আক্ষেপঅনুরাগ – মিথিল ভট্টাচার্য্য
গ্রিলে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে তানিয়া, দোতলার এই ছোট্ট বারান্দাটাই আজ তার বাইরের জগতের সাথে সংযোগের একমাত্র দোর।
দুই বছর আগের সেই কালো দিনটার পর আজ তার গোটা দুনিয়াটাই সীমিত হয়ে থেকে গেছে এই ছোট্ট গণ্ডিটার মধ্যে। আর এই জগতে তার মুক্তির এতটুকু খোলা পথ শুধু এই ছোট্ট বারান্দাটা।
একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে প্রকৃতির বুকে, আর সেই অন্ধকারের সঙ্গী হয়ে আজও আশায় বুক বেঁধে একদৃষ্টে বড়ো রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে সে,
সেই একজনের অপেক্ষায় !
প্রতিদিন কে জানে কোথা থেকে সে এসে দাঁড়ায় তার এই ছোট্ট ব্যালকনিটার ঠিক সামনে। এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে থাকে তার দুই চোখের দিকে,
যেন বলতে চায় আর কতদিন বন্দি থাকবে এই মিনারের চূড়ায় রাপুঞ্জেল? চলোনা সব ছেড়ে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাই অচিনপুরের দেশে। যাবেনা আমার সাথে ???
চিৎকার করে বলে উঠতে চায় তানিয়া, “হ্যাঁ, যাবো। এক্ষুনি নিয়ে চলো আমাকে, এই বন্ধ কারার দ্বার ভেঙে আমাকে নিয়ে চলো সেই অচেনা রূপকথার জগতে”
কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারেনা সে। তার আগেই কুয়াশার ঘোমটায় কোথায় যেন বরাবরের মতো হারিয়ে গেলো তার স্বপ্নের রাজকুমার। রোজের মতো গভীর হতাশায় একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসে তানিয়ার গলা চিরে।
******************
আজ ও কোচিং থেকে ফেরার পথে বড় রাস্তার উপরে সেই পুরোনো বাড়িটার সামনে এসে নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে পড়লো রাজীব। রোজের মতনই আজও বাড়িটা যেন তাকে এক অমোঘ আকর্ষণে টানছে নিজের দিকে । পরিত্যক্ত এই বাড়িটা আজ পাড়ার সবার কাছেই এক আতঙ্কপুরী নামেই পরিচিত। বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে তানিয়া যেদিন ওই দোতলার বারান্দায় উপরের ছাদের চাঙড় ভেঙে মাথায় লেগে মারা যায়,সেই দিন থেকেই বাড়িটা জনশূন্য হয়ে পরে রয়েছে। মেয়েটার বাবা মা নাকি ওই পুরোনো বাড়িটাতে নিজেদের মৃত মেয়ের ছায়া দেখতে পেতেন। তারা ওই অভিশপ্ত বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পরও আরো অনেকেই নাকি ওই দোতলার বারান্দায় দেখতে পেয়েছে কারোর এক অস্পষ্ট ছায়া।
রাজীব আগে এগুলো একদম মানতোনা। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে বাড়ি ফেরার পথে ওই ভাঙা দোতলার বারান্দাটা যেন এক অদ্ভুত ইশারায় তাকে টেনে নিয়ে চলেছে নিজের দিকে। এক অজানা আকর্ষণে একদৃষ্টে রোজের মতন আজও সে তাকিয়ে রইলো ওই একটুকরো খোলা ব্যালকনিটার দিকে। হঠাৎই একমুহূর্তের জন্য তার মনে হলো,কেউ একজন যেন দুচোখ ভরা আশা নিয়ে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে। চমকে উঠে ভালো করে আরো একবার রাজীব ফিরে তাকালো বারান্দাটার দিকে।
নাহ, তারই মনের ভুল। হতাশ মনে বাড়িটার দিকে পিছন ফিরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যত হলো রাজীব।
কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই হঠাতই তার মনে হলো একটা আজব শিরশিরে স্বর যেন দূরের কোথা থেকে ভেসে আসছে তার কানে, যেন বহুদূর থেকে কেউ বড়ো আকুল ভাবে মুক্তির আকুতি জানাচ্ছে তারই কাছে। এক মুহূর্তের জন্য আবার ফিরে তাকালো রাজীব।
না সবটাই শুধু তার এক নিছক ভ্রম, আর কিচ্ছু না!
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পরিত্যক্ত বাড়িটাকে অবশেষে পেছনে রেখে বড় রাস্তা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো রাজীব। …