাবে, দেখবে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়। কিন্তু… কই? কেউ তো তাকালোই না, কোনো প্রশ্ন তো দূরের কথা। উপরন্তু যেদিক থেকে ডাউন ট্রেন আসবার কথা সেদিকে হঠাৎ সবাই ছুটতে শুরু করল। মনে হল, ওদের ঠোঁটের কোণে আটকে থাকা উহ্য প্রশ্নগুলো আমার উপরে বর্ষণ না করে নিজেরাই উত্তর খুঁজে নিতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। অবাক হয়ে দেখলাম, আমার চারপাশের বসন্ত কেমন নিভে যাচ্ছে। গাঢ় সবুজ গাছপালা, লাল টুকটুকে পলাশ, কৃষ্ণচূড়া অথবা ঐ রাধাচূড়া সবকিছুকে কে যেন ইরেজার দিয়ে মুছে দিচ্ছে। অনুভব করলাম, আমার সমস্ত পরিশ্রম, ক্লান্তি, অবসাদ, অসুখ সমস্তটার বাইরে আমাকে ঘিরে ছিল এক রঙিন পৃথিবী। তবু আরাম পাইনি!
মুহূর্তে প্ল্যাটফর্মের আবহ বদলে গিয়ে ধূ ধূ মরুভূমি হয়ে গেল। আমিও ছুটতে লাগলাম উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ছুটন্ত মানুষগুলোর পিছনে। কিন্তু ওরা সমুদ্রের মতো দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে। নাগাল পেলাম না। বসে পড়লাম মরুময় শূন্য প্রান্তরের মাঝে। ছোটো একটা ক্যাকটাসের কাঁটা পায়ে বিঁধে রক্ত ঝরতে লাগল। নাহ্ ওদের নাগাল আমাকে পেতে হবে না। ওরা তো কেউ আমাকে দেখতেই পায়নি অথবা চায়নি। পরিশ্রান্ত আমাকে একটু বসবারও জায়গা দেয়নি। ওদের পায়ের কাছের ধুলোয় পড়ে গেছি, তবুও দেখেনি, প্রশ্নও করেনি। ওরা আবার এদিকে আসবে, আমি জানি, আসবেই। আবার নিজের নিজের জায়গা দখল করে বসবে। আর আমি ক্লান্ত শরীর টেনে টেনে ওদের পিছনে শুধু ছুটে যাব? আমার নিজের জায়গা বলে তো তবে আর কিছুই থাকবে না। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসলাম। রুমালটা বেঁধে নিলাম পায়ের ক্ষতে। বুকপকেটে রাখা কাজের তালিকাটা বের করে মিলিয়ে দেখতে লাগলাম কী কী কাজ এখনও বাকি আছে। আর যে মাসকাবারি বেতন পেয়েছি, সেটা ঠিক আছে তো? সেটা বের করে হিসাব করতে লাগলাম। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল একটা ভিড়ের আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি ওরা ফিরছে। সঙ্গে করে নিয়ে আসছে আমার চারপাশের নিভে যাওয়া রঙিন বসন্ত। আবার সবুজ গাছপালা, নীল আকাশ আঁকা হয়ে যাচ্ছে আমায় ঘিরে। পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিমুলের রূপে আকাশে উৎসবের আমেজ।
[চিত্রঋণ : মৌমিতা ভট্টাচার্য্য ]