এশিয়া ও আফ্রিকা: কাদের উপর নজর রাখবেন বিশ্বকাপে – সৌরাংশু
বিশ্বকাপ শুরুর আগে চটজলদি কিছু টিপস। ইউরোপের বড়ো লিগে খেলা খেলোয়াড়দের তো আমরা সকলেই জানি, কিন্তু তার বাইরে? এশিয়া বা আফ্রিকার কাদের উপর নজর রাখবেন? না সং হুয়ান মিন বা সাদিও মানের কথা বলছি না। মানে যা পায়ের চোট তাতে ওঁকে বিশ্বকাপে না খেলালেই সেনেগালের ভালো হবে। গতবারে যেমন মহম্মদ সালাহকে খেলাতে গিয়ে ভুগেছিল মিশর। সে যাক, চট করে দেখে নিই তাহলে!
এশিয়া থেকে এবার বিশ্বকাপে আছে আয়োজক কাতার, ইরান, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। অপরদিকে আফ্রিকা থেকে আছে সেনেগাল, ঘানা, তিউনিশিয়া, মরক্কো এবং ক্যামেরুন। আমরা দেখে নেব ইউরোপীয় রাডারের নীচ দিয়ে কোন্ উড়ন্ত বিমান এবার কাতারে তারকা হয়ে দেখা দেবে।
এশিয়া:
অলমোয়েজ আলি (কাতার)— কাতার শুধু প্রচুর অর্থের কারণে এই বিশ্বকাপ আয়োজন করছে এবং একেবারেই অযোগ্য দল তা কিন্তু না। সেই ২০১০-এই যখন ঘোষণা হয় যে কাতার ২০২২এর বিশ্বকাপ আয়োজন করবে তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে কাতারের প্রস্তুতি। ২০১১এর এশিয়া কাপ কোয়ার্টার ফাইনালে জাপানের কাছে হারা থেকে ২০১৯এর শেষ এশিয়া কাপে সেই জাপানকেই ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় কাতার। আর সেই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব পান অলমোয়েজ আলি। শুধু তাই নয় আমন্ত্রিত হিসাবে কাতার যখন কোপা অ্যামেরিকা খেলতে যান, সেখানেও প্যারাগুয়ের সঙ্গে ড্রএর ম্যাচে গোল করেন অলমোয়েজ। আর তারপরে উত্তর ও মধ্য অ্যামেরিকার গোল্ডকাপে তো ৪ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। এখন ইকুয়েডর, মানেহীন সেনেগাল বা ডাচদের বিরুদ্ধেও তিনি গোল করে বসেন তাহলে অবাক হবেন না।
মেহদি তারেমি (ইরান)— গত বিশ্বকাপে শেষ মুহূর্তে সোনার সুযোগ এসেছিল মেহদি তারেমির কাছে, পর্তুগালের বিরুদ্ধে ম্যাচটায় যদি শেষ মিনিটে গোলে বল ঠেলতে পারতেন তাহলে প্রথমবারের জন্য ইরান নক আউটে যেত বিশ্বকাপের। কিন্তু সেটা হয়নি, কিন্তু তাতে তারেমি হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। বরং বর্তমানে পোর্তোর হয়ে পর্তুগিজ লিগ কাঁপাচ্ছেন তিনি। এমনকি এবারের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পাঁচ পাঁচটি গোলও করেছেন। ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে যদি চমকপ্রদ পারফরম্যান্স করে তারেমির ইরান তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতেই পারে কিন্তু।
তাকিহিরো তোমিয়াসু (জাপান)— এই বিশ্বকাপের সবথেকে আঁটোসাঁটো এশীয় দল কিন্তু জাপান। তারা গত এশিয়া কাপ ফাইনাল হেরে যেতে পারে কিন্তু যোগ্যতা অর্জনকারী পর্বের শেষ দিকে ফর্ম ফিরে পাবার পর তারা বিভিন্ন ফ্রেন্ডলি ম্যাচে প্যারাগুয়ে, ঘানা, দক্ষিণ কোরিয়া ও অ্যামেরিকাকে ভালোরকমভাবেই হারিয়েছে। শুধুমাত্র ব্রাজিল ও তিউনিশিয়ার কাছে পরাজিত হয়েছে। তাও ব্রাজিলের কাছে নামমাত্র গোলে। আর তার অন্যতম কারণ জাপানের সেন্ট্রাল ডিফেন্সের স্তম্ভ আর্সেনালের তোমিয়াসু। বিশ্বকাপে বেশ শক্ত গ্রুপে জাপান। কিন্তু জার্মানি ও স্পেন উভয় দলেরই সমস্যা গোল করার লোকের অভাব। আর সেই অভাবের সিঁধ কেটে জাপান যে ঢুকে পড়বে না, কে বলতে পারে।
কিম মিন জায় (দক্ষিণ কোরিয়া)— নাপোলি থেকে কালিদৌ কোলিবালির চেলসিতে চলে আসার পরেও কিন্তু ফর্মের বিচারে এ বছর নাপোলি ইউরোপের প্রথম চারটি দলের মধ্যে পড়বে। আর তাতে যেমন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন জর্জিয়ার ভারাতস্খেলিয়া, নাইজিরিয়ার ওসিমহান বা ফ্রান্সের তাঙ্গউই এন্দোম্বেলে তেমনি ডিপ ডিফেন্স থেকে খেলা তৈরি করতে এবং ঠিক সময়ে বিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের পা থেকে বল ছিনিয়ে নিতে সিদ্ধহস্ত বা বলা ভালো সিদ্ধপদ কোরিয়ার কিম মিন জায়। সন হুয়ান মিন, বিশ্বকাপে ফিট হয়ে যাবেন। তাঁর এবং কিমের উপর অনেকটাই নির্ভর করবে, পর্তুগাল উরুগুয়ে এবং ঘানার গ্রুপ থেকে নক আউটে যাবে কি না কোরিয়া।
আফ্রিকা: আচরাফ হাকিমি, টমাস পার্তে, এডোয়ার্ড মেন্ডি কালিদৌ কোলিবালি, এরিক ম্যাক্সিম চৌপে মোতিং বা ভিক্তর ওসিমহানদের আমরা হাল হামেশা দেখতে পাই ইউরোপীয় ক্লাব নাইটে দারুণ পারফর্ম করতে কিন্তু এদের বাইরে কয়েকজনের উপর নজর রাখবেন না?
ইসমাইলা সার (সেনেগাল)— বাঁপায়ের ইসমাইলা ডানপ্রান্তিক উইঙ্গারও খেলতে পারেন আবার আক্রমণত্মক মিডফিল্ডারও। মানে খেলতে পারলে হয়তো তাঁর সঙ্গে জুড়ি দারুণ জমত প্রিমিয়ার লিগের ওয়াটফোর্ডে খেলা এই লমা রোগা ছেলেটির। কিন্তু তা না হওয়ায় সেনেগালের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া অনেকটাই নির্ভর করছে সারের ছিপছিপে শরীর আর লম্বালম্বা পায়ের উপর।
মহম্মদ কুদুস (ঘানা)— নাইজিরিয়াকে হারিয়ে যে কাতার যাবার ছাড়পত্র হাসিল করেছে ঘানা, তার কৃতিত্ব কিন্তু যায় দুই মাঝমাঠের স্তম্ভের উপর। আর্সেনালের টমাস পার্তে এবং আয়াক্সের মহম্মদ কুদুস। গাঁট্টাগোঁট্টা কুদুস দক্ষিণ কোরিয়া, উরুগুয়ে এবং পর্তুগালের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার জন্য কিন্তু প্রস্তুত।
ওয়াহবি খাজরি (তিউনিশিয়া)— ফরাসি লিগ ওয়ানের মঁপলিয়েরের আক্রমণত্মকভাগের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ওয়াহবির উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। অভিজ্ঞ এই খেলোয়াড় ও মাঝমাঠের এলিস শখিরিকে দায়িত্ব নিতেই হবে যদি তিউনিশিয়া ভালো ফল করতে চায়।
কার্ল টোকো একাম্বি (ক্যামেরুন)— ক্যামেরুনের বেশ শক্ত গ্রুপ। ব্রাজিল তো আছেই, সঙ্গে সার্বিয়া ও সুইজারল্যান্ডের মতো আঁটোসাঁটো দুই দল। কিন্তু এরিক ম্যাক্সিম চৌপে মতিং-এর বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ফর্ম এবং তাঁর সঙ্গে অলিম্পিক লিয়ঁর একাম্বি ও অধিনায়ক ভিনসেন্ট আবুবকরের ত্রিফলা আক্রমণে ক্যামেরুন সব হিসাব উল্টোপাল্টা করে দিতেই পারে। বিশেষত বামপ্রান্তিক একাম্বির চোরাগতি সমস্যায় ফেলে দিতে পারে যে কোনও দলকে।
মাজরাউই নৌসাইর (মরক্কো)— বিশ্বের সেরা রাইট ব্যাকদের অন্যতম মরক্কোর আচরাফ হাকিমি। কিন্তু এই বছর বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ডিফেন্সের ডানদিকে ভরসা যোগাচ্ছেন মাজরাউই নৌসাইর। আক্রমণে যদিও হাকিমির গতি নেই, কিন্তু ডিফেন্সিভ প্লেতে হাকিমির থেকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য নৌসাইর। হতে পারে হাকিমিকে ডানপ্রান্তে শুধুমাত্র আক্রমণের জন্য ব্যবহার করে নৌসাইরকে রক্ষণে খেলালেন কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই। আর কাতারের গরমে বয়স হয়ে যাওয়া বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়াকে অথবা অনভিজ্ঞ অথচ গতিশীল কানাডাকে যথেষ্ট বেগ দিতে পারে মরক্কো।
আর মাত্র দুই দিন মাঝে। তারপরেই শুরু সব খেলার সেরা ফুটবলের সেরা টুর্নামেন্ট। আপনারা কী চাইবেন জানি না, তবে মনে প্রাণে চাইব এশিয়া বা আফ্রিকার দলগুলো যেন ভালো ফল করে। বিশ্বজনীন করতে হলে ফুটবলকে তো শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকা বা ইউরোপে আটকে রাখলেই চলবে না!