শঙ্খবেলা – মঈনুল হাসান

শেয়ার করুন

শস্যশূন্য খাঁ খাঁ মাঠের ভেতর থেকে ছন্দের মতো একটা আওয়াজ ওঠে ঝিকঝিক… ঝিকঝিক… পোঁওওও…। আদিম গিরগিটির মতো বুকে হেঁটে কাছের ইস্টিশনের দিকে গড়গড়িয়ে যায় বিকেল পাঁচটার শুকসারি এক্সপ্রেস। ঝিকঝিক সে আওয়াজের সাথে মিশে গিয়ে কালের দীঘলজুড়ে লেগে থাকা বিকেলের পড়ন্ত শেষ আলো ততক্ষণে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ে দিগন্তে; যেখানে ফিরোজা আকাশের সাথে আধোলাল আভা মেলে ধরেছে মোহনীয় এক মায়াবী ইন্দ্রজালের সুখ। সে সুখে সমস্ত দিনের ক্লেদ-ক্লান্তি মুছে যায়, ঘুচে যায় দিনের অপেক্ষা আর চারদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে বহুরূপী সন্ধ্যার রঙ। সে রঙের ফাঁক গলে একটা লজঝড়ে ছন্দহীন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গোঙানির মতো গোঁ গোঁ শব্দ তুলে অভিরূপকে নিয়ে এগিয়ে যায় ইস্টিশনের দিকে। গ্রামীণ সৌন্দর্যের অনিঃশেষ ঘোরের মধ্যে ডুবে থেকে সবকিছু উপভোগ করতে করতে সন্ধ্যার সীমানার কাছে ডুবে যাচ্ছিল সে।
ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আলো দেখে অভিরূপের মনে হলো, চারদিকটা আজ দারুণ ব্যঞ্জনাময়। একেবারে রঙের আখরে মোড়া। পৃথিবীজুড়ে এ ছন্দ-সুর আর রঙ-ছবির মায়াখেলা তাকে বিহ্বল করে তুললেও ফেলে আসা অসম্পূর্ণ কাজের লম্বা ফিরিস্তি মনের ভেতর শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ালে সব কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। মুহূর্তে অভিরূপ শহরে ফিরে যাবার জন্যে আরেকবার ভীষণ তাড়া অনুভব করল মনে। যে করেই হোক ফিরতে হবে আজ, ট্রেনটা বুঝি তাকে রেখেই চলে গেল শেষে।
সন্ধ্যাটা পুরোপুরি নেমে আসেনি ইস্টিশনের গায়ে। কেবল বড় বড় গাছগুলোর শাখা-প্রশাখায় এলোপাথাড়ি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছিল একঘেঁয়ে ক্লান্তির মতো। ওদিকে লম্বা শরীর নিয়ে ছুটে আসা রেলগাড়িটার মধ্যেও তেমন কোনো তাড়া ছিল না। ঠিক যেমনি অভিরূপের মধ্যেও ছিল না মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও। ইচ্ছে ছিল আরও দু একদিন যাদুনগরের পথে-প্রান্তরে হেসেখেলে কাটিয়ে লেখালেখির বেশ কিছু রসদ সাথে করে নিয়ে যাওয়ার। ওটাই ছিল তার ভেতরের অদম্য আকাঙ্খা। তাছাড়া লেখকমাত্রেরই অমন বাসনা হয়। আর আতিথেয়তা? আসলে যারা তাকে সম্মাননা প্রদানের জন্যে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, বরণ করে নিয়েছিল নিজের মানুষরূপে; তাদের কাঁধেই কি বর্তায় না বা তাদেরই কি গুরুদায়িত্ব নয়?
‘সুর ও বাণী সাহিত্য সংসদ’ এর এমন হুলুস্থুল আয়োজন আগে কেউ দেখেনি। পাঁচ বছর আগে সংগঠনটি যখন ঢিমে তালে যাত্রা শুরু করেছিল তখন সদস্যদের নিয়ে অনাড়ম্বরে পরিচিতিমূলক একটা অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল একেবারে সাদামাটা গোছের; তাও বোধহয় সাহিত্য একাডেমীর নিজস্ব চত্বরে মাসিক আড্ডার ঘরোয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানে নিজেদের মধ্যে ওই ছোলামুড়ি, ডালপিঁয়াজু খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত। তবে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিশেষে বর্ধিত কলেবরের এ আয়োজন সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য বাড়িয়েছে। চার-রঙা দাওয়াতপত্র ছাপানো, বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের সম্মাননা জানানো, ভোজনের লম্বা ফর্দ তৈরিসহ কোনো কিছুতেই আয়োজকদের উৎসাহের কমতি ছিল না। প্রথম থেকেই অভিরূপ খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছে বিষয়গুলো এবং তাদের এ আপ্রাণ প্রচেষ্টা তাকে দারুণভাবে মুগ্ধও করেছে।
অভিরূপের সাথে ‘সুর ও বাণী সাহিত্য সংসদ’ এর দুজন ছেলে ইস্টিশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে। এদের মধ্যে পাঞ্জাবীপরা ছেলেটা যে তাকে সারাক্ষণ ছায়ার মতো আগলে রেখেছে তার জোরাজুরিতেই মূলত এই সাহিত্য আয়োজনের অনুষ্ঠানে আসা। ছেলেটির কথাবার্তা, আদবকেতাসহ সবকিছুতে দারুণ এক সম্মোহনী ব্যাপার রয়েছে। অভিরূপকে ঠিক খুঁজে খুঁজে তার সম্মতি আদায় করে যখন দাওয়াতপত্র হাতে দিয়ে বলল, ‘দাদা আসবেন তো? আমরা কিন্তু আপনাকেই গভীরভাবে চাইছি এবং আমাদের মূল উদ্বোধকও আপনি’। তখন আর অভিরূপের ‘না’ বলার শক্তি থাকে না। হাস্যোজ্জ্বল মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভেতরের সমস্ত বিহ্বলতা লুকিয়ে চোখের তারায় যথাসম্ভব বিনয় এনে শেষে তাকেও বলতে হয় ‘নিশ্চয় আসব’।
ছেলেটার পরনে সেদিনও ছিল গাঢ় নীল রঙের একটা পাঞ্জাবী; সপ্রতিভ কণ্ঠে বলেছিল, ‘দাদা, এবার আমাদের সবকিছু আলাদা। বিপুল আয়োজনে আড়ম্বরপূর্ণ হতে যাচ্ছে পুরো অনুষ্ঠান। চার রঙের দাওয়াতপত্র ছাপিয়ে স্থানীয় সাহিত্যসেবী সংগঠনের সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি।-বাহ, তবে তো বিশাল আয়োজন মনে হচ্ছে।-চেষ্টা করছি দাদা। তবে এবার স্থানীয় আর জাতীয় পর্যায় থেকে কমপক্ষে দুজনকে সম্মাননা দেয়ার ইচ্ছা আছে। রফিক ভাই বিষয়টা নিজের মতো করে দেখছেন।রফিক নামটা শুনে অভিরূপের চোখ দুটো সরু হয়ে আসে। রফিক মানে কবি রফিক ইমতিয়াজ নয় তো? তারপর বলল, তুমি তবে আয়োজকদের কেউ নও?রফিক ভাই আমাকে পাঠিয়েছে যে করেই হোক আপনার সম্মতি আদায়ের। তারপর যাবতীয় বৃত্তান্ত শুনে অভিরূপের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় আর ঠিক তখনই মনস্থির করে ফেলে যাদুনগরের সাহিত্য আয়োজনে যোগ দেয়ার; যেখানে তার জন্যে অনেককিছুই অপেক্ষা করছে। রফিক ইমতিয়াজ তার সতীর্থ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। যাদুনগরে আছে, কী সব টুকটাক কাজ করছে এমনটাই জানতো। বাকীটা এ দাওয়াতপত্রধারী ছেলেটার কাছ থেকে শুনে আরও স্পষ্ট হলো। অতএব স্থির সম্মতি দিয়ে এ যাদুনগরের আতিথ্য গ্রহণ করাটা একটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যায় অভিরূপের।
অভিরূপ চক্রবর্তী হালের বেশ উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিশীল একজন কথাশিল্পী এমনটা অনেকে বিশ্বাস করে। তাকে নিয়ে চারপাশে ছড়ানো প্রশস্তিসূচক বিশেষণগুলোর মানে সে খুব একটা গায়ে মাখতে আগ্রহী নয়। কয়েক বছর ধরেই লেখালেখির জগতে পাকাপোক্ত আসন করে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল সে। জীবিকার জন্যে আপাতত মানানসই কাজের সুবন্দোবস্ত রয়েছে, তাই জীবনের তাড়নায় কলমচারী হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়। জীবন সারাক্ষণ এক আশ্চর্য মায়াপ্রহর হয়ে ধরা দেয় তার কাছে; সে প্রহরে যাদুকাঠির মতো কলম নেড়েচেড়ে দেখে কোনো ঐন্দ্রজালিক মহাকাব্যের সৃষ্টি হয় কিনা? অলৌকিক কথার যাদুতে নিজেকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে মাঝে মাঝে প্রিয়তম মানুষের সান্নিধ্যও ভুলে যায় অভিরূপ।
লেখালেখির সূত্র ধরে এই নাতিদীর্ঘ জীবনে কত মানুষের সাথেই তো আলাপ-পরিচয় হলো তার। কতজনকেই আর ধরে রাখা গেছে! শহরতলীর সাহিত্য অঙ্গনের সাথে সেই ছাত্র জীবনেই তার বেশ যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীতে রফিকের মাধ্যমে মফস্বলের ছোট কাগজগুলোর সাহিত্যের সাথে আরও নিবিড় পরিচয় ঘটলে তা আরও প্রাণ খুঁজে পায়। কিন্তু, সে সম্পর্ক যোগাযোগের অভাবে কিছুটা ধূসর হয়ে পড়ে অভিরূপেরই কারণে। অথচ এখন? অনেকগুলো বছর পরে অভিরূপের মর্যাদা বৃদ্ধি কিংবা প্রতিষ্ঠার মুকুটে আরেকটি অনন্য পালক গুঁজে দিতে মফস্বলের সেই রফিকই আবার তাকে খুঁজে বের করে এভাবে ঋণী করে দিল। যাদুনগরের স্থানীয় কোন একজন কবির সাথে সেও নাকি পেতে যাচ্ছে প্রথম সম্মাননা। কথাটা শুনে নিজের কাছেই খুব বিস্ময় লেগেছিল অভিরূপের।
প্রথমে এখানে এসে ‘সুর ও বাণী সাহিত্য সংসদ’ নামটা শুনে একবার মনে হয়েছিল, নামটার মধ্যে শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চার কোনো ব্যাপার-ট্যাপার জড়িয়ে আছে হয়তো। পরে অবশ্য সংগঠনের আদ্যোপান্ত জেনে নামটা যথার্থই মনে হয়েছিল তার। আর সবশেষে সম্মাননা গ্রহণ করে নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের মতো, ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়াছিলে’; ভালোবাসার ঠিক সেরকম এক চনমনে সুতীব্র আবেশ সমগ্র হৃদয়জুড়ে ছড়িয়ে ছিল অভিরূপের। উন্মোচিত এ নতুন অধ্যায়ের কারণে মনে মনে গভীর কৃতজ্ঞতা জানায় বন্ধু রফিকের কাছে।
অভিরূপকে এগিয়ে দিতে ইস্টিশনে এসে তার মনের অস্থিরতা টের পেয়ে অল্পবয়সী ছেলেটা এবার মুখ খোলে। দাদা, এত অস্থির হবেন না। শুকসারি ইস্টিশনে রেলগাড়িটা অনেকক্ষণ থামে। এদিককার সবচেয়ে বড় ইস্টিশন এটি। এখান থেকে অল্প কিছু দূরে যে সরকারি কলেজ আছে ওখানে দূরদূরান্তের অনেক ছাত্র আসে। বিশেষ করে কাছের শামুকসর, থানগাঁও, শোলাকান্দি এমন আরও অনেক গ্রাম… যারা দিনশেষে ফিরে যায়…
ছেলেটার কথাগুলো অভিরূপের ঠিক কানে যায় না। ওর মনোযোগ মোটেও সেদিকে নেই। সে কেবল ভাবতে থাকে, আহা, কী সুন্দর নাম! ইস্টিশনের। শুকসারি। দারুণ প্রেমময় কাব্যিক নাম। অভিরূপ কবি নয়। তারপরও কান থেকে মাথা হয়ে হৃদয়ের কোথায় জানি রিনরিন করে বাজতেই থাকল চার অক্ষরের শব্দগুচ্ছ শুকসারি… শুক… সারি… শু…ক…সা…রি। কবি সাহিত্যিকদের ধর্মই আসলে তাই। যেখানেই যাবেন শব্দ খুঁজে বেড়াবেন অথবা কোনো গল্পের বীজ মাথায় বুনে নেবেন। সেসব কাহিনীগুলো যেমন অদৃশ্য কুহকের মতো হাওয়ায় উড়তে থাকে, ভাসতে থাকে; শব্দগুলোও নাকি চারদিকে অমনি ছড়ানো ছিটানো থাকে। শুধু কায়দা করে কৌশল বুঝে সেগুলো নিজ আয়ত্তে এনে আপন করে নেয়া। ব্যস, হয়ে যাবে নতুন কিছু সৃষ্টি। অভিরূপও ঠিক তেমন করে বসে ভাবছে।
পাঞ্জাবীপরা ছেলেটা এবার মুখ খুলল, ‘দাদা নামুন। আমরা এসে গেছি’। অভিরূপ দেখল, সত্যিই একটা খাপছাড়া ইস্টিশন। লম্বা প্লাটফর্মের শরীরজুড়ে সব কেমন যেন অবিন্যস্ত, যোগসূত্রহীন। মফস্বলের ইস্টিশন বুঝি এমনই হয়। তবু ট্রেন আর ইস্টিশনের নামের মাঝে এক আশ্চর্য সঙ্গতি ও মহাকাব্যিক ব্যাপার ছড়িয়ে থাকায় অভিরূপের ভালোই লাগে। নামের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে এবার সে বলে, তোমরা দুজনে খুব পরিশ্রম করেছ। রেলযাত্রা আমি বরাবরই বেশ উপভোগ করি। তোমরা না হলে এই এখন বাসে চেপে সারারাত ধরে ফেরাটা কষ্টকর হয়ে যেত। শহরে এলে যোগাযোগ করো।
আমরা আর কতটুকুই করলাম দাদা। পাঞ্জাবীপরা ছেলেটার চেহারায় একটা আপ্লুতভাব উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্লাটফর্মের ঝিমানো আলোতেও একটা কৃতজ্ঞ প্রশান্তির ছায়া টুকরো কাচের মতো ছড়িয়ে পড়লো অভিরূপের সামনে। আবার দেখা হবে দাদা…
ছেলেগুলোকে বিদায় জানিয়ে ইস্টিশনের বেঞ্চিতে অভিরূপ চক্রবর্তী বসে থাকে একা। জলপাইরঙা দীর্ঘদেহী রেলগাড়িটা হিসহিস করে তার দীর্ঘ গন্তব্যযাত্রার প্রস্তুতিপর্বের উদাত্ত গম্ভীর স্বর পৌঁছে দিতে চায় একবার। জনশূন্য প্লাটফর্ম ছেড়ে একটু একটু করে এগিয়ে যেতেই জানালার খোপ থেকে দৃষ্টির মায়া নিয়ে সবকিছু আরেকবার পরখ করে নেয় অভিরূপ। জীবনের এও এক বিচ্ছিন্ন মায়া, কুমকুম-আবীরের মতো রঙ ছড়িয়ে পরম আনন্দে রেখে গেল এখানে সে; ভালোবাসার টানে কাটানো কতগুলো রঙিন মুহূর্ত, রাগ-অনুরাগের কিছু যাদুর মতো প্রহর ফেলে গেল মফস্বলের এই যাদুনগরে।
দুই
যাদুনগরের মায়া কাটিয়ে অভিরূপ ফিরে এসেছে তার প্রাণের জায়গায়; নিজ কর্মশহরের দৈনন্দিন ব্যস্ত পরিমন্ডলে। বেশ কয়েক বছরে তার নামডাক ছড়িয়েছে ঈর্ষণীয়ভাবে একটু একটু করে। পেশায় পুরোদস্তুর একজন লেখক হয়ে এখন ওটাই তার জীবন। প্রথমদিকে লিখতে গিয়ে হঠাৎ একদিন সে আবিষ্কার করলো তার লেখালেখির দিগন্ত আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। চাই অনেক বড় পরিসর। আর তখনই হাঁটতে থাকলো কথাসাহিত্যের বহুরঙা পথ ধরে। এখন তো নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতা ছাড়াও তার লেখা ছাপা হচ্ছে নামকরা সব ছোট কাগজগুলোতে। তিনটে বই বেরিয়েছে এখনও পর্যন্ত। বেশ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই এ জগৎকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেছে সে। মাসে অন্তত দু’বার সাহিত্যের ঘরোয়া আড্ডাগুলোতে হাজির হচ্ছে নিজের ভাবনাগুলো সমসাময়িক লেখকদের কাছে তুলে ধরতে। মাঝে মাঝে দু-একটা ফরমাশ, বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ এমন বহুমুখী ঘটনা সবকিছু ছাপিয়ে ভেতরে ভেতরে তার লেখক সত্তাকে সুদৃঢ় করে ভবিষ্যৎ স্বপ্নকে তুঙ্গে তুলে ধরছে।
বেশ অল্প সময়ের মধ্যে খুঁটিনাটি কিছু অর্জনও এল অভিরূপের জীবনে। মাত্র তিন বছরের মাথায় তরুণ সম্ভাবনাময় লেখকদের একটা সম্মাননা পেলো একেবারে জাতীয় পর্যায়ে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত স্বপ্নে বিভোর ছিল সে। আর এখন? লেখকদের যে কোনো আড্ডায় প্রতিশ্রুতিশীল চার-পাঁচজনের নাম এলে তার নামটি আগে উচ্চারিত হয়। সত্যিই, জীবনের এক দারুণ উপভোগ্য সময় পার করছে লেখক অভিরূপ চক্রবর্তী। অথচ, কী আশ্চর্য সে মোটেও সাহিত্যের ছাত্র ছিল না। শ্রাবণীর সাথে পরিচয় হবার পর থেকে তার জীবনে এ অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে গেল। জীবনের এ বাঁকবদল তার কাছে এখন সীমাহীন ঘোরের মতো লাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসনের ছাত্র ছিল অভিরূপ। প্রথমদিকে বিভাগের কয়েকজন বড় ভাইকে ধরে হলের দমবন্ধ পরিবেশে জায়গা করে নিলেও সত্যিকার অর্থে ওখানে তার মন টিকতো না। ওর চিন্তা-রুচি-পছন্দ সবকিছুই ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা, যা ঠিক সবার সাথে মানানসই ছিল না। লোক প্রশাসনের জটিল সব থিওরি আর টিউটোরিয়াল ক্লাশের বাইরে মনটা পড়ে থাকতো সংস্কৃতি আর নাটকের ভিন্ন এক অন্দরমহলের ভেতরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠোনে পা দিয়েই অভিরূপ বুঝে গিয়েছিল ওর ঝোঁক আসলে কোনদিকে। পড়ালেখায় বিষয় নির্বাচনটাও ভুল হয়ে গেল কিনা এ ভাবনাতেই কেটে গেল কয়েক মাস। আর এভাবেই একদিন আবৃত্তির ‘কণ্ঠশীলনের’ ক্লাশে শ্রাবণীর সাথে পরিচয়। 
সমাজকর্মের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী শ্রাবণী সেন। অভিরূপকে একদিন চুপচাপ একা বসে থাকতে দেখে নিজে থেকেই এগিয়ে যায় সে। দু একটা কথা থেকে ধীরে ধীরে আলাপ-পরিচয়; একসময় সখ্য, বোঝাপড়া সবকিছু। তারপর ঘনিষ্ঠতার দু বছর না পেরোতেই হলের পরিবেশ ছেড়ে কাছের ভূূতের গলিতে একটা ছোট্ট মেস দেখে উঠে পড়েছিল অভিরূপ। একদম একা। একার আপাত গোছানো সংসারে শ্রাবণী অবশ্য পাশে থেকেই সাহস যুগিয়েছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
‘একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে’ জীবনের ঠিকুজিতে এমন কোনো স্থির লক্ষ্য ছিল কিনা কে জানে, প্রথম থেকেই অভিরূপের ধ্যান-জ্ঞান সে ইচ্ছাকে নিয়েই আবর্তিত হয়েছিল। একেবারে মেধাহীন না হলেও প্রথম দু বছরের চেষ্টা-প্রস্তুতি শেষ পর্যন্ত আর ধরে রাখতে পারেনি সে। আর ওদিকে শ্রাবণীর সাথে পরিচয় হবার পর সব কেমন যেন গুলিয়ে গেল। তারপরও অন্তত জীবনের পেশাগত লক্ষ্য ঠিক রেখে শহরতলীর খুব কাছের এক বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে আপাতত সন্তুষ্ট রয়েছে সে। আর ওদিকে শ্রাবণী? সমাজকর্মের অধ্যয়ন শেষে বিদেশী একটা এনজিওতে রাতদিন সময় দিয়ে যাচ্ছে সে। পাশাপাশি সংসারের প্রথম পাঠ নেয়ার প্রবল আগ্রহে অভিরূপকেও তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে অবিরাম।শ্রাবণীর সাথে সম্পর্কটা অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে একটা জায়গায় থিতু হতে পেরেছে। পারস্পরিক জানাশোনা বিস্তৃৃত হয়ে সম্পর্কে পরিপক্কতা এসেছে। তারা দুজনেই আসলে জানে, মানুষের চাহিদার কাছে কোনো কিছুই অনতিক্রম্য নয়। প্রবল প্রেমকে ছাপিয়ে যখন সম্পর্ক এগিয়ে চলে তখন শারীরবৃত্তীয় আদিম আনন্দও পেখম মেলে বসে। পুনরুত্থিত সে আনন্দকে তখন আর সংজ্ঞা মেনে দাবিয়ে রাখা যায় না। প্রেমের সাথেই তো কামের সম্পর্ক, আর এর স্বতঃস্ফূর্ততাকে অভিরূপ ও শ্রাবণী দুজনেই স্বাভাবিক গতি দিয়েছে। সহজপ্রাপ্য এ বস্তু অভিরূপের কাছে এখন আর আরাধ্য কোনো বিষয় নয়, বরং তা হয়েছে দৈনন্দিন অভ্যাসের এক হাতিয়ার।
‘অনুরাগ কুমকুম দিলে দেহে মনে, বুকে প্রেম কেন নাহি দিলে’… নজরুলের গানের সে কাতর আর্তির মতো অভিরূপ কি দিন দিন প্রেমহীন হয়ে উঠছে শ্রাবণীর প্রতি? আজকাল তার এমনটাই মনে হয় মাঝে মাঝে। অথচ তার নিজের ঘরে তারা একে অপরকে একান্তে পেয়ে একসাথে বিকেল-সন্ধ্যা কাটিয়েছে, এমনকি রাত্রি পর্যন্তও থেকেছে। রাতের নীরব অন্ধকারে শ্রাবণীর শরীরের গন্ধ গায়ে মেখে উল্লাসিত হয়েছে কখনও, আবার আলতো ছুঁয়ে দিয়ে হেলাভরে ঠেলেও দিয়েছে কোনোদিন। অভিরূপ বারবারই তার ইচ্ছাপূরণের পুতুল হিসেবে শ্রাবণীর সাথে খেলেছে আবার মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয়ে এমনও লক্ষ্য করেছে কামার্ত পুরুষের মতো রাতভর সে থরথর করে কাঁপেনি; আত্মদ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়নি কামনাহীন মন, নিজের অনিচ্ছার বিরুদ্ধেও ভ্রুকুটি আসেনি। বরং রাতশেষে শরীরী কামনার বাইরে প্রেমের কোমল অনুভূতিই স্বর্গীয় আলো ছড়িয়েছে।শ্রাবণীও ওদিকে সবকিছুতে সায় দিয়ে অভিরূপের ইচ্ছায় নিজেকে বিসর্জন দিয়ে খেয়ালি অন্ধকারে স্নান করেছে। কামকে বশ করে সুতীব্র প্রেমের ওমে অভিরূপের মনের সীমানা ছুঁতে চেয়েছে বারবার, ভালো করে বুঝতে চিনতে চেয়েছে অন্য এক মানুষকে। মন্ত্রবদ্ধ জীবনে দুজন মানুষের যা যা প্রয়োজন তার প্রায় সকল আস্বাদই দুজনের নেয়া হয়ে গেছে ততদিনে শুধু অগ্নিস্বাক্ষী করে সাত পাকে ঘোরাটাই বাকী ছিল শেষে।
শ্রাবণীর প্রতি ভালোবাসার আবেগ আগের মতো থাকলেও তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় এখন প্রেম-কাম সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এক অন্য ভাবনায় ডুবে গিয়েছে। অভিরূপের মনের এ বাঁক বদলের চেহারা শ্রাবণীকেও মাঝে মাঝে ভাবনায় ফেলে দেয়। কিন্তু, তারপরও অভিরূপ তার সমগ্র সত্ত্বা নিয়ে ছুটছে এক অনন্ত লক্ষ্যের দিকে। লেখক হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বর্ণচূড়ায় ওঠার হিসাব মেলাতে গিয়ে অন্তরের প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি নিয়ে লেগে পড়েছে দুষ্প্রাপ্য সে মোহের পেছনে, সবকিছুকে ছেড়ে, এমনকি শ্রাবণীকেও। স্বপ্নের সেই সুদূরতম সুন্দরতম হাতছানি, ভিন্নরকম এক প্রতিষ্ঠার আনন্দ ইশারা দিয়ে সারাক্ষণ তাকে বিভোর করে রাখে, কাতর করে রাখে। তিন
যাদুনগরের অনাড়ম্বর সেই সাহিত্য সম্মেলন থেকে ফিরে আসার পর শ্রাবণীর সাথে মানসিক দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে অভিরূপের; দেহের দূরত্ব তো বটেই। ওর সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিল ঠিক মনেও পড়ছে না। ফিরে এসেও কথা অনেক কমে গেছে। সত্যিকার অর্থে, অভিরূপ নিজেও এখন খুব একটা মন থেকে চাইছে না শ্রাবণীর সাথে দেখা হোক। যাক না এভাবে কদিন, বাকিটা পরে দেখা যাবে।
অনেক সময় মানুষের লালিত চাহিদার সোপান নিয়মহীন বাঁধা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলে তার আপন গতিতে। অভিরূপের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হলো। বিকেলে মেস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় ছাত্রজীবনের কথা। ‘মাসলো’ না কার জানি ‘চাহিদা সোপান তত্ত্বে’র বিষয়ে পড়েছিল ও দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে ম্যানেজমেন্টের একটা পার্টে। যতদূর মনে পড়ে, জীবনের চাহিদার একেবারে নিম্নস্তর মানে জৈবিক চাহিদার মধ্যে এখনও অধিকাংশ মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে। এ আকাঙ্ক্ষাই যেন পূরণ হচ্ছে না সারাজীবন ধরে। ওদিকে মনুষ্যজীবনের সার্থকতাকে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে পূর্ণ করে তুলতে সেই সিঁড়ি বেয়ে আরও তো বহুদূর যেতে হবে। অভিরূপ এখন সেই লক্ষ্যের দিকেই হাঁটছে, ছুটছে। 
শহর ছেড়ে শহরতলীর কোনো এক অখ্যাত কলেজে পড়িয়ে আর যাই হোক অনিঃশেষ জৈবিক চাহিদা ডিঙিয়ে নিরাপত্তা বা সামাজিক চাহিদা পূর্ণ করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবনে একটি স্তরের অভাব পূরণ হবার সাথে সাথে সে কেবল পরবর্তী চাহিদার কথাই ভাবে আর তখনই সেটা দৃশ্যমান হয়ে দাঁড়ায়; এই তো তত্ত্বের মূল কথা। তবে কি প্রথম স্তর ছেড়ে এক লাফে চতুর্থ বা পঞ্চম স্তরে যাওয়া সম্ভব নয়? আদৌ কি তা সত্যি নাকি অসম্ভব কিছু? অথবা প্রতিটি মানুষের জীবনই কি এ তত্ত্বের গতি মেনে চলতে বাধ্য? বড় বড় তাত্ত্বিক, জ্ঞানী পন্ডিতরা তো জীবনের বাস্তবতার বাইরে গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠা করে যাননি। তবে কি অভিরূপ বিপরীত দিকে হাঁটছে? এসব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কয়েকদিন থেকে তাকে বেশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। 
চার
ইদানীং অভিরূপ একটা অসম্পূর্ণ নিবন্ধ লেখার কাজে আবারও মনোযোগ দিয়েছে। সম্মাননা গ্রহণশেষে দ্রুত ফেরত আসার কারণটাও তাই। ‘নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি’র ওপর লেখাটা শেষ করার তাগিদ পেয়ে মনে মনে এ নিয়ে কাটাকুটি খেলে সেদিন থেকেই মগজে সাজিয়ে নিচ্ছিল বিষয়টাকে। একটা দুর্দান্ত সৃষ্টির লোভে সেই বিকেল থেকে রাজধানীর জ্ঞান সমাবেশের অক্ষরসমুদ্রের ভেতরে ডুবে আছে অভিরূপ। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর বইয়ের ছড়াছড়ি থাকলেও খুব নির্দিষ্ট করে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার সংকট নিয়ে খুব কম লেখাই খুঁজে পেয়েছে সে। তবে জ্ঞান সমাবেশের ভেতরে অনেকক্ষণ কাটালে এমনিতেই মস্তিষ্কের বন্ধ দরজাসমূহ খুলে যায় আর বিচিত্র চিন্তার সমাবেশ ঘটতে থাকে মগজে। মফস্বলে যাবার আগেও সে এখানে টানা অনেক রাত পর্যন্ত বসে কাজ করেছিল। কারণ সে জানে যে একবার শহরের বাইরে গেলে তার চিন্তা আর লেখায় ভীষণ ছেদ পড়ে। সেই অজুহাতে রীতিমতো বইয়ের মধ্যেই ডুবে ছিল কয়েকটা দিন। কিন্তু, অভিরূপ কিছুই গোছাতে পারেনি। না সম্পর্ক, না জীবনের চাহিদা। শ্রাবণীর সাথে শুরু হওয়া মানসিক দূরত্বটা তখন থেকেই কাঁটার মতো বুকে বিঁধে আছে। একটা পরিণতির আখ্যা পেতে সেটাও অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছে সমান্তরালভাবে।
জ্ঞান সমাবেশের ভেতরে অনেক্ষণ কাটিয়ে অনেক কিছু ঘেঁঁটেও লেখালেখিতে ঠিক মনস্থির করতে পারে না অভিরূপ। একটা স্বাধীন বিহঙ্গের মতো উড়ে যেতে চায় এখন সে। অনেকদিন তো প্রেম করলো শ্রাবণীর সাথে। শ্রাবণী এখন অভিরূপের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে চায়; কিন্তু গৃহধর্মের জন্যে যে পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন তার প্রতি কেন জানি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সে। শুধু সংসার নামক একটা ছাতা খুঁজে তার নিচে দুজনের ঠাঁই নেয়ার বদলে সে এখন ঝুঁকছে তার আত্মপূর্ণতার দিকে। তাই তার কাছে এখন শ্রাবণীও মুখ্য নয়, বরং নিজেকে একজন সত্যিকারের লেখক হিসেবে পরিচিত করে তোলাই মূল উদ্দেশ্য।
মানুষ তো তার চারপাশের মধ্য থেকেই সামাজিক তত্ত্ব তৈরি করে, নিজের মতো আত্মস্থ করে আবার বহুল অর্জিত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তা ভেঙেও ফেলে। সভ্যতার এমন সহজ সত্যটাকে মাথা থেকে সহজে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারছে না কেন অভিরূপ? হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সেটা এগারোটার কাঁটা ছুঁয়েছে। একবার ভাবে, শ্রাবণীর কাছে ফিরে যাবে কিনা? দুজনের সমান্তরাল প্রয়োজন আবার এক রেখাতে মিশবে কিনা সেই অস্থিরতায় তড়িঘড়ি করে দোতলা থেকে বের হয়ে আসে অভিরূপ। বাইরে সড়কবাতির অপার্থিব হলুদ আলোয় পুরো শহরের ক্লান্ত শরীরটা কেমন দুলছে। জনসমাগম কমে এসেছে রাস্তায়। অভিরূপ উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে শুরু করে রাস্তার ফুটপাথ ধরে। একটা সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা একজন মানুষ জীবনের নতুন জয়গান গেয়ে বুক উঁচিয়ে রাস্তায় চলছে একা। তার চোখে পথ হারিয়ে ফেলার কোনো ভয় নেই, আছে শুধু অসমসাহসী দৃষ্টি। একসময় হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় তার বেঁচে থাকা আশ্রয়ের দিকে, অন্ধকার গলির পুরানো ঠিকানার দিকে। একটা ছোট্ট গুমটি ঘর যেখানে যতিচিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে একমুহূর্ত থেমে সিগারেট ধরায় অভিরূপ।
অদূরের অন্ধকার গলির দু ধারে দাঁড়িয়ে আছে সার সার অট্টালিকা, আর সাজানো গোছানো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কত অজানা মানুষ। তারই এক ফাঁক থেকে খুব সস্তা প্রসাধনে গা মুড়ে একটি অল্পবয়সী তরুণী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অভিরূপের দিকে। তরুণীটির চোখের তারায় যে মায়াজড়ানো অলীক জীবনের আকাঙ্ক্ষা লেখা থাকে তাতে দীর্ঘ কোনো কাব্য নয়, থাকে শুধু একটি রাত্রির আহ্বান। সেদিকে তাকিয়ে অভিরূপের আবার শ্রাবণীর কথা মনে পড়লে সারা শরীর গুলিয়ে আসে, মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। আকাশের দিকে ধোঁয়া ছুঁড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অভিরূপের মনে-মগজে তখন পেন্ডুলামের মতো একটি কথাই দুলতে থাকে; না, পৃথিবীতে কামটাই সব নয়। আত্মসুখ নিয়ে বেঁঁচে থাকার মতো আরও অনেক কিছুই অবশিষ্ট আছে এখনও। জীবনের চরিত্রগুলো যদিও সব বাস্তব, সেখানে অলৌকিক সুখে ডুবে যাবার মতো কিছু অনুষঙ্গ এখনও বর্তমান আছে। আর অমনি রাতের আলো ফুঁড়ে, ঝিরঝির হাওয়ার খোলস ছেড়ে অভিরূপের ঠোঁটে রোদনশঙ্খের মতো কার যেন বাণী বেজে ওঠে… নীলা, তুমি দীর্ণ প্রতিমাকে ঢেকে, ফের দাঁড়িয়েছো দেখি, রুগ্ন বাসনার পাশে… পিছুরেখা বরাবর চিরদিন যেখানে পৌঁছে যায় শাপ, আর এক ব্যথাহত সুর…
শহুরে কোলাহলের মতো কানের কাছেও গুনগুন করে বাজতে থাকে সেই পবিত্র শব্দগুচ্ছের মন্দ্র শুদ্ধ উচ্চারণ। একবার খুব করে মনে করার চেষ্টা করে সে; কার যেন কথাগুলো… কার যেন… কবি সৌম্য সালেক নাকি অন্য কারও…

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *