ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ১২)

শেয়ার করুন

দ্বাদশ পর্ব

৩৪.

পরমা দীর্ঘাঙ্গী। রুগ্ন। এলোচুল প্রায়ই। রামচকের সংসার যে কয়টি সূত্র মেনে চলে, তার মধ্যে প্রধান বহমানতা। সূত্রের পর সূত্র ধরে অগোছালো এগিয়ে চলাই তাদের রীতি। কিংবা অরীতিও। তাদের কাছে প্রমাণ বলে কিছু নেই। সিদ্ধান্ত তাদের কোনোদিন ছুঁতে পারে না। মনকে প্রশ্রয় দিয়ে স্রোত আর স্রোত মেখে মেখে ভাসাই তাদের ইচ্ছা। মোহনা তাদের কাঙ্ক্ষিত নয়। পরমা এখনও অবিবাহিতা, কারো কারো সঙ্গে মিশেও সে কুমারী। রামচক জানে তা। এই সকালে বাবা-মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে বেলগাছের তলায় আবেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কত কত আলোক রশ্মি এই সকালে নিজেদের উজাড় করেছে আরও একটা মানসিক সঙ্গমের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য। শুকনো বেলপাতা ঝরে পড়ছে গায়ে মাথায়। পরমা এখন নিশ্চিত ভাবে বলাইয়ের অপেক্ষা করছে না। একটা সুন্দর সকাল যেমনভাবে শুরু হয় কিংবা হওয়া উচিত, তেমনভাবেই শুরু হয়েছে তার কাছে।

আজ শুধু ওই ঘা সর্বস্ব লোকটাকে নিয়ে একটা দুর্বল উৎসাহ ছাড়া বলাই অন্য দিনের মতোই বেশ প্রফুল্ল। এক চোখ দূর থেকে পরমাকে চোখে পড়ে তার। পরমা তখনও লক্ষ করেনি বলাইকে। এই দুই দেখা না-দেখার মাঝে সারা রামচক জুড়ে একটা সবুজ দ্বীপ জেগে ওঠে নিমেষে। পাখিদের কলতান আর সদ্য মৃত আত্মারা সমস্বরে গান গেয়ে উঠবে। পরমার চোখ পড়ে বলাইয়ের উপর।

চোখে চোখ
হাতে হাত
আর এক জোড়া নরম প্রসারিত বুক।

সবুজ নির্জন দ্বীপে একটা ভ্রূণ ক্রমশ পরিণত হয়ে ভ্রূণ-খেলা খেলছে।

আবেশের চরমে কেঁপে কেঁপে উঠছে পরমা বলাই। কোন্ এক অদৃশ্য তরল অতীত তাদের মাঝে চিটে যাওয়া স্বপ্ন হয়ে সুখেল সময় মেলে ধরছে।

—আমরা এইভাবে আরও কয়েকটা সময় থাকি, চারাগাছ মাটি পাওয়া অব্দি…

পরমার সুখ-সৌখিন সুর বেলগাছের কাঁটাগুলো ভোঁতা বানিয়ে দিল নিমেষে। অজস্র কাঠ পিঁপড়ে অদৃশ্য শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে গাছের মগডালে উঠে যাচ্ছে। একদম শেষ চূড়ায় গিয়ে পৌঁছে চারিদিক যখন শূন্য মনে হয় আর লক্ষ পূরণ হয়েছে জেনে আনন্দের তান তুলে নেমে আসে ঝাঁক ঝাঁক।

বলাই আরো জোরে চেপে ধরে পরমাকে। তারপর আলগা বুকে চোখে চোখ রাখে।

মৃদু নির্মল হাসি হেসে সে জানায়—

‘রামচকের এই বেলগাছ আর পিঁপড়েগুলোও কোনো তালিম ছাড়াই নিজের মনে-বোধে রামচক হয়ে গেছে।’

একটা দক্ষিণা বাতাস তার সারা শরীরে কুঁরগির শীতল গভীর স্রোত নিয়ে পরমাকে তৃপ্তি দিয়ে গেল।

৩৫.

মালিনী এখন নিজে চাকে বসে। বেলা ওঠে। বেলা বাড়ে। ধূসর বিকেল একলা মনে একটা স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে লুকিয়ে যায় সন্ধ্যার কোলে। রাতভোর ঘুম। স্বপ্নহীন ঘুম। ঘোর ঘুমের রাত কাটে কাজ আর সংসারের তাগাদায়। ভোর আসে আবার সেই চাকায় করে। পঞ্চু চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর পর্যন্ত, মেঘ বাতাস আর তারা প্রত্যেককে দেখে কিংবা অনুভব করে ভেবেছে, পঞ্চুর ঠিকানা থেকে পাঠানো কোনো সুখী সওগাত! তারপর ওই তারা মেঘ বাতাস শিখেছে কীভাবে দুরন্ত হতে হয় স্মৃতি জড়িয়ে!

উতলা হওয়ার সবটুকু পাঠ তারা পেয়েছে মালিনীর চোখ থেকে।

কয়েকদিনের চাক বাঁধা মেঘ আর বাতাসহীন গুমোট মালিনীকে বিরোধী সুরের ওঠানামার মতন ফিকে অথচ উজ্জ্বল করে তুলেছে।

সেই দিনটার কথা মালিনীর মন আর শরীরে সবসময় ঝড় তোলে। সংসারে থাকার কিংবা সংসার করার যে টান এখন মালিনী অনুভব করে, সেই টান ওই দিনটার পিছু পিছু এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা হয়ে চলছে।

কাদা রাস্তা থেকে সমতল জমিতে নেমে যাওয়ার ঢালটা সবুজ কাঁচা ঘাস দিয়ে ঢাকা। এই পথ আর ঢাল বেয়ে প্রতি হাটবারে মালিনী যায় হাটে। মাথায় খড়ের শক্ত বাঁধুনি দিয়ে তৈরি বিঁড়া। বিঁড়ার উপর মোটা সুতো দিয়ে বানানো জালের ঝাঁকা। ঝাঁকা ভর্তি মাটির বাসন। কয়েকটা হাঁড়ি উপচে পড়ছে ঝাঁকা থেকে। রাস্তার ঢাল বেয়ে নামার সময় বলাইয়ের সঙ্গে চোখাচোখি।

নিমেষে সেই দিন সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ে যায় মালিনীর।

পরমার পিঠ আর চুলে বলাইয়ের স্পর্শ…
ভিজে কাপড়ে একলা মালিনী

শূন্য খামার আর বুজে যাওয়া উনুন ছাড়া মালিনীকে ঘেরে রাখার মতন কিছুই ছিল না সেদিন। বলাইয়ের দিকে একটা অভিযোগের সুর ছুঁড়ে দিয়ে একটা শালিক কাদা খুঁড়ছিল তার নখর পা দিয়ে…

তারপর কতদিন কেটে গেছে। মনের কোথাও পঞ্চুর যাতায়াত নেই। অবিরাম মালিনী অপেক্ষা করে গেছে দু’ জোড়া পায়ের ছন্দ মেলানো শব্দ শোনার জন্য।

দু’ হাত তুলে ঝাঁকা ধরে থাকা মালিনী এখন সর্বস্ব দেওয়ার পণ করে বসে আছে। বাহুমূল থেকে নেমে আসা প্রতিটি রোমকূপ এখন বলাইয়ের স্পর্শ চায়।

একটা ভোরের আলো যেন এই জন্যেই অপেক্ষা করছিল। দ্রুত পায়ে হাটুরে চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে। বলাই এগিয়ে এসে ধরে মালিনীকে।

একটার পর একটা হাঁড়ি গলা তুলে তুলে বেরিয়ে আসছে ঝাঁকা ছেড়ে।

নিঃশব্দে কাদার ওপর গড়িয়ে নিজেদের আকার ভেঙে নিচ্ছে।

মালিনীর তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি সহজাত ভঙ্গিতে বলাইয়ের গলা আর সারা গায়ে প্যাঁচ খাচ্ছে।

হাঁড়ির পেট থেকে যেন এখুনি একটা সুদৃশ মুখ বেরিয়ে এসে তাকে পূর্ণতা দেবে।

৩৬.

নির্জনতাকে সাক্ষ্য রেখে কবি প্রতি শেষ বেলায় তার দৃষ্টি প্রসারিত করে। একটু একটু করে তলে তলে পালটে যাওয়া রামচকের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ তাকে ভাবনার কুয়াশা ছাড়িয়ে ভাবতে বাধ্য করে। ঘোড়ামাঠের ঝাউ সারি আর বকুল গাছে রাশি রাশি জোনাকি এখনও মিটমিট করছে দেখে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে সে।

চোখের সামনে একটা কালো পর্দা ভেসে ওঠে। কোনো এক আনমনা হাত পর্দার ওপার থেকে উঁকি দিচ্ছে।

—কালো কাপড়ে ঢাকা এক ছায়ামূর্তি কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

কবি আন্দাজ করে নিতে পারছে, তার অঙ্গের যথাযথ অবস্থান। সেই মূর্তি তার দুর্বল ক্ষীণ বিবর্ণ হাতদুটো জোড় করে কবিকে যেন কী বোঝাতে চাইছে।

কী বলতে চায় সে!

কত অচেনা মুখ ভিড় করছে সেই মূর্তির আশেপাশে। তাদের প্রতিনিধি হয়ে তার এমন আকুতি কবিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে।

কিছুক্ষণ থেকেই কবির এমন অবুঝ দৃষ্টি আর নীরব প্রতিক্রিয়ায় ছায়ামূর্তি বোধহয় এবার একটু ক্ষুণ্ণ আর অধৈর্য হয়ে পড়ল।

—একটা শুয়োর আনাড়ি রূপ নিয়ে কাদায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। একটা নিরপরাধ গোলাপের ছড়িয়ে থাকা পাপড়ি ফোঁটা ফোঁটা কাদার বৃষ্টিতে দুলে দুলে উঠছে।

অচেনা মুখের মানুষগুলো হেসে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। তাদের মুখে চোখে একটা স্বস্তির রেখা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

ওই ভেসে ওঠা ছবিটা মিলিয়ে গেছে কখন! তবু তার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ঘরে ফেরে কবি। এমন কত স্বপ্ন আর ভাবনার ছবি এখন প্রতি মুহূর্তে তাকে সঙ্গী করে! তারপরের সময়টা কাটে ওই ছবির ওপর হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার দিতে দিতে।

এখন এই কদিন চপলার দেহে কবির মন নেই। অনেক নারীমূর্তি একটাই রূপে তার কাছে ধরা দিচ্ছে। সেই রূপ ধরে তামচক যেমন আসে, তেমনি আসে কুঁরগির ওপারের পৃথিবীও। ঘোঁত ডাকা শুয়োরের পাশাপাশি কাঁচা পুষ্ট গোলাপ কিংবা রাজহাঁসের শরীরের পাশে দাঁড়ানো দেহ লুকোতে চাওয়া প্রসাধিত একটি রমণী—সব সত্যি।

একটা যন্ত্রণা আর আকুতি ফাঁদের মতন তাকে একা করে রেখেছে। এই যন্ত্রণাই যে আসল তা এখন বেশ বুঝতে পারছে কবি। এতদিন সুখের ফাঁকি কিংবা ফাঁকির সুখ জীবনে একটা কোনো অঘটন ঘটার দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকত। আর এই মিলে যাওয়া জীবন তাকে অন্তত নিজেকে একটা চরম বিপন্ন সময়ের মুখোমুখি করেছে। যেখান থেকে শুধু উন্নতিই করা যায়। যেখান থেকে ফাঁকি বা মেকির কোনো ছবি ফুটে ওঠে না।

রামচক আর রামচকের ধারণা তার কাছে দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে।

আজ সূর্য উঠেছে আপন তেজে। কমলা রঙের অমায়িক একটা মুখ—ভাবলে শুধু রামচক নাহলে রামচকের বাইরেও নিশ্চিত এমনভাবেই আলো আর সুখ ছড়াচ্ছে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে কবির। তন্দ্রা চিটে আছে এমন অবস্থায় সে সটান চলেছে কুঁরগির তীর ধরে রামচকের অলিখিত শেষ সীমানায়। এদিকটায় বড়ো একটা কেউ আসে না। রামচকবাসী একটা নির্দিষ্ট নিয়মমাফিক কুঁরগির যে জায়গায় ঘোরে, সেখানে পায়ের হাতের দাগ স্পষ্ট। তাদের লেপ্টে যাওয়া পায়রা পোষা সুখী মনের মতন লতাগুলো লতিয়ে আছে পাড় ধরে।

চপলাকে সঙ্গে নিয়ে এলে নিজের আবেশ আর ভাবনার সাথে অন্তরঙ্গ হতে পারত না কবি। কাল রাতে ঘুম খুব ভালো হয়নি। একটা সুখের সন্ধান পেতে চলেছে সে। যা কিছু সীমানা আর অসীমের পারে পারে ঘোঁত খাচ্ছে কিংবা সাজানো আছে মনের কোণে, সেই সবকিছু খারাপ ভালো সুখ দুঃখ কবি স্মিত হাসিতে বিলিয়ে দেয়। এখন চোখের সামনে কুঁরগি এই জায়গায় শীর্ণ আর রুগ্ন। পাড়ের লতা আর ছোটো ছোটো গাছ ঝুঁকে পড়ে নদীটার আরেক রূপ জানান দিচ্ছে, যা রামচকের পক্ষে সহ্যের অতীত। এপাশে রাজহাঁসগুলো আসে না জড়িয়ে পড়ার ভয়ে। যে কোমল ভাস্করী ঢেউ মোহিত করে অতীত আর ভবিষ্যতকে, সেই ঢেউ আর রং এখানে অসুখী। কিন্তু এই রঙের মাঝেও তলে তলে নদীটার জল বয়ে চলেছে আপন বেগে মোহনার দিকে। একটা পাখি, অজানা নামের, এখুনি জলের পিঠে ছোঁ দিয়ে উড়ে গেল আবার কোন্ এক অসীমের উদ্দেশে। হয়তো কত সীমানা আর মানুষজন পেরিয়ে রক্ত ক্লেদ ঘাম সখ সৌখিন চাদরে গড়াগড়ি দিয়ে ও নিজেকে তবু জীবনের উপযোগী করে তুলেছে!

—দুঃখই যে আসল। পরিস্থিতিই আসলে গড়ে তোলার গড়ে ওঠার বীজ।

চঞ্চল চপলা গুমোট বসে আছে কবির দালানে। পাশে কবির শরীর। ছায়াটাই যেখানে আসল।

দিনের এমন মধ্যভাগে চরাচরের আলো এত তীব্র হয় যে অন্ধকারের অস্তিত্বকে মিথ্যে বলে মনে হয়। আলোর একটা আভা দালানে কবির অস্পষ্ট ছায়াকে দুর্বোধ্য করে তুলেছে। চপলা সেই ছায়ায় চোখ দিয়ে স্থির। অন্য কিছু বেসুরো গাইছে তার মন। এই কদিন সে যা ভাবছে, এখন যা ভাবছে, তার মূল সুর ঘুরেফিরে ঘোঁত খাচ্ছে এক কথায়

—এটাই আসল মানুষ।

একদিন গোধূলিতে সন্ধ্যাতারা আর ঘরে ফিরতে ব্যস্ত একটা কালো মুখ গিরগিটিকে মেলাতে পেরে কবির মধ্যে যে নির্লিপ্ত আনন্দ হয়েছিল, তা চপলা কোনোদিন ভুলতে পারবে না।

চপলার শরীরের দিকে তাকিয়েই থাকে যে মানুষটা, চপলা ঠিক তার মতোই হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *