ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ৭)

শেয়ার করুন

সপ্তম পর্ব

১৮.

আতর বাজার ছেড়ে আসার পর পঞ্চু ভাবনায় ভাবনায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সারা শরীরে একটা রি-রি ভাব তাকে ঝালাপালা করে তুলছে। কী কারণে এই অসহ্য বোধ, সে বুঝতে পারে না। কারণ খোঁজার চেষ্টা ক্রমে তার সমস্ত বোধকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। কিছু মুখে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে। রাত এখন বেশ গভীর। রাস্তার পিঠে আঁশের মতন ঘন ভিড় আর চাপাচাপি নেই। দিনের আলোয় সোনালি আঁশের গুঁড়ি বৃষ্টি রাজপথ ধুয়ে গেছে। রাতের আলোয় পথের পোশাক শুয়ে আছে যেন একটি কালো অভুক্ত কুকুর ছানা। ঘুম আর ক্লান্তি দুঃসহ ভার ফেলে পঞ্চুর দু’ চোখে। উবু হয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকতে থাকতে দুই হাঁটুর মাঝে তলিয়ে যায় তার মুখ। কাঁধের ঝোলাটা নেতিয়ে আছে কংক্রিটের গুঁড়ো অবহেলায় পড়ে থাকা ভিড়ের ওপর। মৃদু ঠান্ডা বাতাস তার চিন্তায় কামড় বসাচ্ছে। এখান থেকে রামচক কোন্‌দিকে, সে ঠাহর করতে পারে না। কিন্তু বেশ বুঝতে পারে যে, এই ঠান্ডা বাতাস রামচক থেকে কুঁরগি বয়েই আসছে। এরকম বাতাস যে আরও আরও বয়ে চলা দরকার, ভাসিয়ে দেওয়া দরকার, মনে মনে বেশ বুঝতে পারছে পঞ্চু। চিৎকার করে বলতে চায় সে। এই ঘণ্টা তিনেক সময়ে তার রামচক বেশি মনে পড়ছে নাকি এই নতুন জায়গাটাতে সে ক্রমে বেমানান হয়ে পড়ছে—এই দুয়ের টানাপোড়েন চলতে থাকে তার ভাবনায়। পঞ্চু ছক কষে ভাবতে জানে না। বিদ্যা-বুদ্ধি বলতে আমরা যা বুঝি, তা-ও নেই তার। ফলত কোন্ কোন্ দৃশ্য বা খণ্ড ভাবনা তাকে মাত্রাছাড়া রুগি করে তুলছে, সে বুঝতে পারে না।

স্থির জলে ভেসে আছে একটা কালো মাংসল রাজহাঁস। জলের রং ম্যাটম্যাটে হলুদ। পাড় বরাবর এক ঝাঁক লোক ভিড় করে এদিক ওদিক ছুটছে। কারো হাতে তির-ধনুক কেউ হাতে নিয়ে আছে একটা আস্ত পাথুরে ঢেলা। রাজহাঁসের অস্থির চলন তাদেরকে আরও উত্তেজিত করছে। পাশেই খোলা মাঠের সারি সারি ঝাউ গাছ থেকে সোঁ-সোঁ বাতাস যেন রাজহাঁসটাকে দিক দেখিয়ে দিচ্ছে। নির্দেশ দিচ্ছে গোপন কোনো জায়গায় আত্মগোপনের। শিকারি মুদ্রায় লোকগুলোর চোখে ভেসে উঠছে বিরক্তি আর হিংসা। একসাথে কতগুলো পাথর আর তির গেঁথে গেল রাজহাঁসের শরীরের নানা অংশে। টুকরো টুকরো পালক ছিন্ন মেঘমালার মতন জলের ওপর ভেসে যাচ্ছে বাতাসের রেশ ধরে। ঝাউয়ের বাতাস এখন রাগী অথচ অসহায়। তার দৃষ্টিতে ক্ষমা নেই ওই শিকারিদের জন্য। ঘোঁতঘোঁত পাক খাচ্ছে নিজেদের গোপন প্রকোষ্ঠে। নড়ে নড়ে ওঠা জলের রেখা বয়ে শিকারিরা জলে নামল। মাংস নিয়ে মুখে চোখে আনন্দ সেঁচে সেঁচে জল থেকে উঠে আসছে তারা।

এমনভাবে তো গাঢ় ঘুমে যাওয়া যায় না! অথচ সে একটা এমন বিশ্রী স্বপ্ন দেখে নিল! হিমেল বাতাস এই নিশ্চুপ রাতে আরও হিম। এরই মাঝে পঞ্চু ঘেমে উঠছে। রামচকে থাকতে কোনোদিন এমন স্বপ্ন সে দেখেনি। সেখানের স্বপ্নে তার আঙুল আর সারি সারি মসৃণ উজ্জ্বল মূর্তি আলো করে দাঁড়িয়ে থাকত। সারাদিনের দেহী ক্লান্তি এখন স্বপ্নের পর, তার মনকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। রাত আর কত বাকি সে জানে না। শুধু ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগে তাকে হাঁটতে হবে। অনেক পথ।

আরেকটা স্বপ্নহীন তন্দ্রা ভোরের কাছে এনে দেয় পঞ্চুকে। রাস্তার ধার ঘেঁষে চলা শুরু করে। কুকুরের চিৎকার আর আলোর স্পষ্টতা ক্রমে পঞ্চুকে বাহারি গাছগুলোর ভেতর সেঁধিয়ে দিচ্ছে। লোকজন ভোরের আলোয় নিষ্পাপ ছবির মতন হেঁটে বেড়াচ্ছে। অপরূপ এক অহিংস ছবি যেন। পঞ্চু ওদের কাছে কোনোকিছু জানতে চেয়ে ভোরটাকে বিশৃঙ্খল করতে চায় না। তার পায়ের বেগ কমে আসছে। প্রায় নিদ্রাহীন একটা ঘটনাবহুল রাত তার মস্তিষ্কের সুন্দর সুন্দর কোষগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে হয়তো।

রাস্তার ওপর মাথা উঁচু করে রাতের বেলায় দাঁড়িয়ে ছিল যে আলোগুলো, তারা এখন ক্ষীণ হতে হতে বিন্দুতে মিলিয়ে যাচ্ছে। ক্ষীণ বিন্দুর মতনই পঞ্চু এগিয়ে চলেছে। ঝোলার মধ্যে থাকা সুতোটা নির্ঘাত জড়িয়ে পাক খেয়ে গেছে, এটা ভাবতেই রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পঞ্চু ঝোলাটা পিঠ থেকে সামনে আনে। জড়িয়ে যাওয়া অবিন্যস্ত চোখ রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ঝোলার ভেতর সুতোটা খুঁজতে থাকে। পায় না। বসে পড়ে একটা পাড়ে হওয়া আকন্দ গাছের পাশে। ঝোলার ভেতর দুটো ক্ষীণ চোখ ঘুরে-ফিরে বের করে আনে জট পাকানো সুতো। হঠাৎই পঞ্চুর চোখের দৃষ্টি পালটে যায়। সেই চোখে এক মূর্তি যেন এখুনি চোখের দান পেল শিল্পীর তুলিতে। তাকে খোঁজ পেতেই হবে। মূর্তির কারিগর হয়ে সে নাম করবে। তার পূর্ব পুরুষের নাম কখনও রামচকের বাইরে আসেনি। এই যাপন নিয়ে পঞ্চু যে করেই হোক, সেই অসাধ্য সাধন করবেই।

১৯.

আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। সকাল ক্রমে বয়সি হতে থাকে। রাস্তার পাশে নল থেকে জল পড়ছে। একটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে রাত্রি জাগরণের অভাব পূরণে। সারি সারি বাস যাত্রী পেটে নিয়ে এগিয়ে চলেছে স্বপ্নের খেয়ায়। সুতো হাতে বসেই আছে পঞ্চু। নির্বিকার। যেন চেতনহীন। এলো আঁচলের এক সাদামাটা ঘরোয়া মহিলা রাস্তার পাশের নল থেকে জল নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ঘোমটা ছাড়িয়ে দেখা যায়, মাথার ভারী খোঁপা থিতিয়ে চেপ্টে আছে ঘাড়ের সঙ্গে। একটা অভিশপ্ত রাত্রি যেন নিয়তির গা ঘেঁষা থেকে নিজেকে বিরত করতে পারছে না। পঞ্চু রামচক থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে মালিনীকে তেমনভাবে মনে করেনি, করতে পারেনি। এই প্রথম ওই মহিলার রেশ ধরে মালিনী ভেসে ওঠে তার মনে। মালিনীর সঙ্গ ধরে সে একবার হেঁটে আসে তার সাধের চাকে। এখন তার নিজের অবস্থা যেমন, তেমনই দশা চাকের। ছাল ওঠা আত্মা সর্বস্ব। ফুরিয়ে আসা আয়ু যেন সাধের ছাঁচ দিয়ে আরও কয়েকটা মূর্তি গড়ে নিতে চায়।

পথ চলতে চলতে এমন একটা দোকান পঞ্চুর নজরে আসে, যার বাইরে থরে থরে সাজানো আছে সরা, মালসা, মাটির প্রদীপ। কোটরাগত চোখ হঠাৎ অপার সম্ভাবনা নিয়ে জ্বলে উঠলেও তার আভা যেমন বাইরের মানুষকে চঞ্চল করে না তেমনি পঞ্চুর চোখ দুটো অমায়িক জ্বলে ওঠে। মনে মনে একবার তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয় বৈকি। রাস্তা থেকে দোকানটায় যেতে তার পা জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা গাছ, রাস্তা কিংবা মানুষ এখন পঞ্চুকে আর পাঁচটা মানুষের সাথে আলাদা করতে পারে না। কিন্তু মনের ভেতরে পঞ্চু আসলে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কখনও বুকে হেঁটে চলছে। আবার হয়তো নখগুলো আঁচড়ে আঁচড়ে স্থির অমোঘ লক্ষ্যটাকে ছুঁতে চাইছে যেকোনো ভাবে।

—কোথায়?

—বলছি, এগুলো কোথা থেকে নিয়েছেন?

—এগুলো এখানে কোথায় তৈরি হয়?
—তুমি কোন্‌টা নেবে?
—না মানে, আমি বলছিলাম, এগুলো যে তৈরি করে এখানে দিয়ে যায়, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। একটু বলুন না…

কাল সারাদিন মেঘলা ছিল। সূর্যের সাথে পৃথিবীর মোলাকাত খুব কম সময়ের। বলতে গেলে, না হওয়ার মতনই। ভারী ভারী মেঘ থেকে দল বেঁধে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পৃথিবীর দিকে নেমে আসার সময় তাদের মধ্যে যে নির্মল আনন্দ আর ঊর্ধ্বশ্বাস আকুতি থাকে, তার সবটুকু এখন ধারণ করেছে পঞ্চু। দোকানি সওদায় ব্যস্ত। পঞ্চুর দিকে এক পলক তাকানোর ফুরসতও নেই। ব্যবসায়ী সুরে আর ভঙ্গিতে প্রথমের কতগুলো বাক্য বিনিময় হলেও এই বিনিময়ে পঞ্চু খরা মাটি হয়েই থেকে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে দোকানের ভিড় কমার অপেক্ষা করে। চোখের পাতা অনেক কষ্টে টেনে বড়ো করে সে গিলছে সরা আর মাটির যাবতীয় কারিগরি।

—তোমার কী?
—তোমার কী লাগবে?

হুঁশ ফেরে পঞ্চুর। চোখের মণি দুটোকে টেনে নিয়ে ফেলে স্থূল বপু দোকানির দিকে। সে কিছু বলতে পারে না হঠাৎ। শুধু ঘোরের বশে দোকানি আর মাটির জিনিসগুলোকে সরলরেখার দুই বিন্দু করে চোখে মায়া সাজায়। তার সকল প্রশ্ন যেন ওই চোখেই। দোকানি বিরক্ত হলে পঞ্চু বলে,
—এই জিনিসগুলো কোথা থেকে নেন আপনারা? ব’লে তার আজন্ম পরিচিত সাজানো থরের দিকে আঙুল চালায়।
—কোথা থেকে আবার! কুমোর ঘর থেকে…
—তার বাড়িটা কোথায়, একটু বলুন না…
—অনেক দূর…



—এই সামনেই একটা আছে, একটু এগিয়ে বামদিকের গলি।

২০.

সপ্তাহ খানেক কুশল মাহাতোর কাছে আছে পঞ্চু। চাকচিক্যে ভরা চওড়া পিচ রাস্তাটা থেকে সূর্য ওঠার দিকে সামান্য একটু এগিয়ে গেলেই কুশলের কুমোরখানা। সরা মালসা বানাতে বানাতে পঞ্চু হাঁটু মুড়ে প্রতিদিন একটা সবুজ স্বপ্নকে খুন করছে। সে নিরুপায়। কুশলের বয়স কম। পঞ্চুর থেকে কম। এই এলাকার নামজাদা শিল্পী হিসেবে তার নাম আছে। কপালে সমান্তরাল ভাবে গোটা চারেক ভাঁজ ভ্রু-এর সঙ্গে মিতালী খেলে। সূক্ষ্ম তুলি টানতে গিয়ে কিংবা কোনো কারণে অবাক বনে গেলে কুশলের এই ভাঁজ তাকে একটা মাটির মূর্তি করে তোলে। যারা তার দোকানে ঠাকুরের বায়না দিতে আসে, তারা কুশলের এই ভাঁজগুলোতে অবলীলায় একটা প্রিয় ঠাকুরের প্রাণ বসিয়ে নিতে পারে। চায়-ও।

পঞ্চু নিজের পরিচয় গোপন করেনি। সে মৃৎশিল্পী। তার পরিবার আছে। চাক আর মালিনী নিয়ে। সে একজন খ্যাতনামা মূর্তি কারিগর হতে চায়। কুশলের কর্মব্যস্ত কিংবা ভাবনায় ব্যস্ত শিল্পীমন প্রথমের কয়েকটা শব্দ শুনেই অন্য প্রসঙ্গে খেই হারিয়ে ফেলে। পঞ্চুর ধাম জানতে চায় না। চাইলেও একটা কিছু বানিয়ে বলার সাহস আর অভ্যেস ইতিমধ্যেই আয়ত্ত করে নিয়েছে পঞ্চু।
এই কদিনে পঞ্চুর বন্ধু হয়েছে বাজারের বিনোদ দাস। ছেঁড়া জুতো মেরামতের দোকান। চাপা রঙের নিরপরাধ মুখ। স্বাস্থ্য ভারী হয়ে সীমা ছড়িয়েছে পেটের কাছে। পান চিবানো লাল কালো দাঁতের হাসি ছড়িয়ে পঞ্চুর সঙ্গে বসে। গল্প করে। উদাস হতে হতে পঞ্চুর মনে পড়ে রামচকের নন্দবাবার কথা। বাজারের কোণে নির্জন দাঁড়িয়ে থাকা বহুবর্ষী বটগাছটার মতন পঞ্চু এখন ধীরে ধীরে দৃষ্টির অভ্যাস হয়ে উঠছে কুশলের। কুশল রাতদিন এক করে মূর্তি গড়ে পর্দা ঘেরা একান্তে। বাইরের মাটির দালানে চাক ঘুরিয়ে পঞ্চু বানায় সেই এএক সরা, মালসা, হাঁড়ি, কলসি। রামচকে থাকতে যে স্বপ্নের পেছনে সে দৌড়েছে ক্রমাগত, আজ সেই স্বপ্ন হাতের নাগালে থেকেও দুঃসহ রাত্রির যন্ত্রণা তাকে ঘুমোতেই দিচ্ছে না।

প্রতিদিন নতুন করে কথা পাড়ে পঞ্চু। কুশলের জবাব দিন দিন ক্ষীণ হতে হতে এখন নিস্তব্ধ বিন্দু হয়ে গেছে। পঞ্চু কোনোদিন মূর্তি গড়েনি নিজে হাতে। এই ক’দিন মাত্র এখানে এসে কুশলের হাতে তৈরি হয়ে যাওয়া মূর্তি দেখেছে। শুরু থেকে শেষ অব্দি একটা মূর্তি হয়ে ওঠার বর্ণপরিচয় পঞ্চুর কাছে অধরা। মূর্তি কীভাবে তৈরি হয়, তার মৌখিক জ্ঞান ছাড়া পঞ্চু কোনোদিন সরেজমিনে মূর্তি গড়ে উঠতে দেখেনি। সাহস পায় না, নিজের থেকে এমন একটা কাজ করার। রামচকে থাকতে সে লুকিয়ে চেষ্টা করলেও তেমন জোর পায়নি। রামচক ঠাকুরদের—দেবতাদের ঘর নয়। কেউ কেউ জানে বা শুনেছে শুধু, রামচকের বাইরে সবখানে নানা ঠাকুরের পুজো হয়। তারা শুনেছে, মানুষের এই বিশ্বাসের কথা-কাহিনি। বিশ্বাস করার জন্য মাটির এক মূর্তিকে দাঁড় করিয়ে নানা উপাচার সাজিয়েছে। তারা মানুষকে বিশ্বাসের থেকেও বিশ্বাস করে দেবতায় বিশ্বাস।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২