জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ৮ )

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ৮ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – ৮

মেদার্দো পাচেকোর ভয়ংকর ঘটনার পর যে শান্তির আশ্রয় আমার দাদু-দিদিমা খুঁজছিলেন, আরাকাতাকা ছিল সে প্রত্যাশা থেকে বহু দূরে। এই জনপদটির সূচনা চিমিলা আদিবাসীদের একটা ছোট্ট গ্রামকে ঘিরে। তারপর সিয়েনাগা পৌরসভার প্রান্তবর্তী জেলা হিসাবে দুর্ভাগ্যের হাত ধরে ইতিহাসের পাতায় তার ঠাঁই। সেখানে না ছিল ঈশ্বরের নিয়ম, না আইনের। বিশেষ করে কলা কোম্পানির বাড়-বাড়ন্তের আমলে যত না সে সমৃদ্ধ হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে গেছে আরাকাতাকা নামের উৎস নদী থেকে: চিমিলা ভাষায় ‘আরা’ মানে নদী আর ‘কাতাকা’ বলা হত তাদের দলের সর্দারকে। সেই জন্য আমরা যারা সেখানকার বাসিন্দা তারা আরাকাতাকা না বলে শুধু বলি ‘কাতাকা’।
সেই সময় দাদু বাড়ির সবাইকে এক কল্পরাজ্যের কথা বলে উৎসাহিত করতেন, বলতেন যে ওখানে রাস্তায় রাস্তায় টাকা ছড়ানো আছে। আর মিনা তখন বলতেন: ‘টাকা হচ্ছে শয়তানের বিষ্ঠা।’ আমার মায়ের কাছেও শহরটা ছিল আতঙ্কের স্বর্গরাজ্য। তাঁর সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি হল দলে দলে পঙ্গপাল এসে চাষের খেত ধ্বংস করে দিচ্ছে। মা তখন নিতান্তই শিশু। বাড়ি বিক্রি করতে যাওয়ার সময় আমাকে বলছিলেন, ‘পঙ্গপালগুলো যখন আসছিল মনে হচ্ছিল যেন পাথরের ঝড় বয়ে যাচ্ছে।’ ভয়ে সন্ত্রস্ত সব মানুষ ঘরের মধ্যে ঢুকে খিল দিয়ে বসেছিল। বোধহয় একমাত্র জাদুবিদ্যাই পারত সেই চরম বিপদ থেকে সবাইকে রক্ষা করতে।

যে কোনো ঋতুতেই আমাদের চমকে দিয়ে শুকনো হ্যারিকেন ঝড় উঠত। বাড়ির চাল যেত উড়ে, নতুন কলাখেত নয়ছয় করে দিত আর সারা শহর ঢেকে যেত মহাজাগতিক ধুলোর আস্তরণে। গ্রীষ্মকালে প্রবল ক্ষরায় গরু-ছাগলদের অবস্থা হত শোচনীয় আর শীতকালে অঝোর বর্ষণে পথঘাট উত্তাল নদীর মতো বয়ে যেত। গ্রিংগো[১] ইঞ্জিনিয়াররা সেই রাস্তায় রবারের ভেলায় চেপে জলে ভাসতে থাকা বিছানার গদি আর মরা গরুদের পাশ কাটিয়ে ঘুরে বেড়াত। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির জলসেচ ব্যবস্থার ফলেই এই ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে যখন কবরের নীচে থেকে মৃতদেহ ভেসে উঠতে শুরু করল তখন কোম্পানি নদীখাতের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
তবে এই সব কিছুর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিপর্যয়টি হল মানুষ নিজে। খেলনার ট্রেনের মতো দেখতে একটা ট্রেন শহরের উত্তপ্ত বালির উপর ছড়িয়ে দিল সারা পৃথিবী থেকে আগত অসংখ্য দুঃসাহসিক মানুষের প্রবাহ আর তারা অস্ত্রের শক্তিতে পথের পর পথ দখল করে নিল। আকস্মিক সমৃদ্ধির সঙ্গে তারা নিয়ে এসেছিল জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ও চূড়ান্ত সামাজিক বিশৃঙ্খলা। ফুন্দাসিয়োন নদীর ধারে ‘বুয়েনোস আইরেস’ নামের বন্দিশিবির ছিল মাত্র পাঁচ লিগ দূরে। সেখানকার বন্দিরা সপ্তাহান্তে আরাকাতাকায় পালিয়ে এসে ভয় দেখানোর খেলায় মেতে উঠত। তারপর যখন চিমিলাদের পাম ও নলখাগড়ায় তৈরি বাড়ির জায়গায় ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির অ্যাসবেস্টসের চাল, মোটা পর্দা ঝোলানো জানলা আর ধূলিমলিন ফুলের লতাপাতায় সাজানো বাইরের ঘর দেওয়া কাঠের বাড়ি তৈরি হতে শুরু করল, পশ্চিমের সিনেমায় দেখা রুক্ষ গ্রামগুলোর সঙ্গে আর আমাদের কোনো পার্থক্য রইল না। বাস্তবিক এত সাদৃশ্য বোধহয় আর কারুর সঙ্গে ছিল না। অপরিচিত মুখের সারি, জনসাধারণের যাতায়াতের পথের উপর পেতে রাখা তাঁবু, প্রকাশ্য রাস্তায় পুরুষদের জামা-কাপড় পালটানো, ট্রাঙ্কের উপর ছাতা খুলে মেয়েদের বসে থাকা ও হোটেলের আস্তাবলে একটার পর একটা গাধার না খেতে পেয়ে মরে যাওয়া–এই চূড়ান্ত বিশৃঙ্কলার মধ্যে যারা প্রথমে এসেছিল তারাই রয়ে গেল সবার শেষে। আর আমরা, যারা নবাগত, তারা হয়ে গেলাম চিরকালের বহিরাগত।

শুধু যে শনিবারের মাতলামোর জন্যই খুনোখুনি হত, এমনটা নয়। কোনো এক দিন সন্ধেবেলার কথা। রাস্তায় চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আমরা বাইরে তাকিয়ে দেখলাম যে মুণ্ডহীন একটা দেহ চলে যাচ্ছে গাধার পিঠে চড়ে। কলাখেত নিয়ে গণ্ডগোলে মাচেতে দিয়ে তার মাথা কেটে দিয়েছে আর সেই কাটা মুণ্ডু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে জলসেচের নালার বরফ ঠান্ডা জল। সেদিন রাতে দিদিমাকে বলতে শুনলাম, ‘একজন কাচাকোই শুধু এরকম ভয়ংকর কিছু একটা করতে পারে।’

কাচাকোরা উঁচু পার্বত্য প্রদেশের বাসিন্দা। তাদেরকে আমরা গোটা মানবজাতির থেকে আলাদা করে চিনে নিতে পারতাম, তা শুধু তাদের জড়তাগ্রস্ত আচরণ বা বাচনভঙ্গির জন্য নয়, অহংকারী ব্যবহারের জন্যও। এমন ভাব করত যেন স্বয়ং মহিমান্বিত ঈশ্বরের দূত। তাদের এই ভাবমূর্তি মানুষের মনে এতটাই ঘৃণার উদ্রেক করেছিল যে কলা কোম্পানি যখন নিজস্ব মিলিটারি দিয়ে কলা শ্রমিকদের হরতাল পৈশাচিকভাবে দমন করল, তখন আমরা ওই মিলিটারিদের সৈনিক না বলে কাচাকো বলে ডাকতাম। তাদেরকে আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতার একমাত্র সুবিধাভোগী জীব হিসাবে দেখতাম এবং তাদের ব্যবহারের মধ্যেও প্রতিফলিত হত যে কথাটা সত্যি। একমাত্র এই ভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব ‘আরাকাতাকার কালো রাত’–সেই ঐতিহাসিক গণহত্যা। সম্মিলিত স্মৃতিতে যার চিহ্ন প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকি ঘটনাটা যে বাস্তবে ঘটেছিল তার নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পর্যন্ত নেই।

সেই শনিবার, যা অন্য যে কোনো শনিবারের থেকে খারাপ, সেই দিনটা শুরু হল যখন শহরের এক ভদ্রলোক–ইতিহাস যার কথা লিখে রাখেনি–একটি বালকের হাত ধরে একটা কাফেটেরিয়ায় ঢুকে এক গ্লাস জল চাইল। সেখানে বসে মদ্যপান করছিল এক অপরিচিত ব্যক্তি। সে বাচ্চা ছেলেটাকে জলের বদলে রাম খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। বাচ্চাটার বাবা ওই ভদ্রলোক তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু লোকটা সমানেই জোর করতে লাগল যতক্ষণ না বাচ্চাটা ভয় পেয়ে অসতর্কভাবে হাত দিয়ে তার মদের গ্লাসটা উলটে দিল। আর লোকটা তখন মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে বাচ্চাটাকে গুলি করে মেরে ফেলল।

এই ঘটনাটা ছিল আমার শৈশবের অন্যতম এক ভয়। কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ার জন্য পাপালেলোর সঙ্গে কোনো কাফেটেরিয়ায় ঢুকলে তিনি আমাকে প্রায়শই সেই ঘটনাটা মনে করিয়ে দিতেন, কিন্তু এমন অবিশ্বাস্যভাবে গল্পটা বলতেন যে তা তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। ঘটনাটা ঘটে থাকবে তাঁর আরাকাতাকায় আসার কিছুদিন পরে, কারণ আমার মা শুধু এটুকুই মনে করতে পারতেন যে বড়োদের মনে ঘটনাটা কী প্রচণ্ড ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। ওই ঘাতক সম্বন্ধে একটা কথাই শুধু জানা গিয়েছিল যে তার কথা বলার ভঙ্গি ছিল আন্দেস পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষদের মতো। এর ফলে শহরের সমস্ত মানুষের রাগ গিয়ে পড়ল ওই লোকটার বিরুদ্ধে শুধু নয়, বরং সেই সব অসংখ্য ঘৃণিত বহিরাগতদের উপরও যাদের উচ্চারণ ভঙ্গির সঙ্গে ঘাতকের কথা বলার মিল আছে। সন্ধে হলেই এলাকার বাসিন্দারা দল বেঁধে চাষের মাচেতে হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ত এবং অন্ধকারের মধ্যে কোনো অচেনা অবয়ব দেখলেই তাকে পাকড়াও করে নির্দেশ দিত:

—‘কথা বলো।’

তারপর শুধুমাত্র উচ্চারণ-বিশেষত্বের জন্য মাচেতে দিয়ে তার গলা কেটে দিত। একবারও ভাবত না যে এত ভিন্ন ভিন্ন ধরণের উচ্চারণের মধ্যে সেই বিশেষ ভঙ্গিটা সঠিকভাবে চিনতে পারা বাস্তবিক অসম্ভব। আমার দাদুর বোন ওয়েনেফ্রিদা মার্কেসের স্বামী দোন রাফায়েল কিনতেরো ওর্তেগা কাচাকোদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও অহংকারী ছিলেন। আমাদের বাড়িতেই তাঁর শততম জন্মদিন উদযাপনের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল কারণ এই গণ্ডগোল না থামা পর্যন্ত দাদু তাঁকে ভাঁড়ার ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

আরাকাতাকায় দু’বছর বাস করার পর পরিবারের দুর্ভাগ্য চরম সীমায় পৌঁছল–মারা গেলেন আমার মাসি মার্গারিতা মারিয়া মিনিয়াতা। বাড়ি আলো করা মেয়ে ছিলেন তিনি। বহু বছর ধরে তাঁর ড্যাগেরেটাইপ ছবি বসার ঘরে ঝোলানো ছিল আর তাঁর নাম এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে বারবার উচ্চারিত হত পারিবারিক পরিচয়ের অন্যতম চিহ্ন হিসাবে। আজকের প্রজন্মের কেউ আর ওই ছবির ঢেউ খেলানো স্কার্ট পরা, পায়ে ছোট্ট ছোট্ট দুটো সাদা জুতো ও কোমর অবধি ঝোলানো বেনির বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে অভিভূত হয় না। একজন প্রমাতামহীর আলংকারিক ভাবমূর্তির সঙ্গে কিছুতেই ওই ছবিকে তারা মেলাতে পারে না। কিন্তু আমার মনে হয় অনুতাপ ও উন্নত এক জীবনের স্বপ্নভঙ্গের ভারে অবনত আমার দাদু-দিদিমার কাছে অন্তহীন দুঃখের ওই অবস্থাই ছিল শান্তির সমতুল্য। যেখানেই থাকুন না কেন আমৃত্যু তাঁরা নিজেদেরকে বহিরাগতই ভেবেছেন।

আসলে তাঁরা তাই-ই ছিলেন। কিন্তু ট্রেনে করে সারা পৃথিবী থেকে মানুষের স্রোত যখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছত, তখন অনতিবিলম্বে তাদের থেকে নিজেদের পৃথক করে নেওয়া সহজ ছিল না। আমার মাতামহ ও তাঁর ছেলেমেয়েদের মতো একই আবেগ নিয়ে এখানে এসেছিল দুরান, বেরাকাসা, দাকোন্তে, কোররেয়া পরিবারের মানুষেরা–সেই এক উন্নত জীবনের সন্ধানে। তাছাড়াও উত্তাল পরিস্থিতির জন্য আসতে থাকে ইটালি, ক্যানারি আইল্যান্ড ও সিরিয়ার লোকজন। সিরিয়ানদের আমরা বলতাম তুর্কী। তারা প্রদেশের সীমান্ত পেরিয়ে এখানে আসত স্বাধীনতা ও যাপনের অন্যান্য পথের সন্ধানে যা তাদের নিজ নিজ ভূমিতে ছিল অধরা। তাদের মধ্যে সবরকম অবস্থার ও সব ধরনের মানুষ ছিল। কয়েকজন ছিল গিয়ানার ফরাসি বন্দিশিবির ডেভিলস আইল্যান্ড[২] থেকে পালিয়ে আসা কয়েদি। কৃত অপরাধের চেয়েও অপরাধের ধরনের জন্য তারা শাস্তি পেয়েছিল। এদেরই একজন ফরাসি সাংবাদিক রেনে বেলভেনোয়া ছিলেন রাজনৈতিক বন্দি। তিনি এই কলা অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং বন্দি জীবনের বিভৎস অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি অসাধারণ বই লিখেছিলেন। এদের সবার দৌলতে–সে ভালো হোক আর মন্দ–আরাকাতাকা শুরুর সময় থেকেই একটি সীমান্তবিহীন ভূখণ্ড হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ভেনেসুয়েলার কলোনিটি। সেখানকার একটি বাড়িতে ছুটির সময় ভোরবেলার বরফ ঠান্ডা জলে স্নান করেছিল দুই কিশোর ছাত্র–রোমুলো বেতাঙ্কুর ও রাউল লেয়োনি–যারা অর্ধ শতাব্দী পরে নিজেদের দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হবে, একজনের পর আরেকজন। ভেনেসুয়েলানদের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে কাছের ছিলেন মিসিয়া হুয়ানা দে ফ্রেইতেস। তিনি খুবই উল্লেখযোগ্য একজন মহিলা, তাঁর গল্প বলার ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা ছিল। প্রথাগত গল্প হিসাবে যে গল্পটি আমি প্রথম শুনেছিলাম তা হল ‘জেনোভেভা অফ ব্র্যাবেন্ট’। মিসিয়া হুয়ানার কাছেই এ গল্প শুনেছি। তাছাড়াও ছোটদের উপযোগী করে তিনি বলতেন বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত সব কাহিনি: ‘ওডিসি’, ‘ওরল্যান্ডো ফুরিয়োসো’, ‘কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো’ এবং বাইবেলের বিভিন্ন গল্প।

আমার দাদু সমাজের যে শ্রেণিতে বাস করতেন তা খুবই শ্রদ্ধেয় ছিল, তবে ক্ষমতা বিশেষ কিছু ছিল না। এমনকি কলা কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমেরিকানরাও তাঁদেরকে মান্য করতেন। তাঁরা ছিলেন বিগত গৃহযুদ্ধের উদারপন্থী সেনানায়ক। শেষ দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জেনারেল বেঞ্জামিন এররেরার আদর্শ অনুসরণ করে তাঁরা এখানেই রয়ে গিয়েছিলেন। নেরলান্দিয়ায় এই জেনারেলের বাড়িতে সন্ধেবেলায় শোনা যেত তাঁর শান্তির ক্লারিনেটের বিষণ্ণ সুর।

এই নিষ্করুণ পরিবেশের মধ্যে আমার মা বড়ো হয়ে উঠছিলেন আর টাইফাস রোগে মার্গারিতা মারিয়া মিনিয়াতার মৃত্যুর পর তিনিই ছিলেন সকলের চোখের মণি। তাঁর স্বাস্থ্যও ছিল দুর্বল। ছোটোবেলা থেকে পালাজ্বরে ভুগতেন। কিন্তু শেষবার যখন জ্বর থেকে সেরে উঠলেন চিরদিনের জন্য সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। সেই স্বাস্থ্য নিয়েই তিনি ৯৭ বছর অবধি বেঁচে ছিলেন। নিজে ১১টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তার সঙ্গে ছিল স্বামীর আরও ৪টি সন্তান, আর ছিল ৬৫ জন পৌত্র-পৌত্রী, ৮৮ জন প্রপৌত্র-প্রপৌত্রী এবং ১৪ জন প্র-প্রপৌত্র-প্রপৌত্রী। অবশ্যই এদের মধ্যে সেই সব সন্তানের কথা ধরা হচ্ছে না, যাদের কথা কেউ জানে না। ২০০২ সালের ৯ই জুন রাত সাড়ে আটটায় যখন তাঁর স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়, তখন আমরা তাঁর একশো বছরের জন্মদিন উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আর ঠিক সেই দিন এবং প্রায় একই সময়ে আমি এই স্মৃতিকথা লেখা শেষ করেছিলাম।

আমার মায়ের জন্ম হয়েছিল বাররানকাসে, ১৯০৫ সালের ২৫শে জুলাই। সেই সময় তাঁর পরিবার যুদ্ধের ধাক্কা সামলে সবে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। যেদিন তিনি জন্মান সেদিন কর্নেলের মা লুইসা মেহিয়া বিদালের মৃত্যুর এক মাস পূর্ণ হয়, তাই তাঁর নামে মায়ের নামের প্রথম শব্দটি দেওয়া হয়–লুইসা। আবার সেই দিনটি ছিল সাধু সান্তিয়াগো এল মাইয়োর-এর দিন, যাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করা হয় জেরুজালেমে। তাঁর নামের দ্বিতীয় শব্দটি আসে ওই সান্তিয়াগো থেকে। কিন্তু মা জীবনের অর্ধেক সময় পর্যন্ত এই দ্বিতীয় নামটা লুকিয়ে রেখেছিলেন, কারণ তাঁর মনে হত সেটা একটু পুরুষালী ও আলংকারিক। তারপর একদিন তাঁর এক অবাধ্য সন্তান নিজের উপন্যাসে সেই নাম সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে দিল।

তিনি বেশ মনযোগী ছাত্রী ছিলেন, তবে পিয়ানোর ক্লাস বাদ দিয়ে। কিন্তু তাঁর মা তাঁকে জোর করে পিয়ানো শেখাতেন, কেন-না ভালো পিয়ানো বাজাতে না পারলে সমাজের উপযুক্ত ভদ্রমহিলা হয়ে উঠতে পারা যাবে না। মা বাধ্য হয়ে তিন বছর পিয়ানো শিখেছিলেন, কিন্তু তার জন্য প্রতিদিন এত পরিশ্রম করতে হত যে এক প্রচণ্ড গরমের দুপুরে সিয়েস্তার সময় তিনি তা একেবারে ছেড়ে দিলেন। তারপর বাড়ির লোকেরা যখন জানতে পারল যে আরাকাতাকার এক উদ্ধত টেলিগ্রাফ অপারেটর যুবকের প্রেমে পাগল হয়ে গেছেন তখন যে একটি মাত্র গুন তাঁর কুড়ি বছর বয়সের বসন্তকে সাহস জুগিয়েছিল তা হল তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা।

আমার যৌবনের অন্যতম বিস্ময় ছিল বাবা-মায়ের এই নিষিদ্ধ প্রেমকাহিনি। সাতাশ বছর বয়সে যখন আমার প্রথম উপন্যাস ‘ঝরাপাতা’ লিখি ততদিনে তাঁদের কাছ থেকে ওই কাহিনির প্রায় পুরোটাই শোনা হয়ে গেছে, কখনও তাঁরা দুজনে একসঙ্গে বলেছেন, কখনও-বা আলাদা আলাদা করে। তবুও সেই সময়েই আমি এ ব্যাপারে সচেতন ছিলাম যে উপন্যাস লেখার কলা-কৌশল শিখতে ঢের বাকি আছে। বাবা-মা দুজনেই খুব ভালো গল্প বলিয়ে ছিলেন। আর নিজেদের প্রেম নিয়ে অসংখ্য সুখস্মৃতিও ছিল তাঁদের। কিন্তু তা এতটাই আবেগমথিত ছিল যে পঞ্চাশ বছর বয়সের পর আমি যখন সেই প্রেমকে উপজীব্য করে ‘কলেরার সময়ে প্রেম’ উপন্যাস লেখা স্থির করলাম, তখন জীবন আর কবিতার মধ্যেকার সীমারেখা ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না।

টীকা:

১। গ্রিংগো: লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে গ্রিংগো বলতে ইংরাজিভাষী মানুষ, বিশেষত উত্তর আমেরিকার মানুষদের বোঝায়।
২। ডেভিলস আইল্যান্ড: ফরাসি গিয়ানার রাজধানী ক্যান-এ অবস্থিত ফরাসিদের একটি পেনাল কলোনি বা বন্দিশিবির, যা ১৮৫২ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কার্যকরী ছিল। এটি কুখ্যাত ছিল বন্দিদের প্রতি অত্যাচার আর উচ্চ মৃত্যু হারের (সর্বাপেক্ষা ৭৫ শতাংশ) জন্য। ফরাসি রাজনৈতিক বন্দিদের বিশেষভাবে এখানে নির্বাসন দেওয়া হত।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২