অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়ের গুচ্ছ কবিতা
লাল চাঁদ অথবা লাল পৃথিবীর কবিতা
১.
কোনো এক ভোরে
আমাকে গাছের নীচে পুঁতে ফেলো, হে সমাজ।
তার উপর ছড়িয়ে দাও তারকাখচিত কিছু গান
যে গান মুখে নিয়ে কুলি বস্তি নেমে আসবে পথে
যুবকেরা পৌঁছে যাবে অলাতচক্রে ঘেরা রাজসভায়
খিদের মুখে দাঁড়িয়েও কাস্তে হেসে উঠবে শনশন করে
সেই গান, হে সমাজ, সেই গান
তোমাকে উপহার দেব বলে জন্ম থেকে এতদূর এলাম।
আমার বাবার হাত লাল, আমার মায়ের হাত লাল
আমি লাল হয়ে যাওয়া অশ্বত্থ গাছের নীচে শুয়ে আছি
এসো, আমাকে পুঁতে ফেলো
শুধু একটি মুঠো করা হাত যেন মাটির উপরে থাকে
সেখান থেকে প্রতিদিন, হে সমাজ, তোমার নাভিতে
আরও একটি হাতের জন্ম হবে
২.
জন্মের সময় আমার রং ছিল লাল।
শোনা যায় জন্মের সময় যে লাল থাকে বড়ো হলে
সে কালো হয়ে যায়।
আমার গায়ের রং এখন মিশকালো।
দাঁত কালো, মুখ কালো, চোখ কালো
আমাকে নিখাদ করার তাগিদে
পাথরে ঘষে ঘষে চামড়া তুলে ফেলার পর
আমার শরীর থেকে লাল রক্ত বেরিয়ে এলো।
মুখের ভেতর নুন ঠেসে দেওয়ার পর
বেরিয়ে এলো লাল জিভ।
আমি চিৎকার করলাম কুকুরের মতো
আর একদলা লাল আগুন গলা থেকে লাফ দিয়ে
সমস্ত ধর্মগ্রন্থের মাঝে পড়ে লাট খেতে লাগল
আমাকে চাবকাও হাড়ের চাবুক দিয়ে
চাবকাতে চাবকাতে লাল করে ফেলো
জন্ম ফিরিয়ে দাও
৩.
কোথাও যাবো না বলে চাঁদের রাস্তা পরিত্যাগ করেছি
তবু আমাকে সেই এনে ফেললে লাল শিকারের মাঝখানে
এবার আমার গা থেকে লাল রংয়ের গন্ধ উঠবে
যারা এতদিন সন্দেহ করত, নিশ্চিত হয়ে যাবে
আমি একজন নিরস্ত্র ব্যাধ
আমাকে খোঁচাবে
আমার ফাঁকা তূণের ভেতর সাপ ঢুকিয়ে ছেড়ে দেবে
আমার পরনে শুধু একটি পতাকা
কোথাও যাব না বলে পৃথিবীর পাড়ায় পাড়ায়
সমস্ত চাঁদ আমি লাল করে দেব
৪.
যে কোনো দোকানে গেলে আমি লাল খাতাটির
দিকে লক্ষ করি।
শোনা যায় কমরেড লেনিনের একটি লাল ডাইরি ছিল,
সেখানে লেখা থাকত ২০৫১ সালে বিপ্লব
কীভাবে হবে।
শোনা যায় কমরেড চে’র একটি প্রিয় লাল রুমালের কথা,
প্রতিবার আক্রমণের সময় সেটি দুলিয়ে শত্রুপক্ষকে ক্ষ্যাপাতেন।
কমরেড কাস্ত্রো কিংবা কমরেড সাভেজের কোনো
লাল টি-পট ছিল কিনা জানা যায়নি।
আমাকে ক্ষমা করবেন জনগণ
প্রতিটি দোকানে আমি টুপির ভেতর থেকে
লাল পায়রা বের করি না
যতক্ষণ না দেখি লাল খাতাটির ফাঁক থেকে
শ্রমিকের ঘাম-রক্ত-অশ্রু উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে
৫.
একটি ধানের মাথায় আমি ঝুলে আছি
আমাকে পাহারা দিচ্ছে যত কৃষকের ছায়া
কে যে কোন্ অন্ধকার ছিঁড়ে দিয়ে শেষে
আমার নরম হাতে তুলে দেবে আগুন শলাকা
আমি দেখি মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে সূর্যের সন্তান
ধানের সমস্ত স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়াই যার কাজ
লাল নদীটির থেকে জল এল কুসুমের মতো
আমি তাকে পান করে নেমে আসি ছায়াদের মাঝে
আমাকে খতম করো, আমার শরীরে ঢালো ক্ষতি
সমস্ত সেলাম তবু অকপটে ঝুঁকে পড়বে
খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি
[ ছবি: কানডিনস্কি, Wikimedia Commons ]