কৃষ্ণকলি – সন্দীপা সরকার

কৃষ্ণকলি – সন্দীপা সরকার

শেয়ার করুন

সময়টা ১৯৫৭ আমি  তখন সদ্য ইংল্যান্ড থেকে গ্রামে ফিরেছি৷পেশায় ডাক্তার৷ ডাক্তারি ডিগ্রি আনতে পারি দেওয়া ইংল্যান্ড৷দাদুর আদেশ মতন অনিচ্ছা সত্বেও ফিরে আসতে হলোদেশের বাড়ি কাটোয়া…… কাটোয়ার জমিদার বংশ আমাদের৷দাদুর বলাই ছিল পাশ করেই গ্রামের লোকের সেবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে হবে৷দাদুর বানানো দাতব্যচিকিৎসালয় তে গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে দিলাম৷৷
 
সেই সঙ্গে শুরু হলো এদিক সেদিক থেকে পাত্রীদের সম্বন্ধ আসা৷২৮বছর তখন বিয়ের পক্ষে নেহাত কম বয়স না,এক খুড়ি পিসিমা তার দেশের বাড়ি মালদা থেকে পাড়াতুতোভাইয়ের পরিবারের একটি ডাকসাইটে সুন্দরীর একখানি ছবি পাঠালেন৷অপরূপা বলা চলে এক কথায়,সে সময়ের ইন্টারমিডিয়েট পাঠরতা ১৮/১৯ বছরের রূপবতী কন্যাটিকেদেখে আমিও বিয়েতে আপত্তি জানাই নি৷বিদেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগটা যদি একবার পেয়ে যাই, এমন  সুন্দরী শিক্ষিতা বউ কেই পাশে লাগবে৷পাত্রী দেখতে গেলাম…….আমি সহদাদু বাবা, কাকা আর আমার বড়দা,জ্যাঠামশায়ের ছেলে৷জ্যাঠা মশাই অনেক কম বয়সে দুরারোগ্য কর্কট রোগে মারা যান৷তখন কোনো প্রকার রিলিফ দেওয়ার মতও চিকিৎসাবেরোই নি৷আমার তখন ৬-৭ বছর, যন্ত্রনায় কাতরাতে দেখতাম মানুষটাকে৷ লিভার ক্যান্সার হয়েছিল৷ কলকাতার সরকারী হাসপাতালে কিছুদিন রাখা হয়েছিল, ডাক্তারদেরপরামর্শ অনুযায়ী আর কিছু করার নেই শুনে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়৷তার ২ সপ্তাহের মধ্যেই উনি মারা যান৷তখনকার দিনে মা কাকিমাদের ঘটা করে পাত্রী দেখতে যাওয়ার চলআমাদের পরিবারে ছিল না৷তাও শ্বশুড়,ভাসুর-দেওরের সাথে তো একেবারেই না৷তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাড়ির মহিলারা যেতে পারলো না৷
 
পাত্রীর বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম,পাত্রীকে আনা হলো৷সাথে মিষ্টি, ফল, লুচি, তরকারি অনেক উপকরন৷ফোটো তে যা দেখেছিলাম তার চেয়ে আরো সুন্দরী দেখলাম,না করার কোনোপ্রশ্নই উঠলো না৷দাদু,বাবা দাদারও সম্মতি আছে বুঝলাম৷দাদা আমাকে ওদের বাড়ির ছাদে গিয়ে মতামত জানতে চাইলো দাদুর কথা মত, কারন আজই দাদু তাহলে পাকা কথাসেরে যাবেন৷ আমিও সম্মতি জানাতে দেরী করলাম না৷দাদু,বাবা,দাদা ধান-দূর্বা টাকা দিয়ে প্রাইমারি আশির্বাদ সেরে পছন্দ জানিয়ে আমরা ফিরে এলাম বাড়ি৷তখন পাত্র-পাত্রীরসামনা সামনি কথা বলার চল ছিল না, এখনকার মতন৷৷
 
পরের সপ্তাহে ১২ই জৈষ্ঠ্য আবার বাড়ির সকল পুরুষ  গিয়ে পাকাপাকি আশির্বাদ সেরে বিয়ের দিনক্ষন পাকা করে চলে এলেন ১৮ই আষাঢ় বিয়ের দিন ধার্য হলো৷পরের সপ্তাহেপাত্রীর বাড়ির লোক এসে আমাকে আশির্বাদ পর্ব সেরে গেলেন৷৷
 
বিয়ের দিন চলে এল,দাদুর বলাই ছিল বিয়ের কাজে যেন কোনো প্রকার ত্রুটি না ঘটে৷সেই জন্য সকাল ৭টার মধ্যে আমার গায়ে হলুদ সেরে ৮টায় মেয়ের বাড়ি রওনা হয়ে গেলএকদল সেই হলুদ সাথে নানাবিধ তত্ত্ব নিয়ে৷দাদু চিরকালই ব্যস্তবাগিশ মানুষ ছিলেন,আমরাও দুপুর ১২ টার মধ্যে বেরিয়ে পরলাম মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে৷৯টা থেকে লগ্ন৷বিয়েরবাড়ি পৌঁছালাম৷ খুব যত্নবান মানুষ এরা আমাদের কোনো প্রকার ত্রুটি ধরার সুযোগই নেই৷বিয়ের কাজ শুরু হলো,শুভদৃষ্টি পর্বতে ঘটে গেল বিভ্রাট,পান পাতা সরিয়ে পাত্রীর মুখদেখেই  সবার চক্ষু চড়ক গাছ,সাথে আমারও৷ কুচকুচে কালো পাত্রী…… যে পাত্রী দেখে বিয়ে ঠিক করেছিলাম সে পাত্রী তো এ-না! সারা বিয়ে বাড়ি হৈ হৈ পরে গেল…….দাদু-বাবা-দাদারা আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে৷ চার জনে ধরা পিঁড়িতে বসা মেয়েটি অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছে,আমাদের পরিবার থেকে মেয়েটির পরিবারের সকল মানুষকেযতধিক অপমানের বাণে বিদ্ধ করা  যায় করা হচ্ছে,মেয়ের বাবা ভদ্রলোকটি আমার দাদুর হাতে পায়ে ধরছেন,হঠাৎ কোথা থেকে মেয়ের মা এসে আমার পা দুটো ধরে কাঁদতেকাঁদতে বললেন “তুমি আমার ছেলের মতো, আমার মেয়ে টাকে বাঁচাও লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার হাত থেকে”৷আমি থতমত খেয়ে পা-টা সরিয়ে নিলাম,উনি এবার আমার হাত ধরলেন, সাথেমেয়ের বাবাও৷যেন পুরো বাংলা সিনেমার প্লট চলছে সারা বিয়ে বাড়িতে৷আমার দাদু মেয়ের বাবাকে খুব রাগান্বিত ভাবে এ রকম তঞ্চকতার কারন জানতে চাইলেন….মেয়ের বাবাগলবস্ত্র হয়ে ক্ষমা চেয়ে আসল কাহিনী বলতে লাগলেন…..”মেয়ে কালো হওয়ার জন্য কেউ তাকে পছন্দ করছিল না৷ বয়স বেড়ে যাচ্ছে,২৪ বছর এখন মেয়ের বয়স….এর পর বিয়েদিতে না পারলে পাড়ায় মুখ দেখানো দায়ী হয়ে পরবে,কানাঘুঁষো ইতি মধ্যে শুরু হয়ে গেছে আমার কালীর আর বিয়ে হবে না৷আমি তাই এই তঞ্চকতার আশ্রয় নিয়েছি,মেয়েটাকেপাত্রস্থ করার জন্য৷ক্ষমা দিদি আপনার ছেলের কথা, আপনাদের পরিবারের কথা জানিয়ে একটা সুন্দরী মেয়ের খোঁজ দিতে বলেছিলেন৷সব শুনে আমি আর লোভ সামলাতে পারলামনা৷ক্ষমা দি ও জানতেন না৷ আমার বোনের মেয়ের জন্য বলেই ‘ওর’ ছবি খানি দিয়েই সম্বন্ধ দেখতে বলেছিলাম৷ওকেই দেখানো হয়েছিল আপনাদের সামনে….৷ আপনারা ক্ষমাকরে মেয়েটাকে লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার হাত থেকে বাঁচান”৷দাদু বললেন— “যাকে আশির্বাদ করেছি তাকে আনুন, ওই পাত্রী ছাড়া বিয়ে দেওয়া অসম্ভব” ৷মেয়ের বাবা বললেন ওই মেয়েরবিয়ে কদিন আগেই হয়ে গেছে৷
 
বিধবা মানুষ বলে বাবাদের ক্ষমা দি মানে হলেন ক্ষমা সুন্দরী পিসি বাবাদের খুড়তুতো বোন তিনি উপস্থিত থাকতে পারের নি৷তিনিও কিভাবে এই খবর পেয়ে ছিঃ ছিঃ করতেকরতে বিয়ের মন্ডপে উপস্থিত হয়ে গেলেন৷হঠাৎ দেখি পিঁড়িটা ততক্ষনে নামানো হয়ে গেছে৷ মেয়েটি অসহায় ভাবে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে…. “কতবারবললাম আমার মত অভাগীর বিয়ের ব্যাবস্থা করো না”৷ সেই সময় বড় দা,বাবা-দাদুর কথা মতন আমাকে চলে আয় বলতেই, মেয়েটির ওপর এক মহিলা আক্রমনাত্মক ভাবেঝাঁপিয়ে পরলেন মুখপুড়ি,অভাগী,অলক্ষী, যা গলায় দড়ি দিয়ে নাতো দড়ি-কলসি বেঁধে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মরে দাদা টাকে আমার শান্তি দে এবার৷বুঝলাম ইনি মেয়ের পিসি৷কথাগুলো কানে পিনের মত বিঁধতে লাগলো৷ কে যেন বলছে আমার প্রতিবাদ করা দরকার৷ যে ভাবা সেই কাজ…..দাদার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হিন্দি সিনেমার হিরোর মতোমেয়েটিকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে, পুরোহিত-কে বিয়ে শুরু করুন বলে নিজে পিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পরলাম৷ সারা বিয়ে বাড়ি বরের সুখ্যাতি তে পঞ্চমুখ৷ দাদু নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়েআছেন, হয়ত আমার সম্মতিতে অপমানিত বোধ করেছেন৷বাবা এগিয়ে এসে বললেন রাগের সুরে “যা করবে ভেবে করবে,সব দায় তোমার৷আমাদের মত অমত আর কিছুইথাকলো না”৷৷
 
বিয়ে শেষ হয়ে বাসর ঘরে বসলাম,বউয়ের সেই পিসিমা একমুখ হাসি নিয়ে  উপস্থিত হয়ে ‘ও’কে বললেন “চওড়া কপাল রে তোর কেলটি, এমন বর পাওয়া মুখের কথা!খুব ভাগ্যভালো না হলে কেউ পায়না”৷যে ক ঘন্টা আগে নিজের ভাইঝি কে মরার পথ বাতলে দিচ্ছিলেন,অভাগী অলক্ষী বলে ভৎর্সনা করছিলেন, সেই এখন  ভালো ভাগ্যের গুন কীর্ত্তনকরছেন৷ আমি বিয়ে না করলে হয়ত মেয়েটি ওনার বাতলানো পথেই হাঁটতো, বলাবাহুল্য হাঁটতে বাধ্য করা হতো৷কেলটিও যে নাম হয় প্রথম শুনলাম৷কালো মেয়ের কত রকমনাম হয় এ বাড়ি না এলে বোঝা থেকে বঞ্চিত থাকতাম৷৷
 
পরেরদিন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম৷মা বউ দেখে কাঁদতে কাঁদতে বরণ করতে লাগলেন, একপ্রকার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন,বুঝতে পারছিলাম গৌরবর্ন সুদর্শন ডাক্তার ছেলের পাশেএই বউ মেনে নিতে পারছিলেন না৷আমিও মহানুভবতা দেখাতে বিয়েটা সেরে ফেললেও বাকী জীবনটা এর সাথে কি করে কাটাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷খালি দেখলাম বড়বউদি ওকে হাসি মুখে মেনে নিলেন৷পরের দিন বউ ভাতের অনুষ্ঠানের যাবতীয় আচার বড় বউদি করে গেলেন৷ কেউ সে ভাবে ধারে কাছে ভীরছে না৷বিকেলে নিমন্ত্রিতঅতিথীদের অভ্যর্থনা জানাতে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলো৷বাড়ির সবাই মুখে একটি কৃত্রিম হাসি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷আমিও মিলিয়ে দেখলাম বন্ধুদের বউদের পাশে আমারবউ একেবারেই বেমানান৷মুখশ্রী সুন্দর হলেও গায়ের রঙে সেটা   চাপা পরে গেছিল৷যদিও মুখশ্রী সুন্দর এটা আমি অনেক মাস পরে লক্ষ্য করেছিলাম৷সে কথাও বলছি ধীরেধীরে৷কানাঘুঁষো লোকের কথা কানে আসছিল,সবাই একবাক্যে কুৎসিত বলে খেয়ে দেয়ে যে যার মত বিদায় নিলো৷রাতের সব নিয়ম বড় বউদি আর আমার ছোট বোন যারপাটনায় বিয়ে হয়েছে সে এসে হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে সেরে যেতেই, আমি দরজাটা বন্ধ করে ওকে বলতে যাব আপনার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো আমার সম্ভব নয়, দেখলামবলার আগেই ‘ও’ নিজেই মাটিতে মাদুর পেতে শুয়ে পরলো৷কথা না বলে আমিও চুপচাপ খাটে গিয়ে শুয়ে পরলাম৷৷
 
এই ভাবে ৩ মাস কেটে গেল ও যতদূর সম্ভব নিজেকে উজার করে দিচ্ছে সংসারে সকলের মন পাওয়ার লোভে৷ভালো রান্না দিয়ে দাদু, বাবা আমার সহ বাড়ির সকলের মন জয়েরপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷আমিও তলে তলে পুনরায় ইংল্যান্ড পালাবার ধান্দা করছি,নাম মাত্র বিয়ের হাত থেকে বাঁচার পথ হিসাবে৷একদিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দাতব্যচিকিৎসালয় থেকে বাড়ি ফিরেই রাত থেকে ধুম জ্বর…..মাথায় অসহ্য ব্যাথা,সারারাত ছটফট করছি,সেই প্রথম বিছানায় বসলো আমার কালো বউ সেবা করার উদ্দেশ্যে৷জল পটিদিয়ে গেছে সারারাত৷আমার কথামত অষুধের বাক্স এনেদিল, সেটা খেয়ে ঘুম দিলাম৷’ও’ সারারাত আমার মাথার পাশে বসে জল পটি দিয়ে গেলো৷দু-দিন পর নিজেই বুঝলামনিউমোনিয়ার উপসর্গ৷ আমার বউ টানা  পনেরো দিন ধরে সেবা করে আমাকে সুস্থ করে তুললো৷তার মাঝে আমি ঘটিয়ে ফেলেছিলাম এক বিপত্তি৷পুরুষালি মনটা জেগে উঠলো,কালো বউটার শরীরটাতে স্বর্গীয় সুখ খুঁজে নিলাম৷ভালোবাসা ছাড়াই দেহের মিলন ঘটিয়ে ফেললাম৷’ও’ নির্দ্ধিধায় নিজেকে সঁপে দিল৷তার পরের দিন থেকে আবার আমার কালোবউটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম৷ ঠাঁই সেই মাটিতে৷ ততদিনে আমার কালো বউটা বাড়ির লোকেদের  নিজের কাজ কর্মের নিপুনতা দেখিয়ে অনেকটাই মন জয় করেফেলেছে৷তার কদিন পরেই বাড়িতে কালী পূজো৷পূজোর দিন দেখলাম সব কাজ নিখুঁত ভাবে করছে মা বউদি দের সাথে৷রাতে পূজোর অঞ্জলি দিয়ে কালীমাকে ভালো করে দর্শনকরতে গিয়ে  মন টা কেমন হয়ে গেল,মায়ের মুখের আদলে আমার বউকে দেখতে পেলাম৷মূহুর্তে মনে হলো পেছনে কি একটা পরে গেল৷সাথে সাথে বাড়ির সকলের চিৎকার শুরুবউটা মাথা ঘুরে পরে গেছে, ‘ও’ কে আমি কোলপাঁজা করে তুলে আমার বিছানায় শোয়ালাম৷জল দিয়ে জ্ঞান ফিরতে নাড়ি দেখে  বুঝে গেলাম সেদিনের আমার অপকীর্তির ফলবউটার পেটে বাসা বেঁধেছে৷বাড়িতে কাউকে জানালাম না৷নিশ্চিত হতে পূজো মিটে গেলে দুদিন পর কোলকাতা থেকে আমার এক গাইনোকোলজিস্ট বন্ধুকে ডেকে পাঠালাম সেদেখে নিশ্চিত বার্তা দিলো আমি বাবা হচ্ছি৷দিন ঘনিয়ে আসছে বাড়ির সকলে খুশি৷আমাদের সম্পর্কের শিথিলতা কারো নজরে কোনোদিনও পরেনি৷বাচ্চার ব্যাপারটা ঘটাতে সবাইনিশ্চিত আমার অগাধ ভালোবাসায় পরিপূর্ন আমার বউ৷৷
 
আমার ডাক্তার বন্ধু অসীম ওকে বাড়ি এসে দেখে যেত,৫ মাসের মাথায় অসীম জানালো আমার বউয়ের শরীরে রক্ত খুব কম, সাবধানে রাখতে হবে৷ভালো করে ফল, টাইম মতোঅষুধ খাওয়াতে হবে৷তখন রক্ত হওয়ার তেমন  অষুধ ছিল না,কুলেখারা নামের পাতা বেঁটে মা-জ্যোঠিমার পরামর্শ মতো বউদি ‘ও’ কে খাওয়াতে লাগলো,কাকিমাও যত্ন করতেন৷লক্ষ্য করতাম কুলেখারার রসটা খেতে পারতো না, বমি করে ফেলতো৷এমনি কোনো খাবারই খেতে রুচি বোধ ছিলনা ওর৷ অষুধটা টাইম মত আমি দিতাম৷ কারন বড় বউদিতেমন শিক্ষিতা ছিলেন না,বাংলা পরতে লিখতে  পারলেও ইংরেজি পারতো না৷৷
 
ওর তখন ৮ মাস চলছে৷ বাড়ির সবাই ক্ষমা পিসির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চলে গেল৷বাড়িতে খালি আমরা দুজন৷খেতে দিতে গিয়ে মাথা ঘুরে আমার সামনেই পরে যাচ্ছিল, আমি ধরেনা ফেললে সেদিন সব শেষ হয়ে যেত৷ওকে ধরে ঘরে নিয়ে বসালাম,থালায় ভাত মেখে খাওয়াতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম ওর চোখের জল গাল বেয়ে পরছে৷আমি বললাম কাঁদছো কেন?শরীর খারাপ করছে?এতদিনের নিরুত্তর  মেয়েটার মনে যে এত ক্ষোভ জমা ছিল আগে বুঝিনি……রাগে দুঃখে জর্জরিত অভিমানিনী আমার হাত দুটো ধরে বললো আমাকে কেন এতযত্ন করছেন?মরে যেতে দিন……আপনার জন্য সুন্দরী,গৌরবর্না,ভালো কোনো বউ দরকার……..মুখটা ভালো করে দেখছি এ-তো কবি গুরুর লেখনির কৃষ্ণকলি! …….পটল চেরাটানাটানা কালো  হরিনীর দুটো চোখ,এক ঢাল থাক থাক করা কোঁচকানো চুল৷ কালী মাকে যদি আরাধনা করতে পারি তবে আমার কৃষ্ণকলিকে এতদিন ভালোবেসে বুকে জড়াতেকেন পারিনি?নিজেকে শিক্ষিত ভাবতে লজ্জাবোধ হচ্ছিল৷ততক্ষন আমার অভিমানিনী কৃষ্ণকলি কত কী যে বলে গেছে আমি শুনিনি৷ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম৷সেই প্রথম ওকেহারানোর ভয় অনুভব করলাম৷না বলা কত কথা সেদিন দুজনে পাশাপাশি শুয়ে বলে যাচ্ছি৷জানতে পারলাম কৃষ্ণকলি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা,রবীন্দ্রনাথের ভক্ত৷ ওকে মাথায়হাত বোলাতে বোলাতে বললাম আজ থেকে তুমি আমার কৃষ্ণকলি৷কবিতাটি আওরাতে লাগলাম…….মাঝ পথে ভুলে যেতে ‘ও’ বাকীটা আওরাতে লাগলো……..ভাব জমে গেলদুজনের৷৷
 
কদিন পর সাধ পর্বও মিটে গেল৷সময় চলে এল কৃষ্ণকলিকে কলকাতার সরকারি হাসপাতালে যেখানে আমার বন্ধু ডাক্তারী করতো ভর্তি করা হলো৷অবস্থা ক্রিটিকাল জানিয়েইঅসীম বন্ড সাইন করালো,আমি বন্ডে এতটুকু দ্বিধা না করে ওয়াইফ চাই বলে সাইন করে দিলাম৷অসীম বলে গেল কিছু বিপত্তি ঘটে গেলে ক্ষমা করে দিস৷সেই প্রথম আমি ওকেহারিয়ে ফেলবো অনুমান করে কেঁদে ফেললাম৷ঠাকুর ডেকে চলেছি,খবর এলো ছেলে হয়েছে……আমি সেসব কিছু না শুনে কৃষ্ণকলির কথা জিজ্ঞাসা করলাম,অবস্থা স্থিতিশীল শুনেআস্বস্ত হলাম৷নাতীর জন্মদাত্রীর পরিচর্যা করে মা ও বউদি অসুস্থ কৃষ্ণকলিকে  ধীরে ধীরে  সুস্থ করে তুললো৷মা তখন অন্য জগতের মানুষ, বউমা বলতে অজ্ঞান৷মা একদিনবললেন কালী নামের বদলে একটা ভালো নাম রাখতো বাবু বউমার৷আমিও সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণকলি রাখো বলে দিলাম৷ সেই থেকে ওর নাম হলো কৃষ্ণকলি৷৷
 
ছেলের জন্মের দু-মাসের মাথায় ইংল্যান্ড থেকে ডাক পাঠালো ওখানকার নামি হাসপাতালের তরফ থেকে৷ ফর্মালিটিটা আগেই সারা ছিল,বন্ড সই করে ফেলেছিলাম পাঁচ বছরেরজন্য৷যে আমি একদিন এর থেকে কোনোভাবে পালাতে চেয়েছিলাম৷সেই আমি যখন লেটারটা হাতে পেলাম হতাশা ঘিরে ধরলো৷বুঝলাম এটা আমার পাপের শাস্তি,অবহেলা করারফল৷সদ্যজাত ছেলে আর সদ্য প্রেমিকা হওয়া বউকে ছেড়ে যাওয়া আমার কাছে নির্বাসন ছাড়া আর কিছুনা৷৷সেদিন বুঝেছিলাম কৃষ্ণকলি কতটা পাথর চেপে রেখেছিল নিজেরমনের মধ্যে৷পাঁচ বছর পর ফিরে এলাম দেশে৷ছেলেও তখন পাঁচ বছরের৷ ছোট বয়সটা ‘ওর’ কাছ থেকে দেখা  থেকে বঞ্চিত থেকে গেলাম বলে আবার প্রানের ঝুঁকি নিয়ে দ্বিতীয়বার কন্যা সন্তানের জননী হয়ে আমার সে আশাও পূরন করলো কৃষ্ণকলি৷আমার কৃষ্ণকলি রত্ন গর্ভা৷ছেলে-মেয়ে দুজনেই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তার৷বিবাহ সূত্রে মেয়ে কানাডায়বসবাস করছে৷জামাইও ডাক্তার৷ছেলে-বউমা দুজনেই বিদেশের ডিগ্রিধারী ডাক্তার৷ছেলে বউমা দুজনেই কলকাতার প্রতিষ্ঠিত সরকারী হাসপাতালের নাম করা ডাক্তার হয়েও প্র-পিতামহের বানানো দাতব্য চিকিৎসালয় কে ভোলেনি৷সপ্তাহে দুদিন আর্তদের চিকিৎসায় নিজেদের ব্রতী করেছে৷বাকী দিন গুলো আমি আগের মতই অসহায় মানুষগুলোর সেবাইনিযুক্ত থাকি৷৷আগের মত যদিও আর শরীরে তেমন যুত পাইনা,তাও চেষ্টা চালিয়ে যায়৷ মন ভালো রাখতে আমরা বুড়ো বুড়ি বছরে একবার মেয়ের কাছে ঘুরে আসতাম৷দুবছরধরে এখন ওরা আসে বছর অন্তর দেখা করতে৷ছেলের একটি কন্যা সন্তান,মেয়ের একটি পুত্রসন্তান৷ এই হলো কৃষ্ণকলি আর আমার ভরা সংসারের ইতিবৃত্ত৷৷

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২