সীমিত ওভারের ক্রিকেট ও ভারত – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় 

সীমিত ওভারের ক্রিকেট ও ভারত – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় 

শেয়ার করুন

‘ক্রিকেট’ শব্দটা উচ্চারণ করলেই বর্তমানে দুটি আলাদা প্রজন্মের কাছে দুই রকম অর্থ দাঁড়ায়; দুই না বলে তিন বলাই ভালো। প্রথম প্রজন্ম যাঁদের কাছে ক্রিকেট মানে দীর্ঘমেয়াদি দুই ইনিংসের সাদা পোশাকের লাল বলের খেলা। দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট মানে প্রথম প্রজন্মের ধারণার সঙ্গে একদিনের ক্রিকেট অর্থাৎ কিনা সাদা পোশাকের লাল বলে সকালে খেলার কথা মনে হবে যাঁরা আবার দিন রাতের ক্রিকেটের জন্য মুখিয়ে থাকতো; যা কিনা রঙ্গিন পোশাকের সাদা বলে খেলা হতো। তৃতীয় অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মের কাছে ক্রিকেট মানে কুড়ি ওভারের মূলত রাতের খেলা। এরা টেস্ট বা একদিনের খেলা দেখে না তা নয়, তবে খুব পছন্দ করে এমন নয়। দ্রুত গতির জীবনে অভ্যস্ত এই প্রজন্মের কাছে দিনান্তে ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে বসে কুড়ি ওভারের বিনোদন যথেষ্ট আকর্ষণীয়।

যদিও বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন যে অতীতের ক্রিকেট মানেই দীর্ঘমেয়াদি দুই ইনিংসের লাল বলের ক্রিকেট, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্রিকেট জন্মেছিল কম সময়ের খেলা হিসেবে। হাফ ডে, ওয়ান ডে ম্যাচই ম্যাচই সম্ভবত সপ্তদশ এবং অবশ্যই অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে খেলা হতো। সিঙ্গল উইকেট ও হতো। পরে দুই ইনিংসের দীর্ঘমেয়াদি খেলার সূত্রপাত হয়। যদিও সেই সময়ের ওয়ানডে বা হাফ ডে ম্যাচ সীমিত ওভারের ছিল না।

সীমিত ওভারের ক্রিকেট কোথায় প্রথম শুরু হয় তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। সন্দীপ বামজাই তাঁর ‘গাটস and গ্লোরী’ গ্রন্থে দাবী করেছিলেন যে বোম্বে শহরে শুরু হওয়া ‘পদ্মাকর তালিম শিল্ড’ সম্ভবতঃ ক্রিকেট দুনিয়ার প্রথম সীমিত ওভারের ক্রিকেট। কিন্তু সম্প্রতি ২০১৭ নাগাদ ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ ও ইতিহাসবিদ বি শ্রীরাম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার ১৯৪৪ সালের ২৪ জানুয়ারি সংখ্যা থেকে দেখিয়েছেন যে ‘বি সুব্রহ্মমনিয়ম মেমোরিয়াল টুর্নামেন্ট’ তার থেকেও পুরোনো। কারণ সেই রিপোর্টে লেখা আছে ‘The contest is played on the basis of either of finished innings or of runs scored in 55 overs on each side’ – নিশ্চিতভাবে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের নিয়মের এরথেকে নিখুঁত উল্লেখ আর নেই। সেই বছর Triplicane cricket club হারিয়ে দিয়েছিলো Madras cricket club কে। Tcc দলে ছিলেন এম জে গোপালন এর মতো ক্রিকেটার। Bcci এর প্রাক্তন সম্পাদক টি শ্রীনিবাসরাঘবন ও এই ম্যাচে খেলেন Tcc এর হয়ে, অবশ্য তিনি তখন ক্রিকেটার, কর্মকর্তা হননি। MCC দলে ছিলেন সি পি জনস্টনের মতো খেলোয়াড়। শ্রীরাম এও দেখিয়েছেন যে বুচিবাবু প্রতিযোগিতা প্রথম যখন শুরু হয় (১৯৪৬ সালে) তখন সেই প্রতিযোগিতাও ছিলো সীমিত ওভারের।

এই পরে বোম্বেতে পদ্মাকর তালিম শিল্ড ও ১৯৫১ সালে কেরালায় পূজা নক আউট খেলা শুরু হয় যা সীমিত ওভারের ক্রিকেট ছিলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে ক্রিকেটে ব্যাপক মন্দা আসে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ অর্থাৎ টেস্ট ম্যাচ ছাড়া মাঠে লোক হচ্ছিল না। এখন যেমন আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে ঘরোয়া ক্রিকেট এর একটা বড় খরচ ওঠে, তখন ব্যাপার ছিলো উল্টো। ঘরোয়া ক্রিকেটের অর্থের যোগান আন্তর্জাতিক ম্যাচ সংগঠিত করতে সাহায্য করতো। ফলে কাউন্টি ম্যাচে সমস্যা শুরু হয়।

এই সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী এম সি সি সীমিত ওভারের খেলা শুরু করে। প্রথমে ১৯৬২ সালে লিস্টারশায়ার, নটিংহ্যামশায়ার, নর্দাম্পটনশায়ার ও ডার্বিশায়ার এর মধ্যে শুরু হয় মিডল্যান্ড নক-আউট কম্পিটিশন। ব্যাপক সাড়া ফেলে, টিভি সম্প্রচার হয় এই টুর্নামেন্টের। এম সি সি সিদ্ধান্ত নেয় বড় আকারের টুর্নামেন্ট করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের পয়লা মে শুরু হলো জিলেট কাপ। প্রথম ম্যাচে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ল্যাংকশায়ার (৩০৪) হারিয়ে দিলো লিস্টারশায়ার(২০৩) কে ১০১ রানে। ল্যাংকশায়ার দলের পিটার মারনার ১২১ আর লিস্টার্সের মরিস হ্যালাম ১০৬ করেন। বল হাতে লিস্টার্সের জন সাভাজ ৪ উইকেট ও ল্যাংকশায়ার এর স্ট্যাথাম ৫ উইকেট নেন। মজার ব্যাপার, ল্যাংকশায়ার এর ব্র্যায়ান স্ট্যাথাম ও কেনেথ হিগস এবং লিস্টার্সের এলান ওয়ার্টন ছাড়া এই দুই দলের আর মাত্র একজনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সংস্পর্শে আসেন। তিনি হলেন লিস্টার্সের ডিকি বার্ড যিনি পরে কিংবদন্তি আম্পায়ার হন।

সীমিত ওভারের ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্যাপক ভাবে। আস্তে আস্তে সীমিত ওভারের খেলা সর্বত্র শুরু হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও একে কিভাবে প্রয়োগ করা যায় তাই নিয়ে ভাবনা শুরু হয়।

১৯৬৫ সালে জিলেট কাপ জয়ী ইয়র্কশায়ারকে সুযোগ করে দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটি সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলার, কিন্তু ম্যাচটি বৃষ্টির জন্য হয়নি। আবার ওই বছরেই ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ইংল্যান্ড ট্যুর করে, সবকটি ম্যাচ ছিলো ৪০ ওভারের। এর মধ্যে সাসেক্সের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ তাঁরা খেলেন, সেই ম্যাচে সাসেক্সের হয়ে মনসুর আলী খান পতৌদি খেলেছিলেন, এবং শেষ ম্যাচ টি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যে ম্যাচে গ্যারি সোবার্স ৬১ করেন।

এখানে বলে রাখা ভালো নব্বইয়ের দশক থেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ গুলির মধ্যে যে গুলি প্রথম শ্রেণির দল খেলে সেগুলিকে লিস্ট এ ম্যাচ বলা হয়। এই ‘লিস্ট এ’ তকমাটির আবিষ্কার করেন এসোসিয়েশন অফ ক্রিকেট স্ট্যাটিস্টিয়ান and হিস্টোরিয়ান নামে একটি সংস্থা। ২০০৬ সাল থেকে ICC এই তকমা সরকারিভাবে মেনে নেয়। প্রতিটি odi কিন্তু লিস্ট এ ম্যাচ ও বটে। জিলেট কাপ লিস্ট এ ম্যাচ ছিলো কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স দলের কোনো খেলাই এই স্বীকৃতি পায়নি, যদিও এই ম্যাচ গুলি সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বাড়িয়ে দেয়। সম্ভবতঃ পতৌদির শেষ নবাব-ই প্রথম ভারতীয় যিনি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেন। অবশ্যই ভারতের সুব্রহ্মণীয়ম, পূজা নক আউট, বুচিবাবু বা তালিম শিল্ড লিস্ট এ তকমা পায়নি।

১৯৬৬ সালে জিলেট কাপ জেতে ওয়ারউইকশায়ার। সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলে। এছাড়া সারের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলে একটি একদিনের ম্যাচ আয়োজন করা হয়। যথারীতি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স সফর করে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি ম্যাচ খেলে। এরই মধ্যে রথম্যান্স ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপ খেলা হয়। বিশ্ব একাদশ ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিলে অঘোষিত ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ম্যাচ প্রকৃত অর্থে প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ হওয়ার যোগ্য কিন্তু এই ম্যাচের এমনকি লিস্ট এ স্বীকৃতিও নেই।

৪ঠা মার্চ, ১৯৬৭। জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫০ ওভারের খেলায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩২৪ রান তাড়া করে ম্যাচ জিতে যায়। মজার ব্যাপার ঐ সফরের টেস্ট ম্যাচ গুলিকে টেস্ট হিসেবে ধরা হলেও এই ম্যাচটি odi স্বীকৃতি পায়নি, যদিও লিস্ট এ স্বীকৃতি পায়। আসলে ওই সময় কমনওয়েলথ এর বাইরে চলে যাওয়ায় icc এই ম্যাচ গুলিকে টেস্ট হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেট ইতিহাসবিদরা একপ্রকার জোর করে একে টেস্ট ধরে। যেহেতু তখন odi বা লিস্ট এ সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিলো না তাই এই ম্যাচ লিস্ট এ হিসেবে পরে ধরা হলেও odi স্বীকৃতি পায়নি।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তান রথম্যান্স ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট কাপ জেতে। এখানেও ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান লিস্ট এ বা odi ধরা হয়নি। যদিও পাকিস্তান কেন্টের বিরুদ্ধে একটা লিস্ট এ খেলে, পাকিস্তানের সব ক্রিকেটারের লিস্ট এ ক্রিকেটে ডেবিউ হয়। ভারত ও ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স এর বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলে ৪০ ওভারের। ভারত ৪০ ওভারে ২৩২ রান তুলে ১৫ রানে হেরে যায়। রমেশ সাকসেনা ৭১, হনুমন্ত সিং ৫০ ও অজিত ওয়াদেকার ৪৭ করেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ২৪৭ করেছিলো। সোবার্স ও লয়েড ৮৬ করেন।

১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে এই প্রায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটি খেলতে পারেনি। আসলে এই সময় প্রায় সব ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটার কাউন্টি খেলতে ইংল্যান্ডে থাকতেন। ফলে প্রদর্শনী ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম নিয়ে এরা খেলতেন বোর্ডের অনুমতি ছাড়া। সম্ভবতঃ এই কারণে এই ম্যাচ গুলির কোনও লিস্ট এ স্বীকৃতিও নেই।

১৯৭০ সাল থেকে জিলেট কাপের পাশাপাশি জন প্লেয়ার লীগ চালু হয়। সব সিনিয়র কাউন্টি দল একে ওপরের বিরুদ্ধে খেলে। জিলেট কাপে কিছু মাইনর কাউন্টি দলও খেলে। এরপরেই বছরেই ইতিহাস তৈরী হয়।

১৯৭০/৭১ মরশুমে এম সি সি গিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ৭ টি টেস্ট খেলা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মেলবোর্ন এর তৃতীয় টেস্ট বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে শেষ দিন দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য ৮ বলের ৪০ ওভারের ম্যাচ খেলা শুরু হয়।জিওফ বয়কট, জন এডরিচ, কিথ ফ্লেচার, বেসিল ডি অলিভিয়েরা, কলিন কাউড্রে, রে ইলিংওয়ার্থ, জন স্নো, এলান নট, প্রভৃতি মূলতঃ টেস্ট খেলে বিখ্যাত ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা খেলতে নামেন বিল লরি, ইয়ান চ্যাপেল, ইয়ান রেডপাথ, গ্রেগ চ্যাপেল, রডনি মার্শ, ডগ ওয়াল্টার্স, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, কিথ স্ট্যাকপোলদের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে।

অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে ব্যাটিং নেয়। ৩৯.৪ ওভারে ১৯০ করে তাঁরা অল আউট হন। জন এডরিচ ৮২ করেন। এটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথম অর্ধ-শতাধিক রান। জবাবে অস্ট্রেলিয়া ৩৪.৬ ওভারে (আগেই বলেছি ৮ বলের ওভার) ৫ উইকেট হারিয়ে ১৯১ রান তুলে নেন। ইয়ান চ্যাপেল ৬০ রান করেন। ৪৬,০০৬ জন দর্শকদের উপস্থিতিতে ৩৩,৮৯৪.৬০ মার্কিন ডলার উপার্জন হয়েছিলো।

পরের বছরেই এর সাফল্য সুনিশ্চিত ভেবে প্রুডেন্সিয়াল কাপ চালু হয় ইংল্যান্ডে। অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের এই দ্বি-পাক্ষিক সিরিজে ইংল্যান্ড ২-১ এ জেতে। প্রথম ম্যাচেই ডেনিস আমিস শতরান করেন।

এরপরেই চলে আসে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড। বেভান কংডনের দল অতি সহজে ইন্তিখাব আলমের দলকে হারায়।

১৯৭৩ সালে প্রুডেন্সিয়াল কোম্পানি দুটো সিরিজ স্পন্সর করে। নিউজিল্যান্ড বনাম ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইংল্যান্ড যার প্রথম ম্যাচে ৩ বল বাকি থাকতে ১ উইকেটে জেতে ইংল্যান্ড, গ্যারি সোবার্সের জীবনের প্রথম ও শেষ odi ম্যাচ, পরের ম্যাচে অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮ উইকেটে জয়ী হয় রয় ফ্রেডরিক্স এর ১২২ বলে করা ১০৫ রানের সুবাদে। এরপরেই শুরু হলো অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড সিরিজ (১৯৭৪)।

১৯৭৪ সালের ১৩ জুলাই। দিনটার গুরুত্ব ভারতের কাছে ২৫ শে জুন ১৯৩২ এর মতোই হওয়া উচিত ছিল। লিডসে ভারত মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। একদিনের ক্রিকেটে প্রায় নবাগত (সংগঠিত ভাবে) ভারত ৫৩.৫ ওভারে ২৬৫ করে। ব্রিজেশ প্যাটেল ৭৮ বলে ৮২ করেন, অজিত ওয়াদেকার ৮২ বলে ৬৭ করেন। গাভাস্কার ৩৫ বলে ২৮ রানই শুধু করেননি, একটা ছয় ও মেরেছিলেন। তবে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বোলারদের অনভিজ্ঞতা ইংল্যান্ড কে মাত্র ৫১.১ ওভারে ২৬৬ রান তুলতে সাহায্য করে। এর পরের ম্যাচে ভারত খুবই খারাপ ভাবে হারে, সেই ম্যাচে প্রথম বাঙালি হিসেবে odi খেলার রেকর্ড গড়েন গোপাল বসু।

ভারতে একদিনের ক্রিকেট অর্থাৎ যে সব ম্যাচ পরে লিস্ট এ তকমা পায় তা শুরু হয় ১৯৭৩/৭৪ সালে। দেওধর ট্রফি নামের সেই প্রতিযোগিতা ছিলো প্রফেসর বলবন্ত দেওধরের নামে। তাঁর তখন বয়স ৮১ বছর। এই জীবন্ত কিংবদন্তির নামে শুরু হওয়া প্রতিযোগিতা ছিল জোনাল ফরম্যাটের। জয়ী হয় পশ্চিমাঞ্চল। প্রথম ম্যাচে হেরে বিদায় নিলেও পূর্বাঞ্চলের গোপাল বসুর করা ৫২ (বনাম দক্ষিণাঞ্চল) শুধু প্রথম হাফ সেঞ্চুরি নয়, ওই প্রতিযোগিতার তৃতীয় ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান ছিলো। এই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য ছিলো ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপের প্রস্তুতি।

ইংল্যান্ডে প্রথম বিশ্বকাপ (অবশ্যই পুরুষদের; কারণ মহিলাদের প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হয় ১৯৭৩ সালে) বসে ১৯৭৫ সালে। প্রুডেন্সিয়াল কোম্পানি বিশ্বকাপ স্পন্সর করে। প্রথম দিন ভারত বনাম ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া বনাম পাকিস্তান এর ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ।

শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবনের নেতৃত্বে থাকা ভারত এই বিশ্বকাপে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। উরস্টারের সঙ্গে একটা ওয়ার্ম আপ ম্যাচ হেরে যায়। আবিদ আলী আর ব্রিজেশ প্যাটেল ছাড়া বলার মতো সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলতে পারে এমন ক্রিকেটার ছিলোই না। উল্টে প্রথম ম্যাচে ৩৩৫ রান তাড়া করে ভারত ৩ উইকেটে ১৩২ তোলে। সুনীল গাভাস্কার ১৭৪ বল খেলে ৩৬ করে অপরাজিত ছিলেন। পরের ম্যাচে ইস্ট আফ্রিকাকে হারালেও শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে ভারত বিদায় নেয়।

১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপের আগে বলার মতো ঘটনা হলো দুটো। ভারত পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম odi খেলে কোয়েটায় এবং জয়ী হয় এবং আরেকটি একদিনের প্রতিযোগিতা ‘উইলস ট্রফি’ শুরু হয় ভারতে।

১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ ভারতের জন্য আরও বিভীষিকা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। শ্রীলঙ্কা সহ সব ম্যাচ ভারত হেরে বিদায় নেয় বিশ্বকাপ থেকে।

১৯৮০’র দশকে চিত্রটা পাল্টে যায়। পরবর্তী বিশ্বকাপের আগে ভারত ২৭টি ওয়ানডে ম্যাচের মধ্যে ৯টি জিতে নেয়। এরমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড কে দুইবার করে, শ্রীলঙ্কাকে তিনবার করে, নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ কে একবার করে হারিয়ে দেয়। এরমধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২৯শে মার্চ ১৯৮৩ সালের ম্যাচটির মাহাত্ম্য আলাদাই ছিলো। মাইকেল হোল্ডিং কে বেধড়ক পিটায় ভারত, রবার্টস একটু কম মার খান কেবল মার্শাল (৭-০-২৩-১) ভালো বল করেন। ভারত ৪৭ ওভারে ২৮২/৫ তোলে। কপিলদেব মাত্র ৩৮ বলে ৭২ করেন (এর মধ্যে হাফ সেঞ্চুরি ২২ বলে), গাভাস্কার ৯০ করেন। এরপর মাত্র ৯৮ রানে ৪ উইকেট ফেলে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। রিচার্ডস ওই ৯৮ রানের মধ্যে একাই ৬৪ করেন ৫১ বলে। ফলে বাক্কাস (৫২) ও দুজোঁ (৫৩) করে লড়লেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৫৫ রানের বেশি তুলতে পারেনি। এই জয় ভারতকে আলাদা মানসিক শক্তি এনে দেয়। এই দলটির ৯ জন বিশ্বকাপে খেলতে যায় ১৯৮৩ সালে।

এবার দলে ছিল অনেক নতুন মুখ। অধিনায়ক ছিলেন কপিল দেব,যিনি ১৯৭৯-এর বিশ্বকাপে ৩ ম‍্যাচে ৫৩ রান করেন আর ২ খানা উইকেট নেন। দলে ছিলেন মহিন্দর অমরনাথ, মদনলাল ( তাঁরা আগের দু’বার‌ও ছিলেন), কীর্তি আজাদ, রজার বিনি, সৈয়দ কিরমানি, সন্দীপ পাটিল , বলবিন্দর সিং সান্ধু, যশপাল শর্মা, রবি শাস্ত্রী, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, সুনীল ভালসন ( একটাও ম‍্যাচ খেলেননি), দিলীপ বেঙ্গসরকার।

এবার‌ই প্রথম গ্রুপ লিগে প্রতিটি দলের মধ্যে দুটি করে ম‍্যাচ খেলানো হয়। ভারতের ব‍্যর্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত এক ব্রিটিশ সংবাদপত্রের সম্পাদক (ডেভিড ফ্রিথ) জানিয়ে দিলেন যে ভারত জিতলে তিনি নিজের কথা নিজে গিলবেন । এই বক্তব্যে আর‌ও ইন্ধন যোগায় সবকটি প্র‍্যাকটিস ম‍্যাচে ভারতের পরাজয়। দু’বারের বিজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন‌ও অপ্রতিরোধ্য।

এবার‌ও গ্রুপ ‘বি’ তে থাকা ভারত ৯ই জুন প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে পড়ে ১৪৪/৫ হয়ে যায়। এটা যদিও অন‍্যান‍্য বারের তুলনায় কিছুটা ভালো। অবশেষে যশপাল শর্মা (৮৯), পাটিল (৩৬), বিনি (২৭), মদনলাল (২১) সবাই মিলে ৬০ ওভারের শেষে ভারতকে ২৬২/৮ এ পৌঁছে দেয়। আশায় বুক বাঁধলেন সমর্থকেরা । বিশ্বকাপের আগে একটা খেলায় ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল। তবে কি…

ওয়েস্ট ইন্ডিজের শুরুটা ভালো হয়। হেইন্স (২৪) ও গ্রীনিজ (২৪) দলকে ৪৯ অবধি টানে। এরপর বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন সান্ধু, বিনি মদনলালরা ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে শুইয়ে দেন। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের রান হয়ে যায় ৯ উইকেটে ১৫৭। ৮ বছর পর ভারত বিশ্বকাপে কোনো ম‍্যাচ জিততে চলেছে, তাও আবার দু’বারের চ‍্যাম্পিয়নকে হারিয়ে। এই অবস্থায় দশম উইকেটে অ‍্যান্ডি রবার্টস ও জোয়েল গার্ণার ৭১ রান যোগ করে ফেলে। ১৯৭৯ সালের সেমিফাইনালের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন এই জুটি (পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ উইকেটে ৬৪ রানের জুটি)। শেষে শাস্ত্রীর বলে কিরমানি গার্ণারকে স্টাম্প করতেই উল্লাসে মেতে ওঠে ভারত । ৩৪ রানে জয় এল। বিনি (৩/৪৮) আর শাস্ত্রী (৩/২৬) অসাধারণ বোলিং করেন। এখানে বলে রাখা ভালো বৃষ্টির জন‍্য খেলা ৯ ও ১০ ই জুন হয়েছিল।

১১ ই জুন ভারত সহজেই জিম্বাবুয়েকে হারায়। জিম্বাবুয়ে প্রথম ম‍্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে চমক দিলেও ভারতের কাছে মাত্র ১৫৫ রানেই গুটিয়ে যায়। মদনলাল (৩/২৭) ভালো বল করেন। কিরমানি নেন ৫ টা ক‍্যাচ। জবাবে ভারত অমরনাথ (৪৪) ও পাটিলের (৫০) ব‍্যাটের ওপর ভর করে ৩৭.৩ ওভারেই প্রয়োজনীয় রান তুলে নেয়।

১৩ ই জুন তৃতীয় ম‍্যাচ ( অস্ট্রেলিয়া) থেকে বিপর্যয় শুরু হলো। কেপলার ওয়েলসকে কপিল ৫ রানের মাথায় বোল্ড করে দিলেও ট্রেভর চ‍্যাপেল (১১০) আর অধিনায়ক কিম হিউজ ( ৫২) দলের রানকে ১৫৫ -এ নিয়ে গেল। এরপর গ্রাহাম‌ ইয়ালার ৬৬ রানের দৌলতে অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে ৩২০/৯ তোলে। কপিল দেবের দুর্দান্ত বোলিংকে (৫/৪৩) সাহায্য করলনা কেউ। উল্টে মদনলাল (১২ ওভারে ২/৬৯), পাটিল (৬ ওভারে ৩৬), অমরনাথ (৪ ওভারে ১/২৭) বেধড়ক মার খেলেন। কপিল দেব প্রথম ভারতীয় বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে এক ইনিংসে ৫ টি উইকেট নিলেন। এরপর শ্রীকান্ত (৩৯) , কপিল দেব (২৭ বলে ৪০ ), মদনলাল (২৭) ছাড়া কেন ম‍্যাকলের বলের সামনে (৬/৩৯) কেউই দাঁড়াতে পারেনি। ৩৭.৫ ওভারে ১৫৮ রানের মধ্যে গুটিয়ে যায় ভারত। ১৬২ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়।

১৫ ই জুন বদলা নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথমে ব‍্যাট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তোলে ২৮২/৯। রিচার্ডস ১১৯ রান করেন। বিনি ৩ উইকেট নিলেও ৭১ রান দেন। জবাবে ব‍্যাট করতে নেমে ভারতের ইনিংস শেষ ২১৬ রানে। মহিন্দর অমরনাথ শুধু ৮০ রান করেন। তাঁকে বাদ দিলে হোল্ডিং (৩/৪০), রবার্টস (২/২৯) এর সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি।

যাইহোক টার্নব্রিজ ওয়েলস-এ ১৮ ই জুন১৯৮৩। ভারতের ইতিহাসে আর এক সোনালী দিন। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ভারত ব‍্যাট করতে নামল। প্রথম ওভারে রসনের দ্বিতীয় বলে গাভাস্কার এলবিডব্লিউ। ভারত ০/১। ১৩ বল খেলে কুরানের বলে বুচারের হাতে ক‍্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন শ্রীকান্ত (০)। ভারত ৬/২। তারপরেই রসনের বলে ডেভিড হাউটনের হাতে ক‍্যাচ দিয়ে অমরনাথ আউট (২০ বলে ৫)। ভারত ৬/৩। পাটিল‌ও গেল ১০ বলে ১ রান করে কুরানের পরের ওভারে হাউটনের হাতেই ক‍্যাচ দিয়ে। গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত। ভারতে ততক্ষণে হাহাকার পড়ে গেছে। এমতাবস্থায় ব‍্যাট করতে নামলেন ক‍্যাপ্টেন কপিল দেব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার সেই রসনের বলে হাউটনের হাতে ক‍্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন যশপাল শর্মা (২৮ বলে ৯ রান)। ভারত ১৭/৫ । এবার বিনির সাথে জুটি বাঁধলেন কপিল। ধীরে ধীরে রান উঠতে লাগলো। প্রাক্তন দক্ষিণ আফ্রিকান টেস্ট খেলোয়াড় জন ট্রাইকসের বলে বিনি ( ৪৮ বলে ২২) যখন আউট হচ্ছেন তখন ভারত ৭৭/৬। তারপরেই রবি শাস্ত্রী (৬ বলে ১) পাইক্রফট-এর বলে ফ্লেচারের হাতে ক‍্যাচ দিয়ে আউট। ভারত ৭৮/৭। এরপর কপিলকে খানিকটা সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করেন মদনলাল। দলীয় ১৪০ রানের মাথায় আবার সেই কুরান- হাউটন জুটির শিকার হয়ে প‍্যাভিলিয়নে ফিরে যান তিনি ৩৯ বলে ১৭ রান করে। অপর প্রান্তে কপিল তখন বিধ্বংসী মেজাজে। শুরু হলো লড়াই। একদিকে কিরমানি (৫৬ বলে ২৪ অপরাজিত) শুধু ধরে স্ট্রাইক দিচ্ছে আর অন‍্যদিকে কপিল জিম্বাবুয়েকে শেখাচ্ছেন ‘ক্রিকেট কিভাবে খেলতে হয়’। শেষে ১৩৮ বলে ১৬ টা চার আর ৬ টা ৬ মেরে ১৭৫ অপরাজিত কপিল। নবম উইকেটে গড়ল বিশ্বরেকর্ড ( ১২৬ অপরাজিত)। ভারত ৬০ ওভারে ২৬৬/৮। কুরানে (৩/৬৫), রসন (৩/৪৭) এর লড়াই কাজে এলো না। জিম্বাবুয়ের হয়ে কুরন (৭৩) ছাড়া ব‍্যাট হাতে সেভাবে কেউই দাঁড়াতে পারল না। ৫৭ ওভারে ২৩৫ রানে জিম্বাবুয়ে অল‌আউট। মদনলাল (৩/৪২) , বিনি (২/৪৫), কপিল (১/৩২), সান্ধু (১/৪৪), অমরনাথ (১/৩৭) সেদিন প্রায় অপ্রতিরোধ্য ছিল। আর সেদিন থেকেই গোটা দেশ অন‍্য খেলা ভুলতে শুরু করল।

২০ শে জুন দেখা গেল অন‍্য ভারতকে। যশপাল (৪০), পাটিল (৩০), কপিল (২৮) সবাই মিলে ২৪৭ তুললেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। হগ (৩/৪০) ও টমসন (৩/৫১) শুধু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল। জবাবে মদনলাল (৪/২০) ও বিনি (৪/২৯) অস্ট্রেলিয়াকে গুঁড়িয়ে দিল। অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ১২৯ রানে অলআউট করে সেমিফাইনালে গেল ভারত। যা প্রথম দিকে কেউই ভাবেনি।

২২ শে জুন ১৯৮৩, সেমিফাইনালে মুখোমুখি ইংল্যান্ড ও ভারত। বাটলার (৩৩), ট‍্যাভারে (৩২) রান ছাড়া আর কোনো ইংল্যান্ড ব‍্যাটসম‍্যান‌ই কীর্তি আজাদ (১২ ওভারে ১/২৮) ও মহিন্দর অমরনাথের (২/২৭) বলের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি। উপরন্তু কপিল দেব (৩/৩৫) ও বিনির (২/৪৩) বোলার ইংল্যান্ডকে ২১৩ তে আটকে দেয়। এরপর ভারত ব‍্যাট করতে নেমে অমরনাথ (৪৬), যশপাল (৬১), ও পাটিলের মারমার কাটকাট ব‍্যাটিং(৩২ বলে ৫১)- এর ওপর ভর করে ৫৪.৪ ওভারে মাত্র৪ উইকেট হারিয়েই জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান তুলে নেয়। ভারত পৌঁছে যায় ফাইনালে। ম‍্যান অফ দ‍্যা ম‍্যাচ হন অমরনাথ।

২৫ শে জুন ১৯৮৩ । দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল‌ই। ৫১ বছর আগে এক‌ই দিনে এই লর্ডসে সি.কে-এর ভারত টেস্ট খেলা শুরু করেছিলো। এবার সেখানেই ফাইনাল। মুখোমুখি দু’বারের বিজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শ্রীকান্ত (৫৭ বলে ৩৮, ৭×৪,১×৬) আর অমরনাথ (৮০ বলে ২৬) ছাড়াও পাটিল একটু ব‍্যাট করলেন। কপিল দেব নেমেই ৮ বলে তিনটি ৪ মেরে আউট। শেষে মদনলাল ২৭ বলে ১৭ আর কিরমানি ৪৩ বলে ১৪ করেন। এমনকি ১১ নম্বরে ব‍্যাট করতে নেমে সান্ধু ৩০ বলে ১১ রান করে ভারতের রান ১৮৩ তে পৌঁছে দেন। রবার্টস (৩/৩২), মার্শাল (২/২৪), হোল্ডিং (২/২৬), গোমস (২/৪৯) ভালো বল করেন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১৮৪ ছিল নস‍্যি, তাই অনেকেই ভেবেছিলেন যে ভারতের স্বপ্ন এবার‌ও অধরাই থাকবে। যাই হোক, প্রথমেই সান্ধুর বল বেশখানিকটা সুইং করে গ্রিনিজের (১২ বলে ১) স্ট‍্যাম্প উড়িয়ে দেয়। তখন ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ৫/১। নামলেন রিচার্ডস। নেমেই মার শুরু। দেখতে দেখতে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ৫০। তারপর মদনলালের বলে বিনির হাতে ক‍্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরলেন হেইন্স (৩৩ বলে ১৩, ২×৪)। ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ৫০/২ ।এবার এলেন লয়েড। রিচার্ডসের রান যখন ২৭ বলে ৩৩ (৭×৪), তখন তিনি তুলে মারলেন মদনলালের বল। কপিল দেব উল্টো দিকে ২৫ গজ দৌড়ে অনবদ‍্য ক‍্যাচ লোফেন‌। ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ৫৭/৩। এরপর‌ই ধ্বস নামে। দেখতেই লয়েড (৮), গোমস (৫) ও বাঙ্কাস( ৮) ফিরে যান। যখন ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ৭৬/৬ তখন দুঁদো (২৫) এবং মার্শাল (১৮) কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন কিন্তু এইসময় অমরনাথ এসে দুজনকেই ফিরিয়ে দেন। ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ১২৫/৮ । সারা ভারত আশায় বুক বাঁধছে। একরানের মধ‍্যেই কপিলের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে গেলেন অ‍্যান্ডি রবার্টস। বিশ্বকাপ আর ভারতের মাঝে তখন দুরত্ব ১ টি উইকেটের। গার্ণার (১৯ বলে ৫) ও হোল্ডিং (২৪ বলে ৬) আরও ২৮ মিনিট অপেক্ষা করালেন। তারপর অমরনাথের বলে হোল্ডিং এলবিডব্লিউ হতেই সারা ভারত মেতে উঠল বিশ্বজয়ের আনন্দে। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ইনিংস শেষ হলো ১৪০ রানে। দারুন বল করেছিলেন মদনলাল (৩/৩১) ও অমরনাথ) অমরনাথ ম‍্যান অফ দ‍্য সিরিজ হন। পরের দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়।

আসলে বিশ্বকাপের আগে ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে হারানো তাদের শিখিয়েছিল যে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ অপ্রতিরোধ্য নয়, তাছাড়া প্রথম ম্যাচেই ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে হারানো তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কপিলের ব‍্যাটিং ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের অনবদ্য বোলিং।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানো এবং
ফাইনালে রিচার্ডসের ক‍্যাচ ছাড়াও একাধিক অলরাউন্ডারের দলে থাকা ভারতে বাড়তি সুবিধা দিয়েছিলো।

ডেভিড ফ্রিথ একটি চিঠি পান জনৈক মান সিং এর থেকে (ম্যানেজার নন, প্রবাসী এক ভারতীয়)। তাতে ফ্রিথের কথা মনে করিয়ে ছিলেন পত্র লেখক। ফ্রিথ মজা করে চিঠিটি ছাপান, সঙ্গে একটি ছবি। তাতে নিজের লেখা পানীয়র সঙ্গে তাঁকে খেতে দেখা যায়।

অনেক স্বপ্নের শুরু হয় ওখান থেকেই। সেদিনের ১০-১২ বছরের শিশুরা যারা আনন্দ করেছিল তারাই পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটের মুখ উজ্জ্বল করে। আজ‌ও সানি-কপিলের হাতে ধরা লর্ডসের ব‍্যালকনিতে প্রুভেনশিয়াল কাপের ছবি অমলীন।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২