কাগজ সভ্যতা – সৌম্যজিৎ রজক
১
কাগজের মানচিত্রের ভেতর আমার কাগজের ঘর
কাগজের শিশুগণ কাগজের স্কুলে যায়
বড়োরাও কাগজের
কাগজেরই বসতি গড়েছে
হাটে ও বাজারে পথে গিজগিজে ভিড়
কেনাবেচা করে তারা, কাগজেরই বিনিময়ে করে
জমিতে জমিতে কাগজের বেড়াও উঠেছে
এমনকি কাগজের কাঁটাতারও সীমানা বরাবর
উদ্বাস্তু কাগজেরা উদ্বাস্তু কলোনীতে থাকে
মাতাল কাগজেরা মাতলামিই করে
কাগজেরা পুচোআচ্চাও করে
এমনকি টুকটাক বিজ্ঞানচর্চাও
যেমন শিকারেও যায় পূর্ণিমা রাতে
কাগজের বাঘ যেমন হয়,
শিকারিও হয় কাগজের
যদিও জঙ্গলের থেকে শহরের দিকে
সরে যাওয়াকেই সভ্যতা বলে মনে করে তারা
কাগজ সভ্যতা উন্নয়নশীল, এ-কথাও বলাই বাহুল্য
নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সেখানে
আগুনের ব্যবহারটুকুই যা নিষেধ
২
সত্যি বলতে কী, উল্লিখিত কাগজের দেশে
আরও অনেক কিছুই নিষিদ্ধ যেমন
অশ্লীলতা, গরুদের খাদ্য হতে অস্বীকার করা,
কাপড়চোপড় পরা—
নবজাতদের ল্যামিনেট করানোর
দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্রই
বিশেষ টীকাকরণের ব্যবস্থাও রয়েছে যাতে
দেশে ‘বৈধ’ কাগজদের দেখেই চেনা যায়
সমকামিতা বা রাজদ্রোহের মতোন অপরাধ
আইনের চোখে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য তবে
কাগজের রাষ্ট্রে কোনো জেলখানা নেই
অপরাধীদের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে
ছুঁড়ে ফেলাই বিধান
৩
ছুঁড়ে ফেলার আগেই যেহেতু তাদের
দুমড়ে মুচড়ে ও দলা পাকানো হয়
ফলে কাগজদের ক্ষেত্রে এ শাস্তি চরমতমই
বুঝতেই পারছেন, কাগজের রাষ্ট্রে
মৃত্যুদণ্ডই কার্যত একমাত্র শাস্তি হিসেবে স্বীকৃত
যেমন সেখানে একমাত্র সত্য হল
কাগজে যা লেখা আছে
এখনও যা লিপিবদ্ধ হয়নি তা বলতে চাইলে
জিওনার্দো ব্রুনো কিংবা লোরকার মতো
ছিঁড়ে কুচি কুচি করাই দস্তুর
এহেন দৃষ্টান্ত কাগজের ইতিহাসে
কম নেই
৪
রীতিমতো গণতান্ত্রিক হওয়ায় নাগরিকদের কিছু
মৌলিক অধিকারও রয়েছে যেমন
যাকে খুশি এরোপ্লেন বানিয়ে উড়িয়ে দেওয়া
এমনকি নিজেরও ওড়ার স্বাধীনতা প্রত্যেকের আছে
যাকে খুশি ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার এমনকি
নিজেকেও নির্বাচিত করার অধিকার আছে
কাগজদের দাবিদাওয়া তুলে ধরা হয় কাগজের সংসদে
কেউ কেউ যাকে মানুষের খোঁয়াড়ও বলে থাকে
সেখানে চেয়ারে বসে কাগজের সাংসদ আর
পেপার ওয়েট থাকে টেবিলে
শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, কাগজের দেশে নানা
সংগঠনও গজিয়ে উঠেছে, এমনকি
কাগজাধিকার কমিশনও
রংবেরঙের কাগজেরা রংবেরঙের
পার্টিও খুলেছে, বিক্ষোভ-টিক্ষোভও কদাচিৎ হয়
খবরের কাগজে কিছু ছাপাও হয়েছে
৫
হোক না কাগজের, পুলিশ তো পুলিশেরই মতো
অপরাপর রাষ্ট্রশক্তির ন্যায়
প্রতিবাদীদের ঠান্ডা করা এখানেও তার মহান দায়িত্ব
হোক না কাগজের, বুলেট তো বুলেটেরই মতো
অবশ্য শুরুতে টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ইত্যাদি প্রভৃতিই রীতি
কাগজের রাস্তার ধারে
কাগজের লাশও পড়ে শেষে
তারও পরে চ্যানেলে চ্যানেলে এমনকি বিতর্কসভাও বসে
—“রাষ্ট্রের আইন থাকলে, আইন-অমান্যের
অধিকারও নাগরিকের ন্যায়সঙ্গত”
—“প্রতিবাদ করা যদি কাগজের মৌলিক অধিকার হয়
পুলিশেরও তবে কণ্ঠরোধ করা…”
এইমতো তর্ক করে বিশিষ্ট কাগজেরা, তবে
দু-একদিনের বেশি বাজারে কাটে না
৬
কাগজের দেশে বড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে
ছোটোবড়ো সংঘাত ভুলে রাষ্ট্র ও নাগরিক
জাতীয় শোক পালন করে
কেউ মরে গেলে নীরবতা
কাগজের স্বাধীনতা দিবসে
কাগজের স্কুলে বিউগল বাজে
কাগজের পতাকা তোলা হয়
জাতীয়তাবাদী কাগজেরা সেইদিন
ভাঁজ করা নৌকার মতো
দুলে দুলে চলে
কাঙালি ভোজন হয় বিশেষ তিথিতে
৭
মাঝেসাঝে ধর্মের নামে তারা দাঙ্গাও করে
বিধর্মীকে বেঁধে রাখে, কাগজের নয়
বাঁশের খুঁটিতে
জুতোপেটা করে আর উল্লাসে মাতে
উল্লাসে ফেটে পড়ে আর তলপেটে সোজা
ঢুকিয়ে দেয়, কাগজ নয়, বল্লম
এফোঁড় ওফোঁড় করে
তবে তারা সর্বাধিক আহ্লাদ পায়
অন্য ধর্মের মেয়েদের, হোক না কাগজের, লুট করার সময়
ধর্মপ্রাণ কাগজের ভেতরের
ধর্মপ্রাণ মানুষটি জেগে ওঠে
৮
কাগজের যৌনতা নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো
বেশি কথা না বলাই ভালো কাগজের কৃষিকাজ নিয়ে
কাগজের শহরে বা গ্রামে পরিযায়ী পাখিরা আসে না
আকাশেও ওরা বর্ডার এঁকেছে
যেহেতু সমস্ত কিছু কাগজেই লেখা, ফলে
কাগজের দেশে কেউ কিছু ভুলতে পারে না কখনও
হয়তো সেকারণেই ওরা অভিযোজনের মাধ্যমে
শোকহীন এক সভ্যতা হাসিল করেছে
৯
বহু প্রাচীন না হলেও, রাতারাতি গজিয়ে ওঠেনি
দীর্ঘ এক প্রক্রিয়ারই অন্তিম পরিণতি এই
কাগজ সভ্যতা আমাদের
আমাদের দুঃস্বপ্নেরই মতো
মানুষ যখন পরিণত হচ্ছিল একেকটা কাগজে
সমস্ত বিস্মৃতি ভুলে যখন সাল তারিখ আর
নানাবিধ তথ্যের স্তূপে
রূপান্তরিত হচ্ছিল দলিল দস্তাবেজে
সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া, ধাপে ধাপে
সকলে পারে না
অথচ কাগজ হতে হলে প্রথমেই ভুলতে হবে কান্না
যেহেতু চোখের জলে কাগজ ভিজে যেতে পারে
সবাই কি পারে চোখ মুছে ফেলতে?
সবাই কি পারে শোক মুছে ফেলতে?
সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া, ধাপে ধাপে
যারা অপারগ, তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়
তারও পরে, শোনা যায়, জ্যান্তই পুঁতে দেওয়া হয়
মাটির গভীরে
সেদিক থেকে দেখলে, পাঠক
আমাদের এই কাগজ সভ্যতা
বিরাট এক কবরস্থানই বটে!