জন্মশতবর্ষে বিস্ময়চমক – দিলীপ মজুমদার

শেয়ার করুন

বিশ শতকের সত্তরের দশকে অখ্যাত সোমেন চন্দের রচনা সংগ্রহ করতে যখন শুরু করি এপার বাংলায় অন্য এক কৌতূহলে, তখন ভাবনার মধ্যে ছিল না একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, সোমেনের জন্মশতবর্ষে, দুই বাংলায় তাঁকে নিয়ে এমন চর্চা হবে। শৈল্পিক প্রতিভা নিশ্চয়ই ছিল তাঁর, কিন্তু রচনা-পুঁজি যে যৎসামান্য। তিন-চারটি কবিতা অকিঞ্চিৎকর, একটি উপন্যাস— তাও আবার খণ্ডিত, দুটি অকিঞ্চিৎকর নাটিকা, গল্প দুই কুড়ির কিছু বেশি। তার মানে তাঁর প্রতিভার বিকাশ গল্পে। গল্পের বাহন গদ্য, মানুষের প্রয়োজনে যার প্রাণ হয়ে আসে ক্ষীণ। মহাজন রবীন্দ্রনাথের কথা হলেও সর্বজনমান্য। কবিতা আর গানের শক্তি মহাকালের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করতে পারে, গদ্য নয়। একবার একটি গদ্যরচনা পড়লে দ্বিতীয়বার পড়তে ক্লান্তি আসে।

সোমেন চন্দের অকালমৃত্যুর পরে চার-পাঁচ দশকের বিস্মৃতি, তারপরে এই গদ্যলেখককে নিয়ে নতুন কৌতূহল আর উদ্দীপনা, এ রহস্যের উৎস কী? না, শুধু হুজুগপ্রিয় বাঙালির ‘জন্মশতবর্ষের হুজুগ’ নয়। এহ বাহ্য আগে কহ আর। তাহলে কি এই তরুণ লেখকের মৃত্যুকাহিনি? পৃথিবীতে যৌবনের ঊষালগ্নে বিদায় নিতে হয়েছে বেশ কিছু প্রতিভাবান কবি-লেখককে। শেলি-কিটসের সঙ্গে আছেন বাঙালি কবি সুকান্ত। ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে তাঁদের মৃত্যুবরণ। বেদনাদায়ক। কিন্তু সোমেনের মৃত্যু ঘাতকের হাতে। আঘাত, উপর্যুপরি আঘাত। ছিন্নবিচ্ছিন্ন তাঁর দেহের উপর উল্লাসনৃত্য। এভাবে মৃত্যুবরণ বলে তিনি আমাদের আবেগকে উদ্দীপিত করেন অনেক বেশি। আরও আছে। সেই ত্যাগ, ত্যাগের মাধ্যমে ভোগের সাধনা। ছেড়ে দিলেন ডাক্তারি পড়া। দেশের কাজ করবেন, মানুষের মুখচ্ছবি ফুটিয়ে তুলবেন লেখায়। তারপরে সতীশ পাকড়াশীর প্রভাব। কমিউনিজমের প্রতি আকর্ষণ। শ্রমিক ফ্রন্টের নেতৃত্ব। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা বৃত্তি নয়, ব্রত। ‘শৌখিন মজদুরি’ কদাচ নয়, ‘চাষার ব্যারিস্টারি’ নয়, ‘কর্মে ও কথায় গানে’ তাদের আত্মার আত্মীয় হওয়ার সাধনা।

এতদিন পরে হলেও সোমেনের জনপ্রিয়তার আর একটা কারণ সাম্যবাদের প্রতি অনুরাগ। বাঙলার মানুষ বহুদিন ধরে বামাচারী। এখনকার কমিউনিস্ট দলগুলির প্রতি বীতস্পৃহ হলেও কমিউনিজমের প্রতি প্রচ্ছন্ন অনুরাগ আছে মানুষের। এখনও। সেই অনুরাগবশত সোমেনের প্রতি অনুরাগ। সে অনুরাগ আরও বর্ধিত হয় সোমেনের জীবনাচরণের দৃষ্টান্তে। মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার আবেগে একটি তরুণ তার কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছে, বিসর্জন দিয়েছে একান্ত ব্যক্তিগত জীবন। ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ। কীসের ভোগ? সমষ্টির মধ্যে ব্যষ্টিকে স্থাপন করার ভোগ। সেই

‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’।

এই তরুণটি আবার তাঁর শিল্পকর্মের চরিত্র বিষয়ে সচেতন। শিল্প প্রোপাগাণ্ডা বা প্রচার নয়, নয় নিছক স্লোগান। সোমেনের রচনায় বার দুয়েক ‘সাম্যবাদ’ শব্দ উচ্চারিত, ‘কমিউনিজম’ একবারও নয়। ছাঁচেঢালা নয় চরিত্র। তাদের শ্রেণিবৈশিষ্ট্য থাকলেও ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য বিবর্জিত নয়। সত্যবতী, প্রশান্ত, জীবানন্দ, শ্রীপতি, সতী, শংকর, ব্রজকিশোর, লীলাবতী, চিত্ত, বীণা, বাচ্চা মৌলবি, রহমান, মন্টু— এসব চরিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যাবে তারা আছে স্ব-স্বরূপে। জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত বলে চরিত্রগুলি জীবন্ত। কষ্টকল্পিত আড়ষ্টতা নেই।

তাঁর গল্পকাহিনির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হতে পাঠকের অন্তরে জন্ম নিতে থাকে একটা প্রত্যয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে। শ্রেণিবিভক্ত, বৈষম্যক্লিষ্ট সমাজের চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। স্পষ্ট হয় শোষণের রূপ, অন্তঃসারশূন্য মধ্যবিত্তের দ্বিধা-দোদুল্যমানতা। শোষণের জাঁতাকলে চাষিকে কীভাবে মজুর হতে হয়, তা দেখে চমকে উঠতে হয়। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’-এ যার আভাস ছিল, তাকে সোমেন স্ফুটতর করেছেন ‘সংকেত’-এ। দাসত্ব কেমন করে মজ্জায় ঢুকে যায় তার উজ্জ্বল উদাহরণ ‘মহাপ্রয়াণ’, যা আমাদের স্মরণ করায় চেকভের ‘দ্য ডেথ অফ আ ক্লার্ক’কে।

সোমেন চন্দের জনপ্রিয়তার আরও একটা কারণ আছে। তিনি মূলত গদ্য লেখক হলেও পদ্যপ্রাণ। তিনটি গল্প থেকে আমি কিছু অংশ কবিতার মতো সাজিয়ে দিচ্ছি:

১.

ভোর না হইতে নানারকম পাখির কলরব শুরু হইয়াছে,
দুইপাশে পাটক্ষেতের সারি,
কিন্তু এ কি!
সেপাইর মতো খাড়া শুধু কয়েকখানা খুঁটি!
মাটির স্তূপ, গভীর জঙ্গল, বটগাছের গাম্ভীর্য, ভয়াবহ নির্জনতা অথচ জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল।

[প্রত্যাবর্তন]


২.

প্রবল বাতাসের বেগে সেই চিঠি পড়ল এক বাবলা গাছের ছায়ায়।

প্রান্তর পার হয়ে সেখানে গভীর বনানী,
অজস্র বুনো ফুলের গন্ধ, তার মাদকতা,
বাঁশঝাড়ে কিচকিচ আওয়াজ,
পাখির ডাকে মুখরিত আকাশ,
হিংস্র প্রাণীদের নির্ভব বিচরণ আর নির্জনতার গন্ধে ভরপুর ;
সেই চিঠি বাবলা গাছের ছায়ায় বসে বুনোফুলের গন্ধ শুঁকতে লাগল ।

[ পথবর্তী ]


৩.

অঙ্গভঙ্গির সঞ্চালনে যে সংগীতের সৃষ্টি হয় সেই সংগীতের আয়নায়
আমার কাছে সমস্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল,
আমি লক্ষ্য করলুম দুই জোড়া পায়ের ভীরু অথচ স্পষ্ট আওয়াজ
আস্তে আস্তে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
অনেক রাত্রে বাবা গুনগুন সুরে গান গাইতে লাগলেন,
চমৎকার মিষ্টি গলা বেহালার মতো শোনা যাচ্ছে।
সেই গানের খেলায় আলোর কণাগুলি আরও সাদা হয়ে গেছে,
মনে হয় এক বিশাল অট্টালিকার সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে সেই গানের রেখা
পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে,
শেষরাত্রির বাতাস অপূর্ব স্নেহে মন্থর হয়ে এসেছে।

[ ইঁদুর ]

সামান্য কয়েকটি রচনা যাঁর পুঁজি, তিনি অসামান্য হয়ে উঠলেন মৃত্যুর অনেক পরে। বিশ শতকের শেষভাগ আর একুশ শতকের প্রথমভাগে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে। যারা নতুন সাহিত্যরীতিতে অভ্যস্ত, যারা নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে কারবার করে। আমি ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহ’-এর নতুন সংস্করণে সোমেন চন্দকে নিয়ে কী কী কাজ হচ্ছে, তার একটা বিস্তৃত তালিকা দিয়েছি। সেটায় চোখ বোলালেই দেখা যাবে সোমেন চন্দের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহের স্বরূপটা। ‘পূর্বমেঘ’, ‘ক্রাক্যার’, ‘প্রহর’ প্রভৃতির মতো ‘আপনপাঠ’-এর পরিচালকরাও তো বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়ে। তারা সোমেন চন্দকে জানতে-বুঝতে চেষ্টা করছে। আলোচনাসভার আয়োজন করছে, পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছে। সোমেনের ঘনিষ্ঠরা যা পারেননি, এরা তাই করছে। সোমেনের জীবন ও রচনা তাদের আকর্ষণ করেছে বলেই এমনটা হচ্ছে।

সেসব দেখে আপশোশ হয়। যাঁর মধ্যে এমন সম্ভাবনা ছিল, এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল তাঁর আয়ু! সতীশ পাকড়াশী সোমেনকে শিখিয়েছিলেন কলমকে তরবারি করে তুলতে। সমাজের অন্যায়, অসাম্যের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠবে লেখকের কলম। ব্রেখট যেমন বলেছিলেন, Fight through writings. Show that you are fighting. Vigorous realism, reality on your side, be on the side of reality. Let life speak.

শেয়ার করুন

Similar Posts

3 Comments

  1. ‘তবে সোমেন চন্দদের ধারাটি আছে। ক্ষীণ অবশ্যই, কিন্তু নিঃশেষিত নয়। সোমেন চন্দদের বাড়ি ছিল নরসিংদী এলাকায়; ১৯৬৯-এ ওখান থেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন তরুণ আসাদ, সোমেন চন্দদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী। এবং সোমেন চন্দের মতোই তিনিও শহীদ হয়েছেন, যদিও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে নয়, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের হাতে। ওই ফ্যাসিবাদীরাও কিন্তু জাতীয়তাবাদীই ছিল। পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদী।’— সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ।

  2. আরেকটু বিস্তারিত পড়তে চাই। কোনো গ্রন্থসূচী পেলে উপকৃত হবো। অগ্রিম ধন্যবাদ রইলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *