আমার ভাষায় তোমার ভাষা খুঁজি – বিকাশ নায়ক
একুশে ফেব্রুয়ারি। যারা জানেন তাদের কাছে একটি আবেগঘন উচ্চারণ। যারা জানেন না তাদের কাছে আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা কিছু না। আর আমরা যারা জানি, বিশেষ করে আমরা যারা বাঙালি, তাদের কাছে এই আবেগঘন উচ্চারণের যে একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে তা অনস্বীকার্য।
পৃথিবীতে যতগুলি রাষ্ট্রীয় ভাষা আছে তাদের মধ্যে অনন্যতম ভাষা ‘বাংলা’। এবং তা অনন্যতম হয়ে ওঠারও একমাত্র কারণ এই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। আর বাংলাই একমাত্র ভাষা, যাকে একটি রাষ্ট্রের প্রধান ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য চারজন ভাষাপ্রেমীকে শহিদ হতে হয়েছিল। শহিদ হতে হয়েছিল সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার’কে। এই একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে। আর সেই আন্দোলনকে ও ভাষাশহিদদের সম্মান জানানোর উদ্দ্যেশ্যে এই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যা একজন বাঙালি হিসেবে আমাদের অত্যন্ত গর্ব ও শ্লাঘার বিষয়। একথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিতে বাধ্য। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। এই ঐতিহাসিক গুরুত্বকে মাথায় রেখেই, আমি আমার আলোচ্য বিষয়কে শুধুমাত্র ইতিহাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছি না।
কারণ, আমার ব্যক্তিগত মতামত অনুযায়ী ইতিহাসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র আলাদা একটি অবস্থান রয়েছে এই মুহূর্তে। আলোচ্য বিষয়টির মধ্যে যেতে যেতে আমার কেবলই মনে হচ্ছে, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শুধুমাত্র একটি দিন নয়। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি একটি ভাবনা।
মাথায় রাখতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একই কথা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করলাম। কারণ এর মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক বিস্তার রয়েছে। একুশে ফেরুয়ারি যতই বাংলা ভাষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অভিজাত হয়ে উঠুক না কেন, সে এখন পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন যতবারই আসে তত বারই জানিয়ে দিয়ে যায় যে সে সমস্ত ভাষার জন্য আন্দোলন। সমস্ত ভাষার সম্মানের জন্যই তার জন্ম।
‘ভাষা’ শুধুমাত্র উচ্চারিত কিছু শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ভাষা মানে বাংলা বা হিন্দি বা ইংরেজি নয়। মনে রাখতে হবে, ভাষা একটি মাধ্যম। মনে ভাব প্রকাশের মাধ্যম। তা একজন মূক ও বধিরের ইশারা হোক কিংবা একজন চিত্রশিল্পীর ছবির চিৎকৃত ধ্বনি। যে শুনতে পায় একমাত্র সেই পায়। আর যে শুনতে পায় বা বলতে পারে ইশারা কিংবা ছবির মাধ্যমে অথবা অন্য যেকোনও মাধ্যমে, সেটাই তার ভাষা। তা সে যেকোনও প্রান্ত বা প্রদেশেরই হোক না কেন। আসলে ভাষার কোনও প্রদেশ হয় না। ভাষা শুধু প্রকাশ-ভঙ্গিমাত্র। আর কিছু না।
তাই আমার কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি একটি ভাবনা। কারণ একুশে ফেব্রুয়ারি মানে, শুধুমাত্র মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের আড়ম্বর নয়। শহিদ-বেদীতে মাল্যদান আর স্মরণ-সভায় দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ বা বক্তৃতা দিয়ে, আমি বাঙালি, খাঁটি বাঙালি করে জাহির করা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে ‘বাংলা ভাষা শেষ হয়ে গেল, গেল গেল সব গেল’ করে হা-হুতাশ করা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে সমস্ত ভাষাকে, মনের ভাব প্রকাশের সমস্ত মাধ্যমকে সম্মান জানানো। এটাই এর প্রাথমিক ও প্রধান শর্ত বলেই আমার মনে হয়।
আমরা দেখেছি, বাংলা ভাষাপ্রেমীরা এখন প্রায়শই হতাশায় ভোগেন। বিশেষ করে শহর বা আধাশহরের শিক্ষিত ভাষাপ্রেমীদের কপালের ভাঁজ যেন কমতেই চায় না। মাথার মধ্যে একটি সুন্দর শব্দ বাসা বেঁধে বসে আছে। সেটি হল ‘আগ্রাসন’। বাংলা ভাষাকে ইংরেজি হিন্দি সহ বিভিন্ন ভাষার শব্দেরা তিলে তিলে গ্রাস করতে শুরু করেছে। অতএব বাংলা ভাষা আর বেশিদিন নয়। আরও অনেক ভাষার মতো বাংলাও একদিন শেষ হয়ে যাবে। বাংলার জায়গায় ইংরেজি হিন্দিরা আদিপত্য লাভ করবে। তখন সাহিত্য-শিল্পেরও অবলুপ্তি কেউ আটকাতে পারবে না। কথাটা যদিও সম্পুর্ণ ফেলে দেবার নয়, তবু মনে রাখতে হবে এই আগ্রাসন কেবলমাত্র শহরকেন্দ্রিক। সুবিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে এর বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই। যেখানে গ্রামাঞ্চলের পরিমাণই অধিক আকার ধারণ করে রয়েছে।
একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, এবং তা অত্যন্ত গভীর ভাবনার বিষয়, তা হল ‘সংস্কৃত’ ভাষার কেন অবলুপ্তি ঘটল ! কারণ সংস্কৃত নিজের গণ্ডীর বাইরে কোনও দিন বেরোতে পারেনি। বা অন্য কোনও ভাষাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে পারেনি। যেহেতু ‘সংস্কৃত’র প্রকৃতি এমনই যে এর বাইরে বেরোনো তার পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব ছিল না। অন্য কোনও ভাষাকে নিজের মধ্যে স্থাপন করে সেটাকে নিজের মতো করে তোলার ক্ষমতাই ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে সে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলল এবং বিলুপ্ত প্রায় হয়ে গেল। পূজোর মন্ত্রোচ্চারণের ঘেরাটোপেই ঘুরপাক খেতে লাগল। যার অন্য কোনও ব্যবহারিক গুরুত্বই রইল না।
অথচ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলে বাংলা ভাষা অনেক বেশি মুক্ত। স্বাধীন ভাষা। বাংলা বাঙালির শুধুমাত্র মুখের ভাষা নয়। বাংলা বুকের ভাষা। সুখের ভাষা। বাংলা প্রথম থেকেই কোনও বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। সে যেমন অন্যের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করতে পারে তেমনই অন্য ভাষাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে তাকে নিজের মতো করে নিতে জানে। যে মানুষ অন্যকে নিজের মনে জায়গা দিতে সক্ষম একমাত্র সেই মানুষই অন্যের মধ্যে জায়গা করে নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম। এ কথা চিরাচরিত সত্য। ভাষার ক্ষেত্রেও এই ভাবনা সমানভাবে প্রযোজ্য। বাংলা ভাষার মধ্যে এখন অনেক ইংরেজি বা হিন্দি-উর্দু-ফারসি সহ নানান শব্দ জায়গা করে নিয়ে নিজেরাই কখন যেন বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। যার সঠিক বাংলাই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় বা ব্যবহৃত হয়ই না আর। আমরা হয়তো অনেক শব্দকে বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা হিসেবে চিনিই না। বাংলা বলেই জানি। পরকে আপন করার মন্ত্রই যেন শিখে নিয়েছে সে। অথচ বাংলা সংস্কৃতরই সন্তান।
প্রথমেই বলেছি, ভাষা হল একটি মাধ্যম। মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। তা সে ইশারা হোক বা ছবির সুরেলা ধ্বনি কিংবা চিৎকারও হতে পারে। তাই বলে এই নয় যে বাংলার মধ্যে শুধুমাত্র অন্য ভাষার শব্দই নিজের জোরে বাংলা হয়ে উঠুক। তাহলে তো তা আর বাংলাই থাকে না। প্রত্যেক প্রদেশ বা রাষ্ট্রেরই মাটির একটা নিজস্ব ভাষা থাকে। আর তা তখনই লুপ্ত হয়ে যায় যখন সে নিজের গণ্ডী থেকে বেরোতে পারে না বা অন্যকে নিজের সীমানায় প্রবেশের অনুমতি দেয় না।
বাংলা সেখানে একটি ব্যতিক্রম ভাষা। যে অন্যভাষাকে যেমন গ্রহণ করতে সক্ষম তেমনই নিজের মধ্যে আবদ্ধ বাতাসকে বের করে দেবার জানালা খুলে দিতেও সক্ষম। তার কাছে একটি ভাবনাই মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয় —
একটি কথা জানাই সোজাসুজি
আমার ভাষায় তোমার ভাষা খুঁজি।
আর প্রত্যেকবার এই একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষার কাছে এমনটাই দাবি করে। শহিদবেদী শুধু একটা কথাই মনে করিয়ে দেয়, অন্য ভাষাকে সম্মান জানিয়ে নিজের ভাষার সম্মান বাঁচাতে পারলেই সেই ভাষা চিরদিন প্রাণবন্ত থাকে। নইলে তাকে ইতিহাস হয়ে যেতে হয়। যেখানে তার তেমন কোনও ঐতিহাসিক গুরুত্বই আর থাকে বলে মনে হয় না।