বিবিধ ভারতীয় ভাষার সুরে সলিল চৌধুরী – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
দেখতে দেখতে ৯৭ বছর অতিক্রান্ত। সলিল চৌধুরী জন্মশতবর্ষের দোরগোড়ায়। সলিল মানে গণসঙ্গীত, সলিল মানে শপথ, সলিল মানে তেভাগা, সলিল মানে উত্তাল চল্লিশের অসমাপ্ত বিপ্লব। আবার সলিল মানে ‘ঘড়ি ঘড়ি মোরা দিল ধরকে’, সলিল মানে ‘জানেমন জানেমন তেরে দো নয়ন’, সলিল মানে ‘ও আমার পদ্মপাতার দিন’…
সালটা ১৯৬১-১৯৬২। হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলেন একটি ফিল্ম বানাবেন, সেখানে সুর করাবেন সলিল চৌধুরীকে দিয়ে। দিদি লতা মঙ্গেশকরকে জানাতে তিনি একফোঁটাও আপত্তি করলেন না। উলটে সলিলকে প্রস্তাব দেওয়ার সময় জানালেন সলিলের সুরারোপিত তাঁর পছন্দের প্রিয় গানটি তিনি মাতৃভাষায় গাইতে চান, কারণ ফিল্মটি মারাঠি।
অতঃপর শুরু হল কাজ। তৈরি হল সুনবাই ফিল্ম। সেখানে রইল পাঁচটি গান। তারমধ্যে ১৯৬১ সালে বাংলায় প্রকাশিত মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের ‘এবার আমার সময় হল যে যাওয়ার’ গানটির লতা মঙ্গেশকরের মরাঠি ‘তুজা সহবা…’, ওই বছরেই (১৯৬২) পুজোয় বেরোনো সবিতা চৌধুরী ‘মনোবীণা এখনি বুঝি’-র সুরে লতাজিরই ‘পৃথিবী না…’ এবং বিষ্ণুপদ দাসের ‘মন ময়ূরপঙ্খী এখনই বুঝি’-র সুরে আশা ভোঁশলের ‘হলভ পালান মঞ্জুল’ ছাড়াও রইল ঠিক আগের বছর ১৯৬১ সালে প্রকাশিত লতাজির কিংবদন্তীতুল্য বাংলা গান ‘সাত ভাই চম্পা’-র মারাঠি লতাজিরই গাওয়া ‘প্রীতখুলে মাঝি সোনেরি সোনেরি’।
আক্ষরিক অর্থে সেই শুরু। বাংলা হিন্দি ছেড়ে সলিল পা রাখলেন অপরাপর ভারতীয় ভাষার গানের জগতে।
‘কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল
সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল
নিজের ছায়ার পিছে
ঘুরে ঘুরে মরি মিছে
একদিন চেয়ে দেখি আমি তুমি হারা…’
এক সলিল অনুরাগীর মতে ‘কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল’ অর্থাৎ দক্ষিণ ভারত (মূলত: কেরালা) সলিলকে আপ্যায়ন করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সেই কারণে ‘সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল’ অর্থাৎ বোম্বে ফিল্মে সুর করা একটু কমে গিয়েছিল (এখানে সূর্য মানে বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি)। অতঃপর ‘নিজের ছায়ার পিছে/ ঘুরে ঘুরে মরি মিছে’ অর্থাৎ নিজেরই পুরোনো গানের সুর বারবার ব্যবহার করে তিনি একদিন দেখলেন ‘আমি তুমি হারা’ অর্থাৎ বাংলায় অনেক দিন তেমন কোনও গান নেই।
যদিও এর কোনও সত্যতা আছে বলে আমার জানা নেই, কারণ নীল ধ্রুবতারা প্রকাশ পায় ১৯৬৯ সালে, ফলে ১৯৬৫-৬৯ কালপর্বে সলিল বাংলায় মাত্র একটি ফিল্ম (পাড়ি)-এ তিনটি গানে সুর দেন এটা ঠিকই এবং বোম্বেতে মাত্র ৪টে ফিল্মে ১৪টি গানে সুর দেন এও ঠিক। কিন্তু মালয়ালম্ ইন্ডাস্ট্রিতে ‘এঝুরাত্রিকাল’ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করেননি বরং বাংলা নন-ফিল্মি গানের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। সব মিলিয়ে ২৬টি গান।
যাই হোক ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হল ‘চেম্মিন’। থাকাজি শিবশংকর পিল্লাইয়ের উপন্যাসের থেকে তৈরি এই ফিল্মে সলিল সুর দিলেন। কান ও শিকাগো থেকে পুরস্কার ছাড়াও ফিল্মটি রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পায়। চারটি গান ছিল ফিল্মে। ‘কাদালিনাককারা’ গানটি গেয়েছিলেন যেসুদাস, পরে এটি বাংলায় (১৯৬৭) গান নির্মলেন্দু চৌধুরী (হায় হায় একি হেরিলাম), ‘মানিসে মাইনে ভারু’ গেয়েছিলেন মান্না দে, যেটা বাংলায় ১৯৭৯ সালে শ্রীকান্তের উইলে গেয়েছিলেন যেসুদাস ও সবিতা চৌধুরী (নাম শকুন্তলা তার), ‘পীনালে পীনালে’ গেয়েছিলেন যেসুদাস ও পি সুশীলা এবং ‘পুত্তানভাল্লক্কারে’ গেয়েছিলেন যেসুদাস, পি সুশীলা, কে পি উদায়ভানু ও পি শান্তা নাইয়ার। শেষোক্ত গানটি একটু অদ্ভুত। ১৯৬৫ সালেই পুজোয় সবিতা চৌধুরী গেয়েছিলেন ‘যারে যা আমার আশার কূল ভেসে যা’ যেটির হিন্দি ওই বছরেই ‘চান্দ অর সুরজ’ ফিল্মে আশা ভোঁসলে গেয়েছিলেন ‘বাগ মে কলি খিলি বগিয়া মেহকে’। আবার ওই বছরই প্রকাশিত ‘পুনম কি রাত’ ফিল্মের ‘সাথী রে তুঝবিন জিয়া উদাস’ গানের ইন্টারলিউডে এই সুরের ব্যবহার করেন সলিল। এই সুরের সঙ্গে আরও কিছু সুর যোগ করে মালয়ালম্ গানটি তৈরি হয়। এই অন্য সুরটি সলিল কবিতা ফিল্মে ব্যবহার করেন ‘শোনো শোনো শোনো গো সবে শোনো দিয়া মন’ (কিশোর কুমার)।
এরপরে ১৯৬৮ সালে ‘এঝুরাত্রিকাল’ যেখানে বাংলা ছবি ‘লাল পাথর’ এর শ্যামল মিত্রের ‘ডেকো না মোরে’ গানটির মালয়ালম্ ভার্সন ‘কাডারুমাসম’ (যেসুদাস) গানটি ছিল।
সলিলের মালয়ালম্-প্রীতি থেমে থাকেনি। ১৯৯৪ অবধি মোট ২৭টি ফিল্মে সুর করেন তিনি (চারটি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সহ)। বহু অবিস্মরণীয় বাংলা ও হিন্দি গানের সুর সেখানে ব্যবহার করেন যার মধ্যে ছিল গাঁয়ের বধূর মতো কাজ। এমনকি মালয়ালম্ ভাষায় নন-ফিল্মি কাজও করেন। সেখানেও ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘পা মা গা রে সা’, ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’ প্রভৃতি গানের মালয়ালি ভার্সন তৈরি হয়।
এছাড়াও সলিল চৌধুরী তামিল ভাষায় পাঁচটি (একটি ব্যাকগ্রাউন্ড সহ), তেলেগু ভাষায় দুটি, কন্নড় ভাষায় তিনটি, অসমীয়া ভাষায় দুটি, গুজরাটি, ওড়িয়া, মারাঠি ও ভোজপুরি ভাষায় একটি করে ফিল্মে সুর দেন। এছাড়াও অসমীয়া ভাষায় কিছু নন-ফিল্মি গান পাওয়া যায়, তবে প্রয়াত সলিল-বিশেষজ্ঞ রণবীর নিয়োগীর মতে ওই গানগুলি একটি তৈরি না হওয়া অজ্ঞাতনামা অসমীয়া ফিল্মের।
এইভাবেই আক্ষরিক অর্থে সারা ভারতের অংশ হয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। ৯৭তম জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।