ইতিহাসের আলোকে নাথপন্থা –  রিঙ্কি মণ্ডল

ইতিহাসের আলোকে নাথপন্থা –  রিঙ্কি মণ্ডল

শেয়ার করুন

নাথধর্ম তন্ত্র, হঠযোগে, সহজিয়া, শৈবাচার, ধর্ম পূজা প্রভৃতি মতের সমন্বয়ে উদ্ভূত একটি সাধনমার্গ। মধ্যযুগে উৎপন্ন এই সম্প্রদায় বৌদ্ধ, শিব তথা যোগের পরম্পরার সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায়। নাথ সম্প্রদায় ভারতের এক হিন্দুধর্মীয় পন্থা। বেদশাস্ত্র এবং পুরানাদিতে মহাদেবকে মহান এবং মহারুদ্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই নাথ সম্প্রদায় রুদ্রজ ব্রাহ্মণ; আর যোগ সাধনাই তাদের প্রধান ধর্ম বলে তারা ‘যোগী’। নাথপন্থীরা ছিলেন মূলতঃ আত্মবাদী; ঈশ্বরবাদী নয়। হঠযোগ ও কায়াসাধনা নাথধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কায়াসাধনায় শরীর নীরোগ ও আধ্যাত্ম সাধনায় অমরত্ব লাভ সম্ভব বলে নাথ ধর্মীরা বিশ্বাস করে। নাথ সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতা শিব; তাই তারা শৈব গোত্রীয়। আমরা বর্তমানে যাদের ‘নাথ’ বা ‘দেবনাথ’ পদবি দেখতে পাই; তাঁরা সকলেই নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত।

নাথেদের উদ্ভবের সময়কাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। মনে করা হয় যে, নাথেদের সূত্রপাত দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে যদিও, একথা সত্যি যে এর কোনো প্রমাণ অদ্যাবধি সম্পূর্ণরূপে পাওয়া সম্ভবপর হয়নি। একাধিক নাথগুরুদের অস্তিত্ব সপ্তম এবং অষ্টম শতাব্দীতে লক্ষ করা যায়। ফলত বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিমাণে গ্রহণযোগ্য নয়। নাথ সম্প্রদায়ের আদিগুরু ছিলেন শিব; যাঁকে নাথ দর্শনে বলা হয়েছে আদিনাথ।

নাথ ধর্মের প্রথম গুরু ছিলেন যোগী মিননাথ। তিনি আদিনাথের প্রধান বা মূল শিষ্য ছিলেন। তিনিই প্রথম নাথ ধর্মের প্রবর্তন করেন। তাঁর সময়কাল ছিল আনুমানিক অষ্টম বা নবম শতক। অবশ্য কোনো কোনো সূত্র তাঁকে আরও পিছিয়ে ষষ্ঠ বা সপ্তম শতক করেছে। তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন গোরক্ষনাথ। তিনি ছিলেন নাথপন্থার চুরাশি সিদ্ধাচার্যের শীর্ষজন। আবার একই সাথে তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ্ তথা বরিশাল-বাখরগঞ্জের বা বাংলা ভাষার প্রথম কবি; যদিও এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। দাবি করা হয় যে তিনি ‘কৌলজনান্মর্নায়য়ের’ রচয়িতা। এটা সংস্কৃত ভাষায় হঠ যোগের অন্যতম প্রাচীন রচনা। তিনি তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথের সাথে হঠ যোগ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সর্বজনীন শিক্ষার জন্য তাঁকে ‘বিশ্বযোগী’ বলা হয়ে থাকে। তবে তাঁর নাম অনেক রূপে লিখিত হয়েছে যথা, মৎসেন্দ্রনাথ, মচ্ছেন্দ্রনাথ প্রভৃতি।

যোগী মিননাথের প্রধান শিষ্য ছিলেন গোরক্ষনাথ। খ্রিস্টীয় দশম বা একাদশ শতকের কোনো এক সময়ে পূর্ববঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নাথ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান গুরু। তাঁর শিষ্য ছিলেন হাড়িপা এবং ময়নামতী। ঐতিহাসিক ব্যক্তি হয়েও তিনি ভক্তের চোখে প্রথমে ‘কিংবদন্তি পুরুষে’ এবং পরে সাধারণের চোখে একজন ‘দেব পুরুষে’ পরিণত হন। কথিত আছে, একদা আদি গুরু মৎসেন্দ্রনাথ শিব কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে কদলীর ‘স্ত্রী-রাজ্যে’ নারী সংসর্গে এসে ধৰ্ম-কর্ম বিসর্জন দেন। শিষ্য গোরক্ষনাথ যোগসাধনবলে বহু কষ্টে গুরুকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। গোরক্ষ বিজয় কাব্যে তাঁর বিজয় অর্থাৎ চারিত্রিক মাহাত্ম্যের কথা প্রচার করা হয়েছে। বাংলা কাব্য ছাড়া সংস্কৃত ভাষায় ‘গোরক্ষ সংহিতা’ ও ‘গোরক্ষ সিদ্ধান্ত’ নামে দুটি গ্রন্থ আছে। গোরক্ষনাথের মঠ, মন্দির ও পূজারী মহন্ত যোগীর অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান। রাজশাহীর ‘যোগীর ঘোপা’, রংপুরের ‘গোরক্ষ মণ্ডপ’, দমদমের ‘গোরক্ষ বাসুলী’ প্রভূতি স্থানে গোরক্ষনাথের পূজার প্রচলন ছিল। বগুড়ার যোগীর ভবনের চারটি মন্দিরের মধ্যে একটি গোরক্ষনাথের বলে মনে করা হয়। লোক চেতনায় গরক্ষনাথের আরও রূপান্তর ঘটেছে। দিনাজপুর, রংপুর অঞ্চলের রাজবংশী ও পলাইয়া কৃষাককুল তাঁকে গো-রোক্ষক দেবতা রূপে পূজা করে। সাধারণ কৃষক সমাজেও গরক্ষনাথের পূজার প্রচলন ছিল। এছাড়াও তাঁকে নিয়ে বহু পাঁচালী (গুকেখর ধারের পাঁচালী), গান (বয়াতি গান), ছড়া ইত্যাদি প্রচলিত আছে। গরক্ষনাথের নামানুসারে উত্তরপ্রদেশের এক জেলার নামকরণ করা হয় গোরক্ষপুর। এবং বর্তমানে সেখানে গরক্ষনাথের মন্দির অবস্থিত।

জলন্ধর্নাথ ভারতের নাথ সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট সাধক হিসেবে বিবেচিত। তিনি মোহযোগী গরক্ষনাথের সময়ে অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন; তাই তিনি গরক্ষনাথের সমসাময়িক হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি মূলতঃ জলন্ধর (পাঞ্জাব) এর বাসিন্দা। রাজস্থান এবং পাঞ্জাব অঞ্চলে তাঁর খ্যাতি বৃত্তীয়মান। নাথ সম্প্রদায়ের যোগীরাজ জলন্ধর্নাথ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। জলন্ধর্নাথের মন্দির গুলো মূলতঃ রাজস্থানের জালোর, নীওয়াই (টঙ্ক), মহামন্দির (যোধপুর) ছাড়াও বহু জায়গায় অবস্থিত রয়েছে। নাথ সাহিত্য গ্রন্থে (নাথ পুরান, শিব পুরান এবং আরও কিছু হিন্দু ধৰ্ম গ্রন্থ) মহর্ষি যোগী জলন্ধর্নাথের গৌরব পাওয়া যায়। জলন্ধর্নাথের শিষ্য ছিলেন কানিফনাথ। কথিত আছে যে, তিনি তাঁর শক্তি থেকে বহু অলৌকিক কীর্তি অর্জন করেছিলেন।

কানিফনাথ নাথ সম্প্রদায়ের যোগী ছিলেন। তাঁর সময়কাল ছিল আনুমানিক চৌদ্দ শতক। তিনি মূলতঃ বাংলার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি কানিফনাথ, কানপা, কানহাপ, কর্নিপা প্রভূতি নামে পরিচয় বহন করেন। কথিত আছে যে, তিনি হাতির কানের সাথে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর দেহটি যেহেতু কালো ছিল সেহেতু তিনি কৃষ্ণপদ নামেও পরিচিতি ছিলেন। কৃষ্ণপদ ছিলেন জলন্ধর্নাথের প্রধান শিষ্য। তিনি তাঁর গুরুর কাছ থেকে হেভরাজ সিদ্ধান্তের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কৃষ্ণপদের পাঁচজন শিষ্য ছিলেন যথা, মেখলা, কানখাল, অচিতি, ভাদালি ও কানহাপার। এঁদের মধ্যে অচিতি ছিলেন অন্যতম শিষ্য। কৃষ্ণপাদের অনুপ্রেরণা বৈরিতা নয়; নাথ যোগের নীতিগুলি থেকে পুষ্টি ছিল। তাঁকে নভনারায়নের আলোকিত নারায়ন অবতার বলে মিবে করা হয়। কালবেলিয়া যোগী নিজেকে কানিফনাথের বংশধর বলে মনে করেন। কানিফনাথের মন্দির মাধীতে অবস্থিত রয়েছে।

ভর্তৃহরি সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যই কিংবদন্তি এবং মিথের আড়ালে ঢাকা। জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি বারানসিতে রাজত্ব করতেন এবং বিক্রমাদিত্য তাঁর কনিষ্ট ভ্রাতা ছিলেন। তাঁর স্ত্রী-র নাম ছিল পিঙ্গলা। বাংলার বিখ্যাত লোকশ্রুতির নায়ক গোপীচাঁদ তাঁর ভাতুষপুত্র ছিল বলে দাবী করা হয়। সমস্ত উত্তর এবং পূর্ব ভারত জুড়ে ভর্তৃহরির কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল। চূনারের একটি বিধ্বস্ত দুর্গকে দেখিয়ে ভর্তৃহরির দূর্গ বলে দেখানো হয়। এমনকি মহাকবি কালিদাসের লেখাতেও ভর্তৃহরির নাম পাওয়া যায়। এমনও শোনা যায় যে, তিনি দক্ষিণ ভারতের এক ধর্মগুরুর শিষ্য হন। ছত্তিশগড়ের রাজা ভর্তৃহরি সংক্রান্ত গান এমনও গাওয়া হয়। তাঁর সময়কালকে গরক্ষনাথের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভর্তৃহরি সম্বন্ধে তিনটি বইয়ের নাম পাওয়া যায়, যথা: ‘বৈরাগ্যশতকম’, ‘বাক্যপাদিয়’, ‘শতকোত্রয়’। 

হিমাচল প্রদেশের চম্বl অঞ্চলে হিমালয় গুহায় বসবাস করে তিনি অবধৃতকে রচনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, একজন ব্যক্তির উচিত তার অভ্যন্তরীণ শক্তির বৃদ্ধি করা; কারণ আমরা বাহ্যিক অনুশীলনের দ্বারা কিছুই বিবেচনা করি না।

রেভানাথের কয়েকটি নামের মধ্যে দুটি নাম হল কাড়সিদ্ধ, সিদ্ধরাজ প্রভূতি। শোনা যায় তিনি নর্মদা নদীর তীরে সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দী নাগাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি দত্তাত্রেয় নিকট দীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। রেভানাথের নামে অন্তত সাত থেকে আটটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। যার মধ্যে সবথেকে পুরানো মহারাষ্ট্রের কোলাপুড়ের সিদ্ধগিরি মঠ এবং সবথেকে নতুন মঠ হল খারসুন্দি নামক এক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধনাথ মন্দির; মাত্র দেড়শো বছর পুরোনো।

কিংবদন্তি অনুযায়ী চৌরঙ্গিনাথ বাংলার পালবংশীয় সম্রাট দেবপালের পুত্র। যদিও তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতে ধৰ্ম প্রচার করেন। শিয়ালকোটে বর্তমানে পাকিস্তানে তাঁর একটা তীর্থস্থান রয়েছে। অনুমান করা হয় তার সময়কাল হল নবম শতক।

গোপিচন্দ্র হলেন নাথ সম্প্ৰদায়ের আরেকজন গুরু। দাবি করা হয় তিনি বিক্রমাদিত্য ও ভর্তৃহরির ভাতুষপুত্র। তাঁর বংশকে মেহেড় বংশ বলা হয়। তিনি হাড়িপার শিষ্য ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন ময়নামতী। তাঁর  নামে গান বাংলা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশেষ ভাবে প্রচলিত। ১৮৭৩ সালে জর্জ আব্রাহাম গ্ৰিয়ারসন মানিকচন্দ্রি রাজার গান নামে এটি প্রথম প্রকাশ করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এর পাঠান্তর সংগৃহীত হলে তা গোপীচন্দ্রের গান নামে পুনঃপ্রকাশ করা হয়। গোপীচন্দ্রের কাহিনি বাংলাদেশ ময়নামতির গান, গোবিনাচন্দ্র গীত  এবং গোপীচাঁদের সন্ন্যাস এই তিন নামে প্রচলিত। এ কাহিনির তিন জন কবি হলেন: দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস ও সুকুর মোহম্মদ।

পূর্বোক্ত নাথ গুরু ছাড়াও আরো কয়েকজন নাথ গুরুর নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন,

ভরতরুহরিনাথ ইনি উজ্জয়নির রাজা এবং পন্ডিত ছিলেন; তিনি তাঁর রাজ্যে ছেড়ে যোগী হয়েছিলেন।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর সিদ্ধ রতনাথ; যিনি উত্তর ভারতের নাথ এবং সুফি উভয় সম্প্রদায়েরই মধ্যে সম্মানিত ছিলেন। 

পঞ্চদশ শতাব্দীর সিদ্ধ ধর্মনাথ; ইনি গুজরাটে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি কাঁচ অঞ্চলে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি কচ্ছ অঞ্চলকে জীবনযাত্রার উপিযোগী করে তুলেছিলেন।

আঠারো শতকের সিদ্ধ মস্তনাথ; তিনি হরিয়ানার একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

নাথ দর্শনের মূল কথা হল সহজ উপায়ে যোগের মাধ্যমে এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া, যেখানে কোনো জন্ম-মৃত্যু নেই। নাথ সম্প্রদায়ের যোগীরা মূলতঃ পতঞ্জলি যোগ দর্শনকে গ্রহণ করেছেন। প্রথমে তাঁরা পূরক, কুম্ভক, রেচক এই ধরনের বায়ু গুলিকে নিজের আয়ত্তে এনে মোক্ষ বা মুক্তি লাভের প্ৰথম স্তর অতিক্রম করতেন এবং তারপর তাঁরা তন্ত্রের কুলকুন্ডলিকা তত্ত্বকে অনুসরণ করে এক দিব্য অনুভূতি লাভ করতেন। এবং এই ভাবেই তাঁরা হঠ যোগের মাধ্যমে জড় দেহকে অপার্থিব দিব্য দেহে পরিণত করত। নাথ ধর্ম ও দর্শন নিয়ে যে চারটি পুঁথি মূল পরিচয় বহন করে; সেগুলি হল, ‘যোগীর গান’, ‘যুগির কাজ’, ‘গোরক্ষ সংহিতা’ এবং ‘যোগচিন্তামণি’। এই পুঁথি গুলিতে হঠ যোগের মাধ্যমে জড় দেহকে অমর করার কৌশল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। নাথ যোগীরা তাঁদের যোগ সাধনের ব্যাখ্যায় রাধা-কৃষ্ণের রূপকও গ্রহণ করেছিলেন। নাথ যোগীরা যেহেতু আত্মবাদী ছিলেন সেহেতু তাদের সম্প্রদায়ে মুসলমানদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাই তাঁরা মূলতঃ হিন্দু যোগ দর্শনের সাথে ইসলামের সাধনা তত্ত্বের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছিলেন। নাথ দর্শনে  বলা হয়েছে যে, যিনি প্রকৃত যোগী তিনি সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে যান। তার কোনো চিন্তা-ভাবনা থাকে না এমনকি নির্বনের প্রতিও তার কোনো আসক্তি থাকে না। বিখ্যাত নাথ যোগী সরাহ এধরণের বহু পদ রচনা করেছেন। নাথ দর্শনে বলা হয়েছে একজন যোগী তার পরম কাঙ্খিত সিদ্ধি লাভ করে থাকেন; যথা, বিন্দুধারণ, পবন নিঃসচাঞ্চল্য এবং চিত্তনিরোগ অর্থাৎ তিনি বীর্য ক্ষরণ রোধ করবেন এবং  মনকে সবসময় শান্ত-ধীর-স্থির করে রাখবেন। নাথ-দর্শন অনুযায়ী এভাবেই একজন যোগী তাঁর পরম কাঙ্খিত সহজ অর্থাৎ সিদ্ধিলাভ করতে পারে। নাথ-ধৰ্ম এবং দর্শনে বৈদিক , মনুসংহিতা, শাক্ত, বৈষ্ণব, জৈন এবং বৌদ্ধ দর্শনের অন্তর্গত নাগার্জুনের শূন্যবাদ এবং বাংলার সহজিয়া মতবাদের প্রভাব আছে।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নাথ সাহিত্য এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। নাথ সাহিত্যে নাথ ধর্মের আচার-আচরণ ও নাথ যোগীদের কাহিনীভিত্তিক সাহিত্য। এ সাহিত্য দুটি ধারায় বিকাশ লাভ করে; একটি হলো সাধন-নির্দেশিকা ; এতে প্রচুর পারিভাষিক শব্দ ও বাক্য রয়েছে এবং বাক্য গুলি উপদেশমূলক। দ্বিতীয় ধারার সাহিত্য হলো গাঁথা-কাহিনি বা আখ্যায়িকা; এতে সিদ্ধা দের সাধন জীবনের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ বা সিদ্ধিলাভের কথা পরিবেশিত হয়েছে। গাঁথা কাহিনি গুলি তুলনামূলক পরবর্তী কালের রচনা; পূর্বধারার সঙ্গে এগুলির কালিক ব্যবধান মাত্র দুই শতকের। এই ধারার সবথেকে উল্লেখযোগ্য কাহিনি হলো গোরক্ষবিজয়; শিষ্য গোরক্ষনাথ কিভাবে গুরু মীননাথ কে উদ্ধার করলেন সেই কাহিনি। গোরক্ষবিজয়-এর প্রথম রচয়িতা হলেন শেখ ফয়জুল্লাহ। তিনি ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ভাগে আবির্ভুত হন । অপরটি হলো ‘গোপীচন্দ্রের গান’; রানী ময়নামতী ও তাঁর পুত্র গোবিন্দচন্দ্রের কাহিনি। যে কাহিনিতে রানী ময়নামতী ও গোবিন্দচন্দ্রের বৃত্তান্ত পাওয়া যায় তাই ‘ময়নামতীর গান’ বা ‘গোপিচন্দ্রের গান’ নামে পরিচিত। রাজা মানিকচন্দ্রের গীত, ময়নামতীর গান বা গোপীচন্দ্রের গান একই ধারার ত্রিমুখ কাহিনি। বিভিন্ন স্থানিক সংস্করণে পৃথক পৃথক ভাবে প্রকাশিত হলেও এগুলির মূলে একই কাহিনির রকমফের লক্ষ্য করা যায়।

এই নাথ সাহিত্য ‘গোরক্ষবিজয়’ আর ‘গোপীচন্দ্রের গান’ গ্রাম্য কবিদের রচনা। যে কারণে এতে কোনও পণ্ডিতি আড়ম্বর বা সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। সহজ-সরল অনাড়ম্বর ভাষারীতি নাথ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। তবু এতে ধর্মতত্ত্ব দার্শনিকতার সঙ্গে কবিতত্বের সুর ও লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ছাড়াও ‘গোরক্ষবিজয়’ হিন্দি, ওড়িয়া, মারাঠি,গুজরাটি,নেপালী ও তিব্বতী ভাষায় গাঁথা মূলক কাহিনী গুলির আলাদা আলাদা সংস্করণ পাওয়া যায়। করুন রসাত্মক গোপীচন্দ্রের গানে প্রাচীন বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন চিত্রের সহজ-রূপায়ণ ঘটেছে। সামাজিক রীতিনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিচয় আছে। গান গুলিতে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মন্য ধর্মের প্রভাব ও অতিপ্রাকৃত তথা অলৌকিকতার স্পর্শ নানাভাবে এসেছে। বাংলার বাইরে গান গুলির প্রচারের উদ্দেশ্যে এগুলিকে মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি , ওড়িয়া প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। গোরক্ষবিজয় সংক্রান্ত ১৭টির মতো পুঁথি অবিভক্ত বাংলা থেকে সংগ্ৰহ হয়েছে। এসমস্ত পুঁথি অধিকাংশই খণ্ডিত। পুঁথি অনুসারে সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন। নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত গ্রন্থের নাম ‘মীন চেতন’। আব্দুল করিম ও পঞ্চানন মন্ডল সম্পাদিত গ্রন্থের নাম যথাক্রমে ‘গোরক্ষবিজয়’ ও ‘গোর্খবিজয়’। এই কাব্যের সময়কাল নিয়ে পন্ডিত দের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। 

নাথ সাহিত্যের কিছু কিছু অংশ সম্পূর্ণ পরিমানে বিলুপ্ত বা পাওয়া গেলেও সম্পূর্ণ রূপে পাওয়া যায়নি। যেমন বাংলার মঙ্গলকাব্য-এর একাধিক আখ্যান নাথ সম্প্রদায়ের থেকে উদ্ভূত। বিশেষতঃ মনসামঙ্গল নিঃসন্দেহে নাথেদের আখ্যান , যার প্রাচীনতম উৎস আমরা জাতক কথায় পাই। এছাড়াও মনে করা যেতেই পারে যে, শাক্তদের তন্ত্র সাহিত্যের একটা বড় অংশ নাথেদের থেকে উদ্ভূত। কোনও কোনও পন্ডিতদের মতে নাথেদের নিজস্ব মহাভারতীয় আখ্যান রয়েছে; যদিও তার কোনও প্রকাশ্য প্রচার নেই। চর্যাপদেও নাথ ধর্ম-দর্শন-গুরুদের উল্লেখ করা যায়। 

নাথেদের মূলতঃ লক্ষ্য করা যায় ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিস্তীর্ন অঞ্চলে। উত্তরপ্রদেশ,বিহার,পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, মহারাষ্ট্র, গুজরাট,পাঞ্জাব,কাশ্মীর, রাজস্থান, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা, আসাম সর্বত্রই নাথপন্থীদের অস্তিত্ব loksht করা যায়। তবে নাথপন্থীদের মূলকেন্দ্র ছিল এককালে পেশোয়ারে। বর্তমানে পাকিস্তানের কিছু কিছু অংশেও নাথেদের লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত, শিয়ালকোট, পেশোয়ার এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অতি সামান্য হলেও নাথেদের অস্তিত্ব রয়েছে। বর্তমানে বাংলা, ত্রিপুরা, আসাম ও উত্তরপ্রদেশে নাথ , দেবনাথ এবং যোগী পদবী ধারীরা যাঁরা অর্ধ-উপবিত ব্যবহার করেন, তাঁরাই হলেন নাথ সম্প্রদায়ের বর্তমান উত্তরসূরি। 

তথ্যসূত্র:  

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস- সুকুমার সেন। 

You tube চ্যানেল- A D’s classes

উইকিপিডিয়া।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২