সম্পাদকীয়
টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছে রক্তপাতের মতো। কান্না ঝরছে মেঘ গলে গলে।
শহর জুড়ে তখন প্রস্তুতি চলছিল উৎসবের। আয়োজন শুরু হয়েছিল অবশ্য অনেক আগে থেকেই। গেল বছর প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মোক্ষকামী জনতার দিকে ফিচেল হাসির সাথে অঞ্জলি অঞ্জলি গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিয়ে ছেলেটা যেই বলে উঠেছিল ‘আসছে বছর আবার হবে’ অথবা ঢাকির পাওনা চুকিয়ে ক্লাব সেক্রেটারি যখন বললেন ‘সামনের বছর চলে এসো ভাই দলবল নিয়ে’ তখন থেকেই আয়োজন শুরু। তারপর সময় রথের চাকা ঘুরতে ঘুরতে সারা হয় খুঁটিপুজো; মাটি লেপা হয় কাঠামোয়; বায়না দেওয়া হয় কুমোরপাড়ায়; প্রতিমার সাজ নিয়ে সান্ধ্য জটলা বসে।
এরই মধ্যে একদিন শহরের কোনো এক প্রান্তে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যস্ত উড়ালপুল। অথবা সর্বভুক আগুনের ক্ষুধাশান্তি করতে শ্মশান হয়ে যায় বহুতল বাড়ি। পূবের হাওয়ায় ভড় করে জল থৈ থৈ শহরের আকাশে উড়ছিল যেসব টুকরো টুকরো আনন্দ তা যেন হঠাৎ দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে নেমে আসে মাটিতে…
আবার একসময় রক্তের ফোঁটা যায় শুকিয়ে। চিতায় জল ঢেলে অস্থি ভাসিয়ে আবার শুরু হয় সারাই-বাছাইয়ের কাজ। সময় রথের চাকা নির্বিকারভাবে আনন্দ দুঃখ সবই যেন পিষে দিয়ে গড়াতে থাকে সামনের দিকে। চাকার আওয়াজে যে সুর ওঠে তা ব্যাখ্যা করব কী দিয়ে? সেই সুরে অতীতের বিষাদের সাথে আগামীর রোমাঞ্চও বাজে। আসলে সুখ, দুঃখ, বিষাদ, আনন্দ বলে আলাদা আলাদা করে কিছু নেই। এরা প্রেমিক-যুগল। হাত ধরাধরি করেই ঘোরে। এরা একে অপরের অর্ধ-অঙ্গ। তাই জন্যই তো আমরা দৈনন্দিন স্খলন-পতন-বিচ্ছিন্নতাগুলিকে ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ বলে অনেকখানি হজম করে নিতে পারি; উত্তর আর দক্ষিণকে কাছাকাছি আনার জন্য পুনরায় শুরু হয় সেতুবন্ধন। শহরের ফুটপাত আবার ভরে যায় দোকানে দোকানে। কাশফুলে ছেয়ে যায় জলাভূমি। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াকে তুচ্ছ করে সুর বাজে আগমনীর—
‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী উমা বড়ো দুখে রয়েছে’…
(চিত্র: সৌরীন )
সত্যি এটাই…..
আনন্দ,বেদনা,হর্ষ,বিষাদ-এইসব নিয়ে জীবনের ছন্দোবদ্ধ সময় প্রতিবার যেন চিরপরিচিত সুরে নতুনভাবে আগমনীর সুর শোনায়।