আঞ্চলিক প্রবাদ – মৌমিতা নাথ
ভাষা তো আসলে সংকেত ছাড়া আর কিছুই না। আগুনকে আগুন আর জলকে জল না বলে হিসেবটা যদি একটু ঘুরিয়ে দিই, শুধু সংকেতেরই যে অদলবদল হবে তা না, অর্থ বুঝতেও সমস্যা হয়ে যাবে। সংকেত ছোটবেলা থেকে আমাদের ধারন করে, এর বিন্দুমাত্র হেরফের হলেই মহা সমস্যা। ট্রাফিক সিগন্যালে একসঙ্গে অনেকগুলো গাড়িকে ‘ধীরে চলো’ বোঝাতে একটা হলদে রঙের আলোই যথেষ্ট। অর্থাৎ ট্রাফিক সিগন্যালেরও এক নিজস্ব ভাষা আছে। ভাষা, ভাবপ্রকাশের এই চিরকালীন মাধ্যমকে নিয়ে কত লড়াই, আগুন। একটি ভাষাকে গায়ের জোরে অন্য ভাষার ওপর চাপাতে গিয়ে ইওরোপের মতো এশিয়াতেও ‘জেনোসাইড’ সংগঠিত হয়েছে। বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রথমবার বাঙ্গালী বিশ্বজয়ীর মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু বিশ্বভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিবাদ বিতর্ক এলখার বিষয় নয়, প্রসঙ্গ মাত্র। বাংলা ভাষা নিয়ে ছুঁৎমার্গ আজও সমানে চলছে। গ্রামীণ বাংলা ভাষার প্রতি শহুরে বাংলা ভাষার বহুকালীন ঘৃণা। তার একটা কারণ হিসেবে বলা ভালো, ভাষা কী, সেবিষয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে জোরালো কোনও পড়াশুনো বা বোঝানোর অভাব। প্রথম ভাগ থেকেই স্কুলে পাঠ নিতে একজন শহুরে শিক্ষার্থী বইয়ের সিলেবাসে নিজের ভাষাই পায়, অথচ একজন আঞ্চলিক পড়ুয়া সেরকম কোনও নিজস্ব ভাষা পায় না। তাকে শহরকেন্দ্রিক ভাষাই শিখতে হয়। তার নিজের ভাষা বইয়ের ভাষার থেকে আলাদা হয়। বাংলা ভাষার রূপ, শহুরে বাংলা ব্যাকরণ, আর কিছু প্রবাদ প্রবচন এসব আয়ত্ত করে বোর্ড পরীক্ষার চৌকাঠ ডিঙোলেও বাংলা ভাষার মূল রূপ রস গন্ধ থেকে বঞ্চিত হয়, যতদিন না গ্রামীণ বাংলা ভাষা মগজযন্ত্রের তারগুলোতে আঙুল ছোঁয়ায়।
গ্রামাঞ্চলে বড় হওয়ার কারণে আমার শৈশব গ্রামীণ বাংলা ভাষার অকৃপণ উষ্ণতা পেয়েছে। স্কুলের ‘পুঁথি’র বাংলা ব্যাকরণের প্রবাদ-প্রবচন বিভাগ বরাবরই টেনে রাখত আমায়। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়’,’ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’, ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’, ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী’ এসব তো ছিলই। তবে যে সব প্রবাদ মা-দিদিমাদের বলতে শুনেছি, তা একটু অন্যরকম, আমার ইস্কুল সিলেবাসের বাইরে। সেগুলো প্রান্তিক, যাকে ভদ্র সমাজ বলে ‘ছোটলোকের ভাষা’। এপ্রসঙ্গে নবারুণ মনে পড়ছে। ‘কাঙাল মালসাট’। জনৈক শিক্ষাবিদের ভাষায় সেই মজার কথা ‘এলেখা টিকবে না, এলেখা মান্য ভাষায় লেখা না’। টেকা না টেকা পরের কথা, তবে ভাষা যে কোনোভাবেই বড় ছোট হয় না, মান্য অমান্য হয়না, সে বিশ্বাস নিজের মধ্যেই তৈরি করে নিয়েছিলাম। আর সে বিশ্বাস থেকেই মায়ের মুখে শোনা প্রবাদগুলোকে বইয়ের পাতায় খোঁজার বৃথা চেষ্টা চালাতাম। যেমন ‘কাঙালির ঝি কম্বলে বসে, পোঁদ চুলকায় আর মনে মনে হাসে’। এখানে ‘পোঁদ’ পিছন অর্থে নয়। পড়তে খারাপ লাগলেও এটাও সংকেত, এটাও ভাষা। আর অনেক মহিলা একত্রিত হলেও তাদের কথায় উঠে আসে নিন্দে, চর্চা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অন্যদের নিয়েই। কারও আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে প্রতিবেশিদের হজম করতে অসুবিধে হয় বৈকি। সেসবেরই হাতেনাতে ফল এইসব চুটকি বা প্রবাদ-প্রবচন।
আমার দিদি প্রায়ই মায়ের সঙ্গে তর্ক, ঝগড়া জুড়ে দিত। এমনও কয়েকবার হয়েছে যে বিয়েবাড়ি বা আত্মীয়বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় হচ্ছে, ঠিক এমন সময়ে ছোটখাটো কোনও বিষয় নিয়ে শুরু হয়ে গেল তুমুল কথাকাটাকাটি, আর মা বলে বসল ‘সেজেগুজে রইলাম বসে, যাওয়া হল না চোপড়ার দোষে’।
মনে পড়ছে আমার প্রাথমিক স্কুলের কথা। সকাল সাড়ে ছটায় শুরু হত। বাড়ি ফিরে ইউনিফর্ম না খুলেই একছুটে চলে যেতাম মাঠে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় নোংরা করে নাহয় ছিঁড়ে ফেরত আনতাম। অথচ পরদিন স্কুলে যেতে যে একটা আস্ত অথচ না পরিষ্কার পোশাক দরকার, তা বুঝতে রাত হয়ে যেত। তাই ছুটতে হত পুকুরের দিকে, নাহয় ছুঁচসুতো নিয়ে আলোর কাছাকাছি গিয়ে বসতাম। আর তা দেখেই মা বলত ‘সারা দিন আলে ঘোলে, রাত্তির হলে কলমি শাক তোলে’। টিমটিমে আলোয় সেলাই করতে অসুবিধে হলেও সেই ‘কলমি শাক’ তুলতেই হত। আর আমার ‘শাক তোলা’ থুড়ি ভাষা শিক্ষার প্রথমভাগগুলো রপ্ত করে নিতাম তখন থেকেই।
মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়েও এমন অনেক চুটকি শুনেছি যাকে ভদ্র ভাষায় প্রবাদই বলে। দিদিমা বারান্দায় বসে সেলাই করতেন, আর সেখানে তাঁকে ঘিরে জনাকয়েক শাশুড়ি আর বিধবা প্রায়ই তাঁদের বৌ-ছেলেদের নামে নালিশ বিনিময় করত। অল্প কথায় দিদিমাকে ফোড়ন কাটতে শুনেছি ‘ভাত দেবার ভাতার নয়, নাক কাটবার গোঁসাই’। শাশুড়ি-বৌ এর চিরকালীন বিবাদ উচ্চ-মধ্য-নিম্ন সব বিত্তের সব সমাজের অলিখিত প্রথা। কথায় কথায় বৌকে খাটো করে নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান না করলে শাশুড়ির মান থাকেনা, তাই ‘এই করে করে পাকলো মাথার কেশ, তুই কিনা বলিস মাগী যমুনায় ভাসে সন্দেশ’ –এর মতো প্রবাদ গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে কান পাতলেই শোনা যায়। তখনো ভাতার, মাগী এসব শব্দের অর্থ করিনি, তবে কানে লেগেছিল তারের টান। যার রেশ এত বড় হলাম, কই এতটুকুও তো কমেনি!
এইসব চুটকি, প্রবাদ কোনোদিন বইতে পড়িনি, সিনেমায় শুনিনি। হাতে গোনা কয়েকজন সাহিত্যিক ছাড়া আঞ্চলিক ভাষাকে যোগ্য সম্মান আর কেউ দেননি। ভদ্র বাঙালিসমাজের উন্নাসিকতা আঞ্চলিক ভাষার আত্মবিশ্বাসকে চিরকাল যে আঘাত উপহার দিয়ে আসছে তাতে তার মহত্ব কোনোদিন তো জাহির হয়ইনি, বরং নিজের দীনতাই পলেস্তারা খসা দেয়ালের মতো বেরিয়ে পড়েছে। তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘টাক মাথায় টিকলি, কত রঙ্গ দেখালি’।
ছোটবেলার নিটোল ছবি। ভালবাসা…
Valo likhechis. Er modhe kyekta amaro sona.procholito boi e ei probad gulor jyga hyni thik I.tarkaron egulo lok vasar modhe pore.r segulo sthan poribes egulor upor nirvor kore vinno rup pay.dokhin 24 parogonar baul gan er kotha sobai bole kintu ei dhoroner probad er kotha tamon keu boleni tai akhono oneker ojana.tobe uchoo sahitye abohelito noy.