বক্সা বনে বিধি ভঙ্গ – বিমল লামা

বক্সা বনে বিধি ভঙ্গ – বিমল লামা

শেয়ার করুন

আগাগোড়াই বক্সার বন বড্ড টানে তাকে। জলদাপাড়া নয়, গরুমারা নয়, চাপরামারিও নয়। বক্সাই টানে বেশি। বারবার এসেও তার আশ মেটে না। হয়তো বক্সার জয়ন্তী আছে বলে। আজ জয়ন্তীর কাছেই থাকবে রাতে। সেখানেই চলেছে বক্সার ছায়াঢাকা মায়াপথ পেরিয়ে।

কিন্তু তার কাছে পৌঁছনোর আগেই বুনো এক শিহরণে কাঁপতে থাকে বিধি। যেন সে কোনও গোপন অভিসারে যাচ্ছে। নীরবে। চুপিসাড়ে।

“কী হল বিধি? কথা বলছ না যে!”
সম্বিত ফিরে পায় বিধি সিদ্ধান্তের কথায়। সোজা হয়ে বসে সিটে। বুকের ওপর চেপে আসা সিটবেল্ট আলগা করে নেয় খানিক। তারপর কথা বলতে গিয়ে দেখে গলায় কুয়াশা জমে একাকার। আওয়াজই বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে।

সিদ্ধান্ত আবার বলে, “আরে হলটা কী?”

তীব্র ধাতব শব্দে তখন দিনমানে ঝিঁঝি ডাকছে বক্সার বনপথে। সামনে-পিছনে যতদূর চোখ যায় দ্বিতীয় কোনও গাড়ি নেই। যেন তারা দুজনেই শুধু কীকরে ঢুকে পড়েছে জনহীন এক সবুজ বায়ুমণ্ডলের ভেতর।

বিধি কথা বলে না। হাত বাড়িয়ে সে চেপে ধরে সিদ্ধান্তের গিয়ার ধরা হাত। সিদ্ধান্ত গিয়ার ছেড়ে ধরে বিধিকে। শারদ অরণ্যের ঘর্মাক্ত ছোঁয়ায় বিধি বলে দেয় যা বলার।

ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়। যদিও দুজনেই বিবাহিত। কিন্তু অন্য কারও সঙ্গে। ওরা শুধু বন্ধু। ভালো বন্ধু। বিধি প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “এ কি অবৈধ বন্ধুত্ব?”

সিদ্ধান্ত বলে, “বন্ধুত্ব কখনও অবৈধ হয়!”

বিধি সিদ্ধান্তকে আবেগে আঁকড়ে ধরতেই যাচ্ছিল আচমকাই গাড়ির বেগ কমে যায়। পিচ রাস্তা ছেড়ে বনের গা-ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করায় সিদ্ধান্ত। সশব্দে পার্কিং ব্রেক টেনে দিয়ে দ্রুত নেমে যায়। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বার করে বলে, “হ্যালো?”

ওপাশের স্বর বিধি শুনতে পায় না। শুধু উইন্ড স্ক্রিনের ওপর বনছায়া ভেদ করে দেখতে পায় সিদ্ধান্ত কথা বলতে বলতে দূরে সরে যাচ্ছে। যেন-বা পালিয়ে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে বিব্রত ভঙ্গিতে।

নিজের মন ঘোরানোর জন্য বিধি বনের দিকে তাকায়। বড়ো বড়ো গাছের গোড়ায়ঠাসা ঝোপঝাড়। খানাখন্দ। জলকাদা। পচা পাতা আর মরা ডালপালায় আচ্ছন্ন বনের মেঝে। তারই ফাঁকে আলো-আঁধারির গোলকধাঁধা। বিধি কল্পনা করে সেই পথে জীবজন্তুর আনাগোনা। বক্সায় নাকি বাঘও আছে। সে-ই রাজা। আর আছে তার অধীনস্থ সমস্ত নিম্ন আর মাঝারি পদস্থ জন্তুরা। নিশ্চয়ই আছে তাদের নিজস্ব সংবিধান, আইনকানুন। আছে বিধিব্যবস্থা যা সকলেই মেনে চলে। তবেই না এত শান্তি জঙ্গলে! মানুষ তার নিজস্ব সমাজে বিব্রত হয়ে পড়লে জঙ্গলে আসে শান্তির খোঁজে। এই যেমন সিদ্ধান্ত…।

আবার বিধি সামনে তাকায়। উইন্ড স্ক্রিনের ওপর রোদ আর বনের ছায়া আলপনা ফেলেছে জলছবির মতো। তার ভেতর দিয়ে সে দেখে সিদ্ধান্তকে। মনে হয় সে আরও দূরে সরে গেছে। আরও আবছা। আরও বিব্রত। ভীষণ বিব্রত। কেমন পাগলের মতো হাত পা নাড়ছে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে।

বিধি ব্যাজার মুখে চেয়ে থাকে। সিদ্ধান্ত কথা বলেই যায়… বলেই যায়… ফিরে আসে না তার কাছে। হয়তো নন্দিতা ফোন করেছে। ওর বউ। বাপের বাড়ি গেছে মালদায়। সে সুযোগটাই ভেবেছিল নেবে বিধির সঙ্গে। তাই জয়ন্তীর ধারে রিসর্ট বুক করেছে। সেখানেই যাচ্ছিল দুজনে। মাঝপথেই এইসব।

বিধি বোর হয়ে গাড়ি থেকে নামতেই যাচ্ছিল হঠাৎ দেখে সিদ্ধান্ত হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসছে। দ্রুত কাছে এসে সিদ্ধান্ত নিজেই খোলে গাড়ির দরজা। বিধির দিকের দরজা। আর ব্যস্ত বিব্রত স্বরে বলে, “বিধি, একবার প্লিজ নামো তো গাড়ি থেকে। নন্দিতা ভিডিও কল করতে বলছে।”

সিদ্ধান্ত প্রায় টেনে নামিয়ে দেয় বিধিকে। তারপর একরকম তাকে ঠেলে দিয়ে বলে, “রাস্তার ঐ পারে গিয়ে দাঁড়াও। পারলে লুকিয়ে পড়ো কোনও গাছের আড়ালে।”

ঠিক তখনই একটা বাইক এসে পড়ে। তাতে দুজন সওয়ারি। সিদ্ধান্ত বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের পথ আটকায়। বাইক থামে। সে তাদের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলে। তখন সওয়ারি দুজন একবার বিধির দিকে ফিরে তাকায়। বিধির মনে হয় ভীষণ নোংরা চোখে। তারপর আরও নোংরা একটা হাসি দিয়ে তারা বাইক থেকে নামে। গিয়ে বসে সিদ্ধান্তের গাড়িতে। একজন সামনে। অন্যজন পিছনে। সিদ্ধান্ত ড্রাইভারের সিটে বসে সিটবেল্ট লাগায়। সিটবেল্ট লাগায় পাশে বসা লোকটাও। তারপর ফোন বার করে কল করে নন্দিতাকে। ভিডিও কল। ইশারায় বিধিকে বলে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়তে।

বিধি ধীর পায়ে পিচরাস্তার অপর পারে চলে আসে। এপারেও সমান ঘন বন। একটা সুঁড়ি পথ চলে গেছে বনের গভীরের দিকে। পথের মুখেই কবেকার শ্যাওলা পড়া জীর্ণ একটা বোর্ড। তাতে লেখা ‘প্রবেশ নিষেধ’।

‘নিষেধ’ শব্দটা কেমন যেন ভীষণ টানে বিধিকে। মনে হয় শুধু তারই পথ চেয়ে এতদিন অপেক্ষায় বসে আছে এই বোর্ডটা। এই শব্দটাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখে।

বিধি আপন মনে ‘নিষিদ্ধ’ সীমানা পেরিয়ে ঢুকে যায় বনের ভেতর। যেন আরও গভীর নিষেধের দিকে। ব্যথিত মনে ভাবে, সিদ্ধান্তও তো তাই চায়। সে অদৃশ্য হয়ে যাক এই বনের ভেতর।

বিধির কান্না পেয়ে যায়। কান্না চেপে ভাবে সৌম্য কি পারত তাকে এই বনের ভেতর একা ছেড়ে দিতে! বাঘ তো কি একটা কাঠ-পিঁপড়ের ভয় থাকলেও কি সৌম্য তাকে পারত এইভাবে ছেড়ে দিতে! অথচ সে সিদ্ধান্তকে বন্ধু ভেবে তাকে ভরসা করে…।

বিধি একবার ফিরে তাকায় গাড়ির দিকে। সিদ্ধান্ত মোবাইল সামনে তুলে ধরে হাসছে দাঁত বার করে। পাশে বসা অচেনা লোকটাকে টেনে নিচ্ছে ফ্রেমের ভেতর। হাত নাড়ছে লোকটাও ক্যামেরার দিকে। যেন বা পুরুষ হয়ে এটুকু তার কর্তব্য আর এক পুরুষের প্রতি। হোক সে যতই অচেনা।

মোচড় দিয়ে ওঠে বিধির বুকটা। হঠাৎ তার ভীষণ ইচ্ছে করে সৌম্যকে কাছে পেতে। তাকে একবার জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখতে। কিন্তু সে উপায় নেই। সে এখন দেশের বাইরে অফিসের কাজে।

বিধি আর কান্না চাপতে পারে না। তার বুক ঠেলে উঠে আসে গভীর কান্না। মোচড় দিয়ে দিয়ে ওঠে তার সারা শরীর। কোনওরকমে নিজেকে সামলে বিধি বেপরোয়া ভঙ্গিতে দৌড় দেয় বনের গভীরের দিকে। অনেক অনেক গভীরের দিকে। ছুটতেই থাকে অপ্রকৃতিস্থের মতো যতক্ষণ না এসে পড়ে আর একটা সাইন বোর্ডের সামনে। বোর্ডের ওপর বাঘের বিরাট একটা মুখ আঁকা। নীচে লেখা- ‘সাবধান! কোর এরিয়া।’

বিধি শুধু এক মুহহূর্তের জন্য থামে। তারপর বেসামাল পায়ে দৌড়ে ঢুকে যায় কোর এরিয়ার ভেতর। বাইরের বনের তুলনায় সবকিছুই গুরুতর যেন এখানে। বনের ঘনত্ব বনত্ব, সব কিছুই। আর সেই জন্যই হয়তো অল্পক্ষণের মধ্যেই বিধি সত্যি-সত্যিই অদৃশ্য হয়ে যায় বনের কোর এরিয়ার ভেতর।

  • * * * * * * * *

সিদ্ধান্তর মিনিট দশেক লাগে বউয়ের ভিডিও কল সামলে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে। দুই বাইক সওয়ারিকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার বিধির খোঁজ করতে। কিন্তু সে কোথাও দেখতে পায় না বিধিকে। গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে দু’বার গলা তুলে ডাকে বিধির নাম ধরে। কিন্তু প্রত্যুত্তর দেয় না বিধি। অথবা থমথমে সেই অরণ্য। শুধু ঝিঁঝির ডাক কানে আসে ধাতব যন্ত্রণার মতো।

ব্যস্ত হাতে সিদ্ধান্ত গাড়ি লক করে। তারপর রাস্তা পেরিয়ে চলে আসে অপর পারে। নিষেধের বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। আর গলা তুলে ডাকে, “বিধি… বিধি… শুনতে পাচ্ছ? কোথায় লুকিয়ে পড়লে!”

সাড়া নেই। থমথম করে শুধু নীরব অরণ্য। আগের মতোই সে জনহীন আবার। মাথার ওপর অদৃশ্য ঝিঁঝিরা সাইরেন বাজায় পাগলের মতো, কোনও জরুরি অবস্থা ঘটেছে হয়তো! যদিও রাস্তা ফাঁকা যত দূর চোখ যায়। চিহ্ন নেই কোনও চলমান জীবের। চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ। তারই ভেতর কোথাও মিলিয়ে গেছে বিধি, যেন আর একটা গাছ হয়ে।

সিদ্ধান্ত এদিক-ওদিক খোঁজ করে বিভ্রান্ত হয়ে। কিন্তু বিধির দেখা মেলে না কোথাও। অগত্যা সে-ও ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নিষেধের সীমানা ছাড়িয়ে।

সিদ্ধান্তও চলে আসে সেই বাঘের ছবির কোর এরিয়া পর্যন্ত। থমকে দাঁড়ায় বোর্ডের সামনে। ভয়ে ভয়ে তাকায় বনের গভীরের দিকে।

হঠাৎ তার কানে আসে মানুষের স্বর। মনে হয় ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ। খানিক যেন যান্ত্রিক কণ্ঠে। যেমন শোনা যায় মোবাইলের স্পিকারে। আসছে বনের গভীর থেকে। যদিও সেদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায় না সিদ্ধান্ত।

সতর্ক পায়ে সে এগিয়ে যায় বাঘের বোর্ড পার করে। সাবধান বাণী অগ্রাহ্য করে। যদিও তার ভয় করে, তবু সে এগিয়ে যায় আরও গভীর বনের দিকে। যেখানে সবুজ কালো হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

খানিক এগিয়ে গাছপালার আড়ালে উজ্জ্বল আলোকিত রং দেখতে পায় সিদ্ধান্ত। ব্যস্ত হয়ে আর ক’পা যেতেই সে চিনতে পারে বিধির শাড়ির রং। উজ্জ্বল আকাশি। কিন্তু তা ছড়িয়ে আছে জঙ্গলের মেঝেতে। যেন বা তাকে…।

ধড়াস করে ওঠে সিদ্ধান্তের বুকটা। ব্যস্ত হাতে সে কুড়িয়ে নেয় একটা মোটা গাছের ডাল। দু’হাতে অস্ত্রের মতো বাগিয়ে ধরে পা টিপে-টিপে এগিয়ে যায় সেই আকাশি আলোর দিকে।

হঠাৎ তার কানে আসে বিধির গলা। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একেবারে হাঁটু মুড়ে বসেছে স্যাঁৎসেতে বনের মেঝেতে। কাঁদছে আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে।

সিদ্ধান্ত নিঃশব্দে পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিধি টেরও পায় না। সে তার ফোনটা সামনে ঠেস দিয়ে রেখেছে একটা পাথরের ওপর। আর চেয়ে আছে সৌম্যর দিকে, ফোনের স্ক্রিনে। বিভ্রান্ত সৌম্যর মুখ। বিধি তাকে কেঁদে কেঁদে বলছে, “তুমি আমাকে একা রেখে কোথায় চলে গেলে সৌম্য! দেখ আমি কোথায় এসে পড়েছি। চারিদিকে বনজঙ্গল বাঘ-ভাল্লুক। তুমি আমাকে বাঁচাতে আসবে না সৌম্য? আমি মরে যাব তুমি না এলে। আমি মরে যাব…।”

সৌম্য বিধিকে সান্তনা দিয়ে বলছে, সে আসছে। চাকরির মুখে লাথি মেরে সে ফিরে আসছে তার কাছে। ততক্ষণ…। ততক্ষণ…।

হঠাৎ সৌম্য খুশি হয়ে বলে, “ঐ তো সিদ্ধান্ত এসে গেছে। দেখ টিটুল, তোমার পিছনে দেখ। আর কোনও ভয় নেই। ও তোমাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সেখানে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো। কাল ভোরে দরজা খুলে আমাকেই সামনে দেখতে পাবে। এখন তুমি সিদ্ধন্তের সঙ্গে যাও। ও তোমাকে নিরাপদে…।”

বিধি বসে বসেই পিছন ফিরে একবার সিদ্ধান্তকে দেখে। সিদ্ধান্ত নীচু হয়ে বিধির কাঁধে হাত রাখে। বিধি এক ঝটকায় তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বুকফাটা বেসামাল কান্নায় শরীর কুঁকড়ে সে গড়িয়ে পড়ে বনের মেঝেতে। সৌম্য আর সিদ্ধান্তের মাঝখানে। তারপর চিৎ হয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। যেন সে ছোট্ট শিশু কোনও। যার হাতছাড়া হয়ে গেছে পরম কোনও ধন। হয়তো সে খেলার পুতুল। হয়তো সে কাঁচা তেঁতুল। অথবা মেলার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া বাবার প্রিয় ছোট্ট টিটুল।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২