তিনি অগ্নিশিখা, তিনি তরবারি ( পর্ব ৩) – বনবাণী ভট্টাচার্য
(৩)
সুকুমারী ভট্টাচার্য একজন আপসহীন সত্যসন্ধানী। সত্যের খাতিরেই তিনি মুক্তির কুঠারে ধ্বংস করতে চেয়েছেন অচলায়তন। টান মেরে ছিঁড়ে ফেলেছেন মিথ্যার জালে ঢাকা সত্যকে। আধিপত্যবাদীদের ‘উৎপাদিত সত্য’-র মুখোশ টেনে খুলেছেন। শিরোপার লোভে যারা চিরকাল ঢোক গিলে সত্যকে অস্বীকার করে এসেছেন, সুকুমারী তাদের লাইনে কখনও দাঁড়াননি। তাঁর এই ভারততত্ত্বর উপস্থাপনা এককথায়, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের সমান। ভারতের ইতিহাস যেমন ব্রিটিশের মনের মাধুরী মেশানো, ব্রিটিশের কলমে এক ‘উৎপাদিত ইতিহাস’, ভারততত্ত্বও তেমনি অনেকখানি প্রভু-শক্তিরই বীক্ষা বিশেষ। ফলে, ঐতিহ্যের প্রতি ছদ্ম মর্যাদাবোধ, অতীতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতায় পরিণতি পায়। তিনি ঔপনিবেশিক প্রাচ্যতত্ত্বের স্বরূপ নির্দেশ করেছেন—“as a Western style for dominating, restructuring and having authority over the orient”। তাঁর দৃঢ় মত প্রাচ্যতত্ত্বকে সহনশীলতার সাথে দীর্ঘসময় ধরে নিরীক্ষণ না করলে, কারোর পক্ষে আত্মস্থ করা সম্ভব নয় যে, প্রাচ্যতত্ত্বে কী বিশাল সুবিন্যস্ত শৃঙ্খলা রয়েছে যার সাহায্যে রেনেসাঁ -উত্তরকাল জুড়ে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিও ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছে, এমনকি রাজনৈতিক–সমাজতাত্ত্বিক, সামরিক—আদর্শগত—বৈজ্ঞানিক এবং কাল্পনিক ভাবে প্রাচ্যতত্ত্বকে উৎপাদন করতে পেরেছে।
তিনি এক সংগ্রামী চিন্তাবিদ্–বিনা দ্বন্দ্বে, বিনা যুদ্ধে তিনি কখনও কিছু গ্রহণ করেননি, ত্যাগও করেননি। তাঁর বোধহয় একটা সুপ্ত মনঃকষ্টও ছিল যে তাঁর নিজের একান্ত ভালোবাসার সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যকে ঘিরে যারা এ যুগে থাকছেন, তারা এই ভাষাকে কখনোই ‘ক্ষুরধার মননের বাহন’ বলে বিশ্বাস করেন না আন্তরিকভাবে। তাঁর গভীর প্রত্যয় ছিল যে, প্রাচীন গ্রিক–হিব্রু–ল্যাটিন ধ্রুপদী ভাষার মতোই সংস্কৃত ভাষারও সেই গুণ–সেই শক্তি বর্তমান, যার সাহায্যে সে আন্তর্জাতিক বিদ্যাচর্চায় নিজের স্থান করে নিতে পারে শুধু না, পারে সাহিত্য ও শিল্পভাবনার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ‘আবহমান জীবন ও চলমান মানুষের পুনরাবিষ্কার’ সম্ভব করতে। অত্যন্ত জোরের সাথেই সুকুমারী বিশ্বাস করেছেন যে, ভারতের চিন্তাস্রোতকে অনুসরণ করতে হলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অবশ্যই অবগাহন করতে হবে। অতি আধুনিক, অত্যন্ত যুক্তিবাদী তাঁর সত্তা কিন্তু সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যকে ঘিরে যে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি ও বদ্ধসংস্কার রয়েছে তাকে ধিক্কার দিয়েও এই প্রাচীন ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যকে দেবভাষা—ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ভাষার অচলায়তন থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে, তাকে অবারিত করার লক্ষ্যে সুকুমারীকে রণক্ষেত্রে নামিয়ে দিয়েছে। বলিষ্ঠতার সাথে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন—সংস্কৃত চর্চা মুখ্যত বিশ্ববিদ্যার শরিক–প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম সঞ্চালকরা বিপ্রতীপে যার মান্যতা দিতে চান না। তাই বেদ–গীতা–রামায়ণ–মহাভারত–উপনিষদের এক রণাঙ্গন থেকে আর এক রণাঙ্গনে তিনি আজীবন তাঁর যুক্তির তরবারি হাতে ছুটে বেরিয়েছেন। এবং এই সব কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা দেবমূর্তির মতো ধর্মগ্রন্থগুলির মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যায় লেখিকা পার্থিব এবং মানবিক মাত্রা যুক্ত করেছেন যুক্তির আলোকে।
তাঁর সমস্ত কাজ ও চিন্তার কেন্দ্রে মানুষ এবং মানুষ। ছোটোবেলা থেকেই তো জানতেন চণ্ডীদাসের সেই শাশ্বত বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। সেই বাণীর অক্ষরপাত ঘটেছে মহাভারতের পবিত্র পাতায়। তিনি দেখেছেন যখন শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন—“গুহ্যং ব্রহ্মং যদিদং তে রূবীমি ন মানুষাৎ শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিত” (একটি গোপন সত্য তোমাকে বলে যাই, / মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এই দুনিয়ায় কিছু নাই)। তাঁর বিশ্ববীক্ষা যে বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে, তার স্রষ্টা যে কার্ল মার্কস, তাঁর একটি প্রিয় লাইন ছিল—ল্যাটিন কবি টেরেন্সের—“Homosum, humani nila me alienum puto” (I am a man, nothing human is alien to me)। সেই পংক্তিই সুকুমারীর জীবনব্যাপী সাধনার মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
ফলে , বেদ–উপনিষদ ও সমগ্র বৈদিক সাহিত্যই একালে এক বিকল্প ভাষ্যে সাধারণের জীবনচর্চায় অনেক সহজ, গুণ্ঠনমুক্ত এবং অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে। “প্রাক্-আর্য, আর্য, অনার্য জাতিগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির নিরন্তর সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে অনবরত রূপান্তরিত সাহিত্য–দর্শন–অধিবিদ্যা–প্রত্নকথার কোন বস্তুনিষ্ঠ গবেষকই কেবল লক্ষ্য করেন ‘projection of vital experience of a people’। আরও খুঁজে পান কেন্দ্রাভিমুখী ও অন্তেবাসী অস্তিত্বের কখনও প্রকাশ্য কখনও প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব এবং অবদমিত বেসরকারি মতাদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত প্রতিবাদের বাচন”। সুকুমারী ভট্টাচার্যই এই গবেষক, যিনি বৈদিক সাহিত্য থেকে তুলে ধরেছেন, মহত্ত্ব ও রহস্যের আবরণ ভেদ করে সে যুগের লোকসাধারণের লাঞ্ছিত বঞ্চিত জীবন এবং মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদের বয়ান। ভারতীয় জীবনে বৈদিক যুগ এক বিশেষ সমীহ অর্জন করে এবং এমন এক সমাজের ছবি আঁকা হয়েছে যেখানে সকলই নবীন সকলই শোভন এবং সকলই বিমল। সেখানে বিদুষী খণা–লীলাবতীরা সমাদৃত হয়েছে পুরুষের মতোই। কিন্তু বিদুষী খণা শেষপর্যন্ত বাক্রহিত হয়েছিলেন। খণা অত্যন্ত দুরূহ গণিতের সমাধান করলে রাজা বিক্রমাদিত্য রাজসভায় তাঁকে দশম রত্নের স্থান দিতে চেয়েছিলেন। আহত পৌরুষে ক্ষিপ্ত খণার স্বামী বরাহমিহির খনার জিভ কেটে নিলেন তাঁর বাক্শক্তি হরণের জন্য। অপরিসীম প্রতীকী তাৎপর্যপূর্ণ এই ঘটনা। ঋগ্বেদ থেকে বেদাঙ্গসূত্রের মধ্যবর্তী সময়কে বৈদিক যুগ বলে মেনে নিলে, এই সময় প্রায় সতেরো-আঠারোশো বছর বিস্তৃত। এই সমস্ত কাল জুড়ে সমাজের সার্বিক অবস্থান যেমন অপরিবর্তিত থাকেনি—মেয়েদেরও অবস্থান অবিকল একই রকম থাকেনি। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ শতকে ভারতের প্রথম সাহিত্য ঋগ্বেদে ঘোষা, শাশ্বতী, গোধা, লোপামুদ্রা, অপালা, বিশ্বব্যারা প্রমুখ মহিলা কবির উল্লেখ আছে। বিশ্পলা একটি পা এবং বধ্রিমতী একটি হাত হারান যুদ্ধে—শশীয়সী বীরত্বের জন্য সুবিখ্যাত। দেবতা ও পিতৃগণকে দৈনন্দিন জল দানে গার্গী বাচক্লবী, বাড়বা আত্রেয়ী এবং সুলভ মৈত্রেয়ীর নাম উল্লেখ আছে। একটি গ্রন্থে পাওয়া যায়—“নারীর যজ্ঞোপবীত দিয়ে দীক্ষা”-র কথা। সুকুমারী এইসবের ভিত্তিতে অভিমত প্রকাশ করেন যে, “অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ধারণা বলে যা মনে হয়, তা হল, আর্য বসবাসের প্রথম কয়েকটি দশকে নারী তার উপনয়ন এবং স্বাধ্যায়ের অধিকার হারায়নি কিন্তু আর্যরা যখন অনার্য পত্নী গ্রহণ করতে শুরু করল তখন সমাজ নারীর উপনয়ন ও স্বাধ্যায়ের অধিকার কেড়ে নিল। অতএব সাধারণভাবে নারী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হল।” নারীর নির্বাসন হল গৃহকর্মে—বাইরের জীবন বলতে যা কিছু একসময় সে উপভোগ করতে পারত তা আর থাকল না—তার মন ও শরীরের উপরও মেয়েদের আর অধিকার থাকল না। নারী হলো পাপ। শতপথ ব্রাহ্মণ বলছে—“অমৃতকে দেখবে না, অর্থাৎ নারী, কুকুর ও কালো পাখি দেখবে না; অন্যথায় পুণ্য ও পাপ জ্যোতি ও অন্ধকার সত্য ও মিথ্যা মিশে যাবে।” নারী আসলে মানুষই নয়, ঊনমানব, অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানুষ নয়। সুকুমারীর ভাষ্য—“এর থেকে নারীর যে দ্ব্যর্থহীন চিত্র বেরোয় তাতে নারীকে মূলত ঊনমানবী হিসাবে দেখা হয়, যার জীবনে একমাত্র উদ্দেশ্য পুরুষকে তার যৌবন, রূপ, লাস্য এবং গৃহকর্মে তার শ্রম দিয়ে তুষ্ট করা।” এর মধ্যেও পুত্রসন্তানের জন্মদানই তার প্রধান কর্তব্য। সুকুমারী প্রশ্ন তুলেছেন কেন নারী তার মানবিক অধিকার এবং সামাজিক সম্মান হারালেন? নারী কীকরে হল তার স্বামীর সম্পত্তি? বৈদিক যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের পরিবর্তনের মধ্যে এর উত্তর খুঁজে তিনি দিয়েছেন।
পশুপালক জাতি থেকে কৃষিতান্ত্রিক জীবনে স্থিতি লাভ করে যে সমৃদ্ধির মুখ আর্যরা দেখতে পায়, সংখ্যালঘু ধনবানরা নিজের ঔরসজাত সন্তানকে সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেবার উদ্দেশ্যেই নারীকে বন্দি করে রাখল অবরোধে, যেখানে অনাত্মীয় পুরুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হল। মা-ই একমাত্র সন্তানের জনককে চিহ্নিত করতে পারে, তাই এই বাইরের জীবিকা-জগত থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা।
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ উল্লেখ করেছে—“সতী স্ত্রী সে-ই যে স্বামীকে তুষ্ট করে, পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর মুখের উপর জবাব দেয় না।” সুকুমারীর মতে এই হল বৈদিক যুগে নারীর প্রকৃত ছবি। “তাকে ব্যবহার করা হয় একটি অসাড়, চিত্তহীন পদার্থ হিসেবে যার অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তার স্বামীর তুষ্টিসাধন করা।” ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তো ভালো নারীর লক্ষণ—“যে স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্রের জন্ম দেয় এবং কখনও স্বামীর কথার উত্তর করে না।” সমস্ত বৈদিক সাহিত্য জুড়েই নারীর কর্তব্য নির্ধারণ করা আছে—কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষ বা স্বামীর করণীয় সম্পর্কে কথা নেই। আর যে কথাটুকু আছে তা সবই নারী লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের, যেমন — বন্ধ্যা নারীকে দশ বছর, শুধু কন্যার জননীকে বারো বছর এবং মৃতবৎসা মা-কে পনেরো বছর পরে স্বামীর পরিত্যাগ করতে পারাটা শাস্ত্র অনুমোদিত। বৌধায়ণ ধর্মসূত্র বলছে—“যে স্ত্রী ভ্রষ্টা সে-ও প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা শুদ্ধ হয়”—কলহপরায়ণ বা ধর্ষিতাদের ত্যাগ করলে স্বামীকে দণ্ড দেওয়া যেতে পারে, স্ত্রীর প্রতি কটুভাষণ করলে উপবাস ও প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় স্বামীকে। নারীর অধিকার ও সম্মান নিয়ে যে ইতিবাচক কথা ও ইঙ্গিত এবং পুরুষের মানবিক বোধের কিছু সংকেত তা বোধহয় খানিকটা সদিচ্ছা এবং চক্ষুলজ্জার ও চোখে ধুলো দেওয়ার বিষয়। সুকুমারী বলেছেন—“বৌধায়ণ গৃহ্যসূত্র ২/২/৬৩, ৬৪ এগুলি যে সাধারণ সদিচ্ছামূলক উক্তি প্রমাণিত হয়। রামের আচরণে এগুলির প্রতি সামগ্রিক অবহেলা, অহল্যার প্রতি গৌতমের এবং রেণুকার প্রতি জমাগ্নির আচরণ থেকে এই মানবিক রীতিগুলি যে অনুসরণ করা হত না তার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।”
শাস্ত্র-অনুশাসন নির্ভর সমাজে নারীর জীবন একান্তই অনুশাসিত—যা পুরুষ চেয়েছে। একসময়ে পত্নী স্বামীর আগে আগে চলত, সূর্য ঊষার পিছন পিছন যেতেন। ঋগ্বেদের যুগে বিধবারা বেঁচে থাকত—স্বামীর সাথে সহমরণে যেতে হত না। নারীর ছিল মানবিক সম্মানও। কিন্তু অর্থ অনর্থের মূলের মত ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও তার উত্তরাধিকার নারীকে গৃহবন্দি করল—উৎপাদনের কাজের থেকে তাকে বিযুক্ত করা হল। তার অস্তিত্ব কতটুকু? কুমারী হিসেবে সে সাহিত্যে অনুপস্থিত, বিধবা হিসেবে তাকে এক বিষন্ন অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হল, সাহিত্যেও তার প্রেমিকার অস্তিত্বটুকুই সব। উৎপাদন থেকে সরিয়ে এনে তাকে বোঝানো হলো তার স্বামীই তার ভরণ-পোষণ যোগান দেয়। ভৃ ধাতু থেকেই এসেছে ‘ভার্যা’ ও ‘ভৃত্য’ শব্দদুটি। ভৃত্যের ভরণ-পোষণ করেন যে প্রভুু তিনিই স্ত্রী বা ভার্যাকে প্রতিপালন করেন। ইংল্যান্ডে পত্নীরা স্বামীকে লর্ড বলেই সম্বোধন করত।
সুকুমারী বৈদিক যুগের গার্গী–মৈত্রেয়ীর তথাকথিত সম্মাননার মোহজাল ছিন্ন করে, নারীর লাঞ্ছনা–অবমাননা–বঞ্চনা–নিপিড়নের নগ্ন ছবি তুলে ধরেছেন বে–পুরাণ–উপনিষদে ডুব দিয়ে। নারীর বিদ্যা-বুদ্ধি পুরুষের কাছে অপ্রিয় এবং অবাঞ্ছিত। তাই বরাহমিহির যেমন খণার জিভ কেটে সমাজকে সহবৎ শিখিয়েছে, তেমনিি, বেদান্ত দর্শনের ভিত যে ‘সোহম্’-তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে সেই ‘সোহম্’ উচ্চারণকারী অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্কে (বাণী কে) অধস্তন করে রাখা হয়েছে। গার্গীর ক্ষমতায় ভীত, তাঁর চ্যালেঞ্জ করার সাহসে স্তম্ভিত ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলে ওঠেন—“আর কথা বাড়িও না গার্গী, নাহলে তোমার মাথা খসে পড়বে”—অর্থাৎ নারীকে নীরব করে দেওয়া হয়েছে। অশিক্ষার অন্ধকারে তারা অবনত মর্যাদায় নিক্ষিপ্ত হয়ে এই নীরবতাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে এবং পুরুষের উপর চূড়ান্ত অর্থনৈতিক নির্ভরতা মেয়েদের বাধ্য করেছে এই নীরবতা–এই প্রতিবাদহীনতাকে মেনে নিতে।
মেনে নিতে পারেননি এ যুগের গার্গী, বিদুষী সুকুমারী ভট্টাচার্য। তাই লাইব্রেরি থেকে লাইব্রেরি—এ প্রতিষ্ঠান থেকে সে প্রতিষ্ঠান, এদেশ থেকে সেদেশ, সংস্কৃত প্রাচীন পুঁথি থেকে প্রত্নতত্ত্বের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো সুকুমারী ভট্টাচার্য নারীর স্বাধিকার আর মুক্তির পতাকা হাতে জনাকীর্ণ অডিটোরিয়ামের মঞ্চ থেকে রাজপথে অগণিতের মিছিলেও সামিল—সামিল উনমানবী থেকে পূর্ণ মানবের প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, কেবলমাত্র মানবতার তাগিদে।