একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ২ )

একজন কমিউনিস্ট – অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী ( পর্ব ২ )

শেয়ার করুন

 

দুই

বলতে পারো। তাছাড়া একটি প্রোজেক্ট শুরু হলে অনেকদিন ধরেই চলে। কাজ চালু হল মানে মাস পাঁচ-ছয় পরে শেষ হয়ে গেল, তেমন কিন্তু নয়। এক-একটি প্রোজেক্ট তিন-চার বছর ধরে চলে। তার মানে ততদিন কাজ রইল—সোজা হিসেব। তারপর কোম্পানির বদল। ফলে কাজ ছাড়তে হলেও যে অনেক কোম্পানি পালটাতে হয়েছে কাকাকে, তা কিন্তু নয়।

তা না হয় হল। কিন্তু তুমি এখন কী করো?

একটু যেন লজ্জা পেল শুভাশিস। বলল, কাজ করি। কাকারই মতন, ঘুরে ঘুরে। তবে আমাকে বাংলার বাইরে যেতে হয়নি কখনও।

একই কাজ?

খানিকটা।

কাকার কোম্পানিতেই করো নাকি?

না।

তবে?

একটি সার্ভে কোম্পানিতে। কলকাতার।

তা কী করতে হয়?

ঘুরে ঘুরে সার্ভে করতে হয়। মানুষের কাছে যেতে হয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাদের কথা শুনতে হয়, জানতে হয়।

কীরকম? একটু বুঝিয়ে বলো দেখি। একটু নড়েচড়ে বসে ভুলাই।

তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে শুভাশিস। বলে, যেমন ধরো, আমাদের বলা হল সাবান নিয়ে কাজ করতে। একটি কোম্পানি সাবান বানায় না। তবে তারা একটি নতুন সাবান বাজারে আনতে চলেছে। সেটা লোকে নেবে কিনা বা কী ধরনের লোকে সেই সাবান পছন্দ করতে পারে, অর্থাৎ তাদের ক্রেতা কে— তা জানতে হলে প্রোডাক্ট নামানোর আগে মার্কেট সার্ভে করতে হয়। আমি সেই কাজ করি।

এখনও কি সেই সাবানের পিছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছ?

হা হা—বলতে পারো।

তার মানে তুমি পুঁজিবাদীদের হয়ে দালালি করছ—এই তো?

একটি বিড়াল কোত্থেকে ছুটে এসে তুড়ুক করে উঠে পড়ল ভুলাই পালের কোলে। তার পরনে চেক লুঙ্গি। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। বিড়ালটিকে পেয়ে ভুলাই খুশি হল খুব। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল।

হুম! আমার তো দুই মেয়ে। বড়োজন দিল্লিতে থাকে, স্বামীর সঙ্গে; ছোটোজন গ্রামেই। কিন্তু মেয়ের ভরসা আমি খুব বেশি করি না, জামাই কী বলে-না-বলে! আর ইনকামও তেমন নেই। আগের মতো আর চাষের কাজ করতে পারি না। তখন ভাগে করে চালিয়েছি। নিজের জমি-ই আর কতটুকু বা! এখন তাই ভাগে দিয়ে সংসার চালাতে হয়। জামাই-ই সব দেখেশুনে নেয়। তবে তাতে আমার চলে না।

শুভাশিস চুপ করে থাকে।

তোমার কাকার এক ছেলে—তাই না?

হ্যাঁ।

শুনি ছেলেটা সুবিধের নয়…

হুম!

নলিনীর এক মেয়ে—এখন প্যারাটিচারি করে। নলিনী চাকরি পেল না বটে, মেয়েটার হয়ে গেল। এখনকার সময় তো মেপেজুপে পা ফেলার। হিসেব করে চলার। ভালো। এতে বাকি জীবনে হা-হুতাশ করতে হয় না। ভবিষ্যতের জন্য ধন গচ্ছিত রাখতে জানো তোমরা। তোমাদের কাছ থেকে এসব শেখার আছে। আমাদের সময় তো এত ভাবাভাবি ছিল না। চাষ করেছি, দল করেছি, ভোটে দাঁড়িয়েছি। আমাদের সময়ে এই গ্রামে কোনোদিন বামদল জেতেনি। এটা একটা রহস্য যে, ওই রমরমার বাজারেও হাতের কদর! পরে তোমার মেজোকাকা নলিনী আমাদের দলে এল। খেলা ঘুরল। আমরা জিততে থাকলুম। আর এখন বাম দলে তোমার মেজোকাকাই সব। তুমি কী কারণে আমার কাছে এসেছিলে যেন?


তখন ঘরে একজন নারী এসে ঢুকল। আচমকাই। দমকা বাতাসের মতো সে এল, দখিনা বাতাসের মতন—সেই বাতাসের কাছে যেন নতজানু হল সে। হালকা ও মৃদু এক সুগন্ধে ভেসে গেল ঘর। যেন মনে হল এক আলো ঝলমলে দুনিয়ার সামনে শুভাশিস এসে পড়েছে। ঘরের গুমোট অবস্থাটা বদলে গেল এক লহমায়। চোখ তুলে তাকাল শুভাশিস। একে সে আগে দেখেনি। তবে এটা তার দোষ নয়। সে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন। সে যেমন একে চেনে না, এও তেমনি তাকে চেনে না, শুভাশিস নিশ্চিত।

এ যে পথে এসেছে, সেটা এই চালার ভেতর বসে দেখা যায় না। তার আসার কোনো শব্দও পায়নি সে। যদি বাইরের দরজা, মানে রাস্তা দিয়ে এসে এই বাড়িতে ঢুকে থাকে, তাহলে ভুলাই পাল-এর নড়বড়ে দরজা ঠেলে ঢুকলে একটু আওয়াজ বয়ে যাবার কথা। না, সে আওয়াজ ওঠেনি বাতাসে। বদলে বাতাসে ভাসছে মৃদু সুবাস। তাকে সোজাসুজি একঝলক দেখেই শুভাশিস বুঝল, মেয়েটি নারী হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ঠিক যেমন সন্ধের বেলকুঁড়িগুলি ফোটার আগে টোবা হয়ে ফুলে থাকে কিশোরী নারীর মতন; সেই ফুটন্মুখ পাপড়িকে বাতাস যখন তার আঙুল ছুঁইয়ে বলে, এবার চোখ খোলো, পূর্ণতা পাক তোমার রূপ—তখন সে ফোটেl

মেয়েটির পরনে খুব সুন্দর ও মিষ্টি রঙের একটি চুড়িদার। কানে ছোট্ট দুল। মুখে আলগা পাউডার। লম্বা চুল ছড়িয়ে আছে পিঠময়। আলগা করে লিপস্টিক লাগিয়েছে না তার অধরের রঙই ওটা, সেটা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। হয়তো সে একটু বেশিক্ষণই তাকিয়েছিল তার দিকে, অপলক। বোঝা যায় তার মধ্যে এক যাদুকরী ক্ষমতা আছে, যা চোখ টানে; সে যেখানে উপস্থিত হয়—সেখানে সে-ই সব, বাকিরা গৌণ।

মেয়েটি তখন চোখ সরিয়ে নিল। চৌকিতে ধপ করে বসে পড়ে বলল, ও দাদু!

একগাল হেসে ভুলাই পাল বলে, ওকে চিনিস?

না। বলে মেয়েটি আবার শুভাশিসের দিকে তাকাল। চোখে মুখে কৌতূহল। তার পর সে দাদুর মুখের দিকে তাকাল। বোঝাই যাচ্ছে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে।

ওর ভালো নাম শুভাশিস। আমরা ওর ছেলেবেলায় ওকে শুভো বলে ডাকতাম। ও-পাড়ার মুখার্জীবাড়ির ছেলে। ওর কাকা একসময় পার্টি করত খুব। তাকেও তুই চিনবি না। হয়তো নাম শুনে থাকবি আমাদের মতন পুরোনো লোকের কাছে। পার্টিকে খুব ভালোবাসতো ওর কাকা। এখনকার মতো পার্টি-করিয়েদের মতন ভালোবাসা নয়, সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ। পার্টির প্রতি এই ভালোবাসা তোদের প্রজন্ম দেখেনি বলতে গেলে। সে ছিল ‘হাত-পাগল জীব’।

আচ্ছা! তুমি যেমন বামপাগলা বামখ্যাপা—হা হা হা।

মেয়েটি হেসে যেন লুটিয়েই পড়বে। খুব হাসতে পারে।

সে কথায় পাত্তা না দিয়ে ভুলাই বলে, ও এখন শহরে থাকে। সেখানেই কীসব কাজ করে। কেবল ও না, ওর বাবা-মা, বোন—সকলেই সেখানে থাকে। পালা-পাব্বনে আসে কি না-আসে। ফলে তুই ওকে দেখিসনি। তাই তুই যেমন ওকে চিনিস না তেমনি ওর কাছেও তুই অজানা। এখন ও সাবান কোম্পানিতে কাজ করে। বয়সে ও তোর চাইতে অনেকটা বড়ো হয়তো। তবে তার জন্যে ওকে আপনি-আজ্ঞে করার দরকার নেই। গ্রামের ছেলে, তুমি করে কথা কইবি। ও আমার কাছে এসেছে, আমার কাছে পার্টির হাল-হকিকত জানতে। আর জানতে চায়, কী ধরনের জীবনাচরণ করলে একজন মানুষ কমিউনিস্ট হতে পারে।

আচ্ছা! তবে তুমি কমিউনিস্ট খুঁজতে শহর থেকে গ্রামে এসেছ। দাদু, আমি তবে যাই?

যা। দ্যাখ দেখি, দিদুন কী করছে। আর একগ্লাস লেবুরজল করে দিতে বল—ছেলেটা কখন এসেছে।

শুভাশিস বলল, এই বিকেলে আর লেবুর জল খাব না, জেঠু।

আরে থামো তো! লেবুরজলের আবার বিকেল-সকাল কী? গরমের দিনে যে-কোনো গৃহস্থবাড়িতে গেলে আর কিছু না হোক, লেবুরজল দেওয়া নিয়ম। আর এই লেবু বাজার থেকে কেনা নয়, আমার গাছের। পাতিলেবু হলে কী হবে, দেখবে কী চমৎকার স্বাদ আর গন্ধ! মন ভরে যাবে তোমার। তুই যা। করে আন।

ঠিক আছে। বলে মেয়েটি চলে গেল। যাবার আগে তেরছা চোখে একঝলক দেখে নিল শুভাশিসকে। তার পর যেমন সাঁ করে এসেছিল তেমনি হুস করে বেরিয়ে গেল।

[ক্রমশঃ]

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২