মোবাইল-চোর – রুমা চক্রবর্তী
অন্য দিনের মতোই অমানুষিক ভিড়ে ঠাসা ট্রেনটা স্টেশনের পর স্টেশন ছুটে চলেছে নিজের মেজাজে নির্বিকারভাবে। তবে, ভিড়ের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সমস্ত অস্বস্তি, বিরক্তি, নাভিশ্বাস, হতাশ্বাস, হাসিকান্না, ধ্বস্তাধ্বস্তি, ঝগড়া, দুরাশা, নিরাশা, উদ্বেগ, তৃপ্তি-অতৃপ্তি ছাপিয়ে একটা দৃশ্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। লাস্ট লেডিস কম্পার্টমেন্টে চোর ধরা পড়েছে, গণধোলাই চলছে।
* * *
‘কী চুরি গেছে?’, ‘চোর কে?’, ‘ছেলে না মেয়ে?’, ‘কেমন বয়স?’, ‘দেখি তো চেনা কিনা?’— ইত্যাদি হরেকরকম প্রশ্ন উড়ে আসছে আশেপাশের জেনারেল কম্পার্টমেন্টের কিছু অতি কৌতূহলী, জানলার রড ধরে ঝুঁকে পড়া মানুষের উচ্চকিত চেরা গলা থেকে। কোনো কোনো ভদ্রলোক আবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হামাগুঁড়ি, ডিগবাজি, জিমনাস্টিক খেতে খেতে সটান মেয়েদের ভিড়ে ঢুকে পড়েছেন। এত আড়ম্বরের মাঝে গেটের কাছে চাপ চাপ ভিড়ে চুপসে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেক-আপ সর্বস্ব মুখে রুমাল-ভেদী ভেউ-ভেউ শব্দ আর কাজল-কালো চোখে দুফোঁটা জল দেখা গেল। কোনোরকমে সুমিষ্ট ধরা গলায় বলল— “আমার পঁচিশ হাজার টাকার স্মার্টফোনটা…”
* * *
ডেইলি প্যাসেঞ্জার যে ভদ্রমহিলাকে গতকাল ঝগড়া শেষ করার জন্য দমদমে না নেমে শিয়ালদা পর্যন্ত যেতে হয়েছিল, গণধোলাইটা তিনিই তদারক করছেন। কালকে তাকে নিয়ে যারা পরিহাস করেছিল অপরাধীকে শাস্তি দিতে আজ তারা সবাই হাতে হাত মিলিয়েছেন।
* * *
দশ বছরের মেয়েটা মার খেতে খেতে কুঁকড়ে যাচ্ছে। চোখের জল আর রক্তে পোশাক ভিজে উঠছে। তবু বলছে না “আমায় ছেড়ে দাও।” একদিকে ভালোই হল। রাক্ষুসে মানুষগুলোর হাতে মার খেয়ে মরে যাওয়া ভাল, তিলে তিলে মরে যাবার থেকে। “এ ছুড়ির মায়ের হাতে মোবাইলটা ছিল, সে তো আগের স্টেশনে নেমে চম্পট। কোলে একটা হাত–কাটা বাচ্চা ছিল না? ভাগ্যিস এ নামতে পারেনি। যতক্ষণ মুখে রা’ না কাড়ে, মারো…” বলতে বলতে কারা যেন তার হাত বাঁধছিল। কোথায় মা? সে যে ছেলেধরা, মোবাইলটা চুরি করে তার হাতে না দিলে দুহাত কেটে রোদের মধ্যে ভিক্ষা করতে হত। আট বছর ধরে দেখেছে মহিলাকে, সে জানে কথাটা কত বড় ভয়ঙ্কর সত্যি।
বাস্তব সমাজের চিত্র। খুব ভালো লাগলো।