তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা – জাদুচৈতন্য
১
জাদুচৈতন্যের তলায় জিভ জৈবশলাকার মতো কাঁপে—
এই তির্যক বিদ্যা আয়ত্ত হল। স্থাণু পথ এমন কঙ্কাল হয়ে
শুয়ে আছে সহজ ভঙ্গিমায়, আমাদের গমন আজও
সহজ মনে হয়। মনে হয় দুই ন্যুব্জ ছুরি পরস্পর কাটাকাটি
পেরিয়ে আমাদের প্রসব করে থেমে গেছে, এবার আমরা
পরবর্তী ছেদক হিসাবে পথ কাটতে কাটতে এগোব।
জাদুচৈতন্যের তলায় কিছুই রৈখিক নয়, যেন বৃত্তের কন্দরে
ভক্তিযোগ জিভ জৈবশলাকার মতো দিক থেকে দিকে
ঘুরে যায়। ঘুরে যায় দুরূহ ইশারার দিকে, আমি সারল্যে
পরম পেয়ে থেমে গেছি। কিন্তুএই থামা বোধি নয়,আয়ু নয়।
পাখি ও উড্ডয়ন যতকাল বিপরীত না হবে, আমাদের
যাত্রাগুলি ততকাল উর্বর হবে না।
২
তুমি মা না দৈত্যের দুহিতা, এই চিন্তায় মাথা ডুবে যায়।
অতিরিক্ত শিশুকাল হল, মৌন সময় হল, চিৎকারের চেয়েও
অধিক কম্পাঙ্কে স্তব্ধ থাকতে শিখেছি একা একা।
তুমি মা না দৈত্য দুহিতা, এই চিন্তা স্নানের ভিতরে
দেহে বর্শার মতো বিঁধছে… যাই হও, যাই হও, যেটুকু নির্মাণ
আমি রেখে যাচ্ছি আমাদের বস্তির জ্যোৎস্নায়,তার শামুকগতি
তোমার কৃষ্ণযোনির দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসবে, মা,মা
ডাকতে ডাকতে জরায়ু অবধি তার রসময় সরণ তুমি টের পাবে
বৃদ্ধদশায়; তুমি দৈত্যের দুহিতা হলে নির্মাণের মাথা কেটে
খেয়ো যা পাবে—অস্তিত্ববিধি,জপ,কুরবানীর উট, পাথর—
সর্বস্ব ও কিছু-না।তবুও সামান্য কিছুমাতৃচিহ্ন প্রকট হলে
একা স্তনমর্দনে আমাদের রক্ত দাও।যত হাঁ-মুখ প্রসব করেছ,
সবাই তোমার সামনে আশার পাঁজর নিয়ে ব’সে…
৩
অতঃপরঘুম কেননাযা খেলা হওয়ারছিল,তা গত।
যা সৎকারেরউপচার ছিল,তা ক্রমশ লোপ পেতে পেতে
কপিশ ঝরনার মতো মৃত্যুপথগামী।আমরা সায়ংকাল থেকে
বাঁচা আরম্ভ করেছি, ভোরঅবধি জরা থাকবে না।বিগ্রহ ধারণা
ক’রে শত্রুশ্রীচরণকমলে সন্তানের কাটা মাথা নামিয়ে রেখেছি,
এই উৎসর্গে অমরাবতীঅবধি একটি শিরশিরে অসুখ ছুটে গেল।
যা ভক্তি,তা ভয়ের প্রতিবিম্ব।জেনেছি এমন সত্য,এখন
ঘুমের ভিতর এষণা থমথম করে, যা খুঁজছি তা সন্ধানের অতীত,
এ তো পরিবর্তিতহওয়ার নয়।শুধুঘুমের দুয়ার আর ঠেলা যায় না
ব’লে,আমাদের নিদ্রাগুলি ফলপ্রসূহবে নাকখনও।
৪
আর কোনো অর্থ নেই;অর্থের সীমানা এত ব্যথা দেয়!
যা লেখা হয়েছে বা হবে,জাদুচৈতন্যের অন্দরে তার ধোঁয়ায়
শুধুসঙ্গীতজ্যান্ত থাকতে পারে।বাকি যা সমালোচনা, কিংবা
নিন্দার নির্মোক তুলে সখ্যের আকুতি,তা আজ কৃত্রিম লাগে,
আকর্ষণীয়লাগে।এই ভ্রম অধিকের উপহার নয়,স্বল্প উন্মাদ
এনে তাদের হাতের ত্বকে অর্থের আগামী রেখে দেখি কোনো
দ্যুতি জাগে কি না।আর কোনোঅর্থনেই, নিকট নৌকার মতো
আশ্রয়ের শিশ্ন তুলে ডেকে নেওয়াসোহাগে সোহাগে।
এ-ই কি সঙ্গমস্পৃহা?এ-ই কি ধ্যানের তন্তু?
যেটুকু ধী,নিয়তিতাড়িত,তার ধ্যান নিগূঢ় তৎসম।
প্রাচীনে আশ্বাস জ্যান্ত রাখি,তাই আজনতুন সহজে নেওয়াযায়।
এর কোনো অর্থ নেই,থাকাও আবশ্যক কিছুনয়।
৫
অভিসন্ধি এমন শত্রু করো,যেন প্রেমের অন্তিম শুধু
তারই হাতে জাগরূক থাকে।মা কিংবা দৈত্যের দুহিতা,এই
অবান্তর সন্দেহের ভেতর শুধুসন্ত্রাসের গাছপালাদেখি।
সুতরাংভুল ছিল।যা কিছুঠিকের মতো মনে হয়,তাইভ্রম—
এমন আপ্তবাক্যে আরওকালো সর্বনাশ হয়।জৈবশলাকার মতো
জিভ নড়ে।যেন মুহূর্তেইতেতো সত্যি ঠিকরেএসে কোপ ভাঙবে
অণ্ডের তলায়।এ অণ্ড কার?মা না দৈত্যদুহিতার?
কিছুইআলাদা নয়।রন্ধনে মাংসের ধৈবত শুনে
জলজীবনের কথা মনে পড়ে।মনে পড়ে লঘু ধ্বংস আমাদেরনয়।
আমাদেরখেলাগুলি সংজ্ঞাহীন,পাঠকের গুহা থেকে সন্তাপে
দূরত্ব বজায় রাখে।আত্মীয়তাশত্রুর জরায়ু।অভিসন্ধি আপাতত
যেখানে যা স্নায়ু আছে টান ও মৃত্তিকা বরাবর,সব কেটে
শূন্য হওয়া।তারপর মুখ স্থির করা।আপাতত এই সত্যে
স্থির হয়ে আছি—কথার জন্তুর মুখে
আর খাদ্য হব নাকখনও।
৬
জাদুচৈতন্যের ওপর সমস্তই জঙ্গম।সময়ের বশবর্তী নয়।
ফলত পরিমাপের অযোগ্য যা কিছু,সমস্তই উচ্চকোটির
অস্তিত্ব হয়ে প্রতিবেশী;নির্মোহ কালের পিঠে তাদের নরম
চলাচল আমাদের স্বচক্ষে দেখার জন্যনয়।চোখ বন্ধহলে
হয়তো যদি-বা সামান্যও দৃশ্যমান হয়,সমস্ত হয় না।
জাদুচৈতন্যের নীচে শলাকা জৈব না অজৈব নাকি মধ্যবর্তী
সমঝোতায় নিজ প্রমা স্থাপন করেছে,আমরা জানি না।
জানি নাযা আয়ুধ ভেবে চৈতন্য বরাবর নিক্ষেপ করি
শিকার বধের আশায়,আদপে তা হত্যা চায়,নাকি ফুল ও ফুলের
করোটি নিয়ে নামতে চায় মাংসেরদুয়ারে।
জাদুচৈতন্যের নীচে মহান হওয়ার লক্ষ্যেকাদের বিকার নড়ে আজ?
ন্যুব্জ ছুরি দুই হল,চার হল,এইভাবে বেড়ে বেড়ে বড় বেশি
পিতা মাতা হল।ওদের রমণ হবে।রক্ত হবে।শুক্র হবে।
আমরা হব অতঃপর।আবার পাখি ও উড্ডয়নের সহবাস আমাদের
সহ্য হবে না।যাত্রাপথ এমনই জটিল,তবুও সহজ ভেবে
হেঁটেহেঁটেআসছি জঙ্গলে।
এভাবে মরণ হলে,আর যেন শাপ না জেগে থাকে!
অসাধারণ লেখা! যেন এই কবির জন্য অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন, গোপনে গোপনে।
শ্রদ্ধা জানাই। ভালো থাকবেন 😊