ইরিনা – পৌষালী সেনগুপ্ত

ইরিনা – পৌষালী সেনগুপ্ত

শেয়ার করুন

সময়টা নরম, মেদুর এক ঋতু। ঠিক শীতের শুরু আর হালকা – মাঝারি গ্রীষ্ম পেরোনো, মধ্য আমেরিকা। চারদিক কর্মব্যস্ত যথেষ্ট — তা সে কর্পোরেট অফিস জগৎ হোক কি অন্যান্য তিন, চার শিফটের কাজের দুনিয়া। বা, বাচ্চা কাচ্চাদের নিয়ে আরও ব্যস্ততম কোন মা এর পৃথিবী!
এইসবের মধ্যে, একদমই রোমাঞ্চকর এক হলিউড মুভির মতোই —- হাহাহা!!, এইটুকু ভেবেই, রু ফেরত এলো তার ভাবনার জগৎ থেকে —- সময় কম।
” রু! ” ওরফে রুদ্রাণী লোরিন মান্ডভা। তবে, ছোট্ট করে ওই, ” রু “! হিসেবেই পরিচিতি … আলাপীদের কাছে। এতবড়ো নাম কার বলার সময় বা দরকার! এই ব্যস্ত গতিময় জীবনে … মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে এসেই, মিলিয়ে যায় …
তোহ্, সেই রু — আস্তে করে বিছানা থেকে বারান্দায় উঠে গিয়ে আয়েশ করে বেনসন & হেজেসটা ধরালো। Post – coital আমেজটা ও এভাবেই উপভোগ করতে ভালোবাসে। বেশ অনেকক্ষণ আরও ফুরফুরে, ফুর্তির মেজাজে থাকা যায়। সিড এর অবশ্য সে স্বভাব নয়। সোজা ঘুমিয়ে পড়বে। ও কিছু মনেও করেনা, রু। ঘুমোতে দেয়। এই স্তব্ধতা, নৈঃশব্দ্য …. এই মুহূর্তগুলো ওর জন্য অসম্ভব জরুরী, প্রিয়….
বহির্বিশ্বের সমস্ত রকম প্যাঁচকে সামলানোর জন্য এই ব্রেক গুলো ওর খুব কাজে লাগে …
…..
সিড, ঘুমের মধ্যেইই হাসছে।
লোকে বলে — ঘুমের মধ্যে নাকি নানান জায়গায় বেড়াতে যায়, আত্মা! কে জানে, স্বপ্ন গুলো তোহ্ কত সত্যিই লাগে! তবে … তৃপ্তি করে ঘুমোলেও, হাসিমুখে ঘুমোয় মানুষ । রু … বেশ কিছুক্ষণ মায়াভরা দৃষ্টিতে দেখে ওর এই রুপটা। বড্ড ভালো, ছেলেটা। আজকালকার দিনের হিসেবে সত্যি, ভালো। তবে …
———————————————————-
নিরিবিলি একটা পাড়া।
অপেক্ষাকৃত, নিরিবিলি। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। মধ্য আমেরিকার ছোট্ট শহরের আশপাশে একটু খুঁজলেই এরকম নির্জন পাড়ায়, সপ্তাহান্তে ছুটি কাটা‌নোর ছোট ছোট বাড়ি, ” কটেজ ” ভাড়া পাওয়া যায়। রু আর সিড, এই ব্যবস্থা নিয়ে খুশি দুজনেই। তুমুল ব্যস্ত কর্মজীবন দুজনেরই! তার মধ্যে আদ্যোপান্ত মাখোমাখো, নরম প্রেমকাহিনী চালানোর মন, সময় ও মানসিকতা — এগুলো কোনটাই ওদের ছিলোনা। কারুরই সময় ঠিক অত নেই, এখানে। কাজের সূত্রে যে পরিচয়, কিছুদিনের মধ্যে তা, ” বিশেষ সুবিধা যুক্ত বন্ধুত্বে ” পাল্টে যেতে সময় নেয়নি … তারই ফলশ্রুতি, এই ব্যবস্থাপনা।যার যার ছুটির দিন মিলিয়ে, টুক করে ঘুরে যাওয়া। পুরোপুরি যান্ত্রিক সময়ের মধ্যে, একটু উষ্ণতা খুঁজে নেওয়া ….
ঘুমের মধ্যে এগুলো ভেবেই, সিড এর মুখময় হাসি ছড়াচ্ছিল। আরও একটা ব্যপার — এই ট্যুর থেকে ফিরেই ওর প্ল্যান এবার, রু – কে পাকাপাকিভাবে নিজের করার। এই শখ ওর দৃঢ় ইচ্ছেয় বদলে যেতে বেশিদিন লাগেনি, ওদের পরিচিতির পর। রু, এটা অবশ্য কিচ্ছু জানেনা।
একবার আড়মোড়া ভেঙ্গে, সিড পাশ ফিরে শুলো। ঘুমন্ত অবস্থায়ও অনেক চিন্তা চলছে মাথায়। সবদিক দিয়ে পচ্ছন্দসই এই মেয়েকেই সে তার জীবনসঙ্গীনী বানাবে, ঠিক করে ফেলেছে। শুধু ওকে জানানোর অপেক্ষা। মনে হয়না ও আপত্তি করবে …..
এই কটেজটা, দুজনেরই পচ্ছন্দ। অবশ্য, কারণ গুলো আলাদা আলাদা, সেটা দুজনের কেউই জানেনা।
বাসাটার সামনে একফালি ফুলবাগান। তাতে কিছু মরশুমি ফুল বাহারি ভাবে সেজে আছে। এসব বাসাবাড়ি, দেখাশোনা করা হয়, বোঝাই যাচ্ছে। বারান্দার হালকা, শীতের শুরুর রোদ খেতে খেতে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়, রু। আলতো পায়ে লাস্যের বিভঙ্গ ছড়িয়ে বিস্রস্ত বিছানায় ফেরত যায়… দ্রুত কাজ সারতে হবে, ফেরার তাড়া আছে। হিথরো এয়ারপোর্ট পৌঁছতেই হবে পরশুর মধ্যে, বাকি দৌড় সেখান থেকে। কোথাও দেরি হলে, সব একসাথে ধ্বসে যাবে ….
——————————————————————–
এরমধ্যে —
টুঁ টুঁ টুঁ …
আজব? আজব তোহ্! রু … রু এলার্ম দিয়েছে? এই ছুটির মধ্যেও? আর, তাহলে বন্ধই বা করছেনা কেন?! উফফ্ … একরাশ বিরক্তি নিয়ে পাশ ফেরে সিড। ওরফে শুভম। শুভম বোস। ইন্টারন্যাশনাল হর্টিকালচার ফোরামের একান্ত ভাবে বাধ্য ও নিয়োজিত সদস্য। যাকে বছরের বেশিরভাগ সময় আমেরিকার প্রত্যন্ত কিছু অঞ্চলে ঘুরতে হয়। ও বাকি সময় … অন্যান্য দেশ…
কাজ নিয়ে অবশ্য ওর কোনও খুঁতখুঁতে ভাব নেই, বা ছুঁৎমার্গও নেই। এই লাইনের পড়াশোনা যথেষ্ট নিজের ইচ্ছে এবং শখে করেছে ও এবং আশানুরূপ চাকরিও পেয়েছে, যার সূত্রে জীবন, এই মধ্য ত্রিশের সময়ও ভালো। বেশ ভালোই বলা চলে — আর্থিক ও মানসিক ভাবে। এখন ওই .. এই রুদ্রাণীকে নিয়ে থিতু হবার ইচ্ছেটা ঠিকমতো কার্যকর করতে পারলেই হলো … ওর বাড়ি বা পরিবারের কেউই আপত্তি করবেনা সেটা নিয়ে ও শিওর। থাকার মধ্যে এখন আছে তোহ্ বৃদ্ধা মা আর বড়দা। তা, মা সদ্য গোখলে থেকে অবসর নিলে কি হবে — সেই জগৎ আর তাঁর সাংস্কৃতিক জগতের বাইরে বেশি কিছু নিয়াই মাথা ঘামানোর সময় তাঁর নেই। বড়দা, বৌদি তোহ্ কবে থেকেই মুম্বইয়ে ….
আর, এখানে চাকরি জীবনের সূত্রে এক কলিগ, মিজ — জামাইকান হবে, সেই একমাত্র ঘনিষ্ঠ মানুষ ওর। যে খেয়াল করে ওর ব্যপারে, যান্ত্রিক ব্যবহার বিনিময় ছাড়া …….
রু, অর্থাৎ রুদ্রাণীর সাথে ওর আ্যপার্টমেন্টের রাস্তার মোড়ের ক্যাফেটেরিয়া কাম রেস্তোরাঁয় আলাপ। পরে দেখা যায়, বাসা কাছাকাছি শুধু নয়, একটা জায়গায় কাজের সূত্রে তাদের অফিসিয়াল জগতেও মেলামেশার ব্যপার এসে পড়ছে … রুদ্রাণী, পাঞ্জাবী – ভিয়েতনামিস, মিক্সড।ওই অল্প ভারতীয় পিতৃত্বের সূত্রে, আলাপ আরেক লেভেল টপকায় এবং তারপর আর যে কোনও মিলেনিয়াল হলিউড মুভির মতোই এগোয়।শুধু, রোম্যান্স ব্যপারটা বাদ দিয়ে। এই যা!
এই যে ওরা সময় পেলেই লংড্রাইভ করে এরকম মাঝদুপুর একটা জায়গায় চলে আসে, বিয়ার ক্রেট আর সিগারেট বাক্সময় জীবন … কোনও নিয়ম বাধা নেই কিছু সময় — সিড জানে, এটা ওরা দুজনই খুব পচ্ছন্দ করে! কাল, কি হবে .. কোথায় কে যাবে, থাকবে … এতকিছু নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কিই বা হয়, হবে?! এটা ওরা ভালোই বোঝে। এই তোহ্ সেদিন এভিচি, টুক করে কেটে পড়লো, চেস্টার বেনিংটনও … এরকম প্রতিনিয়ত সারা পৃথিবীর কেউ না কেউ, কোনও না কোনও কোণে, শেষ হচ্ছে! এই অনিত্য পৃথিবীতে, একটু সুখ — আর কি চাই!
উমম… এটা ভাবতেই বিরক্তি সরে হাসি ছড়িয়ে গেলো ওর পুরো মুখে আর … আর কি, কাম? হবে হয়তো। এই মেয়েটা ওকে কিরকম পাগল করে দেয়, সিড দেখেছে! আগেও নারী সংসর্গে ও এসেছে, কিন্তু এর লাস্য, শরীর, মনন, চোখ — সব যেন কেমন টানে …পুরোনো দিনের সেই রানী ক্লিয়োপেট্রার মতো …
ভাবতে ভাবতে পাশে হাত বাড়ালো সিড। এখনই চাই, রু কে। তুমুল, উন্মত্ত, আদিমভাবে চাই ওর ….. আবছা, আলতো আদরে না আটকে এখন আগ্রাসী ভাবে উপভোগ করবে ও, সেজন্যই না আসা এতদূর! আহ্!
——————————————————————-
….
চ্যাটচ্যাটে, আঠালো।
হাত ভর্তি। কিছু, চুল …দু গাছি। মাথা ব্যাথা — অসম্ভব! চোখ খোলা যাচ্ছে না। ফোলা, ফোলা।ধ্বস্ত, বিধ্বস্ত শরীর। সেরকমই সিগন্যাল দিচ্ছে, ব্রেন।আহ্ .. এটা .. কিহ্!? বিছানায়? হ্যাঁ, তাই তো লাগছে! উফফ …. তাহলে, মাথা? চোখ? হাত পা!? রু!? —- রু কই!? দুম করে মাথাটা জ্বলে উঠলো সিড এর, হুড়মুড়িয়ে চিন্তাধারার ধাক্কায়, তারপর .. তারপর ——
” সিড,
সিড ….!!!!! ”
বহুদূর থেকে, তুমুল উদ্বিগ্ন মিজ -এর গলা শুনতে পেলো, সিড ওরফে শুভম। মিজ, ওর কাজের পার্টনার অফিসের,একমাত্র বান্ধব এই শূন্য পুরীতে … তারপরই টোটাল ব্ল্যাকআউট।
—” আমরা দুঃখিত, উনি আর নেই। “,
মাস্যাচুসেটস এর সরকারী হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার, তার বক্তব্য জানিয়ে, নার্সকে করণীয় সব বলে, বেরিয়ে গেলেন।
মিজ, এবং তার সাথে থাকা আরেকজন, হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই, তৎক্ষণাৎ করতে পারলোনা …. পুলিশ অফিসার রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করতে এগিয়ে এলেন …. মিজ তখনও হতভম্ব, বাড়িতে খবর দেওয়ার কথাও তখন মাথায় আর নেই …
—————————————————————————————————————————————-
প্যারিসের একটা রাস্তার ধারের কফিশপ। বিস্ট্রো! এই কর্নারের বিস্ট্রো টা ওর খুব পচ্ছন্দের। বছরে একবার তোহ্ এদিকে চক্কর ও কেটেই যায় ঠিক!
চোখে রোদচশমা, হাওয়ায় ওড়া চুল। ধোঁয়া ওড়া কফির কাপ, ক্রসোঁর প্লেট নিয়ে এসবই ভাবছিলো —- কে?!
——— পাশ দিয়ে হুশ করে সাইক্লিস্টদের আসা যাওয়া। সবুজ স্কার্ফ জড়ানো, মিষ্টি, মিষ্টি একটা মেয়ে।অসম্ভব সুন্দর ভাবে, পরিপাটি জামাকাপড় পরিহিতা —- নন্দিনী। কেউ একজন।
সামনের টেবিলে একটা মরোক্কো লেদার বাউন্ডেড ডায়রি, খোলা।তাতে লেখা —
————————-
————————-
#Case_Details :
Sl.No.69 —
Origin — Indian.
Net value — 25Mil ( estimated )
Time spent — 6 months ( a bit above average )
Mode of Action — Blunt -force Trauma ; Fatal Head-injury.
Mission Status — Accomplished.

Signing – off : ইরিনা। ইরিনা জুকোবোভিচ ।
—————————-
—————————-
আনমনেই নিজের হালকা বাদামী, ঘন , ঝলমলে চুলে হাত বুলিয়ে, ও হাসলো।
ছেলেটা, ভালো ছিলো। তাই সময় একটু বেশি নিলো।
ভালো, তবে থ্রিল আর পয়সার থেকে কোনও পুরুষমানুষ বেশি ভালো আর কবে হয়েছে!

রোদচশমার আড়ালে, দু ফোঁটা চোখের জল, হাওয়া হয়ে গেলো আর, মুচকি হাসিটাই সবার চোখে ধরা পড়লো, শেষ অবধি!
নাহ্, উঠতে হবে! নিকারাগুয়ার ফ্লাইট আর কিছুক্ষণের মধ্যেই! ওখানের অভ্যন্তরীণ দ্বীপের ক্রাউন প্রিন্স অপেক্ষা করছেন তার নতুন দোভাষী ম্যাডামের ( ও অলিখিত শয্যাসঙ্গীনীর) , অধীর আগ্রহে!
ডায়েরির নতুন পাতায় ততক্ষণে লেখা হয়ে গেছে :—
#Case_Details :
Sl. No.70 —–
Possible Mode of Action — Slow Poisoning ( Laburnum )


[ চিত্রাঙ্কন : মৌমিতা ভট্টাচার্য্য ]

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২